প্রেমপত্র দিলাম প্রিয়তমাকে
প্রেমপত্র দিলাম প্রিয়তমাকে


আমার প্রিয়া ,
আশা করি, পরম করুণাময় ঈশ্বরের আশীর্বাদে তুই ভালোই আছিস।নববর্ষের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, 2018 সালটা তোর খুব খুব ভালো কাটুক।সাফল্য নেমে আসুক। আত্মবিশ্বাস বাড়ুক। সব মিলিয়ে 2018 যেন দুর্দান্ত কাটুক। আমারও যেন 2018 আগের বছরগুলির তুলনায় কিছু ভালো কাটে।অন্তত এই রুক্ষ ঊষর জীবনে যেন কিছু পরিবর্তন নেমে আসে। যাই হোক,তোকে খুব মিস করি এখন! তোর সাথে দেখা হয় না এখন।আর ফেসবুকেও আসিস না তুই, আমি ফোন করলে ফোনও তুলিস না।তাই অগত্যা আজ তোকে এই চিঠি লিখতে বসা।
প্রেমপত্র , হয়তো কিছুটা।আবার একে স্মৃতিচারণও বলতে পারিস।যাই হোক,হয়তো কোনোদিন তোকে প্রপোজ করি নি, কিছুটা লজ্জায় , আর কিছুটা ভয়ে। ভয় ছিল,যদি এই সুন্দর বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়।তাহলে আমার কি হবে! আমাকে প্রেরণা যোগাবার আর কে থাকবে!
সত্যি কথা বলতে কি,দাদুর মৃত্যুর পর যেভাবে ভেঙে পড়েছিলাম , আর তুই যেভাবে অনবরত প্রেরণা যুগিয়ে গিয়েছিলি,তা সত্যই আমার জন্য বিশল্যকরণীর কাজ করেছিল।তোর প্রত্যেক কথা, প্রতিটি মেসেজ , প্রতিটি ফোনকল আমায় ভয়ঙ্কর ডিপ্রেশনের সময়ও চরমভাবে উদ্দীপিত করেছিল। ধীরে ধীরে এক বন্ধুথেকে তুই হয়ে উঠলি আমার প্রেরণা!আজও মনে আছে একদিন তুই বলেছিলি,"আমি তোর ভালো চাই।"সেদিন আমার বিপর্যস্ত প্রাণ, ভেঙে পড়া মন অনুভব করেছিল সত্যিকারের আবেগমথিত ভালোবাসা।তারপর ধীরে ধীরে ফিরতে লাগলাম আমি স্বাভাবিক জীবনে।জীবনে নেমে আসল একের পর এক সাফল্য।বাড়ল তোর প্রেরণা।
মনে আছে, আমরা ছোটবেলাতে এক স্কুলে পড়তাম।আমরা তো এক পাড়ারই ছেলেমেয়ে,একসাথে স্কুলে যেতাম আর একসাথেই স্কুল থেকে ফিরতাম। তুই ছিলি আমার জীবনের প্রথম বন্ধু, আমার প্রাণসখী। ছোটবেলায় একসাথে লুকোচুরি খেলা, কবাডিখেলা, ক্রিকেট খেলার সেইসব মধুর স্মৃতি আজও মনে পড়ে।যেদিন আমি স্কুলে অনুপস্থিত হতাম, সেদিন সন্ধ্যাতেই চলে যেতাম, তোর বাড়িতে হোমওয়ার্কজানতে।কতো সুন্দর ছিল সেইসব দিন। পঞ্চমীর দিন থেকে পুজোর ছুটি শুরুহত স্কুলে। সেদিন একসাথে কতো আনন্দ , স্কুল ছুটি হতেই সঞ্জয়দার দোকানের হিংয়ের কচুরী খেতে ছুটতাম। আমি যেদিন প্রাইজ পেয়েছিলাম, তুই সেদিনআমায় জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলি!তারপর বড়ো হতে লাগলাম। ক্লাস ফাইভে উঠে দুজনে আলাদা আলাদা স্কুলে ভর্তি হলাম, কিন্তু তাতেও বিচ্ছেদ হয়নি আমাদের বন্ধুত্বে। আজও মনে আছে, যখন স্কুল থেকে ফিরতাম, তখন পথে তোর সাথে দেখা হত। আমি চেঁচিয়ে ডাকতাম তোর নাম ধরে । আর আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে তুই হাসতিস। জানিনা কি অমোঘ আকর্ষণ ছিল, তোর কিশোরী মুখের সেই হাসিতে!যত বাজে দিনই কাটুকনা কেন, মনে যত খারাপ লাগাই থাক না কেন, শরীরে যত ক্লান্তিই থাক না কেন-পূর্ণিমারাতের চন্দ্রিমার মতো তোর সেই হাসি সমস্ত ক্লান্তি, সমস্ত অবসাদ,সবরকম খারাপ লাগাকে নিঃশেষ করে দিত, নিমেষে উড়িয়ে দিত। অনুভব করতাম,আবার শারীরিক আর মানসিকভাবে তাজা হয়ে উঠছি। যেদিন স্কুলে যাবার সময় তোরসাথে দেখা হত, সেদিন যতোই ক্লাস থাকুক না কেন, কোনোরকম বিরক্তি, কোনোরূপঅবসাদ অনুভব করি নি।মনের মধ্যে সর্বদাই বিরাজ করত প্রশান্তি, স্ফূর্তি,প্রাণশক্তি। তুই যে শুধুই আমার প্রাণসখাই ছিলি না, তুই তো ছিলি আমার আত্মা। আমার জীবনের উষার প্রথম কিরণ ছিলি তুই!
তারপর ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় তুই আর আমি এক কোচিংএ ভর্তি হলাম,মনেআছে!কাকলী ম্যামের বাংলা, ইতিহাস আর ভূগোল মানে আর্টস গ্রুপের ব্যাচে।আমি পড়াশুনায় ধীরে ধীরে উন্নতি করছি।স্কুলের সেকেণ্ড বয়, খেলাধূলায় ভালো ,কিছুটা জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছি হয়তো!সেসময় তোর সান্নিধ্য আমার জীবনে এনে দিয়েছিল অকাল বসন্তের অনুভূতি! তুই হয়ে উঠলি আমার জীবনের প্রথম খোলা হাওয়া।আমাল খাঁচায় বদ্ধ প্রাণমনকে তুই এনে দিলি মুক্তির স্বাদ।ক্লাস নাইন-টেনে পড়ার সময় আমার বয়ঃসন্ধিকাল।শুনতে পাচ্ছি এই রুক্ষ ঊষর জীবনে যৌবনের পদধ্বনি!তোর শরীরেও তখন এসেছে যৌবন।নদীতে এসেছে জোয়ার।তুই ধীরে ধীরে একজন মেয়ে থেকে নারী হয়ে উঠছিস।সেই সময় কতোবার চুপি চুপি তোর বুকের দিকে তাকিয়েছি!কতো রাতে আমার স্বপ্নে এসেছিস তুই!
যতোবারই পড়েছি সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের 'মৃণালিনী','কপালকুণ্ডলা','দুর্গেশনন্দিনী'- প্রতিবারেই যখন নায়িকার মুখকল্পনা করতে গিয়েছি, মানসচক্ষে দেখেছি তোরই মুখ।যতবারেই পড়েছি কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের 'শ্রীকান্ত', রাজলক্ষ্মীকে কল্পনা করতে গিয়ে তোর মুখই ভেসে উঠেছে।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের 'শেষের কবিতা' পড়ার সময়ই তুই হয়ে উঠেছিস আমার লাবণ্য!
উচ্চ মাধ্যমিকের পর আমরা একই কলেজে ভর্তি হলাম। আমি ফিজিক্স অনার্স আর তুই কেমিস্ট্রি অনার্স। মনে পড়ে ,কলেজের সেই প্রথম দিনগুলি। আমার জীবনে তখন ভরা বসন্তকাল।তুই তখন পূর্ণসলিলা এক তটিনী।যেন স্বর্গের অলকাপুরী থেকে নেমে আসা এক অপ্সরা!তোকে নিয়ে লিখেছি কতো ছন্দ!আমার কবিতার তুই প্রথম কল্পনা, আমার গল্পের তুই প্রথম নায়িকা।কলেজ ক্যান্টিনে কাটিয়েছি কতো মিষ্টি মুহূর্ত, সে কি ভোলা যায়! ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় ভাবলাম ,ভ্যালেন্টাইনস ডে তেই তোকে প্রপোজ করি।কিন্তু নানা চাপে আর মূলতঃ আমারই দোনামনায় এই দুরূহ কাজ করতে সাহস পাই নি মনে!
এরপর শুরুহল ফেসবুকে চ্যাটিং।থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় আমি তোকে ফেসবুকে ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম আর তুই অ্যাক্সেপ্ট করেছিলি।কলেজজীবন শেষ হয়ে গেলেও আমাদের ফেসবুক চ্যাটিং বন্ধ হয়ে যায় নি।মনে আছে, আমার আপলোড করা সব ফটোতেই তোর লাইক আর কমেন্ট থাকত।তুই অভিমানে রিপ্লাই দেওয়া বন্ধ করে দিলেও তুই শুধু অনলাইন কখন আসবি দেখার জন্য কতো রাত অবধি ল্যাপটপে ফেসবুক খুলে বসে থেকেছি! তোর লাইক-কমেন্ট বা কোনো মেসেজ অজান্তেই আমার মুখে হাসি ফুটিয়েছে, কতোবার আমার ভালোলাগা তৈরি করেছে।কতোবার ফেসবুকে তোর আপলোড করা ছবি দেখে পুলকিত হয়েছি, পুজোর মহাষ্টমীর রাতে তোর নীল শাড়ি পরা ছবি শরীর মনকে শিহরিত করেছে বারবার।শারীরিক ও মানসিক দুভাবেই আমি তোকে চেয়েছি!
যাই হোক, সেই যে তুই ফেসবুকে আসা বন্ধ করে দিলি, খুব মিস করতে লাগলাম তোকে।আর এখন তো ফোন করলে তুই আর ফোনও তুলিস না। শুনলাম উইপ্রো তে চাকরি করছিস চেন্নাইয়ে।আমার মতো বেকার ছেলের জন্য তোর সময় হবে কোথা থেকে! জানিস আমি পড়তে খুব ভালোবাসি।সেদিন এক মেঘলা বিকেলে ছাদে বসে পড়ছিলাম মহাকবি কালিদাসের কালজয়ী সৃষ্টি 'মেঘদূতম'এর ইংরাজী অনুবাদ " The Cloud Messenger"।আকাশের কোণে দূর দিগন্তে জমাট হয়েছে কালো মেঘ।বইছিল বাদলা হাওয়া।অনুভব করলাম,স্বর্গের অমরাবতী থেকে বিতাড়িত যক্ষের থেকে আমি কম বিরহসন্তপ্ত নই।
অবশেষে ঠিক করেছি এই পত্রের মাধ্যমেই তোকে প্রপোজ করব।লাগুক না সময়, চিঠি ঠিক পৌঁছে যাবে চেন্নাইয়ে তোর ঠিকানায়।অপেক্ষা করব আমি তোর উত্তরের! যখনস্নিগ্ধ চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত হবে বিশ্বচরাচর, জানলা দিয়ে ভেসে আসবে জুঁই ফুলের সুবাস, বইবে রোম্যান্টিক শীতল সমীরণ, সেই রাতে গোলাপের ফুলেল বিছানা সাজিয়ে অপেক্ষা করব আমি।বিশ্বাস রয়েছে, যে আসবি তুই!
ভালোবাসা নিস।
ইতি,
তোর প্রেমিক অরিজিৎ