Madhuri Sahana

Classics Others

4.4  

Madhuri Sahana

Classics Others

সঙ্কটমোচন

সঙ্কটমোচন

9 mins
324


স্কুলের পড়া ভালো লাগছেনা বিষ্ণুর। মন খারাপ করে জালনার উপর বসে পুকুরের দিকে তাকিয়ে ছিল বিষ্ণু। কয়েকটি সাদা বক পাখি রোজ এসে জলের ধারে বসে থাকে। ওরা মাছের খোঁজ করে। বক গুলো কি করে যেন এক পায়ে খাড়া থাকে, বিষ্ণু বুঝতে পারেনা। বিষ্ণু মাঝে মাঝে চেষ্টা করে দেখেছে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কিন্তু একটানা পাঁচ মিনিটও দাঁড়াতে পারেনি। দুই পায়ের দাড়ালে কি মাছ ধরতে অসুবিধা হয়? বিষ্ণুর পায়ে মশা কামড়াচ্ছে।

মশা এবং জোক এদের খাদ্য তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে রক্ত। রক্তের স্বাদ এদের প্রিয়। স্বাদ শব্দের সাথে মানুষের জিভের একটা উল্লেখ আছে। মানুষের জিভে থাকে একধরনের কোরক তাতেই স্বাদের অস্তিত্ব। যেমন নোনা,‌ মিঠা, তিতকুটে, ঝাল, পানসে ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানেই একটা প্রশ্ন বিষ্ণুর মনে আসে যে মানুষের নিজস্ব স্বাদ এবং অন্যান্য জীবজন্তুর স্বাদের মিল বা অমিল কেমন? যেমন গরু ঘাস ভালো খায় কিন্তু মানুষের জিভে ঘাসের কোনো স্বাদ নেই। তাহলে এটাই প্রমাণিত যে স্বাদ বোঝার জন্য যে টুকু বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হবে তা গরুর নেই অথবা এমন হতেই পারে যে ঘাসের টেষ্ট গরুই বুঝতে পারে মানুষের জিভ সেখানে অচল। 

মশা এবং জোকের জিভ নেই তাদের আছে হুল মানে নলের মতো একটা অঙ্গ, যাতে রক্ত চুষে নেওয়া যায়। মশা বা জোক এরা যদি জল চুষে নিতো তাহলে প্রশ্ন উঠতো না কিন্তু এরা শুধু রক্ত চোষে কেন? মানুষের জিভেই শুধু টেষ্টবাড থাকে? মশাদের হুলে কি রহস্য আছে?

এক টুকরো রুটি এবং এক দলা গুড় ফেলে রেখে দিলে দেখা যায় পিঁপড়ের দল গুড় নিয়ে টানাটানি করছে। গুড়ের মিষ্টি স্বাদ পেয়েছে পিঁপড়ে।‌ নিম পাতায় পোকা লাগে না। নিম গাছের পাতা যে তেতো হয় পোকারা সেটা কি ভাবে বুঝতে পারে? স্বাদের তারতম্য বোঝার জন্য যে মেকানিজম প্রয়োজন কীটপতঙ্গের শরীরে সেটা বর্তমান।‌

কুমিরের দাঁতে অসম্ভব জোর তাহলে কুমির মাংস পচিয়ে খায় কেন? এই ধরনের অজস্র প্রশ্ন বিষ্ণুর মাথায় ঘুরপাক খায়। বিষ্ণু এবার এইট থেকে নাইনে উঠেছে। বিষ্ণু ছোটবেলায় তার মায়ের কাছে প্রশ্ন করতো সেসব প্রশ্নের উত্তর মা নিজের মতো করেই দিতো। ছোটবেলায় বিষ্ণুর কৌতুহলের বিষয় গুলিও ছিল অন্য রকমের। যেমন সুর্য রোজ রোজ দেখা যায় চাঁদকে রোজ দেখা যায় না কেন? চাঁদ সূর্য আকাশের কোথায় থাকে? ইত্যাদি ইত্যাদি।

স্কুলে পড়াশুনা শুরু করার পর বিষ্ণুর প্রশ্ন করার অভ্যাস কিছু কমেনি বরং ওর কৌতুহলের দাপটে ওকে সকলে "কোয়েশ্চেন ব্যাঙ্ক" বলে টিজ্ করে থাকে।

একবার দাদু বিষ্ণুকে বলেছিল পড়াশোনা করে মস্ত গবেষক হতে। বিষ্ণু মানে বইতে পড়েছে গবেষণা করার অর্থ গোরু খোঁজা। কষ্ট করে পড়াশোনা করে গোরু খুঁজতে যাওয়ার কোনো অর্থই বিষ্ণু খুঁজে পায়নি। 

শব্দরূপ পড়তে গিয়ে ভীষণ ঝামেলায় জড়িয়ে ছিল বিষ্ণু। শব্দ কানে শোনা যায় চোখে দেখা যায় না। যা চোখে দেখা যায় না তার আবার রূপ কোথায়? 

স্কুল যেতে একটুও ইচ্ছে করছে না বিষ্ণুর। একটু উদাস মনে হেঁটে পুকুরের পাসের গলিটা ধরে পোড়াবটতলার দিকে এগিয়ে চলেছে ও। ওদিকে একটা জঙ্গল আছে আর কিছু ভাঙাচোরা ইটের পাঁজা। পোড়া বট গাছকে ঘিরে একটা বেদী মতো আছে সেখানে এক সাধু ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকে। এদিকে বিশেষ কেউ আসেনা। বিষ্ণু হাটতে হাটতে জঙ্গলের কাছে চলে এসেছে। বিষ্ণু দেখলো সাধু মহারাজ বেশ কিছু শেকড় বাকড় তুলে এনে জড়ো করে রেখেছে। এই শেকড় গুলো হাটে গিয়ে বিক্রি করবে। বিষ্ণু স্কুলের পোশাক পরে ছিল ওকে দেখে সাধু মহারাজ একটু অবাক হলো কিন্তু কোনো প্রশ্ন না করে শেকড় বাকড় ঝোলায় ভরে রওনা দিল। অনেকটা পথ হেটে এসেছে বিষ্ণু এবার বট তলার বেদিতে বসলো। এই জায়গাটা খুব নির্জন। সাধু মহারাজ চলে গেছে। বটগাছের ছায়ায় বেদিটা বেশ ঠাণ্ডা হাত-পা ছড়িয়ে বসলো বিষ্ণু।

একটা জটায়ু পাখি বিষ্ণুকে ডাকছে, "এই বিষ্ণু! বিষ্ণু!" "তুমি আমার নাম জানলে কি করে?" "তোমার নাম জানি তাই তো তোমাকে ডাকছি। তুমি আমার পিঠে বসো, আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।" 

"কোথায় যাবে?" বিষ্ণু জটায়ুর পিঠে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো। বিষ্ণুকে পিঠে নিয়ে জটায়ু উড়ে চললো। বিষ্ণু মেঘের উপর দিয়ে উড়ে চলেছে জঙ্গল ছাড়িয়ে। ওদের গ্রামের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় স্কুলটা দেখতে পেল বিষ্ণু কিন্তু ওকে কেউ দেখতে পেল না। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর একটা বড় জঙ্গল দেখতে পেল বিষ্ণু। জটায়ু এবার একটা বড়ো গাছের ডালে‌ গিয়ে বসলো। বিষ্ণু জটায়ুর পিঠের উপর থেকে নেমে এলো। একটা খুব সুন্দর ট্রি-হাউজ। বিষ্ণুকে দেখে একজন এগিয়ে এলো। "আসুন আমাদের মহারাজ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।" 

জটায়ু বললো "আমি এখানে অপেক্ষা করছি, তুমি ভেতরে যাও।" বিষ্ণু সেই প্রহরী মতো লোকটার সাথে চললো। ট্রি-হাউজ একটা ছোটখাটো প্রসাদ। সুসজ্জিত সেই প্রাসাদের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে বিষ্ণু মুগ্ধ হয়ে গেল। মার্বেল পাথরের উপর খোদাই করা সোনার কারুকার্য খচিত দেওয়াল বিষ্ণু এর আগে কখনো দেখেনি। রাজ দরবারে রাজা এবং তার জনা তিন মন্ত্রী উপস্থিত রয়েছেন। বিষ্ণু ভিতরে প্রবেশ করে বুঝতে পারলো ওরা অপেক্ষা করছেন। রাজা বিশেষ সমাদর করে অভ্যর্থনা করলেন বিষ্ণুকে। " বিষ্ণু, পৃথিবীর সামনে ভীষণ বিপদ, তাই তোমাকে এখানে আনা হয়েছে। তোমার এখানে এসে খারাপ লাগছে না তো।"

"না, তবে আমাকে কি করতে হবে একটু বুঝিয়ে বলবেন।"

"খুব বেশি সময় হাতে নেই। আমার পুরোহিত মশাই একজন বেদজ্ঞ পন্ডিত উনি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলবেন।" বিষ্ণুকে সাথে নিয়ে রাজা একটা মন্দিরে প্রবেশ করলেন। 

মন্দিরের ভিতরে এক স্নিগ্ধ আলো। যেন পূর্ণ চাঁদের জোছনায় উজ্জ্বল মন্দির প্রাঙ্গণ। অপূর্ব শান্তি বিরাজ করছে। পারিজাত ফুলের সুবাস চারিদিকে। একজন পুরোহিত একটা যজ্ঞ কুন্ডের সামনে বসে আছেন। বিষ্ণুকে আসনে বসেতে বললেন পুরোহিত। যজ্ঞকুন্ডে তাকিয়ে বিষ্ণু অবাক হয়ে গেল। মহাকাশের চিত্র ফুটে উঠেছে সেখানে। সূর্য এবং নবগ্রহের আবর্তন চিত্র বিজ্ঞান বইতে দেখেছে বিষ্ণু। প্রতিটি গ্রহকে আলাদা করে চিনতে পারছে বিষ্ণু। পুরোহিত বিষ্ণুর হাত ধরলেন, ওরা একটা অন্য জগতে প্রবেশ করলো।

"ঠাকুরমশাই, পৃথিবীর বিপদটা কি আমি বুঝতে পারছি না, আমাকে একটু বলুন।"

"খুব সাংঘাতিক বিপদ, সৃষ্টি রসাতলে যাবে। যে ভাবেই হোক চন্দ্রকলা উদ্ধার করতে হবে।"

"চন্দ্রকলা কি? কি করে সেটি খোয়া গেছে?"

"একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র!"

"কোনো কিছু খোয়া গেলে দেবর্ষি যোগবলে সেটি সন্ধান করতে পারেন।"

"চুম্বক ক্ষেত্রের বাইরে যোগবল কাজ করে না।"

"সেকি! চন্দ্রকলাকে চুম্বকক্ষেত্রের বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো কি করে?"

"সেটা একেবারেই অসম্ভব।"

"তাহলে?"

"এমন কোনো বর্মের আড়ালে চন্দ্রকলাকে রাখা হয়েছে সেখানে কোনো তরঙ্গ প্রবাহ প্রবেশ করতে পারছেনা।"

"এ কাজ তো কোন দেবতা করবেন না।"

"না!"

"অসীম জ্ঞানের অধিকারী না হলে এ রকম বর্ম তৈরি করা সম্ভব নয়। দেবতার অগোচরে এই তপস্যা করা কি করে সম্ভব?"

"চন্দ্রকলাকে উদ্ধার করা আশু প্রয়োজন। তদন্তে সত্য উদঘাটিত হবে।"

"চন্দ্রকলাকে উদ্ধার করতে আমি কি ভাবে সাহায্য করতে পারি।"

"দেবরাজ ইন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতির সাথে পরামর্শ করেছেন, তার নির্দেশে মতো তোমাকে আনা হয়েছে। অবতার তত্ত্ব অনুযায়ী জগতে সংকট উপস্থিত হলেই অবতারের আবির্ভাব হয়। তোমার জন্ম লগ্ন বিচার করে তোমাকে এই কাজের জন্য নির্বাচন করেছেন স্বয়ং ব্রক্ষ্মা।"

"সেকি? আমি কি কলির অবতার!!"

"না, এখন ৫১২৪ কলিযুগাব্দ। একটা আকষ্মিক অঘটন ঘটেছে। কলি যুগে অঘটন ঘটে। তাই ত্রাতার আবির্ভাব হয়।"

"ভগবান বলেছেন যা কিছু ঘটছে সবই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী।"

"ঠিকই, পরিকল্পনা ছাড়া কোনো কার্য হয় না। অঘটনের একটা পরিকল্পনা থাকে সেটা ভগবান করেন না।"

"চন্দ্রকলাকে উদ্ধার করার জন্য কিছু কি পরিকল্পনা করা হয়েছে?"

"তোমাকে দ্বাপরযুগে যেতে হবে। এই যে রথটি দেখতে পাচ্ছ এ তোমাকে দ্বাপরযুগের দরজায় পৌঁছে দেবে। তুমি দ্বাপরযুগের ভিতরে প্রবেশ করবে। সেখানে শ্রীকৃষ্ণ তোমার সঙ্গে সাক্ষাত করবেন।"

বিষ্ণুকে রথে ওঠানোর সময় ঠাকুরমশাই ওর চোখ বেঁধে দিলেন। মহাকাশ মহাজাগতিক বিষ্ময়ে ভরা। অজস্র গ্রহ নক্ষত্র নেবুলা আকাশগঙ্গা পার হয়ে যেতে হবে। বিষ্ণু যাতে বিভ্রান্ত না হয় তাই ওর চোখ বেঁধে দিলেন।

দ্বারকায় পৌঁছে গেল বিষ্ণু। প্রবেশ দ্বারের প্রহরী বিষ্ণুকে ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিল না। দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণ কংস বধ করে ওর পিতা মাতাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছেন। পিতা বাসুদেব দ্বারকার সিংহাসনে শ্রীকৃষ্ণের অভিষেক করতে প্রচুর আয়োজন করেছেন। বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিরা আসছেন। বিষ্ণু বুদ্ধি প্রয়োগ করে ওদের দলে মিশে গিয়ে দ্বারকায় প্রবেশ করলো। খুব সমস্যায় পরেছে বিষ্ণু সকলে শুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় কথা বলছে বিষ্ণু বুঝতে পারলেও কিছু বলতে পারছেনা। ও বোবা সেজে অভিনয় করছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ পেল বিষ্ণু। শ্রীকৃষ্ণ সব শুনে বললেন যে কলিযুগে এধরণের সমস্যা তৈরি হবে এ আশঙ্কা তার ছিল । চন্দ্র মন্দিরে প্রবেশ করলেন শ্রীকৃষ্ণ।

আটটি শুক্লপক্ষের কলা এবং আটটি কৃষ্ণপক্ষের কলা মন্দিরে বিরাজমান। চাঁদ যে রূপে দেখা দেন তাতে আলোকিত অংশের হ্রাস বৃদ্ধি অনুযায়ী চন্দ্রকলা পরিচিতি পায়। এই চন্দ্রকলার প্রতিটি দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত। চন্দ্রের পূর্ণ রূপ বারোটি জোছনা। এরা সকলেই সময়ের গন্ডীর মধ্যে নির্দিষ্ট শৃঙ্খলাতে সীমাবদ্ধ। সেই সীমা অতিক্রম করে চন্দ্রকলার অপহরণ একপ্রকার অসম্ভব। শ্রীকৃষ্ণ বললেন "সমন্বয়ের বছরে কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ তিথি দিয়ে মাস শুরু হয়ে, শেষ হয় কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ তিথি দিয়ে। এই মাসটিকে মলমাস বলে গণ্য করা হয়। মলমাসে দেবতারা কলা গ্রহণ করেন না। এই মলমাসেই চন্দ্রকলাকে অপহরণ করা হয়েছে।"

বিষ্ণু বললো "দেবগুরু বৃহস্পতি জানিয়েছেন এই মলমাস অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে চন্দ্রকলা উদ্ধার করতে হবে।"

"কলি যুগে কল্কি অবতার কিন্তু এখনই কল্কি অবতারের সময় হয়নি। চন্দ্রকলাকে বর্মের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সত্যযুগে কূর্ম অবতার। কূর্ম রূপেই সন্ধান করতে হবে। দাদা বলরামের পরামর্শ প্রয়োজন।" এই বলে শ্রীকৃষ্ণ প্রাসাদে চললেন।

শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরাম নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে অনন্তনাগকে আহ্বান করলেন এবং বলরামের নির্দেশে অনন্তনাগ কৃষ্ণপক্ষের কলা অমৃতাকে সাথে নিয়ে জলে প্রবেশ করলেন। মন্দর পর্বত সমুদ্র মন্থনের পর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছেন। অসুরদের অনেকেই মন্দর পর্বতের গুহায় বসবাস করছে। অসুর এবং দানবেরা সুক্ষ্ম দেহ ধারণ করে মর্তে বিচরণ করে এবং নানাভাবে মানুষকে বিব্রত করে চলেছে। বাসুকির গৃহে উপস্থিত হয়ে অনন্তনাগ দেখলেন গায়ত্রী দেবীর চতুর্কুমার সনক, সনন্দন, সনাতন ও সনৎকুমার পাঠে মগ্ন। বাসুকি এদের শিক্ষা দান করছেন। বাসুকি সমুদ্র বিজ্ঞানে প্রগাঢ় জ্ঞানের অধিকারী দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। মন্দর পর্বতে বসবাসরত অসুর এবং দানবদের জঙ্গি কার্যকলাপ বাসুকিকে বিব্রত করেছে নানান সময়। সমুদ্র মন্থনের কারণ থেকেই অসুরদের ক্রোধের উৎপত্তি। সমুদ্র মন্থনের পর বাসুকি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেশি চলা ফেরা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ব্রক্ষ্মা এবং গায়ত্রীদেবীর সহায়তায় টিকে আছেন। পৃথিবীকে রক্ষা করতে গিয়ে বাসুকির এই দুর্দশা হয়েছে তাই তিনি ক্ষোভ ধরে রাখতে পারলেন না। সংকটের সময় আবার শ্রীকৃষ্ণ স্মরণ করেছেন তাকে। অমৃতা উতলা হয়ে নতজানু হলেন, করজোরে প্রার্থনা করলেন, "চন্দ্রকলা পুষাকে উদ্ধার করতে আমাদের সাহায্য করুন"।

"সমুদ্র মন্থনের পরে আমার কর্ম ক্ষমতা অবশিষ্ট নেই। "

"আপনি প্রাজ্ঞ,‌ আপনার পরামর্শ মুল্যবান, তাই তো ভগবান কৃষ্ণ আপনার কাছে সাহায্য আবেদন করেছেন।"

বাসুকির ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হলো। বাসুকি নাগমণিকে কৌটো থেকে বার করলেন। নাগমণির জ্যোতি সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। এই নাগমণির জ্যোতি প্রজ্বলিত করে পুষার অবস্থান জানা যেতে পারে। 

"চমৎকার সমাধান, তাহলে এখুনি নাগমণির জ্যোতি প্রজ্বলিত করুন।"

"নাগমণির জ্যোতি প্রজ্বলিত করতে যজ্ঞের ভষ্ম প্রয়োজন। বৈদিক যজ্ঞ সহজ কাজ নয় তার আয়োজন ব্যায় বহুল এবং সময় সাপেক্ষ। প্রচুর লোকবলের দরকার।"

"আপনি নাগমণি নিয়ে দ্বারকায় চলুন সেখানে শ্রীকৃষ্ণ যজ্ঞের ভষ্ম সংগ্রহ করতে পারবেন।"

"দ্বাপর যাত্রা করতে অনেক ধকল, আমার এই দূর্বল শরীর এই ধকল সহ্য করতে পারবে না। ব্রক্ষ্মলোকে গায়ত্রীদেবীর কাছে আবেদন করে দেখি। তিনি কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারেন কিনা। ওর পুত্ররা আমার ছাত্র।"

ওরা ব্রক্ষ্মলোকে উপস্থিত হলেন। ব্রক্ষ্মলোকে জ্ঞানের অন্বেষণ চলে সর্বক্ষণ। মহর্ষি ও দেবর্ষি পন্ডিতগণ তপস্যায় মগ্ন। সয়ং ব্রক্ষ্মা সৃষ্টি কার্যে লিপ্ত রয়েছেন। গায়ত্রীদেবী সবকিছু শুনলেন এবং পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে ওদের সকলকে সাথে নিয়ে চন্দ্রলোকে পৌঁছলেন এবং চন্দ্রদেবকে যজ্ঞ করতে নির্দেশ দিলেন। চন্দ্রদেব দ্রুত যজ্ঞকুন্ড প্রস্তুত করে মহাদেবকে অনুরোধ করলেন দেবতাদের যজ্ঞে নিমন্ত্রণ জানাতে। মহাদেব স্বর্গে শিঙা ফুকে দেবতাদের যজ্ঞে উপস্থিত হতে অনুরোধ করলেন। যজ্ঞের আয়োজন সম্পুর্ন হলো। গায়ত্রীদেবীর পুত্র সনক, সনন্দন, সনাতন, সনৎকুমার যজ্ঞের পুরোহিত নিযুক্ত হলেন। 

যজ্ঞ সম্পুর্ন হওয়ার পর ভষ্ম সংগ্রহ করে বাসুকি নাগমণিকে উজ্জ্বল করে তুললেন। নাগমনি দর্পণের মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠলো। বাসুকি নাগমণির কাছে চন্দ্রকলাদের অবস্থান জানতে চাইলেন। নাগমনির ভিতর একে একে সকল চন্দ্রকলার ছবি ফুটে উঠতে লাগলো যশা, রতি, প্রাপ্তি, ধৃতি,ছায়া, মরীচ, তুষ্টি। পনেরো জন এসে দেখা দিলেন শুধু পুষার ছবি সামনে এলোনা। বাসুকি মন্ত্রবলে নাগমণিকে পুষার ছবি দেখাতে বললেন। নাগমনি একটা অদ্ভুত প্রাণীর ছবি দেখালো। ওরা এমন প্রাণী কখনো দেখেনি। প্রাণীটির একটা ছবি একে দিলেন চন্দ্রদেব। সেই ছবি নিয়ে গায়ত্রীদেবী ব্রক্ষ্মাদেবকে দেখালেন "এই অদ্ভুত প্রাণীটি আপনি সৃষ্টি করেছেন কোথায়?" ব্রক্ষ্মাদেব মাথা নেড়ে জানালেন, "কলিযুগে এই প্রাণীটির উৎপত্তি, মানুষের কাছে এটি কাঁকড়া নামে পরিচিত। কাঁকড়া জলজ প্রাণী। এর মাংস অতি সুস্বাদু।" 

"সর্বনাশ! মানুষ যদি কাঁকড়া রূপে পুষাকে খেয়ে নেয়, তাহলে কেলেংকারীর শেষ থাকবে না। শিঘ্রই পুষাকে উদ্ধার করতে হবে।"

কালবিলম্ব না করে গায়ত্রীদেবীর কথা মতো অনন্তনাগ দ্বারকায় পৌঁছলেন এবং বলরাম সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ শুনলেন। বিষ্ণু দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের সখা সুদামের গৃহে হরিণের সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতে ছিল। বলরাম তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে অনুরোধ করলেন পুষাকে উদ্ধার করতে। বিষ্ণু ওদের অভয় দিয়ে জটায়ুর পিঠে উঠে বসলো। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জটায়ু উড়ে চলছে বিষ্ণুকে নিয়ে। 

একটা শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো বিষ্ণুর, তাহলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখেছে? পোড়াবটতলার চাতালে বসে বসে কখন চোখ বুজে গেছিল টের পায়নি বিষ্ণু। কিসের শব্দ হলো? বিষ্ণু উঠে সেটা দেখতে গেল। সাধু মহারাজের কুটির থেকে শব্দ আসছে।কুটিরের দরমার দরজা ঠেলা দিতে খুলে গেল। শেকল দেওয়া ছিল ভিতরে বিষ্ণু শেকল খুলে কুটিরে প্রবেশ করলো। একটা টিনের বালতির মুখে কাঠের পিড়ে তার উপর ইট চাপা দেওয়া রয়েছে আর শব্দ আসছে বালতির মধ্যে থেকে। বিষ্ণু ইট সরিয়ে পিড়েটা নামালো। বালতির ভেতর একটা বড়ো মাপের কাঁকড়া ছটফট করছে। বিষ্ণু তাড়াতাড়ি বালতিটা নিয়ে মন্দিরের পুকুরে কাঁকড়া টা ছেড়ে দিল। এবার বিষ্ণুর বাড়ি ফেরার উচিত দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে স্কুল ছুটির সময় হয়েছে। বিষ্ণু ধীরে ধীরে বাড়ির পথ পা বাড়ালো।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics