নরবলি
নরবলি
শহর পুরুলিয়ার থেকে কিছু দূরে পশ্চিম বাঙলা-ঝাড়খণ্ড সীমান্তে ছোট্ট গ্রাম কাঁটাদিহি,তার কিছু দূরেই শাল সেগুন মহুয়ার জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট আদিবাসী বসতি বারুঘুটু, মূল অধিবাসী মুণ্ডা আর সাঁওতালরা। বসন্তকালে পলাশের রক্তিমতায় চারদিক হয়ে ওঠে রক্তিম,ভেসে আসে মন মাতাল করা মহুয়ার গন্ধ, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলে মেতে ওঠে সারহুল উৎসবে, গভীর রাতে অরণ্যের মধ্য থেকে শোনা যায় মাদলের দ্রিমি দ্রিমি দ্রিম দ্রিম আওয়াজ। প্রতি রবিবার শিংবোঙার থানে পূজা দেওয়া হয়।
ভেসে চলে দখিনা বাতাস প্রেমের বার্তা নিয়ে ,সূর্যাস্তের অনুপম দৃশ্য মন ভরিয়ে দেয়,দূরের ধূসর পাহাড়শ্রেণীকে রহস্যের কুয়াশায় ঘেরা কোনো দেশ বলে মনে হয়।কিছুটা দূরে বয়ে যাচ্ছে কংসাবতী, আর অযোধ্যা হিল রিজার্ভ ফরেস্টও খুব দূরে নয়। যাই হোক,আদিবাসী বসতি থেকে দু'মাইল দূরত্বে শাল-সেগুনের গভীর বনানীর মধ্যে রয়েছে এক রহস্যময় পরিত্যক্ত মন্দির। দিনের বেলাও সূর্যের আলো এখানে ভালোভাবে প্রবেশ করতে পারে না,চারদিক কেমন যেন আলো-আঁধারি বলে মনে হয়। মানুষ তো দূরের কথা,কাকপক্ষীও এর ধারেকাছে আসে না। শোনা যায়,এককালে এটির উপাস্য দেবী ছিলেন চামুণ্ডা।
প্রতি শনিবার অমাবস্যায় নাকি নরবলিও হত। এরপর কালান্তরে সেই নরবলি বন্ধ হয়ে যায়।সব কিছু স্বাভাবিকই লাগছিল। কিন্তু ফের যেদিন শনিবারে অমাবস্যা পড়ল,সেদিন গভীর রাতে মন্দির হতে আচমকাই ঘন্টাধ্বনি আর মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ শোনা যেতে থাকল। পরের দিন সকালে আদিবাসীরা চমকে উঠল যখন তারা খুঁজে পেল তাদেরই একজন সুই মুণ্ডা যার মুণ্ডহীন শব আটকে আছে হাঁড়িকাঠের সাথে আর একদিকে ছিটকে পড়েছে তার মস্তক। সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে কিছু সাহসী আদিবাসীও মূর্ছা গেল। সব সন্দেহের তীর এসে পড়ল পূজারী ঝিন্দারামের ওপর। ঝিন্দারাম সবাইকে বোঝাতে চাইলেন তিনি ভীষণ অসুস্থ ছিলেন,তাই সেদিন তিনি মন্দিরে যেতেই পারেন নি।
সন্ধ্যাবেলা যারা পূজা দিতে গেছিল তারা বলল,সেদিন পুরোহিত অনুপস্থিত ছিলেন। মোড়লও বললেন যে,ঝিন্দারাম সেদিন যেতে পারবেন না,তার পরিবার থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।বসতির মানুষ তো শান্ত হল ঠিকই,কিন্তু ঝিন্দারামের ওপর সন্দেহ থেকেই গেল। আর সেই সন্দেহ এক অজানা আতঙ্কে পরিণত হল তখনই যখন ফের শনিবার আর অমাবস্যার সমাপতন ঘটল। পরের দিন হাঁড়িকাঠে পাওয়া গেল ঝিন্দারামের মুণ্ডহীন রক্তাক্ত দেহ,তখনও খাঁড়ায় লেগে আছে তাজা রক্ত,সহজেই অনুভব করা যাচ্ছে এই রক্ত কার। মুণ্ডের চক্ষু বিস্ফারিত,চোখের তারায় প্রতিভাত এক অজানা আতঙ্ক। সেদিনই মোড়ল নির্দেশ দিলেন এই মন্দিরের ধারেকাছে যেন কেউ না আসেন।
সেদিন থেকেই সেই মন্দিরকে পরিত্যক্ত বলে ঘোষণা করা হয়। দু'শো বছর কেটে গেছে। আদিবাসী প্রধানের মেয়ে জিনিদ,প্রেমে পড়েছে পাশের বসতির জুলতানের সাথে। কিন্তু তার পরিবার মানবে কেন! মোড়ল চান মেয়ের বিয়ে পাশের গ্রামের মোড়লের ছেলের সাথেই হয়। কিন্তু প্রেমই বা এসব ভেদাভেদ,বাধাবিপত্তি মানবে কেন! অন্ধকার রাত। আবার সেই শনিবার আর অমাবস্যার সমাপতন ।শালবনকে মায়াময় বলে মনে হচ্ছে। রাতের আকাশে কালপুরুষ যেন রহস্যে ঘেরা কোনো জগতের দিকে হাতছানি দিচ্ছে।মাঝে মাঝে ভেসে আসছে যামঘোষক শিয়ালের ডাক। ভেসে আসছে রাতজাগা পাখির শব্দ। লাল মাটির অনুর্বর পথ ধরে হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলেছে জিনিদ আর জুলতান। না,কারোর বাধা মানবে না তারা,এই আঁধার রাতেই তাদের পালাতে হবে দূরে কোথাও,তাদের গ্রাম থেকে যতোদূরে সম্ভব ।
পথের দুপাশে ঘন অরণ্য,হঠাৎই ভেসে আসল একদল হাড় হিম করা হেঁড়োলের ডাক। না,আজ হেঁড়োলকে ভয় করে না তারা,ভয় করে বসতির মানুষদের,ধরা পড়লে কি যে হবে! আরোও দূরে যেতে হবে,আরোও দূরে! ছুটতে শুরু করেছে দুজনে। অন্ধকারে চোখ মোটামুটি সয়ে গেছে। ছুটতে ছুটতেই দুজনে লক্ষ্য করল এক ভাঙা মন্দির। অন্ধকারে আবছা দেখাচ্ছে। জিনিদ বলল,সে খুব ক্লান্ত,আর পারছে না। এমতাবস্থায় এক পরিকল্পনা খেলে গেল জুলতানের মাথায়,কেন মন্দির তো আছেই,ওখানেই রাত কাটানো যেতে পারে। অন্ধকারে সাপ খোপ তো থাকতেই পারে,তার থেকেও বেশি আতঙ্ক ধরা পড়ার আতঙ্ক।না,এর চাইতে মন্দিরে প্রবেশ করাই ভালো। পরের দিন সূর্যোদয় হবার সাথে সাথেই খোঁজ খোঁজ পড়ে গেল দুই গ্রামে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাদের পাওয়া গেল সেই পরিত্যক্ত মন্দিরে। তবে এক নয়,আজ সেখানে দুই রক্তাক্ত হাঁড়িকাঠ। ভাঙা দেওয়ালের একপ্রান্তে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে একযুগ আগে রাখা এক পরিত্যক্ত খড়্গ,যা দিয়ে অঝোরে ঝরছে রক্ত!