রূপকথায় সেতুবন্ধন
রূপকথায় সেতুবন্ধন
এক
অনেক অনেক বছর আগের কথা। সোনার খনি দিয়ে ভরা ও সমুদ্রে ঘেরা এক দেশ ছিল; নাম সোনাচূড়া। বিক্রমজিৎ ছিলেন সে দেশের রাজা। প্রবল প্রতিপত্তি ছিল তাঁর; যার অধিকাংশই এসেছিল দাদু সুন্দরজিতের কাছ থেকে। তিনিই এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। সোনার খনিগুলোর আবিষ্কর্তা তিনিই। তার সময়েই তৈরী হয়েছিল সোনায় মোড়া লোহার ফটক। সোনালী রঙের প্রাসাদ, যার চূড়া বাঁধানো হয়েছিল খাঁটি সোনা দিয়ে। রাজ্যের বণিকদের মূল ব্যবসা ছিল সোনার অলঙ্কারকে ঘিরে। দেশে বিদেশে সোনা বিক্রী করে ফিরতেন তাঁরা আর লভ্যাংশ জমা পড়তো রাজকোষে। অল্প কিছু জমিতে ফলমূল, গম, সবজী চাষ হত। সামুদ্রিক মাছ ও বুনো পাখী সে দেশের লোকের অন্যতম খাদ্য ছিল। পশুহত্যা সে রাজ্যে নিষিদ্ধ ছিল।
মূল প্রদেশ খনি অঞ্চল, তাই চাষাবাদের অযোগ্য। আশেপাশের অন্ত্যতপক্ষে সাতটি দ্বীপ প্রদেশের চার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তাদেরই কোনটায় ফল, কোনটিতে গম, কোনটিতে চাল, কোনটিতে সবজী চাষ হত। আর সমুদ্রের ধারে বসবাসকারী জেলেরা মাছ চাষ করত। সেটাই ছিল তাদের মূল রুজি রোজকার। কিন্তু দেশের প্রত্যেকটি মানুষের অবস্থা অত্যন্ত সচ্ছল ছিল। চুরি ডাকাতি ছিল না বললেই চলে। অপরাধের শাস্তি হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা মৃত্যু। রাজ্যবাসীর ঘরে এত ঐশ্বর্য্য ছিল যে চুরি ডাকাতি, নিজেদের মধ্যে মারামারির প্রয়োজন পড়তো না। তবে শত্রুদেশ থেকে আক্রমণ আসতো মাঝে মধ্যেই। বিশেষ করে সুন্দরজিতের জ্ঞাতি ভাইদের রাজ্যগুলি থেকে। সেনা বাহিনী, নৌবাহিনীর পারদর্শিতায় যুদ্ধের আঁচ কখনো প্রজাদের গায়ে লাগতে দেন নি মহারাজা বিক্রমজিৎ।
একদিন বিকেলে সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে ম্রিয়মান। প্রাসাদের ছাদে বিক্রমজিৎ রাণী ভানুমতীকে নিয়ে বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়েছেন। দূরবীন চোখে লাগিয়ে রাণী মোহিত স্বরে বলে উঠলেন, “অপূর্ব! আচ্ছা দূরের ঐ দ্বীপটির নাম কি?”
“সুন্দরবন। দাদুর নামেই নামকরণ হয়েছিল।”
“দ্বীপটির সৌন্দর্য্যের কোন তুলনা নেই। কত রংবেরঙের সামুদ্রিক পাখী সমুদ্র সৈকতকে রঙীন করে তুলেছে! সবুজ টিলার উপর থেকে ঝরঝর করে ঝরণা নামছে! গত পূর্ণিমায় দেখলাম যে দ্বীপটা অর্ধেকটা ডুবে গিয়েছে; সাদা ফ্যানালু বড় বড় ঢেউ যেন মুক্তোর মালা ছড়াচ্ছে।”
“ঠিকই দেখেছো রাণী...বছরের চারটি পূর্ণিমায় ওদিকের সমুদ্রের জল ফুলে ফেঁপে ওঠে। জংলী পশু পাখী সব তখন আশ্রয় নেয় গড়ের সবচাইতে উঁচু ও ঘন জঙ্গলের গুহায়। তখন বাঘ, সিংহ, শেয়ার ভাল্লুক, গরিলা, হরিণ, সাপ, ঈগল সকলে একে অপরের বন্ধু; বিপদের দিনে একে অন্যকে বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা করে। সেই সময় ওদের আহারাদি আমার সৈন্যরাই রেখে আসে। মনুষ্য জাতির বসবাসের অযোগ্য ঐ দ্বীপ।”
“বা! মহারাজ...আমাকে বেড়াতে নিয়ে চলুন ঐ দ্বীপে...কুমার পৃথ্বীও পশু পাখিদের দেখে খুব খুশি হবে। জন্মাবার পর থেকে সে তো এই প্রাসাদেই বন্দী হয়ে আছে একপ্রকার...”
“তুমি আর যেখানে যেতে চাইবে, আমি নিয়ে যাব রাণী...কিন্তু ওখানে নয়...”
“কেন রাজন? ও দেশ তো তোমার রাজ্যেরই অংশ...”
“তা বটে! তবে দাদুভাই ও দ্বীপকে স্বাধীন ঘোষনা করেছিলেন। ওখানে শিকার করা নিষিদ্ধ করেছিলেন। তাই এ রাজ্য কেন অন্য রাজ্যের কেউই সে দ্বীপে যাতায়াত করতে পারে না। তাছাড়া ওটা জানোয়ারদের দ্বীপ; এমনিতে যথেষ্ট হিংস্র ওরা। মানুষ দেখলেই মেরে ফেলে। শুধু পূর্ণিমার ঐ চারদিন জোয়ার এলে সৈনরা প্রাণ হাতে করে যায় এবং খাদ্য নামিয়ে দিয়েই চলে আসে।”
“তবে ঐ দিনেই যাব আমি...”
“বেশ। নিয়ে যাব...তবে দূর থেকে দেখেই চলে আসবো কিন্তু...”
“আচ্ছা...তাই হবে।”
তিনমাস পরে সমুদ্রবন্দরে সাজো সাজো রব। উন্নতমানের রণতরী সাজানো হয়েছে। রাজামোশাই সপরিবারে সমুদ্রবিহারে যাবেন। সেনাপতি বল্লালসেন এসে খবর দেন।
“মহারাজ তরী প্রস্তুত। চলুন তবে...যাওয়া যাক...”
“একি! সেনাপতি আপনি কোথায় চললেন? আমরা বেড়াতে যাচ্ছি। যুদ্ধে নয়। আপনি রাজ্য সামলান। ক’দিনের তো ব্যাপার। আমরা ফিরে আসবো তাড়াতাড়ি...”
অমায়িক মহারাজ বিক্রমজিৎ মহামন্ত্রী চন্দ্রনাথের কথাও শুনলেন না। তাঁর হাতে রাজ্যভার সঁপে দিয়ে সামান্য কিছু সৈন্য ও রাজ্যবাসীদের সঙ্গে নিয়ে বজরায় উঠে পড়লেন। রাণী ভানুমতী ও দুইবছরের শিশু পুত্র পৃথ্বীজিৎও সঙ্গী হল। সফরে গান, নাচ, উৎসবের শেষ ছিল না। মহানন্দে কাটলো দিনগুলো। কোন কোন দ্বীপে নেমে অতিথি সৎকার গ্রহণ করাও হল। দূর থেকে সুন্দরবন দ্বীপ দেখাও হল। সৈন্যরা ছোট নৌকায় করে গিয়ে খাদ্য নামিয়েও দিয়ে এল। এবার ফেরার পালা। তরী এগিয়ে চলেছে ঢেউয়ের তালে তালে। সূর্য্যের ছবি আঁকা পালগুলি হাওয়ায় পতপত করে উঁড়ছে। আগেরদিন পূর্ণিমা ছিল। রূপালী চাঁদের জোৎস্না সমুদ্রকে অপরূপ করে সাজিয়েছে। রাজা রাণী আরাম কেদারায় বসে সেই দৃশ্যই দেখছিলেন। ছোট্ট পৃথ্বী বজরার ভিতরে নিজের ঘরে ঘুমে কাত। সারাদিন যা দুষ্টুমি করেছে সে! হঠাৎ পশ্চিম আকাশে উঠলো ধুলিঝড়। ক্রমশঃ সেই ঝড় তুফানে পরিণত হল। চাঁদ মেঘে ঢাকা পড়ল। বৃষ্টির তোড়ে বজরার পাল ছিঁড়ে গেল। ঢেউয়ের ধাক্কায় একের পর এক কাঠের পাটাতনে চিড় ধরল। সারারাত ধরে কি যে তাণ্ডব হল!
দুই
সুন্দরবনের সমস্ত বন্যপ্রাণী দূর থেকে সে দৃশ্য দেখেছিল। সকাল হতেই তারা নেমে এল নিজনিজ ভূমিতে। কিন্তু আজ যেন কি একটা অন্যরকম ঘটে গেছে! মানুষের গন্ধ আসছে কেন নাকে? নেকড়ের দল, সিংহ, বাঘ, সমস্ত হিংস্র প্রাণী সৈকতের দিকে ছুটল। একটি ছোট্ট শিশুকে বালিতে মাখামাখি হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা গেল। হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে সে। মানুষের বাচ্চার কান্না শুনে ছুটে এসেছিল গরিলা মাও। সেই বাচ্চাটিকে উদ্ধার করলো অন্য হিংস্র পশুদের কাছ থেকে। নিজের স্তন্যপান করিয়ে তার কান্না থামালো। তারপর শিশুটিকে নিয়ে সটান চলে এল পুরাতন গুহায়। সেখানেই থাকে জঙ্গলের বয়ঃজেষ্ঠ্য সদস্য ঠাকুরদাদা গরিলা। শিশুটির গলার হারের লকেটে রাজা রাণীর ছবি আর হাতের উল্কিতে সূর্য্য চিহ্ন দেখেই চমকে উঠলো সে।
“এ তো সোনাচূড়ার রাজকুমার! কাল তুফানে ভেসে এসেছে!”
“আর এর বাবা-মা...?”
“জানি না। বাজ পাখিকে পাঠাও দেখি একবার প্রাসাদের দিকে খবর নিয়ে আসুক!”
বাজ পাখি সেদিন সন্ধ্যায় যে খবর নিয়ে এল তাতে ঠাকুরদাদা গরিলা মুষড়ে পড়ল।
“কালকের তাণ্ডবে রাজা রাণীর মৃত্যু হয়েছে। তাদের মৃতদেহ ঘিরে শোক পালন চলছে প্রাসাদে...”
“আহারে! বেচারা রাজকুমার। এত ছোট বয়সে অনাথ হল...এখন কি হবে ওর? শত্রু কচি বাচ্চাটাকে মেরে রাজ্য ঠিক দখল করে নেবে গো...”
“না! তবে আমরা কি করতে আছি? আমরা জংলী জানোয়ারেরা মানুষ করবো একে। মনে রেখো এর প্রপিতামহ সুন্দরজিতের অবদান আমরা কোনদিন যেন না ভুলি। তিনি ছিলেন বলেই আমরা বেচে বর্তে আছি। নাহলে হিংসুটে মানুষরা কবেই এ জঙ্গল কেটে সাফ করে দিত। ধ্বংস করে দিন অরণ্যকে...”
পশুদের সভা ডেকে বলল বুড়ো গরিলা।
“আজ থেকে এই রাজকুমার আমাদেরই একজন। ওর গায়ে একটা আঁচড় যেন না লাগে!”
বাঘ, নেকড়ে যদিও রাগে গড়গড় করতে থাকলো, কিন্তু এই বয়স্ক গরিলার আদেশ অমান্য করার সাহস জঙ্গলের কারোর নেই। তাছাড়া শিশু কুমারের মিষ্টি ব্যবহার পশুদেরও মুগ্ধ করেছিল। হিংসা দ্বেষ ভুলিয়ে দিয়েছিল। যদিও বা কেউ তাকে আঘাত করার চেষ্টা করত, তাদের মায়ের কাছে এমন মার খেত যে সে ভুলেও কুমারের দিকে আর তাকাতো না। জঙ্গলের প্রতিটি পশু-মায়ের আদরের ধন হয়ে উঠেছিল সে! অতএব সেই জঙ্গলেই হেসে খেলে বড় হতে থাকলো রাজকুমার। ক্রমে সে নিজের ভাষা ভুলে গেল। পাখি, পশুদের ভাষা রপ্ত করলো। ঈগল তাকে মাছ ধরতে শেখালো। সিংহ সুচতুর শিকারী করে তুললো। শেয়ালরাজা তাকে বুদ্ধির তালিম দিল। হনুমানদের কাছে সে ডালে ডালে চলার শিক্ষা নিল। আর যুদ্ধ যেহেতু তার রক্তে, তাই একটু বড় হতেই নিজেই গাছের ডাল কেটে তরবারি শিক্ষা করতে থাকলো। আর গরিলা মা? তার মত আপন এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। সে মানুষ বলে তাকে মাছ-মাংস ঝলসিয়ে খাওয়াত। তবে দুধ, ফল ইত্যাদিই খাওয়ার অভ্যেস করিয়েছিল বেশী। গাছের ছাল, ঘাস পাতা দিয়ে জামাকাপড় তৈরী করে পরাতো। সে বুঝিয়েছিল যে মনুষ্য জাতির লোকেরা উলঙ্গ থাকে না।
ক্রমে রাজকুমারের বয়স বিশ বছর ছাড়ালো। গরিলা মা পড়লো মহা ফাঁপড়ে। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী সকলকেই বিয়ে করে গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করতে হয়। কিন্তু রাজকুমার তো মানুষ, তার উপযুক্ত পাত্রী পাওয়া যাবে কোথায়? বাজ পাখি সমস্ত পাখির দলকে আদেশ করলো,
“যাও...ঘুরে এসো প্রত্যেকটি রাজ্যে...খরব নিয়ে এসো...কোথায় আছে রাজকুমারের উপযুক্ত অবিবাহিত পাত্রী...?”
পাখীরা এসে খবর দিতেই সরোজমিনে তদ্ন্ত করতে হনুমানের দল ল্যাজ উঁচিয়ে রওনা দিল দেশ থেকে দেশান্তরে। কিন্তু ব্যর্থ
মনোরথ হয়ে ফিরলো। জংলী রাজকুমারের জন্যে জংলী পাত্রী কোথাও পাওয়া গেল না। জংলী মায়েরা চিন্তন শিবিরের ডাক দিল। সেখানেই সিদ্ধান্ত হল যে রাজকুমারকে তার দেশে ফেরৎ পাঠিয়ে দেওয়া হবে। মানুষের বাচ্চাকে জংলী বাচ্চায় রূপান্তরিত করে তারা মস্ত ভুল করেছে।
“এখন সে বড় হয়েছে, আত্মরক্ষা করতে শিখেছে; এবার তার নিজের রাজ্যে ফিরে যাওয়াই উচিৎ। তা নাহলে সোনাচূড়ার রাজপরিবারের প্রতি ঘোর অন্যায় করা হবে।”
রাজকুমার তো কিছুতেই রাজী নয়। অভিমান করে চোখের জল ফেলতে থাকে সে। রাগ করে গাছের ডাল ভাঙতে থাকে। গরিলা মা তাকে যথাসম্ভব বুঝিয়ে শান্ত করে।
“তুই তো আমাদের দেশের রাজা...যখন খুশি আসবি বেটা...আমরা জংলী জানোয়ার...রাজপাটের কি বুঝি? তোর অধিকার তোকে পাইয়ে দিতেই হবে বাবা... তোর বাপ ঠাকুরদার কাছে আমাদের ঋণের সীমা নেই! আমরা পশু হতেই পারি, কিন্তু অকৃতজ্ঞ নই।”
সুতরাং সাতদিন ধরে কাঠ জোগাড় করে নৌকা তৈরীর কাজ চললো। বানর সেনা থেকে শুরু করে পাখীর দল সকলেই হাত লাগালো এই শুভ কাজে। নির্দিষ্ট দিনে রাজকুমার সকলকে চোখের জলে ভাসিয়ে বিদায় নিল। সঙ্গী হল বাজ পাখি ও বন্ধু হনুমান।
তিন
পাঁচদিন জলে ভাসতে ভাসতে উপস্থিত হল তারা সোনাচূড়ার বন্দরে। তাদের নৌকা আকারে ছোট, তাই বুঝি সৈন্যদের চোখে পড়লো না। বাজ পাখি পথ দেখিয়ে তাকে প্রাসাদ অবধি নিয়ে গেল। হনুর সঙ্গে গাছের ডাল বেয়ে রাজকুমার প্রথমেই পৌঁছাল ছাদে। সেখানে তখন মন্ত্রীকন্যা মুক্তোমালা তার সখীদের নিয়ে নাচ গানে মত্ত ছিল। রাজকুমারকে লাফিয়ে আসতে দেখে চিৎকার করে উঠল তারা।
“ওমা গো! একে? সারা গায়ে বড় বড় লোম...লম্বা লম্বা চুল...গোফ দাঁড়ি ভর্তি মুখ! অদ্ভূত পোষাক! ওয়াক! গায়ে ভটকা গন্ধ!”
রাজকুমার ওদের ভাষা বুঝতে পারল না। সে অসহায় ভাবে চেয়ে থাকল। সৈন্যরা এসে তাকে বন্দী করে নিয়ে গেল। ছাদের পাঁচিলে বসে বাজ পাখি আর হনুর এসব দেখা ছাড়া কিইবা করার ছিল।
“হনুভাই...বিপদ! চলো গিয়ে খবর দিই গরিলামাকে...”
“তোমার যা বুদ্ধি! গরিলা মা মানুষের সমাজে এলে বেঁচে ফিরতে পারবে?”
“তবে?”
“দেখোই না কি হয়! আমাদের কুমারের বুদ্ধিও তো কম নয়!”
সত্যি তাই। কুমার পৃথ্বী আকারে ইঙ্গিতে, ইশারায় নিজের কথা বোঝানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু রাজসভায় উপস্থিত সকলেই বিষয়টা নিয়ে হাসাহাসি করতে থাকলো। জংলী অথচ সহজ সরল মানুষের চরিত্রকে বোঝার মত মানসিকতা তাদের নেই যে! মহামন্ত্রী চন্দ্রনাথ সভায় এসে উপস্থিত হলেন। এতগুলো বছর তিনিই রাজ্যভার সামলেছেন, রাজ সিংহাসনে রাজদণ্ড রেখে। তার বিশ্বাস ছিল যে রাজকুমার পৃথ্বীরাজ একদিন ঠিক ফিরে আসবে। কুমারের হাতে আঁকা আবছা উল্কির চিহ্ন ও গলায় ময়লা হয়ে যাওয়া সোনার হারের লকেটে রাজা রানীর ছবি দেখে তিনি যারপরনাই খুশী হয়ে উঠলেন। জড়িয়ে ধরলেন রাজকুমারকে। চোখে জল নিয়ে ঘোষনা করলেন,
“কুমার পৃথ্বী ফিরে এসেছে! রাজ্যে উৎসব পালিত হোক!” জংলী রাজকুমারের দায়িত্ব গিয়ে পড়লো মন্ত্রীকুমার পল্লব এবং কুমারী মুক্তোমালার ওপর। রাজকুমারও বুঝতে পারল, যেভাবেই হোক এদের ভাষাটা আগে রপ্ত করতে হবে, তা নাহলে ঘোর বিপদ। প্রায় মাস ছয় ধরে চললো প্রস্তুতিপর্ব। তারপর পল্লবকুমার যেদিন স্নান করিয়ে, পরিষ্কার পরিছন্ন করে, জংলা পোষাক পরিবর্তন করে রাজপোষাক পরিহিত পৃথ্বীজিৎকে রাজসভায় উপস্থিত করল, সেদিন উপস্থিত কারোর চোখের পলক পরছিল না। কি সুন্দর, সুঠাম দেহ গঠন। কি অমায়িক হাসি ও ব্যবহার! মুক্তমালার কাছে দুবেলা ভাষা শিক্ষা করতো রাজকুমার। তাই অল্প স্বল্প সৌজন্য মূলক কথা বলতে শুরু করেছিল সে। মিষ্ট ভাষনের দরুন প্রশংসার বন্যা বয়ে যেতে থাকলো সভাঘরে।
পৃথ্বিজিৎ নিজে তো ভাষা শিখতোই আবার সেই ভাষা বাজ পাখি আর হনুমানকেও শেখাত। তারা ঠাট্টা করে বলল, “ভাই...বলো দেখি তোমার ভাষাটিকে পছন্দ নাকি ভাষা-দিদিমনিকে?” লজ্জা পেল পৃথ্বীজিৎ। এই অভিব্যক্তিটাও তো মুক্তোমালার কাছেই শিখেছে সম্প্রতি।
পৃথ্বিজিৎ আর মুক্তোমালার মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠলো ঝড়ের বেগে। বাগানে হাসি মস্করায় দুজনকে মেতে থাকতে দেখে মন্ত্রী চন্দ্রনাথ দুজনের চারহাত এক করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঘটা করে রাজকুমারের বিয়ে হয়ে গেল। চারদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানে চারবেলা পেটপুরে খেল সবাই। তাছাড়া বিভিন্ন রাজ্য থেকে অভ্যাগতরাও এসেছিলেন। পাঁচদিনের দিন পৃথ্বীজিতের রাজ্যাভিষেক যে! রাজ্যে খুশির অন্ত নেই।
কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও পৃথ্বীর মন চলে গেল সুদূরে সুন্দরবন জঙ্গলে। সমস্ত পশু জানোয়ারদের জন্যে ভীষন মন খারাপ করে তার। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। গলার কাছে কান্নাটা আটকে আসে। মানুষের রকম সকম তার ভাল লাগে না। সে এদের ভাষা ভাল করে বোঝে না। এরা নিজের লোককেই বন্দী করে। তাকে শাস্তি দেয়; মৃত্যুদণ্ড দেয়। প্রয়োজনে যুদ্ধ করে সব কেড়ে নিতেও পিছপা হয় না। এত আছে তবুও আরো চাই! এত লোভী কেন মানুষ? আর এত নৃশংস! সারারাত ছাদে পায়চারী করতে থাকে সে।
সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী মুক্তোমালা স্বামীর এইরূপ ব্যবহারে অধৈর্য্য হয়ে ওঠে। “কি হয়েছে? আমায় খুলে বল...”
“তুমি কি বুঝবে?”
“নিশ্চয়। আমি তোমার স্ত্রী...সুখে দুঃখে তোমার পাশে থাকাটা আমার কর্তব্য...”
“মনুষ্য জাতির সমাজে আমার নিজেকে বড় বেমানান মনে হয়। তোমাদের সমাজে সব কিছু নকল। মানুষের কত ঐশ্বর্য্য আছে, তবুও আরো চাই। আর না পেলে ছিনিয়ে নিতে চাওয়া...এসব আমার ভাল লাগে না মুক্তোমালা...”
“জঙ্গলেও তো জন্তুরাও শুনেছি হিংস্র...”
“হুম। তারা অশিক্ষিত, বুদ্ধিহীন তাই হিংসা করে। তবে সে হিংসা শুধুমাত্র নিজেদের খাদ্য আহরণ করার উদ্দেশ্যে...প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে...তারা বন্ধুত্বকে মর্যাদা দেয়...আর যাই হোক মানুষের মত পিছন থেকে আক্রমণ করে না...”
“তবে তুমি কি করতে চাও রাজকুমার?”
“আমি জঙ্গলে ফিরে যেতে চাই মুক্তোমালা। ওটাই আমার জন্যে সঠিক জায়গা।”
“বেশ। তাই হবে। চলো...দাদা ও বাবার সঙ্গে কথা বলি...এ বিষয়ে...” মন্ত্রীমোশাই সব শুনে ব্যথিত হলেন। চিন্তান্বিত হলেনও বটে।
“দেখ বাবা...রাজা ছাড়া রাজ্যপাট চলে কি করে বলো দেখি...তোমার জ্ঞাতি ভাইরা সুযোগ পেলেই আক্রমণ চালাচ্ছে। এ রাজ্য থেকে রাজ-ঐশ্বর্য্য চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে! আমার বয়স হয়েছে! প্রজাদের কথা একবার ভাববে না?”
“ভেবেছি মন্ত্রীমোশাই! পল্লবকে অভিষিক্ত করা হোক। ওই একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি রাজ্য চালানোর জন্যে। শিক্ষা দীক্ষা, সাহস বুদ্ধিমত্তা কোন কিছুর অভাব নেই ওর।”
“কিন্তু লোকে কি বলবে? আমাকে লোভী, চালাক বলবে...নিন্দামন্দ করবে...”
“বেশ! তবে যা করার আমিই করবো...কাল আমার রাজ্যাভিষেক হোক"
. মঙ্গলবাদ্য বাজিয়ে পৃথ্বীর রাজতিলক হল। অভিষিক্ত হল সে। কিন্তু পরক্ষণেই সকলকে অবাক করে দিয়ে রাজার মুকুট পল্লবকুমারের মাথায় পরিয়ে দিল পৃথ্বীজিৎ। নিজের বুড়ো আঙ্গুল কেটে রক্ততিলক এঁকে দিল বন্ধুর কপালে।
“আমি জঙ্গলে বড় হয়েছি। রাজ্য পাটের কিছুই জানি না। সোজা-সাপটা মানুষ, কূটনীতি বুঝি না। অতএব এ ক্ষমতা ভোগ করার কোন অধিকার আমার নেই। মন্ত্রীমোশাই নিজেকে উজাড় করে দিয়ে রাজ্য ও সিংহাসন রক্ষা করেছেন এতগুলো বছর ধরে। পল্লবকে সব রকম শক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তাই পল্লবকুমারই রাজা হবার উপযুক্ত ব্যক্তি। উপস্থিত সকলে ধন্যধন্য করে উঠল।
চার
তারপর নিজের রাজপোষাক পরিত্যাগ করে সবুজ ঘাস পাতার পোষাকে নিজেকে সজ্জিত করলো পৃথ্বিজিৎ। মুক্তোমালাও স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করলো। ছোট একটি তরী’তে পল্লব আর কিছু সৈন্য নিয়ে তারা রওনা দিল সুন্দরবন দ্বীপের উদ্দেশ্যে। বাজ পাখী আগেই গিয়ে খবর করেছিল তাই সমস্ত জংলী মায়েরা সমুদ্র সৈকতে হাজির হয়েছিল অতিথি বরণ করতে। নতুন বৌকে বরণ করে নিল তারা সাদরে। দুদিন ধরে খাঁটি দুধ, গাছের সুস্বাদু ফল ইত্যাদি সহকারে বাকী অতিথিদেরও সেবা করা হল।
তারপর এল সেই বিদায়ক্ষণ। “অনেক ঋণ রয়ে গেল বন্ধু...কিভাবে শোধ করবো?” পল্লব বললো।
“বন্ধুত্বের মধ্যে ঋণ কিসের? যখনই বিপদে পড়বে এই বন্ধুকে স্মরণ কর। যে কোন শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা এই জঙ্গলের প্রাণীরা রাখে...”
জঙ্গলের সমস্ত পশু একযোগে হুঙ্কার দিয়ে পৃথ্বীকে সমর্থন জানালো। রাজার নৌকা পাল তুলে জলে ভাসলো। সামুদ্রিক পাখিরা পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। এভাবেই মানুষ আর বনের পশুর মধ্যে ভালবাসার সেতুবন্ধন হল ও সখ্যতা বজায় থাকলো, যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও উন্নতিকল্পে একান্তভাবেই প্রয়োজন।
“আর...আমার গল্পটিও ফুরালো...নটে গাছটি মুড়ালো...”