স্মৃতিটুকু’ই থাক
স্মৃতিটুকু’ই থাক


সেদিনও ছিল এমনি গোধূলিবেলা। মুখোমুখি বসেছিলাম দুজনে, মিলেনিয়াম পার্কের বেঞ্চিতে। তুই আর আমি। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় তোকে আরও ফর্সা লাগছিল। তোর ব্রণর দাগগুলোতে লাল আভা ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। দেখছিলাম তোকে দু’চোখ ভরে। আর ভাবছিলাম, ‘আগে কেন দেখিনি তোকে এমন করে? মাত্র ক’টা বছর তো আগের কথা। ক্লাশে, ক্যান্টিনে, বাবুদার চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়েছি ঘন্টার পর ঘন্টা; কই এমন করে তখন তো ভালবাসতে ইচ্ছে করে নি। ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া দেখার সময়ে সিনেমাহলে কিংবা ইডেন গার্ডেনসে কতবার তোর হাত আমার হাত স্পর্শ করেছে। কই শিহরণ জাগেনি তো? তবে আজ কেন এমন হল? ঝুপ করে সন্ধ্যে নামতেই পার্কের আলোগুলো জ্বলে উঠল। তুই আমার চিবুকটা আলতো করে তুলে ধরলি। বললি, “আলো-আঁধারিতে তোর চোখ দুটো একদম অন্যরকম লাগে। মনে হয় পানকৌরির মত ডুব দিই টলটল করা ঐ সরোবরে...” আমায় চমকে দিয়ে ঠোঁটে আলতো চুমু খেলি তুই। আমার শরীর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে গেল।
সেদিনও হয়েছিল, যেদিন তোর সঙ্গে গঙ্গায় ভেসেছিলাম। মাঝি একমনে দাঁড় বাইছিল। আর তুই আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে গুন গুন করে গান গাইছিলিস। “দিলবর মেরে কবতক মুঝে অ্যায়সেহি তড়পাওগে...” আমি তোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘোলা জলের ঢেউ দেখতে থাকলাম। তারপর কি জানি কি মনে হল, দুষ্টুমি করে তোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। টাল সামলাতে না পেরে তুই চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লি আর আমি তোর বুকে মাথা রেখে শুয়েছিলাম। তুই আলতো করে আমার বাদামী চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলিস। কি যে ভাল লাগছিল! তবুও আমি বুঝিনি যে তুই আমায় ভালবাসতে শুরু করেছিস। যখন তুই পাপিয়ার সঙ্গে ঝগড়া করে সম্পর্ক শেষ করে দিলি, সেদিনও অনুভব করিনি যে তুই আমার জন্যেই...। দক্ষিনেশ্বরে গঙ্গার ঘাটেই তোদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছিল। আমি সুমন আর দেবজিতের সঙ্গে দূরে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করছিলাম। তারপর তুই আমাকে প্রপোজ করলি পিকনিকের দিন, ব্যাণ্ডেলে। সেও তো সেই গঙ্গার ঘাটেই। আমি ঠাস করে তোকে চড় কষিয়ে দিলাম। বললাম, “আমরা শুধুই বন্ধু। যদি এটা ভুলে গিয়ে থাকিস, তাহলে আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করার চেষ্টাও করিস না।” তুই করিস নি যোগাযোগ আর।
কিন্তু আমি করেছিলাম ফোন তোর ল্যাণ্ডলাইনে। দীর্ঘ দশ বছর পর। মোবাইল নাম্বার জানা ছিল না। তোর প্রিয় বান্ধবী, তোর বেস্ট ফ্রেণ্ড সদ্য স্বামীহারা হয়েছে শুনে তুই আর অভিমান করে থাকতে পারিসনি। ছুটে এসেছিলিস। প্রতিদিন একটু একটু করে আমায় সজীব করে তুলছিলিস। আমিও তোকে আমার সবটুকু দিতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। কতদিন হাতে হাত ধরে হেঁটেছি দুজনে গঙ্গার পাড় দিয়ে। কতদিন তোর কাঁধে মাথা রেখে ঢেউ গুনেছি। আমরা কোথায় যেন হারিয়ে যেতাম রোজ রোজ। মনে পড়ে নির্মাল্য?
হুম! জানি তোর মনে পড়ে! আর মনে পড়লেই রাগে গড়গড় করতে থাকিস তুই। আধ বোতল ব্ল্যাক ডগ গলায় ঢেলে আমার নাম্বারে ডায়াল করিস। আমি হ্যালো বললেই শুরু হয়ে যায় গালি বর্ষন। কি করে পারিস রে? কি করে এত খারাপ কথা বলতে পারিস তুই? এটা জেনেও যে আমি তোকে ভালবাসি। খুব ভালবাসি, আজও। তুইও তো আমায় ভালবাসিস। সেদিন তো দুজনেই ডিসাইড করেছিলাম যে সরে আসব। তুই বিবাহিত। তোর স্ত্রী আছে, মেয়ে আছে। আমরা কি ওদের ঠকাতে পারি? পারি না তো, বল। তাই তো সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। জানি। তোর রাগ করাটা স্বাভাবিক। সেদিন যদি তোকে আমি প্রত্যাখ্যান না করতাম, তোর প্রপোজাল রিজেক্ট না করতাম, তাহলে হয়তো আমরা দুজনে আজও...।
না! তারপর থেকে আর গঙ্গার ধারে যাওয়া হয়নি। ভেলপুরী, ফুচ্কা খাওয়া হয়নি। স্কুপে আইসক্রিমও খেতে আসিনি। তুই আসিস হয়তো বিদিশা আর টুম্পাকে নিয়ে। তখন তোর আমার কথা মনে পড়ে নিশ্চয়। নিশ্চয় মনে পড়ে সেই বৃষ্টিভেজা দিনের কথা। উথাল পাথাল ঢেউ উঠেছিল নদীতে। তোর দু’হাতে হাত রেখেছিলাম আমি। বলেছিলাম, “ভালবাসি তোকে......তুই?”
তুই তোর মুঠিতে শক্ত করে ধরে রেখেছিলস আমার আঙ্গুল গুলো, বলেছিলিস, “ভালবাসি তো...”
আমাদের ভালবাসা হারিয়ে যায় নি রে নির্মাল্য, হারিয়ে যেতে পারে না। বহমান নদীর স্রোতের মত ভেসে চলবে অনন্তকাল ধরে। বন্ধনহীন সে চলা। ভালবাসাকে যে বাঁধতে নেই, বন্ধু। তাই সেই ভালো লাগা ক্ষণ, ভালবাসার মুহূর্তগুলো না হয় স্মৃতি হয়েই বেঁচে থাক! তোর মনে...আর আমার হৃদয়ে!!