Madhuri Sahana

Abstract Tragedy Classics

3  

Madhuri Sahana

Abstract Tragedy Classics

প্রবর্তন (২)

প্রবর্তন (২)

12 mins
175


দাসবাড়ির বসার ঘরে ভবেন্দ্রনাথ এবং ননীবালার একটা সাদাকালো ছবি টাঙানো আছে ননীবালা চেয়ারে বসে আছেন পেছনে দাঁড়িয়ে ভবেন্দ্রনাথ। টালিগঞ্জের এক স্টুডিওতে ছবিটা তুলেছিলেন ভবেন্দ্রনাথ। প্রখর ছবিটা এনলারজ করিয়ে ফ্রেমে বাঁধিয়ে নীচের ড্রইংরুমে রেখেছে। বসার ঘরে যতীন সেই ছবিটাই দেখছে। মিতালী কে একটা মোবাইল ফোন দিয়ে যাবে এবার। মিতালী দুদিনের বেশি ছুটি নিতে পারেনা শান্তিবালা বেশ অসুস্থ। আটমাস পর যতীন ফিরেছে লাখখানেক টাকা জমিয়েছিল কাজ করে। কিছু টাকা ব্যাঙ্কে রেখেছে কিছুটা খরচ করে গ্রামের ঘরগুলো মেরামত করেছে। এবার ঠিকাদার ওদের পুরুলিয়া নিয়ে যাবে সেখানে তিনচার মাসের কাজ আছে। তাই মিতালীর কাছে এসেছে। যতীন চেয়েছিল মিতালী কে গ্রামে নিয়ে যেতে কিন্তু তা হয়নি। মিতালী নীচে এসে উস্কোখুস্কো যতীনকে দেখলো। বেলা তিনটা বাজে যতীন ভাত খেয়েছে নাকি জিজ্ঞেস করল। যতীন হোটেলে ভাত খেয়ে এসেছিল। মিতালীর গড়ন গঠন ভালো ছিল এখন আরো ভালো লাগছিলো। যতীন মোবাইল ফোনটা মিতালীর হাতে দিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ছোটখাটো একটা কিপ্যাডফোন হাতে পেয়ে মিতালী খুশি হলো। যতীন চলে যেতে মিতালী উপরে শান্তিবালার ঘরে চলে এলো শান্তিবালা জেগেই ছিলেন এতো তাড়াতাড়ি মিতালী ফিরে আসায় খানিক অবাক হলেন, "কিরে স্বামীকে জলমিস্টি কিছু দিয়েছিস? নাকি খালি মুখেই ফিরিয়ে দিলি!" "হোটেল থেকে খেয়েই এসেছিল, ঠিকাদার ডেকেছে তাই তাড়াতাড়ি চলে গেছে।" মিতালী ফোনটা দেখালো শান্তিবালাকে। শান্তিবালা দুহাতে ভর দিয়ে বিছানায় উঠে বসলেন। 

কমলা দুপুরে একটু ভাতঘুম দিয়ে নেয়, শেখর বাসায় নেই ছেলে স্কুলে। শেখরের ফোন আসায় কলটা রিসিভ করলো, "হ্যালো" শেখর জানায় "বড় পিশেমশাই ঘন্টা খানেক হলো মারা গেছেন, বর্ধমান থেকে ফোন করেছিল" 

"কি সর্বনাশ! এখন কি বর্ধমানে যাবে?"

"হ্যা, যেতে তো হবেই"

"মা জানে?"

"মাকে খবরটা দাও"

"ঠাকুরপো কে জানিয়েছো?"

"হ্যা, বলেছি।"

শেখর ফোন কেটে দেয়। কমলা অতসীর ঘরে যায় অতসী সবটাই শুনেছে প্রখরের কাছে দুই জা এবার ভাবনায় পরে শ্বাশুড়িকে খবরটা দিতে হবে। কমলা আর অতসী শান্তিবালার ঘরে গিয়ে ওর বিছানায় বসে। শান্তিবালা দুই বৌমাকে একসাথে দেখে বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটেছে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকে। কমলা আস্তে আস্তে বিজয়শংকরের মৃত্যু সংবাদ দেয়। শান্তিবালা চোখ বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকেন। বিশ্বাবসুর মৃত্যুর কিছুদিন পরে গঙ্গা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর গঙ্গার মৃত্যু হয়েছে বছর দশেক আগে। এতোদিন বিজয়শংকর ছিলেন তাই একটা যোগসূত্র ছিল টেলিফোনে মাঝে মাঝে কথা হতো এবার সেসব বন্ধ হবে। শেখর এবং প্রখর বর্ধমানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে। মোটোরগাড়িতে কলকাতা থেকে বর্ধমানে পৌঁছতে রাত দশটা বেজে গেল। এতো বড়ো বাড়িতে বিজয়শংকর একাই থাকতেন। একজন মালি আর একজন ভৃত্য ছিল ওর দেখাশোনা করতে। বিজয়শংকরের কয়েকজন জ্ঞাতি এই গ্রামেই থাকেন ওরা মৃতদেহের পাসে বসে ছিল শেখর প্রখর পৌঁছতে ওরা মৃতদেহ সৎকার করার জন্য নিয়ে গেল।  

বিজয়শংকর অধ্যাপনা করেছেন এবং লেখালেখি গবেষণা নিয়েই থাকতেন খুব বেশি লোকজনের ভীড় তিনি এড়িয়ে চলতেন। বিশ্বাবসুকে নিজের মনের মতো করে মানুষ করেছিলেন। ছেলের মৃত্যু বিজয়শংকর মন থেকে মেনে নিতে পারেনি একদম একা হয়ে গিয়েছিলেন। ঘরের চারদেয়ালের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। গঙ্গা যে কদিন বেঁচে ছিল তার শুশ্রূষার ত্রুটি রাখেনি। গঙ্গার শ্রাদ্ধ করেছিলেন গৌড়িও মঠে বৈদিক মতে। শেখর এবং প্রখর পিশেমশাইকে শ্রদ্ধা করতো। বিজয়শংকর একমাত্র কথা বলতেন শান্তিবালার সাথে, খোঁজ খবর নিতেন নিয়মিত। শান্তিবালাও বড়ননন্দাই বিজয়শংকরকে খুব ভক্তি করতেন। সমস্ত বাড়ি বই দিয়ে ঠাসা বিজয়শংকরের। শেখর ভাবলো এই বই গুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন পিশেমশাই এগুলো পড়ে পড়ে নষ্ট হবে এবার উই খাবে। বিজয়শংকরের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে বই গুলো বিতরণ করে দিলে ভালো হতো। কিন্তু সেসব করবে কে? ওদের পক্ষে কলকাতার বাইরে বেশি থাকা সম্ভব নয় কাজকর্ম পন্ড হবে। বাড়িটার দেখভাল করার কি ব্যবস্থা আছে সেটা জানতে পারলে ভালো হতো। এসব ভাবতে ভাবতে ওরা শ্বশানে পৌঁছল সেখানে কিছু লৌকিক কাজকর্ম আছে। বিজয়শংকরের মুখাগ্নি করবে ওর ছোটভাই অনাদিশংকর। প্রখর অনাদিশংকরের জামাইয়ের কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছে বিজয়শংকরের উইল যে উকিলের কাছে আছে তাকে মৃত সংবাদ দেওয়া হয়েছে। দাহ করার কাজ সম্পন্ন করতে করতে ভোর হয়ে গেল। প্রখর বিজয়শংকরের অস্থি একটা মাটির ঘটের মধ্যে নিয়ে রাখলো কলকাতায় গঙ্গার ঘাটে বিসর্জন দেওয়ার জন্য। বর্ধমানে কাজ শেষ হলে ওরা কলকাতার উদ্দ্যেশে রওনা হলো। 

তিয়াসার স্কুলে এনুয়াল ডে ফাংশন অতসী তিয়াসাকে একটা রবীন্দ্র নৃত্য শিখিয়েছে স্টেজে পারফর্ম করার জন্য। তিয়াসাকে রোজ রিহার্সাল করতে হচ্ছে। "মন মোর মেঘের সঙ্গী" এই গানে তিয়াসা সোলো পারফর্ম করবে। স্কুল ছুটির পর তিয়াসাকে অতসী নিয়ে যায় নাচের টিচারের বাড়িতে। তিয়াসা রোজকার মতন পিজা অথবা আইসক্রিম খাওয়ার বায়না ধরেছে। অতসী তিয়াসাকে নিয়ে ফুডকোর্টে ঢুকে একটা পিজার অর্ডার দিয়ে টেবিলে বসলো। তিয়াসা একটু শান্ত প্রকৃতির খুব বেশি ছটফট করে না। ওর দাদাদের নিয়ে এখনো নাজেহাল হতে হয় অতসীকে। অতসী নিজের জন্য একটা কোল্ডড্রিঙ্ক নিয়েছে। পাসের টেবিলে দুজন ভদ্রমহিলা অতসীকে হাত নাড়লো প্রত্যুত্তরে অতসী হাসিমুখে ঘাড় নাড়লো। বুটিকের খাতিরে এনাদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখতে হয়। অতসীর মায়ের বুটিকের দোকান এবং প্রচুর কাস্টোমার বছরে চার পাচটা মেলাতে ওদের বুটিকের এগ্জিবিশন হয় অতসী ওর মাকে সাহায্য করে। পিজা খাওয়া শেষ করে তিয়াসা নাচের ক্লাসে গেল। নাচের টিচার তিয়াসার সাজ পোশাক নির্দিষ্ট করে দিলেন ফুলের গয়না আর হলুদ লাল সাদা কম্বিনেশনের সুতির শাড়ি। স্কুলের ম্যাডামের সাথে অতসী ফোনে কথা বলে নিলো। ফেরার পথে নীলু আর হিমুর জন্য পিজা নিয়ে নিলো। 

বাড়িতে শোকের পরিবেশ। শান্তিবালা বিজয়শংকরের মৃত্যুতে গভীর শোকাহত। কমলা বিজয়শংকরের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান উপলক্ষে বর্ধমানে যাবে। বর্ধমানে কমলার বাবামায়ের শরীর খুব একটা ভালো নেই এই উপলক্ষে কয়েক দিন বাবামায়ের কাছে থেকে আসবে কমলা। শেখর বর্ধমানে শ্বশুরবাড়ি বেশি যায় না। খুব প্রয়োজনে দু এক ঘন্টা কয়েক বার গেছে। কমলাও তাই কখনো বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকতে সুযোগ পায়নি। এই নিয়ে কমলার একটা ক্ষোভ রয়েছে। মিতালীর উপর বেশ নির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন শান্তিবালা তাই একটু নিশ্চিন্ত হয়েছে কমলা। অসুস্থ শাশুড়ির কথামতো দিন চারেকের জন্য বর্ধমানে যাবে কমলা। নীলু আর হিমুকে সাথে নিয়ে যাবে। 

বর্ধমানে কমলার বাবার কাঠের পৈতৃক ব্যবসা। বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ি চেরাই করার মেশিনের কারখানা। বেশ পুরনো বড়ো বাড়ি ওদের, একান্নবর্তী পরিবার। দুই কাকা কাকিমা তাদের ছেলেমেয়ে। জনার্দনের কাঠের গোলার কাছে কমলা দুই ছেলে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। কমলার ভাই সুবল এগিয়ে এসে ওদের বাসার ভেতরে নিয়ে গেল। জনার্দনবাবুর বয়সের ভারে ন্যুব্জ ঘরের বাইরে আসতে পারেন না মেয়ে এবং নাতিদের আসার সংবাদে যারপরনাই খুশি। কমলার মায়ের আহ্লাদের শেষ নেই মেয়েকে কাছে পাওয়ার আনন্দে আটখানা। বাড়িতে আনন্দের হাট বসে গেল বড়কাকিমা ছোটকাকিমা ওদের আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখেনি। নীলু হিমু মামারবাড়ীতে সঙ্গী পেয়ে গেল কমলার দুই কলেজ পড়ুয়া ভাই রঞ্জিত আর সঞ্জিতকে। বড়োকাকার দুই ছেলে রঞ্জিত আর সঞ্জিত ছোটকাকার কোনো সন্তান নেই। সুবলের বৌ পরমা মেয়ে সোনাইকে কমলার কোলে দিলো। খুব মিষ্টি হয়েছে সোনাই বড়ো বড়ো টানা টানা চোখ ফোলা ফোলা গাল একটা পুতুল যেন। এর আগে যতবার কমলা বাপের বাড়িতে এসেছে সকালে এসে বিকেলে ফিরে গেছে। পরমার বড়ননদ কমলার সাথে যতটুকু কথাবার্তা হয়েছে তা দুর থেকে টেলিফোনেই। সোনাইএর অন্নপ্রাশনে এসেও ঘন্টা খানেকের বেশি থাকতে পারেনি কমলা শেখরের সাথে ফিরে যেতে হয়েছিল। মায়ের অসুখের সময় নার্সিংহোমে এসে দেখে গিয়েছে কিন্তু থাকা হয়নি। কমলার মা আর্থারাইটিসে ভুগছেন দীর্ঘদিন। এখন প্রায় চলৎশক্তিহীন। কমলা মায়ের শিয়রের কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মায়ের দুচোখে জলের ধারা দেখে কমলার চোখ চিকচিক করে উঠলো। 


রঞ্জনা কমলার ছোট কাকিমা। রঞ্জনা বৌ হয়ে এসেছিল তখন কমলা কলেজে পড়ে তাই এদের খুব ভাব, প্রায় বন্ধুর মত। অনেক বছর পর রঞ্জনা আর কমলা ছাদের উপর মাদুর পেতে বসে নিজেদের গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেছে। পরমা চা আর আলুর চপ নিয়ে এলো। 

"নীলু হিমু কোথায় রে?" কমলা প্রশ্ন করলো পরমাকে।

"রঞ্জীতদের সাথে আছে। ওরা চারজনে কেরাম খেলছে।" পরমা জানালো।

"ভাই কখন আসবে?"

"নটা নাগাদ। ছোট কাকি তুমি কি মটনটা রান্না করবে? মশলা করিয়ে রেখেছি।" 

রঞ্জনার রান্নার হাত ভালো, এবাড়িতে ভালো কিছু রান্না হলে সেটা রঞ্জনা করে। রঞ্জনা বললো "করবোখন, আজকে রাতের মেনু কিরে?"

"রুটি মটনকারি আর দইকাতলা।"

"ভাত নেবে গেছে?"

"হা, ছোট হাঁড়িতে ভাত করেছে। রুটি সেঁকা হয়ে গেলে চলে এসো। আমি দেখি ওদিকে কতদূর হয়েছে।" পরমা চলে গেল।

রঞ্জনা বললো "সোনাই এবার উঠে পড়বে, ওর খাওয়ার সময় হলো।" 

কমলা গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সোনাইকে রঞ্জনা কোলে পিঠে করে বড়ো করছে। যৌথপরিবারে‌ নিজের সন্তান না থাকলেও ছেলেপুলের অভাব বোঝা যায় না তবু আক্ষেপ তো থেকেই যায়। রঞ্জনার বাপের বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো না সে গরীবের ঘরের মেয়ে। ছোট কাকা ভালোবাসা করে বিয়ে করেছে রঞ্জনাকে। এই বিয়েতে দাদুর একেবারেই মত ছিল না। তারাপীঠে গিয়ে ওরা বিয়ে করেছিল। দাদু বাড়িতে ঢোকার অনুমতি দেয়নি। দু'মাস বাড়িতে আসেনি ছোট কাকা তারপর জনার্দনবাবুর চেষ্টায় সবকিছু মিটমাট হয়। কমলার মা শশুরকে বুঝিয়ে একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান করে ওদের ঘরে তুলেছিল। সেই সময় তুলসী মামি এসেছিলেন এবং কমলার বিয়ে ঠিক করেন শেখরের সাথে। রঞ্জনা নিজ গুনে এদের সকলের মন জিতে নিয়েছিল এমনকি দাদুও রঞ্জনাকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলেন ঠাকুমার বাংলা জোড়া দিয়ে ছিলেন উপহার স্বরূপ। রঞ্জনা গর্ভবতী হওয়ার পর সাতমাসের সাধ দেওয়াও হয় এরপর রঞ্জনা বাবার বাড়িতে গিয়েছিল বাচ্চার জন্ম দেওয়ার জন্য। প্রসবের সময় খুব খারাপ অবস্থা হয়েছিল রঞ্জনার একেবারে যমে মানুষে টানাটানি। মাকে বাঁচানো গেলেও বাচ্চা বাঁচাতে পারেনি। এরপর রঞ্জনা তিনচার মাস খুব অসুস্থ ছিল ওর আর সন্তান হয়নি।

পরমা চলে যাওয়ার পর কমলা আরো খানিক রঞ্জনার সাথে কথাবার্তায় মশগুল রইল। পরমা প্রাইমারি স্কুলে টিচারের চাকরি করে। বড়কাকার বন্ধুর মেয়ে পরমা। এই গ্রামে প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পাওয়ার পর বড়কাকা সুবলের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করেছিল। পরমা বাড়িতে শাড়ি পরে থাকার চলন বদলেছে সালোয়ার কামিজ রাতে নাইটি এসব পরা শুরু করেছে। বাড়ির বাইরে বেড়াতে গেলে জিন্স টপ পরে। পরমার নিজের কোনো ভাইবোন নেই বাবা মা আছে। রবিবার বা স্কুলে ছুটি থাকলে পরমা বাপের বাড়ি যায়। সুবল মটোরবাইক করে দিয়ে আসে। 

অতসী দুবার ফোন করেছিল। কমলা বাড়িতে না থাকায় অতসীর সংসার সামলাতে অসুবিধা হচ্ছে। রাত পোহালে বিজয়শংকরের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান কমলাকে সকাল সকাল পৌঁছতে হবে সেখানে। কলকাতা থেকে শেখর এবং প্রখর দুজনেই উপস্থিত থাকবে তবে ঘন্টা খানেকের বেশি সময় থাকতে পারবে না। শ্রাদ্ধের কাজ হয়ে গেলে নিয়মমাফিক একদিন জিরেন থাকবে তারপর দিন নিয়মভঙ্গ। কমলা শ্বাশুড়ির খোঁজ নিয়েছে, শান্তিবালা এখন খুব কম কথা বলেন। রাতে এখানে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ হয়। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কমলা ঘুমিয়ে পরেছে। সকালে রঞ্জনা ডেকে দিল। বর্ধমানের সকালটা কলকাতার থেকে অনেক আলাদা। কলকাতায় কমলা ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘুম থেকে ওঠে সকালের চা তৈরি করে ফ্লাক্সে ভোরে রাখে। হাজারটা কাজ সামলাতে সামলাতে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। কমলা স্নান সেরে একটা হালকা রঙের পিওর সিল্ক শাড়ি পড়লো, পিওর সিল্ক শাড়ি পরে সারাদিন থাকা অসুবিধা হয় না তাঁতের শাড়ি খুব ঘেঁটে যায়। নীলু হিমুকে দুপুরে সুবল পৌঁছে দেবে। সকাল সকাল গিয়ে ওদের বোর লাগবে ওখানে। রঞ্জনা ওদের ঠিক সময়ে পাঠিয়ে দেবে। পরমার ছুটি নেই নাহলে কমলা পরমাকে সাথে নিত। বিজয়শংকরের বাড়িতে পৌঁছে কমলা দেখল পুরোহিতরা এসে গেছে। বসার ঘরে পুজোর আয়োজন করা হয়েছে হলটা বেশ বড়ো। অনাদিশংকর কমলাকে বললেন,"এসো মা, তুমি এখন একটু দেখাশোনা কর। তোমার শ্বাশুড়ির সুস্থ আছেন তো? শেখর কখন আসবে?" 

"বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যে এসে পরবে।"  

পুরোহিতরা শ্রাদ্ধের আয়োজন গোছানো শুরু করে দিয়েছে কমলা ওদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। বাড়ির সামনের উঠানে অতিথি আপ্যায়নের আয়োজন করা হয়েছে। গ্রামের লোকজন সকলেই একবার আসবে। আত্মীয়স্বজন এই গ্রামেই থাকেন অনাদিশংকর সাধ্যমতো আয়োজন করেছেন। ব্যাঙ্ক পোস্টাফিসে বিজয়শংকরের সঞ্চিত অর্থ অনাদিশংকর ওঁর শ্রাদ্ধের আয়োজনে ব্যবহার করেছেন। গ্রামে যারা আত্মীয়স্বজন আছেন তাদের মধ্যে একটা বুলিং বছরভর চলে কিন্তু কোনো অনুষ্ঠান হলে সকলেই উপস্থিত হয়। কমলা বর্ধমানে বড় হয়েছে তাই ওকে সকলেই কমবেশি চেনে। গঙ্গা এবং বিজয়শংকরের দুটো বড়ো বড়ো ছবি রজনীগন্ধার মালা দিয়ে সাজিয়ে শ্রাদ্ধের আসরে রেখেছে। বিশ্বাবসুর ছবিটাও সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। পুরোহিতের কন্ঠে গীতা পাঠের সুর এবং ধুপের গন্ধ পরিবেশটা পবিত্র করে দিয়েছে। আমন্ত্রিতরা একে একে আসতে শুরু করেছে কলকাতা থেকে শেখর এবং প্রখর এসে পৌঁছেছে। শ্রাদ্ধের পুজো পাঠ শেষ হতে হতে বিকাল হয়ে গেল। কমলা সব শেষে অন্নজল করেছে। পুরোহিতদের বিদায় দিয়ে অনাদিশংকর শেখরকে থেকে যেতে অনুরোধ করলেন। শেখর জানায় "বাড়িতে মায়ের শরীর ভালো নেই, থেকে যাওয়া সম্ভব নয়।" এরপর ওরা কলকাতায় ফিরে যায়। আগামী কাল হরিসংকীর্তন গান হবে। আগামীকাল কীর্তনের আসরে আসবে অনাদিশংকরকে কথা দিয়ে কমলা বাপের বাড়িতে ফিরে আসে।  

জনার্দনবাবু তার পৈত্রিক কাঠের কারবারের আরো উন্নতি করতে দুটো বড়ো বড়ো কাঠচেরাই মেশিন কিনেছিলেন। বর্তমানে কারখানায় বিশজন মজুর কাজ করে। ওদের কাঠের গোলা থেকে লরিতে করে কাঠের তক্তা কলকাতায় চালান যায়। বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ি লরিতে করে কারখানায় আসে জনার্দনবাবুর দুই ভাই বর্তমানে ব্যবসা দেখাশোনা করে। জনার্দনবাবু ছেলেকে ব্যবসার কাজে নিযুক্ত করেছেন। দুই কাকার সাথে সুবল কারখানা এবং কারবার নিয়ে ব্যস্ত। নীলু আর হিমু এখানে গ্রাম এক্সপ্লোর করতে বেরিয়েছে। রঞ্জিত আর সঞ্জিত ওদের ছিপ দিয়ে মাছ ধরার কায়দা শিখিয়েছে, গুলতি দিয়ে পেয়ারা পাড়তে শিখিয়েছে। 

ভোলা কাঠের কারখানায় কাজ করে এবং ভোলা নারকেল গাছে উঠে ডাব পেড়ে আনতে ওস্তাদ। নীলু আর হিমু ভোলার কেরামতি দেখে অবাক। অনেক উঁচু নারকেল গাছের মাথায় ভোলা তরতরিয়ে উঠে ডাব পেড়ে নিয়ে এসেছে। ডাবের জল কলকাতায় কত খেয়েছে ওরা কিন্তু একেবারে গাছে উঠে ডাব পেড়েআনার কৌশল দেখেনি কখনো। ভোলা পায়রা পোষে। নীলু আর হিমু বায়না ধরেছে পায়রার ডিম দেখবে। সঞ্জিত আর রঞ্জিত ভোলার বাড়ি বিলক্ষণ চেনে। ওরা চারজন ভোলার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। ভোলার পায়রার খোপে একডজন পায়রা আছে। নিলু একটা পায়রা ধরার জন্য হাত বাড়াতেই সেটা উড়ে গেল। ভোলা ওদের পায়রার ডিম দেখালো। ভোলার বাড়িটা মাটির দেয়ালের উপর খড়ের চাল। উঠানে পাট কাঠির মাচায় লাউ ঝুলে রয়েছে। ভোলার মা সামনের ডোবায় বসে বাসন ধুয়ে নিচ্ছিল ওদের দেখে উঠে এলো। দাওয়ায় মাদুর বিছিয়ে বসতে দিল। একধামা মুড়ি আর বাতাসা নিয়ে এসে ওদের খেতে অনুরোধ করলো। বর্ধমানের লোকেরা খুব মুড়ি খায় সেটা নীলু হিমু জানে। কলকাতায় ওরা ঝালমুড়ি খায় মাঝে মাঝে তবে এতো মুড়ি খেতে গেলে চোয়াল ব্যাথা করবে। ওরা দুজন দুমুঠো মুড়ি তুলে নিলো। ভোলাদের গ্রামটার চারদিকে শুধু ধান গাছ সবুজ আর সবুজ। হিমু ভূগোল বইতে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদন হয় বর্ধমানে। ভোলার বাবা গরুরগাড়ি চালায়। দুটো বড়ো বড়ো শিং বলদ বাঁধা রয়েছে আর একটু দুরে গরুরগাড়িটা রাখা আছে। নীলু বা হিমু কেউই আগে গরুরগাড়িতে চড়েনি। ওদের মনে হলো গরুরগাড়ি একবার চেপে দেখা উচিত কিন্তু মুখফুটে বলা হলোনা।

 

কমলার মা এবাড়িতে বউ হয়ে আসার প্রায় দশ বছর পর বড়কাকিমা এসেছিলেন। দাদু ঠাকুমা বড়কাকিমাকে নতুন বৌ বলে ডাকতেন। বড়কাকিমা ঠাকুমার মৃত্যুর পর রাধাগোবিন্দ মন্দিরের সেবায় মন দিয়েছেন। তিনবেলা গোবিন্দের ভোগ দেওয়া তার যত্ন করা এসব নিয়েই বড়কাকিমা থাকেন। রঞ্জিত আর সঞ্জিত রঞ্জনার কাছেই আদর যত্নে বড়ো হয়েছে। কমলার মা দীর্ঘ দিন বাড়ির হেঁসেল সামলেছেন, এখন ব্লাড প্রেসার কোলেস্টেরল সুগার রোগে কাহিল। এখন বেশি নড়াচড়া করতে পারেন না। জনার্দনবাবু প্রায় চলৎশক্তিহীন তিনবার স্ট্রোক হয়ে গেছে। পরমার মেয়ে সোনাই ওদের ঘরে দোলনায় শোয়ানো থাকে ওরা সোনাই এর দুষ্টুমি দেখে আর টিভিতে সিরিয়াল দেখে সময় কাটান। কমলা বাড়িতে আসায় টিভি দেখা বন্ধ হয়েছে। বড়কাকিমা মালপোয়া ভেজে রেখেছে ক্ষীর বানিয়েছে বেশি করে। কমলার এসব খাওয়ার সময় হচ্ছে না। পরমা ঠিক করেছে স্কুল থেকে ছুটি নেবে সকলে মিলে জমিয়ে খাওয়া দাওয়া আর আড্ডা হবে। কমলার বিজয়শংকরের শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান শেষ হলে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার কথা কিন্তু এরা এবার কমলাকে দুদিন বেশি রাখতে বদ্ধপরিকর। বহুদিন পর কমলাকে ওরা কাছে পেয়েছে। 

কমলা শ্বাশুড়ির সাথে ফোনে কথা বলেছে শান্তিবালা খুঁটিনাটি জেনেছেন এবং বিজয়শংকরের পারলৌকিক ক্রিয়া নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে শুনে শান্তি পেয়েছেন। দূর্গাপুরে তুলসীর মৃত্যুর পর তেমন খোঁজ খবর করা হয়নি। কমলা মামার বাড়িতে খোঁজ নিয়েছে। কমলা শেখরকে জানিয়েছে দুদিন রেস্ট নিয়ে তারপর কলকাতায় ফিরবে। 

বুনিয়া এসেছে কমলার সাথে দেখা করতে। বুনিয়া জেলা ব্লক অফিসে চাকরি করে। কমলার ক্লাসমেট ছিল বুনিয়া। বুনিয়া প্রান্তিক গোত্রের মেয়ে। তখন আদিবাসী তফসিল জনগোষ্ঠীর যে কতিপয় মেয়ে স্কুলের গণ্ডিতে ঢোকার সুযোগ করে উঠতে পেরেছিল বুনিয়া তাদেরই একজন। স্কুলে পড়ার সময় কমলা বুনিয়া কে বই খাতা দিয়ে সাহায্য করতো। কমলার পুরানো হয়ে যাওয়া স্কুলের পোষাক গুলো বুনিয়া পরে স্কুলে যেত। সেই অভাবের দিন গুলো বুনিয়া মনে রেখেছে। এখন বুনিয়া স্বামী সন্তান নিয়ে সংসারী, সরকারি চাকুরেদের একজন। বুনিয়া এসেছে কমলাকে সাথে নিয়ে যেতে হস্তশিল্পের মেলায় সেখানে প্রান্তিক মহিলাদের হাতে তৈরি সব জিনিস পাওয়া যায়।


বেশ একচোট হৈচৈ করে কয়েক দিন কাটলো হিমু ও নিলুর। ওরা মামার বাড়িতে বেড়াতে আসার মজা পুরোটাই উপভোগ করেছে । কলকাতায় ফিরে বেশ মন খারাপ হবে ওদের। অতসী সাংসারিক কাজকর্মে তেমন পটু নয় কোনো দিনও। তাছাড়া তিয়াসার স্কুলের অনুষ্ঠানে ওকে বেশি সময় দিতে হচ্ছে। কমলা না থাকায় অতসীর অসুবিধাই হচ্ছে। কাজের লোকের ভরসায় সব কিছু ফেলে রাখা যায়না। কমলা ফিরে আসায় অতসী খুশি হলো।


কমলা বাড়িতে না থাকায় মিতালীর অনেকটা কাজের চাপ বেড়ে গেছিল। বিন্দুমাসি এবাড়িতে পুরোনো লোক রান্নাঘরের কাজ সেই বেশি জানে। তাই বিন্দুমাসি আর মিতালী এই কয়দিন সামলে দিয়েছে। যতিনের দেওয়া ফোনটাতে মিতালীর অনেক সুবিধা হয়েছে প্রয়োজনে মায়ের সাথে কথা বলা যায়। রাত নটার পর রোজ যতিনের সাথে ফোনে কথা হয় মিতালীর। যতিনের মদ বা গাঁজার নেশা নেই। পুরুলিয়াতে একটা বাঁধ মেরামত কাজের জন্য ওরা গেছে। পুরুলিয়াতে রোদের তাপ খুব, সারাদিন খাটুনির পর শ্রমিকদের তাঁবুতে আগুন জ্বেলে রান্না হয়। রাতে গরম ভাত খাওয়া হলে কিছুটা ভাতে জল ঢেলে রেখে দেয় পরদিন সকালের জন্য। সকাল পানতাভাত খেয়ে কাজে বেরিয়ে যায়। দুপুরে ঠেলাগাড়িতে কচুরি বিক্রি হয় ওরা কচুরি কিনে খায়। যতিনের সাথে যারা আছে সকলেই নেশা করে। মিতালী মনে মনে দক্ষিণরায়ের কাছে অনুরোধ করে যাতে যতিন নেশার কবলে না পরে। 


  


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract