Mausumi Pramanik

Romance Tragedy

0.2  

Mausumi Pramanik

Romance Tragedy

প্রথম প্রেম

প্রথম প্রেম

7 mins
1.4K


আজ তোমাদের একটি প্রেমের গল্প শোনাব। একটি ষোল বছরের মেয়ের প্রথম প্রেমে পড়ার গল্প। মেয়েটির জন্ম, বড় হয়ে ওঠা, স্কুলে যাওয়া সবকিছুই হয়েছে উত্তর কলকাতার এঁদো গলির একটি বাড়ীতে; যেখানে লম্বা লম্বা গরাদের জানালা দিয়ে অন্য বাড়ীর বেডরুমে কি হচ্ছে দেখা যেত। যে বাড়ীর বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্য বাড়ীর বারান্দায় খবরের কাগজ ছুড়ে দেওয়া যেত। যে বাড়ীর উনুনের ধোঁয়া পাশাপাশি বাড়ির লোকেরা খেয়ে কাশতে বাধ্য হত। এক বাড়িতে কি কথা হত, তা আর পাঁচটা বাড়ির লোকের অজানা থাকত না। স্বভাবতই এইসব বাড়িতে ছেলেমেয়েরা বড়দের কড়া শাসনের মধ্যে বড় হয়ে উঠত। এমনিতেও তখন মোবাইল, ইন্টারনেট ছিল না, এমনকি ল্যাণ্ডফোনও সব বাড়িতে ছিল না। তখন চিঠি, টেলিগ্রামে খবর আসত-যেত। যদি কেউ প্রেম করত, সেটাও চিঠির মাধ্যমে; বন্ধ সুগন্ধি খামে। তাই সকলের পক্ষে জানা সম্ভব হত না।

       এইরকমই এক পরিবেশে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে স্টার মার্কস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল মিঠু। মিঠুর ভাল নাম সায়ন্তনী। মিঠু ও টুকটুকি দুই পিঠোপিঠি বোন। তবুও ওদের দুজনের মধ্যে ভাব তো ছিলই না বরং হিংসা দেবী সর্বদা বিরাজমান করতেন ওদের সংসারে। মিঠু কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী বাবা প্রিয়তোষের প্রিয় ছিল আর টুকটুকি মা অঞ্জনার। তাই নিয়ে বাবা মায়ের মধ্যেও লেগে যেত ঝগড়া। অবশ্যই জামাকাপড়, খাবার দাবার নিয়ে নয়, প্রতিযোগিতা ছিল লেখাপড়ার ক্ষেত্রে। মিঠু কখনোই ক্লাশে ফার্স্ট হতে পারে নি, যেখানে ফার্স্ট পজিসানটা টুকটুকির বাধা ছিল। আবার খেলাধুলা, সেলাই এই সব ব্যাপারে মিঠু নাম্বার ওয়ান, টুকটুকি এই সব বিষয়ে কোন ইন্টারেস্ট ছিল না। মিঠুর যেখানে স্কুল কামাই একদিনও হত না, টুকটুকির সেখানে সর্দি-জ্বর লেগেই থাকত।

       এইভাবেই চলছিল তাদের চারজনের জীবন উত্তর কলকাতার এই ভাড়া বাড়িতে। পাশাপাশি তিন বাড়ীর সদস্যরাও ছিল তাদের সহজ সরল জীবন যাপনের সাক্ষী। তবে প্রিয়তোষবাবু কবে যে লেকটাউনে জমি কিনে বাড়ি শুরু করে দিয়েছিলেন সেটা কেউ টের পায় নি। জানতে পারা গেল সেই দিন, যেদিন তাঁর প্রতিবেশীরা নিমন্ত্রিত হলেন গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে। বাড়ি করতে গিয়ে প্রচুর লোন হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তাই তিনি নীচের অংশটিতে ভাড়া বসিয়েছিলেন।

সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার শ্রীকুমার ভট্টাচার্য, তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী ও বি. এস সি পাশ করা ছেলেকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে এসে উঠলেন। মৃণালিনী দেবীর গায়ের রং টুকটুকে ফর্সা; লাল পাড় শাড়ি পরে যখন পূজোর ঘর থেকে বেরোতেন, মনে হত স্বয়ং ঠাকুর বেরিয়ে এলেন। ছেলে দীপঙ্কর অবিকল মায়ের গায়ের রং পেয়েছিল। ছ’ ফুট লম্বা, ফর্সা দীপঙ্কর কলেজের হার্টথ্রব এবং প্লে-বয় অবশ্যই। অনেকদিন থেকেই ওরা এই অঞ্চলে থাকছিলেন, আর ডাক্তারকে কার না প্রয়োজন হয়। তাই প্রিয়তোষ বাবুরা সেখানে আসার পর দোকান, বাজার, কোচিং, কলেজ ইত্যাদি ব্যাপারে দীপঙ্করই ছিল ওদের গাইড। ব্যবহারের গুনে সে ক’দিনের মধ্যেই সে কাকু কাকী এদিকে পরিচিত প্রতিবেশী, বন্ধু ইত্যাদি ছেড়ে আসার কারণে মিঠুর মন ছিল খারাপ। স্কুল ছেড়ে সে কলেজে ভর্তি হয়েছে, মর্ণিং কলেজ। সেখানেও তার মন বসছে না। দীপঙ্কর সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব নিল মিঠুর মন ভাল করার। অঞ্জনার আপত্তি ছিল কিন্তু প্রিয়তোষ বললেন,

“মেয়েদের বড় হতে দাও অঞ্জনা...ওভাবে আঁচলে বেঁধে রেখো না... 

প্রিয়তোষ বাবুর বাড়ীর ছাদটি ছিল অনন্য। লাল,সবুজ হলুদ পাথর দিয়ে মোজাইক করা। আর অঞ্জনা ও মৃণালিনী দুজনে মিলে সেখানে বাগান গড়ে তুলেছিলেন। মিঠু কলেজ থেকে ফিরত বারোটার মধ্যে। দীপঙ্কর চাকরীর চেষ্টা করছিল, গান শুনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে তার দিন চলছিল। মিঠুকে পেয়ে তার বেশ মজাই হল বলা যায়। দুপুর থেকে সন্ধ্যে অবধি দুজনে ছাদেই কাটাত। মিঠু মন-প্রাণ খুলে দীপঙ্করের সাথে গল্প করত। ধীরে ধীরে সেটা ওর অভ্যাসে পরিণিত হয়ে গিয়েছিল। অদ্ভূত ভাল লাগার বশবর্তী হয়ে গিয়েছিল সে। দীপঙ্করেরও যে ওকে ভাল লাগত না তা নয়। সে তো সর্বদা নতুনের সন্ধানেই থাকে। নিজের ডায়রিতে তার সেই ভাল লাগার কথা লিখেছিল মিঠু, আবার কি কারণে দীপুর সামনে সেটা ছিঁড়েও ফেলল। দীপু অতি উৎসাহে সেই টুকরো গুলো থেকে কিছু লেখা উদ্ধার করতে পেরেছিল আর বুঝেছিল যে এই মেয়েটা তার প্রেমে পড়েছে।

মিঠু সহজ সরল মনের মেয়ে। প্রেম, ভালবাসা কি তার অজানা। কেউ তাকে বলেই নি। দু বছর আগে তার পিরিয়ড শুরু হয়েছে, সেটা যে কেন হয় প্রতি মাসে তার কারণটাই সে জানে না। এখনও তার স্তনের বোঁটা শক্ত হয়নি, সেখানে এখনো সে ব্যাথা অনুভব করে। একজন ছেলে আর মেয়ের মধ্যে পার্থক্যটা সে ভাল করে বোঝেই নি। তবুও হৃদয়ের ভিতর একটা আলোড়ন উঠত; বইয়ের পাতায় সে তার দীপুদার মুখ দেখতে পেত। কলেজে, বান্ধবীদের প্রেমকিরা যখন কলেজের গেটের বাইরে অপেক্ষা করত, মিঠুর মনে হত, ‘ইশ! যদি দীপুদাও আসত আমায নিতে...’

 যেদিন সে শুনল যে তার দীপুদা পাটনা যাচ্ছে ইন্টারভিউ দিতে তার বেশ মন খারাপ হয়েছিল। চোখে জল নিয়ে সে বোকার মত বলেই ফেলল,

“ যাচ্ছো যাও...কিন্তু আমার জন্যে কি রেখে যাচ্ছো?”

সেদিন দীপঙ্করের মনও বোধহয় এই ছোট্ট মেয়েটার অভিমানে বিগলিত হয়েছিল।

“কি চাও...বলো?”

“কিস করো...” বাম হাতের মুঠো বাড়িয়ে দেয় মিঠু।

দীপঙ্কর আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ওকে টেনে নিয়ে যায় ছাদের সিঁড়িতে। একটা দরজা বন্ধ করে নিজেদের আড়াল করে সে। দু বাহু দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিঠুকে। মিঠুর স্তনে ব্যাথা লাগতে থাকে। তবুও সে চেয়ে থাকে দীপুর দিকে। দীপঙ্কর ওর সিগারেট খাওয়া তামাটে ঠোঁট দিয়ে মিঠুর নীচের ঠোঁট চেপে ধরে। মিঠু চোখ বন্ধ করে ফেলে। দীপঙ্কর ওর ঠোঁট চুষতে থাকে। মিঠু দীপঙ্করকে আঁকড়ে ধরে; বুকে মুখ গুঁজে দেয়। মুহুর্তের মধ্যে তার চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এসে দীপুর টিশার্ট ভিজিয়ে দেয়। পরক্ষনেই সে ভয় পেয়ে যায়। বোকার মত প্রশ্ন করে,

“দীপুদা...কিছু হবে না তো?”

“কি হবে?”

“ না আমি তো এর আগে কোনদিন...”

“দূর! বোকা মেয়ে...এতে কিছুই হয় না...ওসব বায়োলজিকাল ব্যাপার...তোমায় পরে বুঝিয়ে বলবো...” সেদিন বোকা মেয়েটার সরলতা দীপঙ্করকে হতবাক করেছিল।

       তারপর? তারপর যা হবার তাই হল। দীপঙ্কর চাকরী পেয়ে মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করবে, এমনটাই স্থির করল। মিঠু অনেক চেষ্টা করেছিল সকলকে বোঝানোর তার মত করে; হতে পারে সেটা বোকামি...যে সে দীপুদাকে ভালবাসে। কেউ মত দেয় নি। মৃণালিনী গায়ের রং, জাত ইত্যাদি নিয়ে সংকীর্ণ ছিলেন। প্রিয়তোষ বাবুর দীপঙ্করের শিক্ষা, কেরিয়ার, চাকরী ইত্যাদি নিয়ে অমত ছিল। অত এব মিঠুকে এই আঘাত সহ্য করতে হল। তার উপরে আবার উপরি পাওনা হল টুকটুকির প্রেম দীপুদার প্রতি। সে রাতে ঘুম থেকে উঠে দেখা করতে গিয়ে বাবার হাতে ধরা পড়ল দু দুবার। বোকা মেয়েটা তখনও বুঝল না যে দীপঙ্কর শুধু তার সঙ্গে খেলা করেছে একদিন।

       টুকটুকি মিঠুর থেকে স্মার্ট। যেদিন সে বুঝেছিল যে দীপঙ্করকে সে পাবে না, রাস্তার মোড়ে এক চড় কষেছিল। আর মিঠু? সে জানালার বাইরে মাধবীলতার সাদা-লাল-গোলাপী ঝোকার দিকে তাকিয়ে কবিতা রচনা করত। সে কবিতায় প্রেম আর বিরহের মিশ্রন ঘটেছিল। রাত বারোটা অবধি মশার কামড় খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকত ব্যালকনিতে। হিরোর মত তার দীপুদা বাইক নিয়ে এসে বাড়ির সামনে দাঁড়াবে। উপর দিকে একবার তাকাবে। তার সঙ্গে চোখাচোখি হবে। ব্যাস ঐটুকতেই সে খুশী। ভোরে কোচিং যাবার সময় নীচের সিড়িতে নেমে জোরে জোরে বলত,

“মা...আসছি...”। দীপু নিজে ঘর থেকে বেরিয়ে আসত। কামনালিপ্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকাত মিঠুর দিকে। ঐটুকু নিয়েই মনকে শান্ত করত মিঠু। যদিও একেলা ঘরে বালিসে মুখ চাপা দিয়ে রাতের পর রাত কেঁদেছে সে।

       বিয়ের কার্ড যখন ছাপা হয়ে গিয়েছে, শিলিগুড়ি যাবার রকেট বাসের গুমটিতে দীপুদার সঙ্গে একবার দেখা করতে গিয়েছিল মিঠু। “তুমি এমন কেন করলে দীপুদা? তুমি আমায় ভালবাসো না? তাহলে কিস করলে যে...”

“আমার চোখে তখন রঙ্গীন চশমা ছিল মিঠু...এখন আমি ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে দেখি সবকিছু...”

মিঠু পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে গুমটি থেকে। তখন সে ছিল ষোল...এখন সে কুড়ি। এই চার বছরে কি করে রঙীন স্বপ্ন সাদা কালোতে রূপান্তরিত হয়? কই তার তো হয় নি? সে তো তার দীপুদাকে এক মুহুর্তের জন্যে ভুলতে পারে নি?

       অঞ্জনা এই সময়ে মিঠুকে বোঝান। “অল্প বয়সে এরকম হয় রে, এটা কিছুই না। ওর থেকে ঢের ভাল ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব আমি দেখিস।” হলও তাই। ডিভিসিতে চাকরীরত এক সুপাত্রের সঙ্গে মিঠুর বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের আগে বেশ কয়েকমাস মেলামেশা করেছিল সে তন্ময়ের সঙ্গে। তখন সে প্রায় ভুলে গেল কিভাবে তার চোখের সামনে দিয়ে তার দীপুদা বরের বেশে বউ নিয়ে ঘরে এসেছিল কিংবা নীচে, দীপুদার ঘর থেকে সদ্যজাত শিশুর কান্নার আওয়াজ। কারণ তখন তার চোখ তন্ময়কে বরবেশে দেখতে চাইছিল। যদিও বিয়ের সময় দীপুদারা ঐ বাড়িতে আর থাকছিল না। ফ্ল্যাট কিনে উঠে গিয়েছিল সোনারপুরে। তবুও সে জানতে পেরেছিল যে দীপুদা খবর পেয়েছে যে তার কত ভাল বরের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে। কারণ ঐ অ্যাপার্টমেন্টে প্রিয়তোষ বাবুর এক কলিগ থাকতেন। তিনি নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলেন।

       এখন সায়ন্তনী ছেলে, মেয়ে শ্বশুর, শাশুড়ী, ননদ, ভাজ নিয়ে ভরা সংসারে মহাব্যস্ত। দীপুদার মুখটা তার আর মনেই পড়ে না। কিন্তু......। এখানে বড় একটা কিন্তু থেকেই গেল। কি সেটা? সেটা হল সেই চুম্বন। সেই চুম্বনটা আজও ভোলে নি মিঠু। ভুলতেই পারে নি। তাই রাতের বেলা শারীরিক সম্পর্ক করার সময় তন্ময় যখন মিঠুকে চুম্বন করতে চায়, মিঠু হয় মুখ ঘুরিয়ে নেয় কিংবা ঠোঁট চিপে শুয়ে থাকে। অন্য যে কোন ভালবাসা দিতে তার বাধা নেই...শুধু ৯৮চুমু দিতে তার আপত্তি। কারণ আজও যে তার দীপুদার চুম্বনের স্বাদ তার ঠোঁট থেকে মিলিয়ে যায় নি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance