বজ্রবরাহীর মন্দির
বজ্রবরাহীর মন্দির


বাঙালীর কাছে শিমূলতলা চিরকালই ভ্রমণের জন্য আকর্ষণীয় স্থান।ঝাঝা থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত এই স্থান চিরকালই বাঙালীকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে এসেছে। যেমন এখানকার রাজবাড়ি একা একা দাঁড়িয়ে ইতিহাসের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে, তেমনই সুন্দর এখানকার অন্যা রিসর্ট,নন্দী ভিলা। ধারা ফলসের অপরূপ অপার্থিব সৌন্দর্য দু'চোখ জুড়িয়ে দেয়। এছাড়াও আছে মহাকাল ও মহাকালীর মন্দির ফলসের পাশেই। প্রাচীনকালে বাঙালীরা স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে শিমূলতলাতেই যেতেন। আছে চোখ জুড়ানো হলদি ঝরণা,লাট্টু পাহাড়, সইকিটিয়া।আছে স্বামী বিবেকানন্দ মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড ইনস্টিটিউশন। পশ্চিম বলতেই তো সেকালে বোঝাত ঝাঝা,গিরিডি,যশিডি, শিমূলতলা,দেওঘর,ঘাটশিলা,টাটানগর। বাঙালীদের খুব প্রিয় ভ্রমণ এবং স্বাস্থ্যোদ্ধার করার জায়গা।
কথাসাহিত্যিক থেকে শুরু করে বিভূতিভূষণ অবধি প্রমুখের লেখায় এই স্থানগুলোরই বর্ণনা পাওয়া যাবে। দুপুরবেলা। কোলকাতা থেকে আসা সীতামারি এক্সপ্রেসে শিমূলতলা স্টেশনে নামলেন গৌতমবাবু। স্টেশনের একপাশে থাকা মহুয়া গাছটা দেখে মন হু হু করে উঠল তাঁর। কতোদিন পরে এখানে ফিরে এসেছেন! মনে পড়ে গেল তার সেই বন্ধু সমিতের কথা। যাকে নিয়ে দূরে দূরে অ্যাডভেঞ্চার করতে যেতেন। কোথায় না কোথায় গিয়েছিলেন। যেমন গিয়েছিলেন ডুয়ার্সে, তেমনই উড়িষ্যার সারান্দা ফরেস্ট, তেমনই গিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশের সাতপুরা ও কানহা টাইগার রিসর্টে। একসাথে ট্রেক করেছিলেন উত্তরাখণ্ডের চামোলীতে অবস্থিত রহস্যময় হ্রদ রূপকুণ্ডে,যেখানে নবম শতকের সময়কালীন তিনশোরও বেশি কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া গেছিল। নন্দা ঘুন্টি থেকে তুষারময় পথে রূপকুণ্ড ট্রেক করার কথা ভাবলেই এখনো গা ছমছম করে ওঠে গৌতমবাবুর।
তারপর বাইক নিয়ে শিমলা থেকে লাদাখের ট্যুর -উফফ অপূর্ব অভিজ্ঞতা। মধ্যপ্রদেশের সাতপুরা পর্বতে ওঠা সেও ভোলা যাবে না। একসাথে দু'জনে গিয়েছিলেন সিকিম। রক্তিম রডোডেনড্রনের দেশ সিকিম,বৌদ্ধ মনাস্ট্রির দেশ সিকিম,সিকিম মানেই তিস্তা আর রঙ্গিত, সিকিম মানেই ছাঙ্গু,গুরুডংমার ও খেচেওপালরি লেক। সিকিম মানেই কার্টক,লিংডুম আর রুমটেক মনাস্ট্রি। কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য দু'চোখ জুড়িয়ে দেয়। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী পদ্মসম্ভব যাকে গুরু রিংপোচেও বলা হত তিনি অষ্টম শতকে এই দেশে বাস করতেন। আবার সিকিম মানেই বজ্রযানী তন্ত্ররহস্য। গা ছমছমে পাহাড়ের দানব ইয়েতি বা মিগোইয়ের গল্পকথা। সবই ঠিকঠাক চলছিল। জীবনটাকে স্বপ্নের মতো লাগছিল। একদিন সমিত গৌতমকে দিল দারুণ একটা প্ল্যান। কোলকাতা থেকে একসাথে বাইকে করে নর্থ সিকিম গেলে কেমন হয়! নর্থ সিকিম মানেই চোলামু লেক,গুরুডংমার লেক,বরফে মোড়া লাচুং,লাচেন ও থাঙ্গু ভ্যালি। প্রথমেই প্রস্তাবটা শুনে মন নেচে উঠল গৌতমবাবুর। না,এটা স্বপ্নের সুযোগ,এই অ্যাডভেঞ্চারটা কোনো মতেই মিস করা চলবে না। যেমন ভাবা তেমনি কাজ! একদিন সোনালী সকালে এই শিমূলতলা থেকে দুজনে বাইকে করে রওনা দিলেন সিকিমে, যাই হোক উত্তর সিকিমে পৌঁছালেন। প্রকৃতির অপার্থিব সৌন্দর্য দেখে মন ভরে গেল। জানতে পারলেন এখানেই কাছাকাছি কোথাও বজ্রবরাহীর মন্দির আছে। প্রতি শনিবার রাতে সেখানে পূজা হয়।
ব্লু পাইন,ফার আর বার্চের গভীর অরণ্যের মধ্যে অবস্থিত সেই মন্দিরে একমাত্র যারা বজ্রযানী তন্ত্রে সিদ্ধ তারাই পূজা দিতে আসে,সাধারণ বাইরে থেকে আসা মানুষ তো দূরের কথা, স্থানীয় লেপচা অধিবাসীরাই সেখানে যায় না। তো সেবার কি হল,একজন স্থানীয় লেপচার কাছে এই মন্দিরের কথা শুনেছিল সমিত আর গৌতম। পাহাড়ের মধ্যে গভীর অরণ্যে অবস্থিত এই বজ্রবরাহীর মন্দিরের কথা। কথিত আছে, এখানে শনিবার আর পূর্ণিমা বা অমাবস্যার সমাপতন যখন হয় ,তখন পূজা দিলে অনন্ত শক্তির মালিক হওয়া যায়। জগতের সমস্ত সাফল্য অর্জন করা যায়। সমিত আর গৌতম যখন এই কথা শুনেছিল,তার খুব কাছাকাছিই ছিল শনিবার আর অমাবস্যার সমাপতন। বজ্রযানী তন্ত্র সম্পর্কে সমিতের লেখাপড়া ও উৎসাহ ছিল চিরকালই দেখার মতো। গৌতমের অনেকবার নিষেধ করা সত্ত্বেও সমিত পূজা দিতে গেল ঐ মন্দিরে। গৌতমের মনে একটা চিন্তাই স্থান পেয়েছিল,এইসব বজ্রযানী দেবদেবীরা স্থানবিশেষে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে,অতি ভয়ঙ্কর। বজ্রবরাহী দেবী বজ্রযানী বৌদ্ধধর্মের এক ভয়ঙ্করী দেবী। এনাকে তুষ্ট করতে হলে বজ্রযানী তন্ত্রে সম্পূর্ণভাবে সিদ্ধিলাভ করা প্রয়োজন। দেবী তুষ্ট হলে ভক্তকে অভীষ্ট ঋদ্ধি আর সিদ্ধি প্রদান করেন। আবার,দেবীকে তুষ্ট করতে না পারলে বা সাধনায় কোনো ভণ্ডামি থাকলে দেবী সাধকের মুণ্ডচ্ছেদ করে রক্ত পান করেন। এতোটাই তিনি ভয়ঙ্করী! এনার সঙ্গিনী মেখলা এবং কনখাল। যাদের অপর রূপ আমাদের এই হিন্দু ধর্মে ডাকিনী যোগিনী।
সুতরাং,আগে থেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুতি না থাকলে এনার সাধনা করা উচিতই নয়। ইনিই মহাশক্তিধারিণী দেবী বজ্রবরাহী! আর এই চিন্তা যখন গৌতমের মনকে গ্রাস করে নিল,তখন সে সমিতকে বারবার নিষেধ করতে লাগল,প্রাণাধিক বন্ধুর যাতে না কোনো ক্ষতিসাধন হয়। না,নিষেধ শোনেনি সমিত। শনিবার অমাবস্যার রাতে এক স্থানীয় লেপচা পুরোহিতের সঙ্গে ছুটে গিয়েছিল সেই বজ্রবরাহীর মন্দিরের দিকে। তারপর আর পূজা দিয়ে ফেরে নি সমিত,হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল,শূন্যে মিশে গিয়েছিল। বন্ধুর জন্য খোঁজাখুঁজি আর অশ্রুবিসর্জন করা ছাড়া কোনো রাস্তা খোলা ছিল না সমিতের কাছে। কতোদিন আগেকার কথা। আজ সেই ঘটনার পর চল্লিশ বছর কেটে গেছে। গৌতম সেন আজ প্রতিষ্ঠিত একজন বিজ্ঞানী,বেঙ্গালুরুতে থাকেন,স্ত্রী -কন্যা নিয়ে সুখের সংসার। হঠাৎই তিনি পেয়েছেন তাঁর প্রাণের বন্ধু সমিতের চিঠি। তাহলে সমিত বেঁচে আছে! সেই সমিত,দুজনে মিলে একসাথে শিমূলতলায় বড়ো হয়েছেন,কতো আনন্দ করেছেন ছোটবেলায়। হর্ষোল্লাশে প্রাণ নেচে উঠল তার । সমিত বেঁচে আছে এবং শিমূলতলাতেই আছে।আজ সেই সমিত তাকে ডাকছে। কোলকাতাতে অনেক কাজ ছিল। সেই কাজগুলো সেরে শিমূলতলায় এসেছেন গৌতমবাবু । সমিতের বাড়ির ঠিকানা জানেন তিনি। পৌঁছাতে কোনো অসুবিধা হবে না। দু'দিন পরে খবর বেরোল যে,বাঙালী বিজ্ঞানী গৌতম সেন নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন। তিনি কয়েক দিন আগেই শিমূলতলার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে,তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।