Aparna Chaudhuri

Comedy

3  

Aparna Chaudhuri

Comedy

রায়বাবুর লাভ লেটার

রায়বাবুর লাভ লেটার

6 mins
617


সকাল থেকে রান্না ঘরে টুং টাং শব্দ হচ্ছে। আজ রায়বাবু নিজেই চা করছেন। অন্যদিন ওনার রায়বাঘিনী, মানে রায়গিন্নিই করেন , কিন্তু আজ তিনি কোমরের ব্যাথায় কাবু। নড়তে চড়তে পারছেন না। অগত্যা ওনাকেই রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে হয়েছে।

ওনার আবার চা না খেলে ঠিক ‘প্রেশার’ আসে না। আর এতো সকালে কাজের মেয়ে প্রমিলাও আসে না। রান্নাঘরে ঢুকে উনি ঠিক কোনখান থেকে শুরু করবেন বুঝতে পারলেন না । চারিদিকে জিনিষ ছত্রাকার হয়ে পড়ে আছে। একদিকে এঁটো বাসনের ডাঁই ।

প্রথমে কাপ দুটো খুঁজে বার করে সে দুটোকে ধুলেন। তারপর একে একে চামচ, ছাঁকনি, ট্রে, চায়ের সসপ্যান সব ধুলেন। চা করার সমস্ত জিনিষ ঝকঝকে করে ধুয়ে তবে উনি চা বানানো শুরু করলেন। আসলে উনি হলেন পারফেকশনিস্ট।

আধ ঘণ্টা বাদে দু কাপ প্রায় ঠাণ্ডা চা নিয়ে হাসি হাসি মুখে উনি যখন পৌঁছলেন শোবার ঘরে, রায়গিন্নী হেসে বললেন,” ভাগ্যিস আমাদের বিয়েটা দেখে শুনে হয়েছিল।“

“ কেন?”

“ না, মানে এক কাপ চা করতে যার এতো সময় লাগে তাকে যদি প্রেমপত্র লিখে প্রেম নিবেদন করতে হত......” বাকিটা আর শেষ করতে পারলেন না, হেসে গড়িয়ে পড়লেন।

“ অ্যাই অ্যাই দ্যাকো...... ডোন্ট আন্ডারএসটিমেট......”

“ থাক থাক তোমায় আর ফিল্মের ডায়লগ ঝাড়তে হবে না।“

“ আচ্ছা তুমি আমায় ভাব কি বলত? আমার কলেজের কত মেয়ে আমার জন্য পাগল ছিল তুমি জানো?”

“ আচ্ছা? তা তাদের কি হল? সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে পাগল হয়ে পাগলা গারদে চলে গেল? তুমি সময় করে তাদের ডাকে সাড়াই দিতে পারলে না!”

“ ক্‌-কে বললে? দিয়েছিলুম তো। শুনতেই যখন চাইছ তাহলে খুলেই বলি।“ নিজের বানানো চায়ে সশব্দে একটা চুমুক দিয়ে রায়বাবু বেশ গুছিয়ে বসলেন।

ওনার গল্প শুরু করার আগে এইবেলা ওনাদের একটু পরিচয় দিয়ে দিই। সিদ্ধেশ্বর রায়, মানে আমাদের গল্পের রায়বাবু ছিলেন পুলিশের দুঁদে অফিসার। এই বছর সাতেক হল রিটায়ার করেছেন। ওনার স্ত্রী স্বপ্না রায় ছিলেন স্কুল টিচার।

রায়বাবুর বাবা, ওনার ছোটবেলায় মারা যান। ওনার মা অনেক কষ্ট করে ওনাকে এবং ওনার পরের পাঁচ বোনকে মানুষ করেন। রায়বাবু চাকরি পাওয়ার পর পাঁচ বোনের বিয়ে দেন। স্বাভাবিকভাবেই ওনার নিজের বিয়ের কথা উনি ভাবতেই পারেননি। ছোট বোনের বিয়ে হয়ে যাবার পর ওনার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। 

বলতে গেলে, মায়ের দেখাশোনা করার জন্য বাধ্য হয়েই, ওনাকে বিয়ে করতে হয়। তখন ওনার বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই ওনার মা মারা যান।

রায়বাবু নিঃসন্তান। কিন্তু ওনার বোনের ছেলেমেয়েরাই ওনার নিজের সন্তানের মত। রায়গিন্নী এই বছর দুয়েক হল রিটায়ার করেছেন।

উপরের বর্ণনা শুনে যদি কারো মনে হয় যে অবসর প্রাপ্ত পুলিশ অফিসার বাড়ীতেও তার পুলিশি মেজাজে থাকেন বা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা তার পরিবারের সকলকে তার ছাত্র মনে করেন তাহলে কিন্তু খুব ভুল হবে। ওনাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত বন্ধুত্ব আছে। ওনাদের হাব ভাব দেখলে মনে হবে দুজনে যেন ক্লাসমেট।

রায়বাবুর মত গপ্পে লোক খুব কম পাওয়া যায়। আর ওনার সবচেয়ে উৎসাহী শ্রোতা হলেন রায়গিন্নী।

রায়বাবু যেই গল্প বলার জন্য তৈরি হলেন তখন রায়গিন্নীও বালিশে হেলান দিয়ে গুছিয়ে বসলেন শোনার জন্য। রিটায়ার্ড লাইফের এই তো মজা !

“তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি।“ রায়বাবু শুরু করলেন, “ বাবা আমায় একটা সাইকেল কিনে দিয়েছিল। তাতে চড়ে আমি কোচিং ক্লাসে পড়তে যেতাম। তখন আমাদের পাড়ায় আর কোন ছেলের অত ভালো সাইকেল ছিল না। আমি সাইকেল চালিয়ে পাড়ার মধ্যে দিয়ে গেলে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত।”

“ ওমা ! তাকিয়ে দেখত কেন? তারা কি কখনো সাইকেল চড়া ছেলে দেখেনি?” রায়গিন্নির চোখে দুষ্টু হাসি।

মুখে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে উনি বলে উঠলেন, ”তা কেন? আমি তখন এতো হ্যান্ডসাম ছিলাম যে লোকে একবার দেখে আর চোখ ফেরাতে পারতো না, বুঝলে?”

রায়গিন্নী মুচকি হেসে বললেন, “বুঝেছি, আগে বাড়ো।“

“ আমাদের কোচিং ক্লাসে একটা মেয়ে পড়তো। খুব সুন্দর দেখতে। নাম পিয়ালী। ও থাকতো আমাদের পাশের পাড়ায়। ক্লাসের সব ছেলেরাই ওকে মনে মনে পছন্দ করত । কিন্তু সাহস করে কেউ ওর দিকে এগোতে পারতো না।“

“কেন?”

“ কারণটা ছিল ওর দাদা। ওর দাদা রবিদা, ছিল ভীষণ বদরাগী আর গুন্ডা টাইপের। সবাই তাকে ভয় পেত। “

“তুমি পেতে না?”

“ আমিও পেতাম। কিন্তু সেটা দেখাতাম না। একদিন বন্ধুদের সাথে বাজি ধরলাম। পিয়ালীকে প্রোপোজ করতে হবে। বেশীর ভাগ ছেলে হাত তুলে দিল। কিন্তু আমি আর স্বপন পিছু হটলাম না। ঠিক হল আমরা যে যার ইচ্ছা মত উপায়ে প্রোপোজ করতে পারি।“

“ হুম তারপর?”

“ আমি পিয়ালীর বেস্ট ফ্রেন্ড রত্নার সাথে ভাব জমালাম। ওকে খুলে বললাম সব কথা। রত্না আমায় একটা খুব ভালো বুদ্ধি দিল। বলল একটা সুন্দর করে প্রেমপত্র লিখতে, তাতে যেন কোন নাম না থাকে। তাহলে ধরা পড়লেও আমার নামটা কেউ জানতে পারবে না। ওর কাছে পিয়ালীর ফিজিক্সের খাতাটা আছে। ও ওই খাতাটার মধ্যে চিঠিটা ভরে পিয়ালীর কাছে পৌঁছে দেবে। পরে ও পিয়ালীকে নাম টাম সব বলে দেবে। আমি সারা রাত জেগে একটা দারুণ প্রেমপত্র লিখে ফেললাম। তারপর সেটা একটা গোলাপি খামে ভরে, তাতে বেশ করে পারফিউম লাগিয়ে, রত্নার কাছে দিয়ে দিলাম। মনে মনে আমি ভীষণ খুশী। রত্না সেদিন দুপুরে গিয়ে চিঠিটা পৌঁছে দেবে পিয়ালীর কাছে। তারপর পিয়ালী চিঠিটা পেয়ে কি কি করবে মনে মনে তা নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতে লাগলাম।“

“ পরের দিন কি হল? পিয়ালী তোমার সঙ্গে কথা বলল?”

“ ধ্যুর! পরের দিন দেখি ক্লাসে পিয়ালী এসে স্বপনের পাশে বসলো। আমরা সবাই অবাক। স্বপন আমার দিকে ভুরু নাচিয়ে ইশারা করলো, ‘কিরে?’। আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। এদিকে রত্না সেদিন ক্লাসে আসেনি। ক্লাসের শেষে আমরা সবাই স্বপনকে চেপে ধরলাম। কি ব্যাপার জানতে। স্বপন হেসে বলল, সেদিন ক্লাস থেকে ফেরার পথে ও পিয়ালীদের বাড়ীর সামনের একটা সুনসান গলিতে দাঁড়িয়ে ছিল। পিয়ালী যেই ওই গলিতে ঢুকেছে ও সোজা গিয়ে ওকে প্রপোজ করেছে আর আশ্চর্য ভাবে পিয়ালীও অ্যাকসেপ্ট করেছে।”

“ তাহলে তোমার চিঠি?”

“ সেটা আমি জানতে পারলাম দুদিন বাদে। কারণ রত্না দুদিন ক্লাসেই আসেনি। যেদিন রত্না ক্লাসে এলো আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম , ‘কিরে আমার চিঠিটার কি হল?’ ও প্রথমে খুব লজ্জা পেয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে যা বলল তা শুনে আমি হতবাক। ও সেদিন দুপুরে পিয়ালীর ফিজিক্সের খাতাটা নিয়ে গিয়েছিল ওদের বাড়ী। কিন্তু বাড়ীতে পিয়ালী ছিলনা। রবিদা দরজা খোলে। ও তখন খাতাটা না দিয়ে চলে আসছিল কিন্তু রবিদা ওর হাতের খাতাটা দেখতে পেয়ে যায়। তখন একরকম বাধ্য হয়েই ও খাতাটা রবিদাকে দিয়ে দেয়। কিন্তু যদি রবিদা কোন প্রশ্ন করে, সেই ভয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসে ওদের বাড়ী থেকে। রবিদা আমার সাঙ্ঘাতিক পারফিউম লাগানো চিঠিটা অনায়াসেই খুঁজে পায়।“

“ তারপর? তোমার ভাগ্যে নিশ্চয়ই মার জুটেছিল?”

“ না না। এইখানেই তো টুইস্ট। চিঠিটায় কারুর নাম ছিলনা। আর রত্না ওরকম ছুটে পালিয়ে যাওয়াতে রবিদার ধারণা হয় চিঠিটা রত্না লিখেছে ওর জন্যে।“

“বল কি?”

“ আরে শোনো না ......চিঠিটা পাবার পর, পুরো একদিন রবিদা রত্নাদের বাড়ীর আশপাশেই ঘুরতে থাকে। ভয়ে রত্না বাড়ীর থেকে বেরোয় না। পরের দিন রত্না যেই বেরিয়েছে, রবিদা ওকে পাড়ার মোড়ে পাকড়াও করেছে। রত্না তো ভয়ে কাঁটা। কিন্তু রবিদার তখন একেবারে এক ভিন্ন অবতার। প্রেমে গদ্গদ রবিদা রত্নার হাত ধরে বলে, ‘তুমি আমায় এতো ভালবাস আমি তো তা জানতাম না’। রত্নারও রবিদার ওপর দুর্বলতা ছিল......”

“ এ বাবা! তোমার অত যত্নে লেখা লাভ লেটারটা বেমালুম ঝেড়ে দিল?”

“ তা কি করবে বল? যদি বলে যে না ওটা ওর লেখা নয়, তাহলে আমি নির্ঘাত মার খেতাম। তাই ও চুপচাপ রবিদার প্রপোসালটা অ্যাকসেপ্ট করে নিল। তাতে দুদিকই রক্ষা পেলো। অবশ্য আমার লেখার খুবই প্রশংসা করেছিল। বলেছিল যে চিঠিটা অত সুন্দর লেখা হয়েছিল বলেই নাকি রবিদা ওকে প্রোপোস করেছিল। যদি ওটা পিয়ালী পেত তাহলে সেও নাকি না বলতে পারতো না। “

“ জানি তো ! তুমি তো পারফেকশনিস্ট। কিন্তু ভাগ্যিস পিয়ালী পায়নি, নাহলে আমার কি হত?” হাসতে হাসতে বললেন রায়গিন্নী ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy