arijit bhattacharya

Horror Action Thriller

3  

arijit bhattacharya

Horror Action Thriller

রূপকুণ্ডের সন্ধানে

রূপকুণ্ডের সন্ধানে

24 mins
965


বিকেল পড়ে আসছে। অস্তমিত দিবাকরের লাল আলো পশ্চিম আকাশের বুকে এক অবর্ণনীয় রক্তিম প্রতিপ্রভার সৃষ্টি করেছে ।দূরে আকাশের গায়ে উড়ে চলেছে এক ঝাঁক ব্লু হুইস্টলিং থ্রাশ।সম্ভবত নিজেদের বাসায় ফিরছে। এই ব্লু হুইস্টলিং সারস আর হিমালয়ান বুলবুলের উপস্থিতি বলেই দিচ্ছে কাছাকাছি জলাশয় রয়েছে। তুষারে ঢাকা পাহাড়ের বুকে হয়তো রয়েছে কোনো লেক। চামোলী থেকে দূরে নন্দাদেবী পাহাড়ের কাছে এই দিকটায় আগে আসেনি প্রমিত আর কুহেলী।বইছে হিমগিরির হিমশীতল হাওয়া। কিন্তু ওরা জানেও না যে ওরা ওদের স্বপ্নের এতো কাছাকাছি চলে এসেছে,অবশেষে পূরণ হতে চলেছে ওদের এতদিনের অভিলাষা । হ্যাঁ,ওরা চলে এসেছে রূপকুণ্ডের খুব কাছাকাছি । হ্যাঁ,উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুন হিমালয়ের নৈসর্গিক ল্যান্ডস্কেপের বুকে অবস্থিত সেই টেকটোনিক লেক,যাকে কেউ বলে অতি পবিত্র আবার কেউ বলে অভিশপ্ত। এই লেককে যখন আবিষ্কার করেছিল সভ্যসমাজ সেই ব্রিটিশ আমলে,তখন এখানে খুঁজে পাওয়া গেছিল প্রায় সাতশোটির মতো নরকঙ্কাল।চমকে গেছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সভ্যসমাজ। প্রমিত শুনেছে,মধ্যযুগে দিল্লীর শেষ রাজপুত হিন্দু রাজা পৃথ্বীরাজেরও অনেক আগে মোটামুটি 850-900 খ্রিস্টাব্দের দিকে এই অঞ্চলে ছিল চন্দ্রবংশীয় রাজপুতদের একটি ছোট রাজ্য। কিন্তু,কোনো এক অজানা কারণে (হয়তো প্রকৃতির কোপ)তা ধ্বংস হয়ে যায়। এই নরকঙ্কালগুলি সেই রাজ্যের অধিবাসীদেরই। কিন্তু এতদিন ধরে কঙ্কালগুলি অবিকৃত থাকল কিভাবে,এখানেই সবচেয়ে বড়ো প্রশ্নচিহ্ণ যা কপালে ভাঁজ ফেলেছে প্রত্নতাত্বিক আর নৃতত্ববিদদের। যাই হোক,প্রমিত আর কুহেলী দুজনেই ভূগোল নিয়ে রিসার্চ করে। এখন একই কলেজের অধ্যাপক আর অধ্যাপিকা।দীর্ঘদিনের স্কুল ,কলেজ আর ইউনিভার্সিটিতে মিষ্টি মধুর প্রেমের পর সম্প্রতি তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। চামোলীর অদূরেই অবস্থিত এই পার্বত্য লেক নিয়ে তাদের দুজনেরই প্রচুর ইন্টারেস্ট।তাই তারা ঠিক করেছে তাদের হানিমুন ডেস্টিনেশন হবে এই রূপকুণ্ড। হাওড়া থেকে কাঠগোদাম হয়ে তারা পৌঁছেচে চামোলীতে। চামোলী থেকে নন্দা ঘুন্টি হয়ে রূপকুণ্ডের রাস্তা খুবই দুর্গম। খুবই বন্ধুর। ঝড়,বৃষ্টি আর ধস তো আছেই,তাছাড়া এই পার্বত্য পথে রয়েছে আরও এক বিভীষিকা। আরও এক অজানা ভয়। যার নাম মিগোই। নন্দা ঘুন্টির দেবী নন্দার মন্দির পেরোবার পরই শুরু হয়েছে উৎপাত।গাইড বলেই ছিল জায়গাটা ভালো নয়। না মানুষ না জন্তু!বলা বাহুল্য,পাহাড়ের মানুষের কাছে এক আতঙ্ক। আগে প্রমিত আর কুহেলী ভাবত যে,এসব আর কিছুই নয়,এখানকার নিরীহ নিরক্ষর মানুষদের কল্পনা আর অন্ধবিশ্বাস। একটা কথা তো চালুই আছে,যেখানে বিজ্ঞানের শেষ, সেখানেই অন্ধবিশ্বাসের শুরু ।আর তার যুক্তির যেখানে শেষ,সেখানে জন্ম নেয় ভয়। কিন্তু,আজ তারা বিশ্বাস করে মনেপ্রাণে যে,না, মিগোই রয়েছে,সত্যিই রয়েছে। সে মহাচতুর আর মহাভয়ঙ্কর। তারা অনুভব করেছে,এমনকি কয়েকবার সচক্ষে দেখেও ছে। ধূসর লোমে ঢাকা,মানুষের মতো হাঁটে,কিন্তু মুখ আর হাত পা ভল্লুক বা নেকড়ের মতো। বনমানুষ আর ওরাং ওটানের সাথে অনেক পার্থক্য । এছাড়াও মিগোই য়ের কাছে আছে আরও এক অলৌকিক ক্ষমতা। যখন তখন নিতে পারে সাধারণ পাহাড়ি মানুষের ছদ্মবেশ। বিভ্রান্ত করতে পারে সাধারণ মানুষকে। উফ কি ভয়ঙ্কর! মাঝে মাঝে ভাবে প্রমিত,অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর প্রমিত ব্যানার্জি । নেহাত ঈশ্বরের অনেক কৃপা তাই তারা এতদূর আসতে পেরেছে। গাড়োয়াল অঞ্চলের স্বনামধন্য তান্ত্রিক অঘোরীচণ্ড বলেছিলেন,একমাত্র রূপকুণ্ডের পবিত্র জলই ধ্বংস করতে পারে শয়তান মিগোইয়ের মায়া।তখন লোকটাকে উপেক্ষা করলেও এখন প্রমিত আন্তরিকভাবে চাইছে সেই মহাতান্ত্রিক অঘোরীচণ্ডের সান্নিধ্য । কিন্তু রূপকুণ্ড আর কতোদূর!দিনের আলো পড়ে আসছে। আঁধার হলেই ঘটবে মিগোইয়ের আগমন। পুবাকাশে গোল থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ ।নীল স্বচ্ছ আকাশে সেই চাঁদকে অপূর্ব লাগছে। প্রমিতের মনে পড়ল আজ পূর্ণিমা। তাদের তরুণ কুমায়ুনী গাইডকে মিগোই এক স্বল্পবসনা লাস্যময়ী সুন্দরী মেয়ে সেজে বিভ্রান্ত করে আগেই তাদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। হয়তো মেরেই ফেলেছে!প্রমিতের মনে পড়ে চাঁদের আলোয় মেয়েটার কোনো ছায়া পড়ছে না।প্রমিত আর কুহেলী মিলে কতো নিষেধ করেছিল সুরজকে। কিন্তু সুরজ তাদের কথা শুনলে তো। পতঙ্গ যেমন ছুটে যায় উজ্জ্বল বহ্নিশিখার দিকে আর আগুনে পুড়ে মরে,তেমনি কামের তাড়নায় আর যৌবনের আধিক্যে সুন্দরীতে মোহমুগ্ধ হয়েছিল সুরজ আর তাতেই ঘটল বিপত্তি। হাওয়ার গতি বাড়ছে। আজ রাতে আবার তুষারপাত হবার সম্ভাবনা। আরে,ঐ তো লেকটা।অ্যালপাইন অরণ্যের পটভূমিকায় লেকটাকে অপূর্ব লাগছে। সারা বিশ্বচরাচর এক অপূর্ব নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন ।চাঁদের রূপোলী আলো লেকের জলে এক মায়াবী প্রতিপ্রভার সৃষ্টি করেছে ।রূপোলী চাঁদের প্রতিবিম্ব রূপোলী লেকের জলে পড়েছে।না,আর ভয় নেই!এই লেকের জলই ধ্বংস করতে পারে মিগোইকে। লেকের জলই ধ্বংস করতে পারে মিগোই কে ।অজেয় কে জয় করার অনাবিল আনন্দে নেচে উঠল প্রমিত আর কুহেলীর মন। আর তখনই প্রমিতের নজর গিয়ে পড়ল তার থেকে কিছুটা দূরে মহাপুরুষ মহাজ্ঞানী অঘোরীচণ্ডের ওপর ।কিন্তু লোকটা এতদূরে এখানে এল কি করে! চাঁদের আলোয় অঘোরীকে অপরূপ লাগছে। কপালে রক্ততিলক,রক্তবর্ণ বসন,রক্তবর্ণ দুই আঁখি যেন জ্বলছে। হাত নেড়ে অঘোরী ডাকলেন প্রমিতকে। অভিলাষা পূরণের আনন্দে অঘোরীর দিকে গুরুর কৃপাধন্য পরম ভক্তের মতো ছুটে গেল প্রমিত আর কুহেলী ।কিন্তু আতিশয্য খুব খারাপ জিনিস ।আর আতিশয্যের বশেই ভুল করে বসে মানুষ।এখানে অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো আর ভক্তির আতিশয্যে ভুল করল প্রমিত আর কুহেলীও। আর চরম ভুল করল। একটু মনের স্থিরতা বজায় রাখলে তারা দেখতে পেত যে,চাঁদের আলোতে প্রমিত আর কুহেলীর গুরু অঘোরীচণ্ডের কোনো ছায়া পড়ছে না। 2018 সালের এপ্রিল মাসের মধ্যাহ্নের নিদাঘের গরমের তীব্রতা ।জোরদার চলছে ক্যারাম খেলা উত্তর কোলকাতার হাতিবাগান অঞ্চলে। তীব্র দাবদাহে পুড়ছে পৃথিবী। সুজয় বলে উঠল,"উফ গরমে আর পারা যাচ্ছে না। কাছেপিঠে কোনো সুন্দর জায়গা থেকে ঘুরে আসলে ভালো হয়।"অরুণিমার মুখে হাসি, "তাহলে চল এই গরমে চলি হ্যামিলটনগঞ্জ। ওখানে আমার মাসতুতো বোন থাকে। উফ করোনেশন ব্রিজ,শাল-সেগুনের মায়াবী সবুজাভ অরণ্য,মূর্তি নদী-সেই অনাবিল সৌন্দর্য ভোলার নয়। আমি এর আগে দু বার গেছি। চা বাগান,বক্সা জয়ন্তিয়া পাহাড় জাস্ট উফ।অফুরান সৌন্দর্য ।এই গরমে কিন্তু ভালো একটা ট্রিপ হবে।" এবার বাধ সাধল মুখচোরা জয়দীপ। "আমাদের বস কিন্তু ভ্রমণ পছন্দ করে না খুব একটা,ও পছন্দ করে রিস্ক,ও পছন্দ করে অ্যাডভেঞ্চার। ও পছন্দ করে যেখানে প্রাণের ঝুঁকি থাকবে। সেদিক থেকে মনে হয় ও ডুয়ার্সটাকে বর্ষায় প্রেফার করবে। এখন হয়তো ও পছন্দ করবে রাজস্থান বা ছোটনাগপুর।" "মাথা খারাপ নাকি।এই গরমে রাজস্থান। আমাদের লিডার ঝুঁকি নিতে ভালোবাসে ঠিকি,কিন্তু ও এই গরমে রাজস্থান যাওয়ার মতোও পাগল নয়।"বলল রূপালী।"তাহলে কি ছোটনাগপুর?"প্রশ্ন অরুণিমার ঠোঁটের আগায়। "আরে ,ছাড় তো তোদের ছোটনাগপুর। আগেরবার ঐ দুর্জন না কার্জন কিভাবে অ্যাটাক করেছিল মনে নেই। কথায় বলে না,যে রক্ষক সেই ভক্ষক। উফ্,কি ফেরোসাস ছিল!দাদাকে একটু হলেই তো স্বর্গেই পাঠিয়ে দিচ্ছিল।"বলে উঠল সুজয়।"আমি তো আগেই সাবধান করেছিলাম ওর থেকে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা সেই দিন ওর কাছে রামচন্দ্রের লকেটটাই ছিল না। তখনই আমার মনে সন্দেহ জাগে।" "কিন্তু দুর্জন যদি ওয়্যারউল্ফ বা নেকড়ে মানবই হবে ,তাহলে বুন্দেলীর নরপিশাচদের হাত থেকে আমাদের বাঁচালো কেন!ও তো একদিন আগেই নেকড়ে মানবে পরিণত হয়েছিল ঝিন্দারামের দ্বারা ঘায়েল হয়ে ।"প্রশ্ন করল অরুণিমা। "আরে এটাই তো ট্রিকস।এখনোও এই প্রশ্নটা আমাদের পাজল করছে ।ও আমাদের সেই রাতে বাঁচালো কেন!"চিন্তিত মুখে বলল রূপালী। "তোরা দেখ এই উত্তর সেই দিতে পারে যে কোরবার হোটেলে দুর্জনকে নিজের হাতে ধ্বংস করেছে । আর সে হল আমাদের বস সুনীপ সাহা।তবে আমি যদিও দাদাকে এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করি নি,আমার মনে আসছে এর পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। এক হয়তো দুর্জনের রক্তপিপাসী নেকড়ে মানব সত্ত্বা তখনো জেগে ওঠে নি,সে সাধারণ মানুষই ছিল। হয়তো বুঝতে পারে নি ও ইনফেক্টেড হয়েছে,আর দ্বিতীয়ত হয়তো এটা ছিল তার কৌশল।ও হয়তো ভেবেছিল আমাদের পাঁচজনকে শিকার ও একাই করবে। মনে আছে,ও যখন নেকড়েতে পরিণত হয়েছিল, সেটা ধূসর আর কতো বড়ো ছিল । ওর গর্জন পৃথিবীর সাহসীতম মানুষের বুক কাঁপানোর জন্য যথেষ্ট ।" রূপালী বলল,"কিন্তু ও বুঝতে পারে নি যে কার সাথে পাঙ্গা লড়ছে।সুনীপ সাহা যে সে লোক নয়। মনে আছে বিপদে বুদ্ধি স্থির রেখে লাফিয়ে উঠে পরিয়ে দিয়েছিল ওর হাতে নিজের জার্মান সিলভারের ঘড়ি। আর তাতেই যন্ত্রণায় ছটফট করে আর্তনাদ করে উঠেছিল পিশাচটা।" "আর এরপর ওর বুকে বসিয়ে দিয়েছিল ওর আলমারিতে রাখা ওরই ব্রহ্মাস্ত্র ।মানে রূপার ধারালো ফলাযুক্ত কাঠের শূল। আর তাতেই নরপিশাচটা করে উঠেছিল মুমূর্ষুর অন্তিম আর্তনাদ ।আর তারপরেই সব শেষ। এভাবেই শয়তানের সাথে মুখোমুখি এনকাউন্টারে জিতেছিল সুনীপ সাহা।জিতেছিল আমাদের 'ফাইভ বেস্টিস'।"সুজয়ের গলায় উপচে পড়ছে গর্ব। "তাহলে কিসের কথা চলছে বন্ধুগণ!" দরজা দিয়ে ঘর্মাক্ত কলেবরে প্রবেশ করল সুনীপ।পেটপুরে খেয়ে এসেছে হাতিবাগানে নিজের বাড়ি থেকে।গ্রুপের নাম এখন 'ফাইভ বেস্টিস',সাজেশনটা সুনীপেরই ছিল । একটু আনকমন নাম হলেই ভালো হয়। লোকে তাদের একটু অন্যরকম নামেই চিনুক না। সুনীপ বলল,"তোরা তো জানিসই তোদের মতো আমার এই মাথায় গোবর ভরা নেই। বাইরে থেকে তোদের আলোচনা সব শুনেছি। শোন ,একে প্যাচপেচে গরম।তোদের নিরাশ করব না। আমরা এবার যাচ্ছি বাগ এক্সপ্রেস করে কাঠগোদাম হয়ে কুমায়ুন হিমালয়ের বুকে।আমাদের গন্তব্যস্থল এবার রহস্যে ঘেরা হ্রদ রূপকুণ্ড ।" সুজয় জিজ্ঞাসা করল, "রূপকুণ্ড সেটা আবার কোথায়!আমি তো সুরজকুণ্ডের নাম শুনেছি ,আর তুমি বলছ রূপকুণ্ড! "সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুনীপ বলল,"হ্যাঁ রে,এই রকম লেক সত্যিই আছে। আর এর অবস্থান উত্তরাখণ্ডের চামোলীর ক্যানভাসের বুকে নন্দা ঘুন্টির কাছে । ব্রিটিশরা যখন এই লেক আবিষ্কার করেছিল তখন এখানে খুঁজে পেয়েছিল নয় নয় করে প্রায় সাতশোটা নরকঙ্কাল।" "হ্যাঁ দাদা, বলো কি!"চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করল সুজয়।"আমি ঠিকই বলছি, তোরা পারলে গুগল সার্চ মেরে দেখে নিস। আর না হলে আমার কথা শোন।" সবাইয়ের মনে হল এই কথা না শুনলে তাদের লিডারকে অপমান করা হবে। বলা বাহুল্য, সবাই রাজি হয়ে গেল সুনীপ সাহার প্রস্তাবে। "যখন এই ঘটনা ঘটল ,তখন থেকে এই লেকটাকে কেউ বলে অভিশপ্ত লেক,কেউ বা বলে মায়াবী লেক,কেউ বলে ভুতুড়ে লেক। কিন্তু ,কেউ কেউ বলে এক অদ্ভূত কথা। এই লেকটা নাকি ইহলোক আর পরলোকের দরজা। তাই এর জল নাকি অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা,নাকি অসুরদের নিধন করতে যাবার আগে ভগবান রুদ্রদেব মোহিনীকে নিয়ে এই হ্রদের সামনে বসে পূজা দিয়েছিলেন। তাই এই কুণ্ড অতি পবিত্র!"সবাই হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে সুনীপের দিকে।সুনীপ আবার বলতে শুরু করল,"কিন্তু আমাদের মাইথোলজি নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। আমাদের জানতে হবে যে,এর পেছনে আসল সত্যটা কি!" "ইতিহাসবিদরা কিন্তু বলছেন অন্য এক কথা। সময়টা মোটামুটি সাড়ে আটশো থেকে নশো খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী ।উত্তর ভারতে তখন শক্তি বাড়ছে রাজপুতদের। প্রথমে গুর্জর প্রতিহার,তারপর সোলাঙ্কি,চৌহান,পরমার-এইভাবে বিভিন্ন রাজপুত বংশ নিজেদের শক্তি আর শ্রেষ্ঠত্ব বৃদ্ধি করছে ।এখন এই রাজপুতদের মধ্যেও বিভাগ ছিল,কেউ ছিল সূর্যবংশী আর কেউ ছিল চন্দ্রবংশী,আবার কেউ নাগবংশী।এখন এই সূর্যবংশী আর চন্দ্রবংশীদের মধ্যে ছিল প্রচণ্ড রেষারেষি ।কেউ কাউকে সহ্য করতে পারত না। " এক গেলাস ঠাণ্ডা জল খেয়ে আবার শুরু করল সুনীপ,"তো কুমায়ুনের এই অঞ্চলটাতেও তখন ছিল চন্দ্রবংশী রাজাদের রাজত্ব ।কিন্তু চিরদিন কারোর সমান যায় না। তোরা তো জানিসই যে,আমাদের হিমালয় পর্বত পরস্পরের দিকে অগ্রসর দুটো পাত বা প্লেটের মাঝখানের ভাঁজে অবস্থিত, তাই এই অঞ্চলটা চিরকালই ধস আর ভূমিকম্পপ্রবণ।তো সেবার হল এক ভয়াবহ ভূমিকম্প।ধ্বংস হয়ে গেল চামোলীর চন্দ্রবংশী সভ্যতা । আর যেখানে ছিল রাজপুতদের দুর্গ,সেখানেই এখন অবস্থিত কুণ্ডটি। আর ঐ নরকঙ্কালগুলি হল ওখানকার উচ্চপদস্থ রাজপুতদের,যারা কিছুটা দৈব বিদ্যা জানত।আর এর ফলে নিজের রূপ যৌবনকে সময়ের সাথে অবিকৃত রাখতে পারত।" পিজ্জা তে কামড় বসিয়ে জয়দীপ বলল-"বল কি!" সুনীপ বলল,"হ্যাঁ,আর এই বিদ্যাই সাহায্য করেছে ওদের কঙ্কালকে অবিকৃত রাখতে। না হলে,তোদের কি মনে হয় কঙ্কালগুলি থাকত। এই হাজার বছরে ওরা ধূলো হয়ে মাটিতে মিশে যেত।" মাথা নেড়ে সায় দিল সুজয়-"হ্যাঁ সেটা তো হতেই পারে। কারণ ভায়া।তোমার সাথে ছত্তিশগড়ের বুন্দেলী গিয়ে যা দেখলাম ,তারপর থেকে আর জাদুটোনা আর তন্ত্র মন্ত্রকে পুরোপুরি অবিশ্বাস করে উড়িয়ে দিতে তো পারি না।" কন্ঠস্বরে এক অনবদ্য দৃঢ়তা নিয়ে সুনীপ বলল,"আর সেজন্যই আমাদের গন্তব্য এবার রহস্যে ঘেরা রূপকুণ্ড ।" সুনীপ বলল,"এবারে আমরা অ্যাডভেঞ্চার করতে যাচ্ছি রূপকুণ্ডে। আগের বার যেমন বুন্দেলীতে আমরা নরপিশাচের সম্মুখীন হয়েছিলাম,তেমনিই এবার আমাদের শত্রু হল মিগোই। হয়তো আমাদের লড়াই করতে হবে মিগোইয়ের সাথে।" সুজয় চেঁচিয়ে বলে উঠল,"মিগোই!সেটা আবার কি!একটু বুঝিয়ে দাও ভায়া প্লিজ। তাহলেই কৃতার্থ থাকব তোমার কাছে।"রোদ পড়ে আসছে। সুজয়ের এই রসিকতাতেই জোরে হেসে উঠল সবাই। সুনীপ নিজের সহজাত গাম্ভীর্য বজায় রেখেই বলল,"ওরে গাধা,তোর সবকিছু নিয়ে এইভাবে ঠাট্টা মারাটা কোনোকালেই বন্ধ হবে না। শোন,যুক্তি আর প্রত্যক্ষ প্রমাণের যেখানে শেষ আর অন্ধবিশ্বাসের যেখানে শুরু ,সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে মিগোই। এক ভয়ংকর জীব। পাহাড়ের আতঙ্ক। না মানুষ না পশু!সাক্ষাৎ শয়তান। যদিও বিজ্ঞান বলে এই মিগোইয়ের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ মিথ্যা,তবুও ফ্রাঙ্ক এস স্মিথ ,এন এ টোম্বাজি এদের ফটোগ্রাফ মিথ্যা কথা বলে না। তিব্বতের প্যাংবোচে মনাস্ট্রি তে মিগোইয়ের মাথার খুলি সযত্নে রক্ষিত আছে। ওরা মিগোইকে পাহাড়ের দেবতা বলে পূজা করে। তাহলে এতো কিছু তো এক নিমেষে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।যা রটে,কিছু তো ঘটে!"এক  নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল সুনীপ।রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল সবাই। অরুণিমা বলে উঠল,"আচ্ছা এই মিগোই অনেকটা ইয়েতির মতো। কি বল!"সুনীপ বলল,"কিন্তু সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হল মিগোই মানুষের ছদ্মবেশ ধরতে পারে,ও ঐভাবেই আমাদের বিভ্রান্ত  করবে। আমাদের শুধু সতর্ক থাকতে হবে ,যাতে ও আমাদের ট্র্যাপে না ফেলতে পারে। ও কিন্তু নানাভাবে সুযোগ খুঁজবে।বুঝলি তোরা?" সবাই সায় দিলে সুনীপ বলে উঠল,"শোন আগের মাসে কোলকাতার এক নামী কলেজের অধ্যাপক আর অধ্যাপিকা ওখানে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে । পুলিশ কোনো ট্রেস করতে পারছে না। কিন্তুস্থানীয় এক তান্ত্রিক অঘোরীচণ্ড বলছে সম্পূর্ণ অন্য একরকম কথা। তার কথায় মিগোই তাদেরকে বিভ্রান্ত করে মৃত্যুর মুখে নিয়ে গেছে। এবং সেই অধ্যাপক অধ্যাপিকার নাম প্রমিত ব্যানার্জি আর তার স্ত্রী কুহেলী সেন ব্যানার্জি ।ভীষণ ক্রিটিকাল কেস! আমার ধারণা আমরা এই পাজলটা সলভ করতে পারব। অঘোরী কি সত্য কথা বলছে না প্রমিতবাবু এখনো ও বেঁচে রয়েছেন!আর মিগোই কি বাস্তবে রয়েছে! এইসব প্রশ্নই আমাকে হাতছানি দিচ্ছে কুহেলিকা ঘেরা রূপকুণ্ডের দিকে। শোন তোরা রেডি হ। আজই আমি যাচ্ছি বাগ এক্সপ্রেসের এসি থ্রি টায়ারে পাঁচটা সিট রিজার্ভ করতে। নেক্সট মাসে যাচ্ছি রূপকুণ্ড ।" রাত সাড়ে নটায় হাওড়া থেকে ছাড়ল হাওড়া কাঠগোদাম বাগ এক্সপ্রেস। হিমালয় অভিযানের জন্য টগবগ করে ফুটছে ফাইভ বেস্টিস উত্তেজনায়। তারা সবাই এসি থ্রি টায়ারের যাত্রী ।স্টেশন থেকেই খাবার জন্য কোল্ড ড্রিংস্ আর পিৎজা কিনেছে সুজয়।যথাসময়ে ছাড়ল ট্রেন। আর এই ট্রেনেই কাকতালীয় ভাবে সুনীপের সাথে দেখা হয়ে গেল মৌমিতার।মৌমিতা সুনীপের কলেজের বন্ধু। জুলজি অনার্স নিয়ে পড়ত ,কিন্তু এখন স্ট্রিম চেঞ্জ করে ক্রিপটোজুলজি নিয়ে রিসার্চ করে।কয়েক মাস আগে দেশের নামীদামী পত্রিকায় অস্ট্রেলিয়া আর সাউথ আফ্রিকার আতঙ্ক বুনিপ নিয়ে লেখা ওর কিছু আর্টিকেল বেরিয়েছিল। এক নিমেষে মৌমিতা রায় কে চিনে গিয়েছিল সবাই।যাই হোক,ট্রেনে কথা বলে জানতে পারল যে,সেই মৌমিতা এখন বুনিপকে ছেড়ে হিমালয়ের আতঙ্ক ইয়েতি বা বিগফুট কে নিয়ে পড়েছে।মৌমিতা এখন ইয়েতি কে নিয়ে গবেষণা করতে ব্যস্ত আর ইয়েতি বা The Abominable Snowman কে নিয়ে ও একটা বইও লিখে ফেলেছে। "The Fearsome Dweller of the Frozen Mountain."সুনীপকে ঐ বইটার এককপি দিল মৌমিতা । মৌমিতাকে কৌতুহলবশত সুনীপ জিজ্ঞাসা করল কুমায়ুনের আতঙ্ক মিগোইয়ের ব্যাপারে।উত্তরে যা বলল মৌমিতা,হতবাক হয়ে গেল সুনীপরা। ইয়েতির মতো মিগোইও কুমায়ুন হিমালয় ও নেপাল হিমালয়ের এক বিভীষিকা। 'মিগোই'কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল যে রক্ত পান করে।যাই হোক,কিন্তু মিগোইয়ের মুখে মানুষের রক্ত লেগে গেলে সে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। মিগোই হল হিমালয়ের ইয়েতি আর স্ক্যানডিনিভিয়ার বিভীষিকা ট্রোলের মাঝামাঝি । শরীরের গড়ন ইয়েতির মতো হলেও মুখ হিংস্র ভল্লুক বা নেকড়ের মতো। আর এটা যখন তখন মানুষের রূপ ধারণ করতে সক্ষম । বলা বাহুল্য, পূর্ণিমার রাতে চাঁদের মায়াবী আলোয় বিপজ্জনক হয়ে ওঠে মিগোই,তখন সে অপরাজেয়। কিন্তু ,পার্বত্য অঞ্চলে কিছু পবিত্র কুণ্ড (sacred lake) রয়েছে ,যার জল ধ্বংস করতে পারে মিগোইকে! এইসব শুনে ইউরোপের ওয়্যারউল্ফের কথা মনে পড়ে গেল অরুণিমার । আর সুনীপের মনে খেলে গেল এক জটিল সমীকরণ। মৌমিতা যে sacred lake র কথা বলছে তাদের মধ্যে রূপকুণ্ড ও কি পড়ে! পুরাণে তো রয়েছেই ,এই কুণ্ড বড়ো পবিত্র।রূপকুণ্ডের জল দিয়ে তারা শিকার করবে মিগোইকে না কি মিগোই শিকার করবে তাদের!এই প্রশ্নের উত্তর তো সময় ই দিতে পারে। রাতের বেলা লাচ্চা পরোটা আর চিকেন খেয়ে শুয়ে পড়ল তারা। এই খাবার পুরো সুজয়ের বাজেটে ।সুনীপরা দেখে অবাক হয়ে যায় কি ভাবে সুজয় মাঝে মাঝে কল্পতরু হয়ে যায়।যাই হোক,খেয়ে দেয়েই আজ তার স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে ঘুমের দেশে চলে গেল সুনীপ। আর তারপরেই দেখল অদ্ভূত এক স্বপ্ন। আকাশ স্বচ্ছ নীল। ফুরফুরে হিমেল হাওয়া বইছে ।চারদিকে শুধু শুভ্রধবল বরফ আর বরফ।দিগন্তরেখায় তুষারঢাকা গগনচুম্বী পর্বতশৃঙ্গ। মাঝে মাঝে অ্যালপাইন গুল্ম আর রডোডেনড্রনের ঝোপ ।দূরে নিচের দিকে সবুজ ব্লু পাইন আর ফারের বনানী।সুনীপের পরণে ট্রেকারের পোষাক। ওর সাথে আছে একজন গাড়োয়ালী শেরপা। সুনীপ বলে উঠল,"দেখলে তো,তোমরা মিছেই ভয় পাও ।ঐসব মিগোই ফিগোই কিচ্ছু হয় না। সরল গ্রামবাসীদের কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস।আর ঐ অন্ধবিশ্বাসের দরুণ এই কুমড়োর ফালির মতো পাহাড়টার কাছে কেউ আসতে চায় না।"সাথের গাড়োয়ালী তরুণ আমতা আমতা করতে লাগল। আর তাতেই ক্ষেপে উঠে সুনীপ বলল,"শোনো এখান থেকে রূপকুণ্ড বেশি দূরে নয়। তুমি যদি না যাও ,তাহলে আমি একাই যাব।দেখি তোমার মিগোই আমার কি ক্ষতি করতে পারে!" অদ্ভূত ভাবে হেসে উঠল গাড়োয়ালী ছেলেটি। গাড়োয়ালী ভাষায় বলল,"আপনি এখনও মনে করেন যে,মিগোই আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।"সারা শরীর জুড়ে অদ্ভূত এক শিরশিরে অনুভূতি খেলে গেল সুনীপের। বিকাল বেলা । বইছে ফুরফুরে হিমেল হাওয়া।অস্তমিত সূর্য পশ্চিম আকাশে এক গোলাপী প্রতি প্রভার সৃষ্টি করেছে।আকাশের এক কোণায় কুমড়োর ফালির মতো চাঁদ । সেই চাঁদের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকালো যুবকটি। আর তারপর সেটা অদ্ভূত ঘড়ঘড়ে গলায় সুনীপকে বলল-"কিন্তু সাহেব,মিগোই তো ইতিমধ্যেই আপনাকে ফাঁদে ফেলেছে।"অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠল যুবকটার শরীর।আর তারপরেই ঘটতে লাগল পরিবর্তন ।ছুটে পালাবার ক্ষমতা নেই সুনীপের। মুহূর্তের মধ্যে যুবকটি পরিণত হল ধূসর লোমে ঢাকা হাতে পায়ে বড়ো বড়ো বাঁকানো নখরযুক্ত প্রাগৈতিহাসিক কোনো প্রাণীতে। না মানুষ,না নেকড়ে আর না ভল্লুক। এ এক বিচিত্র জীব!আকারে অন্তত তেরো ফিট তো হবে। জ্বলন্ত সবুজাভ হলুদ চোখে সুনীপের দিকে তাকাল জন্তুটা।তারপর এক এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগল সুনীপ সাহার দিকে।সুনীপ এখনোও বিস্ময়ে নির্নিমেষ নয়নে নৃ পশু টিকে দেখছে। হাঁ করল জন্তুটি,চোয়াল থেকে লালা ঝরে পরছে আর চোয়ালে ধারালো চকচকে দাঁতের সারি। তখনই সম্বিৎ ফিরল সুনীপের। করে উঠল বুকফাটানো আর্তনাদ আর তাতেই ভেঙে গেল ঘুম! উফ্, স্বপ্নটা কতো ভয়ঙ্কর ছিল। ধড়মড় করে উঠে বসল সুনীপ ।সারা গা ঘেমেনেয়ে ভিজে গেছে।ভোর চারটে বাজে। একটু পরে পুবাকাশকে রঙিন রঙে রাঙিয়ে উঠবেন দিবাকর । প্রতিভাত হবে উষার ব্রাহ্মমুহূর্ত।ট্রেন জসিডি পেরিয়ে প্রচণ্ড গতিতে বিহার ঝাড়খণ্ড সীমানার পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ঝাঝার দিকে ছুটছে। তার বন্ধুরা সবাই গভীর ঘুমে অচেতন। মৌমিতাও নিদ্রায় আচ্ছন্ন। বাথরুমে গিয়ে চোখমুখে জলের ঠাণ্ডা ঝাপটা দিল সুনীপ। আর তখনই দেখতে পেল তার পকেটের মধ্যে কেউ রেখে দিয়েছে অন্য ভাষায় লেখা একটা চিরকুট। চোখে ভালো করে জলের ঝাপটা দিতেই চোখমুখ অনেকটা ফ্রেশ লাগল। ভালো একটা অনুভূতি হল। আর তারপর নিজের মোবাইল অন করে মোবাইলের টর্চের আলোয় চিরকুটটা ভালোভাবে নিরীক্ষণ করল সুনীপ। হ্যাঁ,সে যা ভেবেছে তাই। ভাষাটা তার অতি চেনা। তিব্বতী! চিরকুটটা একবার পড়ে নিজের মনে হাসল সুনীপ। সে যা ভেবেছে তাই। মানে তাদের প্রতিপক্ষ তার খেলা শুরু করে দিয়েছে।এটা প্রথম পদক্ষেপ তাদের শত্রুর। আর সে তো এটাই আশা করেছিল। কিন্তু প্রতিপক্ষ এত তাড়াতাড়ি পদক্ষেপ নেবে তা সে বুঝতে পারে নি। যাই হোক,চিরকুটটা জিন্সের পকেটে ঢুকিয়ে রেখে আবার নিজের সিটে এসে বসল সুনীপ। পুবাকাশকে কিছুটা আলোকিত লাগছে!সূর্যোদয়ের ঠিক আগের মুহূর্ত ।না আজ ঘুম আর আসবে না। অ্যান্ড্রয়েডটা নিয়ে তাতে অ্যাংরি বার্ড খেলতে শুরু করল সুনীপ। ঝাঝা পেরিয়ে গেল। মোটামুটি ভোর পাঁচটার দিকে ট্রেন থামল কিউল এ। আকাশে টকটকে লাল গোল বলের মতো সূর্য।এখানে ট্রেন থামবে গোটা ছয়েক মিনিট। দরজা খুলে ট্রেন থেকে নামল সুনীপ।দুই মিনিটের জন্যই হোক,অনুভব করল মুক্তি। প্রকৃতির সতেজ বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিল।উফ রাতের দুঃস্বপ্নের পর এক ঝলক তাজা মুক্তির হাওয়া! কতো আরাম! কিছুক্ষণ পর ইঞ্জিন হুইসল মারতেই ট্রেনে গিয়ে বসল সুনীপ । কিন্তু সেখানে ট্রেনে উঠলেন এক রহস্যময় ব্যক্তি। গায়ে সন্ন্যাসীদের গেরুয়া পোষাক, গা থেকে বেরোচ্ছে দামী আতরের গন্ধ,হাতে দামী স্মার্টফোন,এসেই জাঁকিয়ে বসলেন। আর নির্নিমেষ চক্ষে তাকিয়ে থাকলেন সুনীপের দিকে। বড়ো অদ্ভূত ছিল সেই দৃষ্টি,মরা মাছের মতো স্থির দুই চোখ।বুকের রক্ত জল হয়ে গেল সুনীপের। সকাল দশটার দিকে মজঃফরপুরে নেমে গেল মৌমিতা। এখানে অনেকক্ষণ থামে ট্রেন।সুজয় আজ সবার জন্য বিহারের টিপিক্যাল পরোটা আর পাটনাই খাসির রান্না কিনে এনেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুনীপ । আজকের দিন পুরোটাই ট্রেনে কাটবে। সন্ন্যাসীর সাথে পরিচয় হয় সুনীপের। তিনি নিত্যানন্দ স্বামী। গোরক্ষপুরে থাকেন। সুনীপকে বললেন,"বাবা মৃত্যু তো দেখছি তোমার সঙ্গী হয়ে আছে। খুব সাবধান। সামনে বড়ো বিপদ। যাকে তুমি সবচেয়ে বেশি ভরসা করবে,তার মধ্যে দিয়েই মৃত্যু তোমাকে ছোঁবে।" এক শিরশিরে অনুভূতি খেলে গেল সুনীপের শরীরে। এক অজানা আতঙ্ক! বিকেলের দিকে এক অপরূপ দৃশ্য। চারদিক মেঘলা করে এসেছে। উত্তর বিহারের সবুজ মাঠঘাটের ওপর দিয়ে ছুটছে ট্রেন। দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত !দিগন্তে ঘনকৃষ্ণ জলধর। প্রকৃতিকে অপূর্ব রোম্যান্টিক লাগছে। সুনীপের ইচ্ছা হল তার ভালোবাসার মানুষকে আপন করে পেতে আর তার গভীর গোপন ভালোবাসার সেই মানুষটি হল অরুণিমা।অরুণিমার প্রতি নিজের অনুভূতিকে আর আটকে রাখতে পারছে না সুনীপ । এবার সে অরুণিমাকে বলবেই নিজের মনের কথা। জানাবে নিজের অনুভূতি। কিন্তু তখনও জানে না সুনীপ,কামরার আরেক প্রান্ত থেকে একজোড়া হিংস্র চোখ আদিম ক্ষুধা নিয়ে মাপছে সে ও তার বন্ধুদের। পরের দিন সকালে যখন সুনীপের ঘুম ভাঙল তখন ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে ,হিমালয়ের কোলে ছবির মতো সুন্দর শহর লালকুঁয়াতে। এখানে ট্রেন বেশ কিছুক্ষণ থামবে। ট্রেন থেকে বেরিয়ে স্পেশনের তাজা হাওয়ার মধ্যে খানিকক্ষণ ঘুরল সুনীপ আর সুজয়। সুন্দর ছবির মতো স্টেশন।দিগচক্রবালে সবুজ কুমায়ুন হিমালয় ,কোনো কবির কবিতার মতো। যাই হোক,সুনীপ লক্ষ্য করল যে ,নিত্যানন্দ স্বামী অনুপস্থিত। তার মানে আগেই কোনো স্টেশনে নেমে পড়েছেন। আর চিরকুটটাই বা কোথায় গেল,সে কতো যত্নে আগের দিন সেটা নিজের পার্সের মধ্যে রেখেছিল। ভূত কেন,ভগবানেরও সাধ্য নেই ওটাকে উদ্ধার করার।কিন্তু ওটা আজ গেল কোথায়! রাত্রে হয়তো ও যখন পার্সে জিনিসটা লোকাচ্ছিল তখনই কেউ হয়তো খেয়াল করে ফেলেছে। আচ্ছা ঐ চিরকুটটা নিত্যানন্দ স্বামীই কায়দা করে লেখেন নি তো! লোকটাকে তো দেখে ঠিক সুবিধার বলে মনে হল না। হয়তো তিব্বতীও জানেন!সুনীপের চিন্তায় ছেদ পড়ল ট্রেনের হুইসলে। লালকুঁয়া থেকে কাঠগোদাম নিসর্গ প্রকৃতি। পার হয়ে গেল স্কুল,সেনাছাউনি আর তখনই সুনীপের চোখে প্রতিভাত হল দিগন্তরেখায় সবুজ হিমালয়।এরপর পেট্রোলিয়াম শোধনাগার পেরিয়ে হলদওয়ানি।আজ দিনটা রৌদ্রজ্জ্বল দিন,চারপাশে অপূর্ব পরিবেশ।প্রকৃতিকে আপন করে ভালোবাসতে ইচ্ছা করে। হলদওয়ানি পেরোতেই একটা ব্যাঙ্কিং বা বাঁক। এরকম বাঁক ভারতীয় রেলে খুব কমই আছে। গোটা ট্রেনটা U আকৃতি নিয়ে এমনভাবে বাঁকে যে শেষ কামরা থেকেও ট্রেনের ইঞ্জিনটা দেখা যায়। এখানে ট্রেনের গতি অনেক ধীরে রাখতে হয়,নাহলে দুর্ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা। সকাল 10-30 টা নাগাদ ট্রেন ঢুকল কাঠগোদামে ।কাঠগোদামে নামী হোটেল সত্যার্থে উঠল সুনীপরা। এখানকার ম্যানেজারও বাঙালী। শুভময় বোস।ফোনে আগেই কথা বলে ফাইভ বেস্টিস এর জন্য রুম বুক করে ফেলেছিল সুনীপ।এখন হোটেলে জাঁকিয়ে বসল ফাইভ বেস্টিস। কিন্তু প্রথম রাত থেকেই জমে উঠল ঘটনার ঘনঘটা। শুভময় বোস এমন একজন লোক যার সাথে দেখা হলেই আলাপ করতে ইচ্ছা করে। বয়স চল্লিশের কোঠায়,চোখে শান্তিনিকেতনী চশমা। পরণে সাধারণ পোষাক। মুখে সবসময় এক অমলিন হাসি বিরাজমান ।দেখে মনেই হবে না এতোবড়ো একটা হোটেলের ম্যানেজার।ব্যবহারে বিনয় ফুটে উঠেছে।শুভময়ের সাথে আলাপ করল সুনীপরা। কুমায়ুন হিমালয়ের কোলে অবস্থিত বহু পুরনো শহর এই কাঠগোদাম।এখান থেকে নৈনিতাল,সাততাল,মুক্তেশ্বর,রাণীক্ষেত খুব কাছেই।আজ এটা ভারতীয় রেলের শেষ স্টেশন।এর পরেই হিমালয়। হিমালয়ের ভাবর অঞ্চলে অবস্থিত শহর কাঠগোদামের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি ধৌলা নদী।কাঠগোদাম কথাটির অর্থ হল,যেখানে কাঠ জমিয়ে রাখা হয় ও পরে প্রয়োজন পড়লে তা সংগ্রহ করা হয়। পূর্বে বলা হত চৌহান পট্টি,কাঠগোদাম এখন কুমায়ুন হিমালয়ের বনজ সম্পদের বৃহত্তম সংগ্রহশালা। এখানে তিনদিন কাটিয়ে ট্রেকার ধরে সুনীপরা যাবে চামোলী। রাতেই ঘটল গণ্ডগোলটা।শুভময় বোসের সাথে আলোচনা সেরে রাতের খাবার খেতে নিজের নিজের রুমে শুতে গেল ফাইভ বেস্টিস। এক রুমে শুধু ছেলেরা আর মেয়েদের জন্য আরেকটা রুম। মানে এক রুমে সুনীপ ,সুজয় আর জয়দীপ হোটেলের উত্তরমুখো ঘরটায় আর করিডরের কোণার দিকে পুবমুখো ঘরটায় রয়েছে অরুণিমা আর রূপালী। রাত তখন সাড়ে বারোটা-একটা হবে। সারা হোটেল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সুনীপদের রুমে টিমটিম করে জ্বলছে মৃদু নীলাভ মিনিবাল্ব। সেই মিনিবাল্বের হালকা মৃদু আলো সারা ঘরে ব্যাপ্ত হয়ে অদ্ভূত এক রহস্যময় আলো আঁধারির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সুজয়। জয়দীপের তো রীতিমতো নাক ডাকতে শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু ,সুনীপের কিছুতেই ঘুম আসছে না। মনে উথাল পাতাল করছে প্রশ্নের ঝড়। আর এই কৌতুহল কিছুতেই ওকে দু'চোখের পাতা এক করতে দিচ্ছে না! কেন প্রথমে কিছুতেই শুভময় বোস ওদের উত্তরমুখী ঘর দিতে রাজি হচ্ছিলেন না! কি আছে সেই উত্তরমুখী ঘরটায় ! কেন তিনি প্রথমে এত দোনামনা করছিলেন! বলা যায়,এখন তিনি কিছুটা বাধ্য হয়েই দিয়েছেন,যেহেতু অন্য ঘরগুলি বোর্ডারে ভর্তি তাই। কিন্তু,তাও ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেছে সুনীপ যে,তার মন দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন। গলার স্বর পালটে গেছে। চোখমুখ দিয়ে ফুটে বেরোচ্ছে উদ্বেগ। তিনি আজ রাতে সুনীপকে বারবার বারণ করেছেন যে,রুমের উত্তরমুখো জানলাটা ওরা যেন না খোলে। এবং শেষমেষ বলতে গেলে,সুনীপের কাছ থেকে একরকম নিশ্চয়তা আদায় করেই তাকে বিদায় নিয়েছেন। ইশ,ঘরটা কেমন যেন বদ্ধ বদ্ধ লাগছে। কোথাকার এক পাহাড়ি কুসংস্কার যে আজ শনিবার তায় পূর্ণিমা। এইসব রাতে নাকি পাহাড়ে অপদেবতা নেমে আসে। সেই প্রেত সাধারণ মানুষের প্রভূত ক্ষতিসাধন করতে পারে। না,এই সব কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেবার কোনো মানেই হয় না। বিদ্রোহ করে উঠল সুনীপের যুক্তিবাদী মন।না,আজ সে দেখিয়ে দেবে,এই সব প্রেতাত্মার লোককথা সাধারণ মানুষের ভ্রান্ত কুসংস্কার ছাড়া কিছুই নয়। আর এই ঘরে জানলা কেবল একটি,তাও এখন রুদ্ধ করে রাখতে হচ্ছে বলে গোটা ঘরটাই কেমন যেন বদ্ধ বদ্ধ লাগছে। এক ঝটকায় জানলা খুলে ফেলল সুনীপ। আর তারপর যা দেখল মুগ্ধ হয়ে গেল সে। এই হোটেল টা মূল কাঠগোদাম শহরের বাইরে। বিশ্বচরাচর ভেসে যাচ্ছে চাঁদের রূপালী জ্যোৎস্নায়। মেঘমুক্ত স্বচ্ছ আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ,এইসব পাহাড়ি জায়গা যেখানে বায়ুতে দূষণ কম,সেখান থেকে খুব সুন্দর লাগে দূরে শালের বনভূমি,আর তারও দূরে দিগচক্রবালে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে অরণ্যে ঘেরা হিমালয়ের রহস্যের জগৎ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকল সুনীপ। প্রকৃতি যেন তাকে কিছু বলছে ,রহস্যের কথকতায় আহ্বান করছে।চারিদিকে অনন্ত নিস্তব্ধতা।সুনীপ শুনতে চাইল প্রকৃতির শাশ্বত সঙ্গীত।আর তখনই হল গর্জন,আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে এক অপার্থিব জীবের হাড়হিমকরা গর্জন। যেন একসাথে এক ডজন নেকড়ে খেপে গিয়ে চিৎকার করছে! একটানা সেই অপার্থিব গর্জন শুনে বুকের রক্ত জল হয়ে গেল সুনীপের। জন্তুটা নিশ্চয়ই খুব ক্ষুধার্ত এবং এখন খুব ক্রুদ্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুজয় আর জয়দীপের ঘুম ভেঙে গেছে। এই বীভৎস আওয়াজটা তারাও শুনেছে। আর শুনে থরহরিকম্প।সেই রাতে ঘুমালো না কেউ। সুনীপ অবাক হয়ে গেল যখন পরের দিন সকালে ও জানতে পারল এই দানবের আওয়াজ কেউ শোনে নি।এমনকি তাদের বন্ধু রূপালী আর অরুণিমাও নয়। শুধু ঐ পৈশাচিক ডাক তারাই শুনেছে যারা উত্তরমুখো ঘরটায় ছিল।আর সুনীপের দৃঢ় বিশ্বাস,ডাকটা এসেছে উত্তরের পাহাড় অঞ্চল থেকে। মনে হয়েছিল,একপাল নেকড়ে যেন রক্তের তৃষ্ণায় পাগল হয়ে গেছে। পরে শুভময় বোসের সাথে এই বিষয়ে গোপনীয়তা বজায় রেখে কথা হয় তার। শুভময়বাবু তাকে বলেন,"এজন্যই আমি উত্তরমুখো ঘরটা কাউকেই দিতে চাই না। মনে হয়,মিগোই য়ের মধ্যে আবার রক্তের তৃষ্ণা জেগে উঠেছৈ। খুব শিগগিরি আপনাদের ওপর নেমে আসতে চলেছে দেবতার কোপ।"বলেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যান তিনি। যেন অতি গোপন কোনো রহস্য ফাঁস করে দিয়েছেন! কেমন যেন অজানা ভয় তাঁর চোখমুখে ছেয়ে গেছে। সুনীপ বুঝতে পারল এই উত্তরমুখো ঘরটায় রহস্য একটা কিছু আছেই। আর যে রহস্য ভেদ করতে হলে তাকে যেতে হবে ঐ উত্তরের পাহাড়তলির দিকে। কিন্তু ওদিকেই তো আছে তাদের গন্তব্যস্থল রূপকুণ্ড। আর আছে ভয়াল ভয়ঙ্কর সুচতুর মিগোই। সুনীপের ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে যে ,পাহাড়ের বিভীষিকা খুব তাড়াতাড়িই ছদ্মবেশ ধরে তাদের কাছে আসতে চলেছে। তাদের বিভ্রান্ত করে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যেতে। কাঠগোদাম থেকে ট্রেকারে নন্দা ঘুন্টি যেতে সময় লাগল চার ঘন্টা। সুনীপরা যখন নন্দা ঘুন্টিতে এসে পৌঁছাল তখন বাজে বেলা 11 টা। চারিদিকে শুধু ধবলশুভ্র বরফ আর বরফ। সেই স্বচ্ছ তুষার দ্বারা সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে এক অপূর্ব মণিময় প্রভার সৃষ্টি করেছে। গাড়ির ড্রাইভার জয় রাঠৌরকে প্রথম দর্শনেই ভালো লেগেছে সুনীপদের। উঠতি যৌবনসম্পন্ন রাজপুত যুবক,ঘটনাটা হল সুনীপ যখনই রূপকুণ্ডে যাবার কথা বলল,এক লহমায় রাজি হয়ে গেল। দোনামনা করল না।যাই হোক,নন্দা ঘুন্টিতেই সুনীপদের দেখা হয়ে গেল মহাতান্ত্রিক অঘোরীচণ্ডের সাথে। কপালে রক্ততিলক,রক্তাভ আঁখি,রক্তবর্ণ পোষাক। লোকটার দিকে একবার তাকালেই ভয় ভয় করে। সুনীপরা ঠিক করেছে যে,নন্দা ঘুন্টিতে পাক্কা একদিন থাকবে। সবাই তাঁবুতে ঘুমোচ্ছে। গভীর রাতে একসাথে চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে ছিল সুনীপ আর জয়। দেখছিল চন্দ্রালোকিত রাত্রে প্রকৃতির শোভা। মাথার ওপরে গোল চাঁদ স্বচ্ছ সুনীল আকাশে অপরূপ প্রভা (halo ) সৃষ্টি করেছে। অঞ্চলটায় উদ্ভিদ বলতে প্রধানতঃ অ্যালপাইন গুল্ম। আর মাঝে মাঝে রডোডেনড্রনের ঝোপ। পাহাড়ি ঠাণ্ডা হাওয়া ঝিরঝির করে বয়ে শরীরে এক শিরশিরে কাঁপুনি ধরাচ্ছে। সুনীপের পা থেকে মস্তক মোটা কাপড়ের পোষাকে ঢাকা। শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য হাতে মোটা গ্লাভস। মাথায় স্কার্ফ আর টুপি। শরীরকে গরম রাখার জন্য ব্ল্যাক কফি খাচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যথেষ্ট শীতলতা অনুভব হচ্ছে। চমৎকৃত হল সুনীপ।আজকের এই সুবিশাল সুউন্নত হিমগিরি,আর ক্রেটাসিয়াস যুগের টেথিস মহাসাগর।প্রকৃতির কি আশ্চর্য পটপরিবর্তন।কোনো কিছুই স্থায়ী হয় না,একমাত্র পরিবর্তনই স্থায়ী হয়। চার পাশের পাহাড় নীরব নিঝুম। প্রকৃতি যেন খুব সন্তর্পণে কিছু রহস্যকে লুকিয়ে আছে।শুভময় বোসের কথা মনে পড়ে গেল সুনীপের মিগোইয়ের এখন রক্তের তৃষ্ণা বেড়ে গেছে।কিন্তু মিগোই তো এখনও তাদের সামনে এল না। তারা তো তাদের গন্তব্য রূপকুণ্ডের অনেক কাছে চলে এসেছে। তাহলে কি মিগোইয়ের উপকথা মিথ্যে!বাস্তবে কি পাহাড়ের বিভীষিকা মিগোইয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই! জয় রাঠৌরের মধ্যে আগে থেকেই পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল সুনীপ। কথা বলতে বলতে গলার স্বর কেমন যেন অস্পষ্ট কর্কশ হয়ে গেছে,মুখ দিয়ে অসংলগ্ন কথাবার্তা বেরোচ্ছে। তারপর তা রূপান্তরিত হল কোনো হিংস্র পশুর দুর্বোধ্য হিংস্র গোঙানিতে। জয়ের শরীরে ঘটতে লাগল পরিবর্তন চাঁদের আলোয়! জামা কাপড় ছিঁড়ে গেল,শরীরটা আকারে বাড়তে লাগল। হাত পা ধূসর লোমে ভরে গেল। চোখ হলদে সবুজ হয়ে জ্বলতে লাগল।কান লম্বাটে হয়ে গেল,হাত পায়ে গজিয়ে উঠল পশুর মতো বাঁকা ধারালো নখর।জয় নিমেষে পরিণত হল এক দুপেয়ে আদিম জীবে যার হলুদ সবুজ চোখ আদিম জিঘাংসায় জ্বলছে।হাঁ করল পশুটি। আর তখনই সুনীপের চোখে পড়ল জন্তটির চোয়ালে ঝলসে উঠল চন্দ্রকিরণে একজোড়া ধারাল ভয়াল একজোড়া শ্বদন্ত।মুখ দিয়ে ঝরে পড়ছে লালা! সুনীপ স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে,মিগোই তাদের বিভ্রান্ত করে ফাঁদে ফেলেছে। এখন বুদ্ধি স্থির না রাখলে এই দুর্গম পাহাড়ে মিগোইয়ের হাতে মরতে হবে সবাইকে।আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গর্জন করে উঠল জন্তুটি যার হাইট কম করেও পনেরো ফুট হবে।সুনীপ চিনতে পারল এবার। এই সেই গর্জন যেটা সুনীপরা কাঠগোদামের হোটেলে উত্তরমুখো ঘর থেকে শুনেছিল। দূর থেকে শুনলেই রক্ত জল হয়ে যায়,আর এখন তো বিভীষিকা তার সামনে।হয় এই লড়াইয়ে সে জয়ী হবে,নাহলে তাকে মিগোইয়ের অনন্ত রক্ততৃষ্ণার শিকার হতে হবে। এদিকে মিগোইয়ের গর্জনে সবার ঘুম ভেঙে গেছে তাঁবুতে। বাইরে বেরিয়ে তারা যে দৃশ্য দেখল তাতে রূপালী আর জয়দীপ সেখানেই আতঙ্কে সংজ্ঞাহীন হয়ে লুটিয়ে পরল। আর এদিকে ঘটনার ঘনঘটায় সুজয় কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে তাকিয়ে রইল সেই আতঙ্কের দিকে। খস-খস-খস,পা ঘষটে ঘষটে সুনীপের দিকে এগিয়ে আসছে পাহাড়ের বিভীষিকা।আর তখনই বিদ্যুৎচমকের মতো সুনীপের মনে ভেসে উঠল মিগোইয়ের দুর্বলতা। হ্যাঁ,মিগোই দুটো জিনিসের কাছে কাবু,একটা রূপকুণ্ডের পবিত্র জল আরেকটা কাঠের আগুন। সুনীপের পকেটে লাইটার ছিল। সেটা দিয়ে তাঁবুর পাশেই পড়ে থাকা মেহগিনি কাঠের মশালে আগুন জ্বেলে জন্তুটার দিকে ঘুরে দাঁড়াল সুনীপ। মশালের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল অনেকটা জায়গা। থতমত খেয়ে গেল জন্তুটা। হিংস্র মুখচোখে তার একঝলক ভয়। সুনীপ বুঝল এই তার দুর্বলতা। সুনীপ মশাল নিয়ে এগিয়ে আসতেই লাফিয়ে দূরের পাহাড়ের দিকে পালিয়ে গেল জন্তুটি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সুজয়। কিন্তু,সুনীপ জানে এই শেষ নয়। মিগোই আবার আসবে।কিন্তু পরবর্তী আক্রমণের আগেই তাদের পৌঁছাতে হবে ঐ দূরের রূপকুণ্ডে। পরের দিন সকালে রূপকুণ্ডের দিকে রওনা হল সুনীপরা। নন্দা ঘুন্টি থেকে রূপকুণ্ড চার ঘন্টার পথ। হেঁটেই যেতে হবে।চারিদিকে শুধু পাথর আর বরফ। যেদিকে চোখ যায় কেউ যেন সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে! আজকের দিনটা সুন্দর বললেও কম বলা হবে। আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মতো সাইরাস (cirrus)মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। চারদিকে পাহাড়ের পরিষ্কার হাওয়া বইছে। মাঝে মাঝে ঝাউ আর দেবদারু গাছ। আর কোথাও কোথাও রডোডেনড্রনের ঝোপ! সেখানে ফুটে রয়েছে টকটকে লাল রডোডেনড্রন,যেকোনো ভ্রমণপিপাসু পর্যটককে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। যত কাছে আসছে রূপকুণ্ড,প্রকৃতি ধীরে ধীরে খুলছে তার অন্তর্বাস। আরও মোহময়ী লাগছে তাকে! কিন্তু,এইসব কিছু উপভোগ করার সময় আর পরিস্থিতি কোনোটাই নেই সুনীপদের। তাদের সাথে খাবার আর জল দুটোই শেষ হয়ে গেছে। তারা চলেছে তো চলেইছে। সামনে চড়াই উৎরাই। পথ দুর্গম,বন্ধুর। সুনীপের মনে পড়ল,"কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে,দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে!" অরুণিমা বলল,"উফ আর পারি না,আর কতোদূর! চারদিকে শুধু পাথর আর বরফ। চলতে চলতে পা তো গেল।" সুজয়ও বলল,"সত্যি দাদা,যেকটা মিশন ছিল এটা তাদের মধ্যে অন্যতম কঠিন। অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। কতো স্বপ্ন ছিল হিমালয়ে ঘুরব,আর এখন এখান থেকে সশরীরে বেরোতে পারলে বাঁচি। কাল রাতে যা দেখলাম,তারপর রূপকুণ্ড চুলোয় যাক,আর একমুহূর্ত এখানে থাকার ইচ্ছা নেই আমার।এখন তো বরফ দেখলেই ভয় লাগছে।" গম্ভীর হয়ে থাকল সুনীপ। কাল রাতে যা বিভীষিকা তারা দেখেছে,সেই আতঙ্ক থেকে এখনো কেউই বেরোতে পারেনি।সুনীপও যথেষ্ট চিন্তিত। যদিও এখনো মিগোই আর তাদের সামনে আসেনি,তবুও আক্রমণ করতে কতোক্ষণ! আর এখন ওদের সাথে না আছে আগুন,না আছে রূপকুণ্ডের পানি।আর নন্দা ঘুন্টি থেকে এই বরফের দেশে মিগোইয়ের প্রভাব আর শক্তি দুইই বেশি।আর মিগোই তো তাদের বিভ্রান্ত করবেই। কিন্তু,হাল ছাড়বে না সুনীপ। মিগোইয়ের সাথে সেও সর্বশক্তি দিয়ে লড়বে।চোয়াল শক্ত হয়ে গেল সুনীপের। তারা যখন রূপকুণ্ডে এসে পৌঁছাল তখন সূর্য মাথার ওপর। চারিপাশে পাহাড় আর পাহাড়। আর তার কোলে একচিলতে টলটলে পরিষ্কার স্বচ্ছ জল। সেই নীল স্বচ্ছ জলে আকাশের সুনীল প্রতিবিম্ব অদ্ভূত এক মায়াবী ল্যান্ডস্কেপ সৃষ্টি করেছে। টলটল করছে জল। আশেপাশে রডোডেনড্রন গুল্ম।ফুটে রয়েছে লাল রডোডেনড্রন ।প্রকৃতি এখনো অপরূপা। এখন মধ্যাহ্নে যদি জায়গাটা এতো সুন্দর হয়,তাহলে চাঁদনি রাতে কি হবে! সৌন্দর্যের মায়াবী বিচ্ছুরণে স্তম্ভিত হয়ে গেল সুনীপ। না এইখানে একটু জিরানো যায়। লেকের পাশে বসল সুনীপরা,মুখচোখে জল দিল।ফ্রেশ লাগল। ইশ,লেকের জল কি ঠাণ্ডা,পা ডুবিয়ে বসল সুনীপরা।ঝিরঝির করে বইছে হাওয়া।আকাশে উড়ে যাচ্ছে ব্লু হুইস্টল থ্রাশ। কিছুক্ষণ পর চমকে উঠল সুনীপ। সামনের ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসছেন সেই তান্ত্রিক অঘোরীচণ্ড।কাছাকাছি কোথা থেকে বাঁশির শব্দ ভেসে আসছে।মধুর কিন্তু রহস্যময়!অঘোরীচণ্ড যত কাছে আসছেন,বাঁশির শব্দটাও ততো স্পষ্ট হচ্ছে।শব্দটায় এক অপূর্ব সম্মোহনী শক্তি রয়েছে যার হাতছানি উপেক্ষা করা খুবই কঠিন! অঘোরীচণ্ডকে অপূর্ব লাগছে। মুখ থেকে যেন এক অদ্ভূত রশ্মি বেরোচ্ছে।দু চোখ জ্বলছে।অরুণিমাকে হাত নেড়ে ডাকল অঘোরী। আর মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার দিকে এগিয়ে গেল অরুণিমা।আর তখনই হতবাক হয়ে গেল সুনীপ। লেকের জল স্বচ্ছ,সেখানে তাদের পাঁচজনের প্রতিবিম্ব পড়লেও অঘোরীর কোনো প্রতিবিম্ব পড়ে নি। আরেকটা জিনিস দেখল সুনীপ,অঘোরীর পায়ের গোড়ালি উল্টো।ব্যাপারটা বুঝতে এক মুহূর্ত ও লাগল না সুনীপের।কিন্তু সেও হার মানার পাত্র নয়। শত্রুর এই অন্তিম প্রহার প্রতিহত করতেই হবে তাকে। অঘোরীকে চমকে দিয়ে অঘোরীর দিকে ভীমবেগে ছুটে গেল সুনীপ।তারপর অঘোরীকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল রূপকুণ্ডের জলে। আর তখনই এক ভয়ানক আর্তনাদে কেঁপে উঠল চারদিক। রূপকুণ্ডের জলে পড়ে অঘোরী রূপান্তরিত হয়েছে ভয়াবহ মিগোইতে। সেই মিগোই জলে ঝাপটা ঝাপটি করছে সুনীপের সাথে। কিন্তু সুনীপের সাথে আর পারছে না পাহাড়ের দানব। তার কোষে কোষে শুরু হয়ে গেছে এক ভয়াবহ যন্ত্রণা।কিন্তু তা নিয়েও সে তার দাঁত আর নখর দিয়ে আঘাত করে যাচ্ছে সুনীপের শরীরে। রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে রূপকুণ্ডের জল। কিছুক্ষণ পর লেকের পবিত্র জলের সংস্পর্শে আগুন ধরে গেল অঘোরীর শরীরে। আর কিছুক্ষণ পরে পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়ে গেল সেটা। চিহ্ন রইল না আর পাহাড়ের বিভীষিকার। শেষ হল আতঙ্ক। ক্ষতবিক্ষত শরীরে জল থেকে উঠে এল সুনীপ। মিগোইয়ের ভয়াবহ আর্তনাদে জয়দীপ আর সুজয় আগেই অজ্ঞান হয়ে গেছে। অরুণিমা আর রূপালী বাকরুদ্ধ।এতক্ষণ তারা যেন চোখের সামনে কোনো হরর সিনেমা দেখছিল।এখন যা ঘটল,তা তারা বিশ্বাসই করতে পারছে না। এও কি সম্ভব! সব ভালো যার শেষ ভালো। শুভশক্তির কাছে হার মানতেই হল অশুভ শক্তিকে। সুনীপরা টলতে টলতে যখন নন্দা ঘুন্টির ক্যাম্পে পৌঁছাল ,তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে! সমাপ্ত


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror