জিন্দা কবর-ইতিহাসের কুহেলিকাময় একটি আশ্চর্য ঘটনা
জিন্দা কবর-ইতিহাসের কুহেলিকাময় একটি আশ্চর্য ঘটনা


সময়কাল অষ্টাদশ শতক। হঠাৎই নগর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। নগরের কিছু শিশুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কান্নায় শিশুদের মায়েদের বুক ভেঙে যাচ্ছে। বাবাদের চোখে ঘুম নেই। কেটে যাচ্ছে একের পর এক নিদ্রাহীন নিশা।অবশেষে পাওয়া গেল শিশুদের।নগর সংলগ্ন নবাবের মহলের কাছে।
শিশুদের না বলে তাদের অর্ধভুক্ত মৃতদেহ বলাই ভাল। নির্মম কোনো মানুষ বা জানোয়ার সেই নিষ্পাপ শিশুদের কলজে ছিঁড়ে খেয়েছে,তারপর তাদের কলজেহীন মৃতদেহ ফেলে দিয়েছে সেই পরিত্যক্ত প্রান্তরে। কিন্তু কার কাজ হতে পারে এটা! মানুষ বা অন্য কোনো পশুর! নগর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। সবার মনে একটাই আতঙ্ক আর যেন এরকম অঘটন না ঘটে। কিন্তু আবার ঘটল অঘটন। আবার পাওয়া গেল চার মাসের শিশু রিয়াজের দেহ সেই নবাবী মহল সংলগ্ন প্রান্তরে। এবারও যেন কেউ যেন ছিঁড়ে নিয়েছে তার কলজে। হায় আল্লাহ্ ,এতো নির্মমতার কাজ কার হতে পারে!
বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন রিয়াজের মা আমিনা।
আতঙ্কে কাঁপতে লাগল নগর। কার হতে পারে এ কাজ। এ হারাম কাজ কে করতে পারে! সারা নগর জুড়ে এক সন্দেহের বাতাবরণ। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মানুষের গভীর মননে অবিশ্বাসের এক চোরা স্রোত কাজ করছে। তাও নগরবাসীর মনে দৃঢ় বিশ্বাস এই জঘন্য কাজ কোনো মানুষ করতে পারে না। এ নিশ্চয়ই নগরের বাইরে গভীর অরণ্য থেকে আসা শিয়াল বা হুড়ালের কাজ। কিন্তু হুড়াল বা অন্য কোনো হিংস্র প্রাণী আসলে তার গর্জন তো শোনা যাবে,আর দ্বিতীয় কথা হুড়াল বা অন্য কোনো হিংস্র প্রাণী যাই হোক না কেন,শুধু শিশুর কলজে টা খেয়ে ছেড়ে দেবে! আর ঘুমন্ত মায়ের পাশ থেকে শিশুকে টানতে টানতে নিয়ে যাবে,মা জানতেও পারবে না। কাজটা কোনো মানসিক বিকৃতিসম্পন্ন মানুষেরও তো হতে পারে। যার মানসিক বিকৃতি তাকে এই পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে সে এইপ্রকার কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। নগরবাসী ভাবান্বিত,এই কাজ নবাবী মহলের কারোর নয় তো। নবাব মুর্শিদকুলিদুহিতা আজিমুন্নেসা বহুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু,কোনো এক দৈববলে তিনি হঠাৎই সুস্থ হয়ে উঠছেন। আজিমুন্নেসার সুস্থতা যেসব বাঁদীরা দেখছে,তারা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাদের কাছ থেকেই খবর রটাচ্ছে সারা নগরে। আজিমুন্নেসার হাকিম জুলফিকার সুস্থতার জন্য এমন এক গুপ্ত পদ্ধতি বলেছেন,যা বিশ্বস্ত বাঁদী ও খোজা ছাড়া কেউ জানে না। এমন সময়ে ফিরোজা বেগমের কথায় বিনা মেঘে বিভীষিকার বজ্রপাত ঘটল নগরে। গভীর রাতে নাকি তার ছেলেকে বলপূর্বক তুলে নিয়ে গেছে নবাবী প্রহরীরা,এর পরে সেই নিষ্পাপ শিশুর কলজেহীন দেহ পাওয়া গেল সেই পরিত্যক্ত প্রান্তরে। বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন ফিরোজা বেগম,সব সম্পদ ফিরে পাওয়া যায় ,কিন্তু হারানো সন্তান কে কি আর ফিরে পাওয়া যায়!নগরবাসীর মনে জন্ম নিতে লাগল বিদ্রোহের অগ্নি।
স্থান বাঙলার মুখসুদাবাদ যার নাম কিছুকাল আগেই মুর্শিদাবাদে পরিণত হয়েছে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর নামে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ নবাব মুর্শিদকুলির পূর্ব ইতিহাস কেউ সঠিক বলতে পারে না,কেউ বলে তিনি দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণসন্তান ছিলেন,তার প্রকৃত নাম ছিল সূর্যনারায়ণ মিশ্র,পরে ধর্মান্তরিত হয়ে তার নাম হয়েছিল মহম্মদ হাদি। কেউ বলে তিনি ইসলাম ধর্মালম্বীই ছিলেন,তার প্রকৃত নাম ছিল জাফর খান। আবার কারোর মতে তিনি এই বাঙলারই ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যাই হোক,এই কথাটা সম্পর্কে অনেকেই অবহিত যে তিনি বহু দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন। কিন্তু,নিশ্চিত করে বলা যায় ঈশ্বরের আশীর্বাদের মাথায় থাকলে ও ভাগ্যলক্ষ্মী সহায়ক হলে জীবনে উন্নতিরও বিলম্ব ঘটে না। স্বভাবতই,মুর্শিদকুলি খাঁ খুব দ্রুতই মোগল বাদশার সুনজরে আসেন এবং তাঁর জীবনে
অভাবনীয় উন্নতি শুরু হয়।
প্রথমে দাক্ষিণাত্যের সুবেদার হিসাবে নিযুক্ত হন,পরে এই বাঙলারই নবাব হিসাবে নিযুক্ত হয়ে মুঘল বাদশাহের নিয়ন্ত্রণে
র মোটামুটি বাইরে চলে আসেন ।বাংলা,বিহার,উড়িষ্যার বিপুল ধনরাশি তার অর্থনৈতিক অবস্থাকে পাহাড় প্রমাণ করে তোলে। শুধু শাসন ও রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়,মুর্শিদকুলি খাঁ ছিলেন আদ্যপ্রান্ত কোরাণ নিবেদিত এক পরম ধার্মিক মুসলিম। এতটাই তিনি ধর্মকে গুরুত্ব দিতেন যে মহম্মদের জন্মলগ্ন মউলিদ উদযাপন করার জন্য,সমস্ত মসজিদ মোমের আলোকসজ্জায় সজ্জিত করে রাখতেন।
যেখানে ইতিহাস আমাদের বলে বিভিন্ন বাদশা আর নবাবের একাধিক বেগম,একের বেশি দাসী আর বাঁদির কথা,একের বেশি নারীর সাথে যৌন সম্পর্কের কথা,সেখানে মুর্শিদের প্রিয়তমা একজনই -নাসিরি বাণু বেগম। তাদেরই দুই কন্যা,এক পুত্র। তাদেরই মধ্যে একজন হলেন এই অপরূপা সুন্দরী আজিমুন্নেসা। শৈশব থেকেই মুর্শিদকুলি খাঁর বড়ো স্নেহের দুহিতা আজিমুন্নেসা , বলতে গেলে তাঁর নুর-এ-নজর। তাই তো শৈশব থেকেই সমস্ত শিক্ষা ,সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞান শিখিয়ে তিনি বড়ো করেছেন আজিমুন্নেসাকে।আজিমুন্নেসা তাঁর নয়নের মণি,সমস্ত শিক্ষায় সুশিক্ষিতা , উত্তম আচরণে পারদর্শিনী,সুচরিতা,এমনকি অপরিচিত ব্যক্তির সাথেও উত্তম আর বিনীত আচরণ করা -এহেন কন্যাকে নিয়ে তার গর্বের সীমা নেই।
এহেন হীরকদ্যুতি বিচ্ছুরণকারিণী কন্যার জন্য যোগ্য পাত্র অনুসন্ধান করা খুব আবশ্যক। এক্ষেত্রে উড়িষ্যার সুবেদার সুজাউদ্দিন মহম্মদ খান অপেক্ষা যোগ্য পুরুষ আর হয় না। সুজাউদ্দিন যথেষ্ট সুপুরুষ,এছাড়াও সুজাউদ্দিনের যে ব্যাপারটা মুর্শিদকুলিকে যথেষ্ট আকৃষ্ট করে সেটা হল সুজাউদ্দিন মহম্মদ খানের পাহাড়প্রমাণ উচ্চাশা। আপাতত মুর্শিদকুলির মনে হয় সুজাউদ্দিনই যোগ্য পাত্র আজিমুন্নেসার স্বামী হয়ে ওঠার। জীবনের সব সিদ্ধান্তে সাফল্য পেয়েছেন মুর্শিদকুলি। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস এই সিদ্ধান্তেও তাঁর কন্যার জীবন হয়ে উঠবে মধুময়। যাই হোক,শুভ মহরত দেখে হয়ে গেল নিকাহ।
যাই হোক,জীবন থাকলে মরণ থাকবেই। 1727 সালে ইহলোক ত্যাগ করলেন মুর্শিদকুলি।
ফিরে আসি কাহিনীতে।নবাবী বিশ্বস্ত পাত্র নাসিরুদ্দিনের মুখ থেকে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল খবরটা। আজিমুন্নেসা বেগম তার আগের থেকে অনেকটাইই সুস্থতায় ফিরেছেন। এ কি অদ্ভুত প্রত্যাবর্তন। আজিমুন্নেসা বেগমের সুস্থতা নেহাৎই আকস্মিক, না কি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো এক যাদুমন্ত্র।অবশেষে নাসিরের খবরে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল সংবাদ। আজিমুন্নেসা বেগম নাকি শিশুদের কলজে খাওয়া শুরু করেছেন। আর দেখে কে,বিদ্যুতের মতো সংবাদ ছুটে গেল সুজা খানের কাছে। স্বামী হলে কি হবে,কতো প্রেমের মুহূর্ত আছে তার আজিমুন্নেসার সাথে।
কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে মুহূর্তের মধ্যে বিলম্ব হল না তাঁর। আজিমুন্নেসা কে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হল জিন্দা কবরে। ইতিহাস এই ঘটনার কথাই বলে।এর পরে সুজা খান হয়ে উঠলেন বঙ্গের দ্বিতীয় নবাব।যদিও ক্ষমতা বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হল না তার পক্ষে। ক্ষমতায় এলেন সরফরাজ খান।
আচ্ছা,এই ইতিহাসের কি সবটাই সত্য! না কি রহস্যের কুহেলিকায় ঢাকা রয়েছে কিছু অস্পষ্ট নির্মম ঘটনাবলী।
মহম্মদ সুজা খানের লক্ষ্য ছিল মুর্শিদাবাদের তখত আর জইব-উন-নিসার মহব্বত।আজিমুন্নেসা বেগম ছিলেন এই লক্ষ্যে তাঁর প্রধান বাধা।কবিরাজের হয়তো কোনো অজানা ওষধির গুণে ঐশ্বরিক ক্ষমতায় সুস্থ হয়ে উঠছিলেন আজিমুন্নেসা বেগম। সুজা খান দেখলেন এরকম হলে মুর্শিদাবাদের তখত তিনি আর কোনো দিন পাবেন না। পরিস্থিতি অনুযায়ী,বিশ্বস্ত লোক লাগিয়ে শিশুদের হত্যা করা ও তাদের কলজে বের করে নেওয়া এবং তার দুর্নাম আজিমুন্নেসার ওপর নিহিত করে তাকে রাস্তা থেকে ছড়িয়ে দেওয়া কোনো ব্যাপারই নয়।
আজও মুর্শিদাবাদ(লালবাগ) শহরের এক প্রান্তে সুদৃশ্য বাগিচায় ঘেরা ও মসজিদ সংলগ্ন 'জিন্দা কবর'- আজিমুন্নেসা বেগমের সমাধি বহু বছর ধরে এক কুহেলিকাময় কাহিনীকে নিজের বুকে চেপে রেখেছে,যে সত্য একমাত্র পরম করুণাময় আল্লাহই জানেন।