প্রবর্তন
প্রবর্তন
শশীর সকালে ঘুম ভেঙেছে খানিক বেলা করেই। নিমের কাঠি দিয়ে দাঁতন সেরে, পাড়ার মোড়ের কর্পোরেশনের কলের জলে মুখ ধুয়ে, কোমরের গামছায় মুখ পুছে, ঝরুদার চায়ের গুমটির কাঠের বেঞ্চিতে বসে একমুঠো ভাঙা বিস্কুট বাটি থেকে তুলে নিয়ে এক ভাড় চা নিজেই ঢেলে নিয়েছে অভ্যাসমতো। ঝরুদা দোকান রেখে প্রয়োজনে বাইরে গেলে শশী খানিক দোকানদারি করে ঝরুদাকে সাহায্য করে দেয় তাই শশীর দু'বেলা চা ঝরুদার দোকানে বাঁধা। ঝরুদার গুমটিতে খৈনী গুটকা বিড়ি পাওয়া যায়। দোকানে কেনাবেচা ভালোই হয়। শশীর কোনো নেশা নেই। চা খেয়ে খানিকক্ষণ বেঞ্চে বসে আছে। এরপর শশী বিপুলদার গ্যারেজ দিকে যাবে। এবার ঝরুদা কথা বললে "দুধয়ালা খুব দেরি করছে আজ, একবার দেখা করে তাড়া দিয়ে যাস শশী"। শশী ঘাড় নেড়ে উঠে পড়ে। যাওয়ার পথে খাটাল ঘুরে দুধয়ালাকে দুধ দিতে বলে বিপুলদার গ্যারেজে পৌছল। গ্যারেজের কাজ শশীর খুব পছন্দ, টুকটাক যন্ত্রপাতি নিয়ে নিজেও হাত লাগায়। গ্যারেজে নতুন গাড়ি এলে নেকড়া দিয়ে পুছে দেয়। এলাকায় যাদের গাড়ি আছে তাদের সকলকেই চেনে শশী। দুই জন মেকানিক আছে গ্যারেজে তাদের সঙ্গে শশীর সুখদুখের কথাবার্তা হয়। গাড়ি সারাই হয়ে গেলে টেষ্ট ড্রাইভে শশী ড্রাইভারের সঙ্গে যায়। বিশেষ করে বাইকের হাইস্পীড শশীর খুব পছন্দ। একটা আলাদা আনন্দ পায় শশী বাইক চালাতে।
একটা ইঞ্জিন খুলেছে বিপুলদা সেটাই দেখছিল শশী পিছন থেকে গাবলুদার ডাক শুনে ঘুরে তাকালো গাবলুদা ডাকছে। গাবলুদা মানেই পার্টির কাজ, ঝান্ডা মিছিলে লোক জোগাড়, দেওয়াল লিখন আর ছোট খাটো পাড়ার ঝামেলায় নাকগলানো। শশী এগিয়ে গেল গাবলুর সঙ্গে। বড়রাস্তার বাসস্টপের পাসে একটা ছোট ঘরে গাবলুদের পার্টি অফিস, এখন টিভিতে ক্রিকেট খেলা চলছে কয়েক জন ছোকড়া বসে খেলা দেখছে। গাবলু আর শশী ঢুকলো ঘরে, এখনো দাদা গোছের কেউ নেই। আসবে বোধহয়, তাই গাবলু শশীকে ডেকে এনেছে। গাবলু শশীকে বলল "আজকে শম্ভুদা ওদের পার্টি অফিসে থাকতে বলেছে"। শম্ভুদা লোকাল কাউন্সিলর। বিকেলে চঞ্চল মিত্রর শোক সভার মিটিং আছে মিউনিসিপ্যালিটির হলে। সেখানে ডিএসপি এবং ডিএম আসবে। ফুলের মালা ও ফুলের তোড়া জোগাড় রাখতে হবে। চঞ্চল মিত্র ছিলেন এই অঞ্চলের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা সভাপতি। চঞ্চল মিত্র প্রয়ানে তার অনুগত বাহিনী ভীম চৌধুরীকে নেতা করতে বেপরোয়া চেষ্টা করছে। শম্ভুদা আন্দাজ করেছে আজকের মিটিংয়ে ভীম চৌধুরী ও তার দলবল গন্ডগোল করতে পারে। শশীকে সাথে নিয়ে গাবলু শম্ভুদার নির্দেশ মতো ফুল, মিষ্টির প্যাকেট, মিনারেল ওয়াটার এনে অফিসে রাখলো। পার্টির কাজ থাকলে শশী খুশি হয় পেট ভরে বিরিয়ানী খাওয়া যায়। আজকে সারাদিন শম্ভুদার সঙ্গে থাকতে হবে। সাতটায় মিটিং শুরু। সাড়ে সাতটার মধ্যে আস্তে আস্তে গেস্টরা সব চলে এসেছে। ভীম চৌধুরী ও তার দলবল রয়েছে। শশী গাবলু গেস্টদের দেখভাল করছে ভলেন্টিয়ার ব্যাজ লাগিয়ে। চঞ্চল মিত্রর একটা বড় ছবি লাগানো হয়েছে, ফুলের মালা দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে একমিনিট নিরবতা পালন করা হয়েছে। একে একে সবাই বক্তব্য রাখছেন অনুষ্ঠান চলছে মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যান প্রবীর চক্রবর্তী বলতে উঠলেন তখন ভীম চৌধুরী ও তার চেলারা স্লোগান দিতে শুরু করলো অনুষ্ঠানের ছন্দপতন। চেয়ারম্যান প্রবীর চক্রবর্তীকে উত্তেজিত করে তার বক্তব্য ভন্ডুল করে দেয়া হলো। প্রবীর চক্রবর্তী রাজনীতিতে পোড় খাওয়া লোক, আমন্ত্রীত অতিথিদের সামনে কোনো সংঘাতের পথে পা দিলেন না। বক্তৃতা বন্ধ করে দিয়ে বসে পড়লেন। ডামাডোলে অনুষ্ঠান তাড়াতাড়ি শেষ হলো। এর কয়েক মাস পর ভীম চৌধুরী মোটোরবাইক করে বাড়ি ফেরার পথে কিছু লোক ভীমকে লাঠি শাবল দিয়ে পিটিয়ে মারলো। খবরের কাগজে লিখেছে দলীয় অন্তর্দন্দ্ব। দলের কর্মীরাই ওকে পিটিয়ে মেরেছে। পুলিশ এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে।
কথাতে আছে কালিঠাকুর জলে পড়লে শীতের শুরু হয়। এসময় শিশির পড়ে সকালে বিকালে। বাতাস ঠান্ডা হতে শুরু করে। বাজারে শীতকালীন সবজির আমদানি হয়। এভাবেই বড়দিন এগিয়ে আসে। বাঙালি কমলালেবু, জয়নগরের মোয়া, নলেনগুড়ের সন্দেশের সাথে কেক পেস্ট্রি নিয়ে চিড়িয়াখানা বা ইকোপার্কে ভীড় করে। শশীদের পাড়ার এলাচ সাহেবের নিজের বাড়িটা চুনকাম করে পরিস্কার করে ডিসেম্বর মাসে। যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষ। এলাইজা থেকে অপভ্রংশ এলাচ সাহেব লোকে বানিয়ে দিয়েছে। এলাচ সাহেবের বাড়িটা বড়দিন উপলক্ষে টুনিলাইট আর রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়। লাল টুপি পরে, সাদা দাড়ি লাগিয়ে চকলেট বিলি করেন এলাচ সাহেব। এপাড়ায় বড়দিনের সময় পিকনিকে যাওয়ার রেওয়াজ আছে। পিকনিকে বিস্তর খাওয়া দাওয়া নাচ গান হৈচৈ হয়। শশী ক্রীসমাস ফেস্টিভ্যাল দেখতে কলকাতার আংলোপাড়া বো ব্যারাকে যায়। পঁচিশ ডিসেম্বরের পার্কস্ট্রিটের আলোকসজ্জা এবং সেন্ট ক্যাথিড্রাল চার্চের মিডনাইট ক্যারল শশী প্রিয় উৎসব।
প্রতি বছরের মতোই পঁচিশে ডিসেম্বরের রাতে পার্কস্ট্রিটে ক্রীশমাসের আনন্দ শেষ হলে মেট্রোস্টেশনের কাছে একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে চায়ের জন্য অর্ডার করেছিল শশী। বেঞ্চে কয়েকটি ছেলে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। শশী কান খাড়া করে শুনতে থাকলো ওদের কথাবার্তা। কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পারলো এরা বিভিন্ন রকম আডভেঞ্চার ভিডিও রেকর্ডিং করে। হুগলি ব্রিজ থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে সেই আডভেঞ্চার মোবাইল ক্যামেরায় রেকর্ড করা ওদের এখনকার প্লান। ছেলে গুলো প্রায় শশীর সমবয়সী। শশীর ওদের দলটা খুব পছন্দ হলো। এদের দলে ভীড়তে চেয়ে, "একদিন না একদিন সবাই মরবে, আজকে মরলে কি সমস্যা" শশী হিরোদের মতো বললো। উসমান এই দলটার নেতা শশীর কথায় খুশি হলো। স্টান্ট বাজিতে আলম বেশ বেপরোয়া। আলমের সাথেও শশীর বন্ধুত্ব হলো। শশী ওদের তৈরী কিছু ভিডিও দেখলো। তীব্র গতিতে ছুটে আসা রেলগাড়ির সামনে দিয়ে ভল্ট দিচ্ছে আলম। ওদের দল খতরো কি মহাখিলাড়ি। খিদিরপুরে সুভাষ কলোনীতে ওরা থাকে। শশী ওদের সঙ্গে খিদিরপুর এলো ।
উসমান ঠিক করেছে ব্রীজের উপর থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দেবার ভিডিও রেকর্ডিং করবে কিন্তু সেতুতে পথচারীদের ওঠার অনুমতি নেই। পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে কি করে সেতুর মাঝখানে পৌঁছনো যাবে ছয় সাত জনের একটা দল নিয়ে সেটাই আলোচনা হচ্ছে। মাঝে মাত্র চারটি দিন। রবিবার খেলা হবে। খুব করে অনুশীলন চলছে। সকলের মধ্যে চাপা উত্তেজনা সবাই আবেগে ভাসছে আলমকে নিয়ে। জীবন বাজি রাখার খেলা "খতরো কি মহাখিলাড়ি"। প্রবল উৎসাহ কিন্তু সেতুর উপর মাত্র পাঁচ জন যাবে। কয়েক জন ব্রীজের দুদিকে পুলিশের উপর নজর রাখবে। শশী ওদের দলে মিশে গেছে ওর মনেও খুব উত্তেজনা। আলমের অন্য ভিডিও গুলো বেশ গাঁয়ে কাটা দেয় ওদের চ্যানেলের প্রায় দশ লক্ষ সাবস্ক্রাইবার। ব্রীজের উপর থেকে কোনো লাইফ সাপোর্ট ছাড়াই গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে আলম এগিয়ে যাচ্ছে। উসমান পুরোটা ভিডিও রেকর্ডিং করেছে।
শশী দেখলো এদের কেউ কেউ বিভিন্ন চ্যাটিং এপ্লিকেশন ব্যবহার করে লোকজনের কাছ থেকে টাকা পয়সা আদায় করে। মহিলাদের নামে ফেক প্রোফাইল তৈরি করে আলাপ পরিচয় পাতায়। পরিচয় যখন ঘনিষ্ঠ হয় তখন ভিডিও কল করে মহিলাদের নুড পিকচার দেখায় এবং স্ক্রিনশর্ট তুলে সেই স্ক্রিনশর্ট সোশ্যাল মিডিয়া তে ছড়িয়ে দেওয়ার নামে ব্ল্যাকমেল করে। আগে একবার খিদিরপুরের বাস্কুল ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে এক যুবক ডকের জলে তলিয়ে গেছে। পুলিশের খাতায় অনেকের নাম আছে। এই দলের রকবাজী করার অভিজ্ঞতা আছে।
সুভাষ কলোনীর গলির মুখে পিচের রাস্তায় শেখর দাস বিধায়ক কিন্তু এবার দলের টিকিট পায়নি। ওর ভাই প্রখর দাস ঠিকাদারি করে। এখন ঠিকাদারিতে অনেক টাকা। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা শ্রমিকদের ঠিকাদারের মাধ্যমে চুক্তির ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগ করে। বস্তির কম বয়সী ছেলেদের কাজে পাওয়া যায় সহজেই তাই এদের কিছু কম টাকা দিলেও চলে। আট ঘন্টার বদলে এরা দশ বারো ঘন্টাও কাজ করে দেয়। খবরের কাগজে প্রায়ই খবর দেখা যায় নর্দমা সাফাই করতে গিয়ে শ্রমিকের মৃত্যু। এই নিয়ে সমাজের কোনো মাথাব্যথা নেই। এবারের ভোটে শেখর দাস টিকিট পায়নি ফলে তিনি ও তাঁর অনুগামীদের ক্ষোভ তৈরী হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে বস্তির গলিতে এগারোটা বোমা পড়েছে । বোমার স্প্লিন্টারে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে দুটি শিশু আঘাত পেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অশান্তি ছড়িয়েছে সুভাষ কলোনীতে। স্থানীয় লোকজন পুলিশকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখিয়েছে এই ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক যোগ রয়েছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করেছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে দু'দলের দুস্কৃতিদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় বোমা পড়েছে। বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছে।
শশী কাকভোরে বেরিয়ে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে নিজের বাড়ি ফিরে এলো প্রায় সপ্তাহ দুয়েক নিজের এলাকায় ছিল না। ঘরে ঢুকে খাটিয়ার উপর বসে পড়লো। তারপর একটা বস্তা গায়ে টেনে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। গতকাল রাতে ঘুমাতে পারেনি। ভয়ে ভয়ে ছিল নতুন ছেলে দেখে যদি পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। কতক্ষন ঘুমিয়ে ছিল মনে নেই গাবলুর ডাকে ধড়পড় করে উঠে বসলো। গাবলুর সাথে বিপুলদার গ্যারেজে চললো হাইওয়ের পাশে লরি দাঁড় করিয়ে লরিড্রাইভারা কাঠকুটো জ্বেলে রান্না করে গাবলুওদের মাল সাপ্লাই দেয়। কয়েকটি বোতল নিয়ে ওরা সেদিকে চললো।
যতিনের শ্বশুরঘর স্টেশন সংলগ্ন বস্তিতে, দরমা আর টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি ঝুপড়ি গুলোতে গোটা পঞ্চাশেক পরিবারের বাস। এই বস্তির লোকজন পেশায় রিক্সা চালক অথবা রাজমিস্ত্রিদের সাথে জোগাড়ের কাজ করে। মহিলারা গৃহপরিচারিকার কাজ করে। যতিনের শাশুড়ি লোকের বাড়িতে থালাবাসন মেজে রোজগার করে। ওর ঘরের পাসেই ওদের একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, কোনরকম মাথা গোঁজার মতো। এই বস্তিতেও ঘর নিতে গেলে পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। যতিনকে টাকা দিতে হয়নি। যতিন ঠিক করেছে আর নিজের গ্রামে ফিরে যাবে না। যতিনের বৌ মিতালীও তাই চায়।
এবারের বন্যায় যতিনদের গ্রামের চরম ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবার বর্ষায় ওদের গ্রাম ভেসে যায়। যতিনের বাবা পেশায় ছিলেন মৎস্যজীবী, তার একটা নিজের নৌকা ছিল। যতিনরা তিন ভাই মাছ ধরার কাজে বাবাকে সাহায্য করতো। পঞ্চায়েতের ইটের রাস্তা পেরিয়ে ওদের গ্রামে ঢোকার একটা বাঁশের সেতু। সেইটা ভেঙে গেলে গ্রামবাসীদের জলবন্দি হয় থাকতে হয়। বর্ষায় গ্রাম ভেসে যায় গবাদিপশু মরে যায়। এখন সরকার থেকে ত্রাণ পাঠায় কিন্তু তাতে দুর্ভোগ কমেনা। যতিনের বাবা গতবছর মারা গেছেন যতিনের জীবিকার্জনের পথ একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। সুন্দরবনের মানুষ প্রধানত চারটে জিনিসের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে ধান , পান , শাকসবজি আর মাছ। গত কয়েক বছর ধরে সামুদ্রিক ঝড়ের প্রবল দাপটে সবগুলোই ক্ষতির মুখে। একেরপর এক বাঁধ ভেঙেছে নদীর জল ঢুকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলমগ্ন। মাছের আড়ত গুলো আস্ত নেই। নৌকা, দোকান, মানুষে গমগম করা সমুদ্র সৈকত এখন শুনশান। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গবাদিপশুর মৃতদেহ, ইট কাঠ সিমেন্টের ভেঙে পড়া বাড়ির সারি। যতিন ঠিক করেছে গ্রামে আর ফিরে যাবে না। গ্রামে এখন ওদের ভাত জোটানোর কাজ নেই। এই অঞ্চলে দিনমজুরি করে কোনো রকমে টিকে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বৌ মিতালী লোকের বাড়ি বাসনধোয়ার কাজ নেবে। করিম চাচার সাথে কথা বলেছে যতিন। শনিবার করিম চাচা যতিনকে নিয়ে গেছিল ঠিকাদারের কাছে। ঠিকাদার যতিনকে কাজের জন্য অন্য রাজ্যে পাঠাতে চাইছে ।
আজকে সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা, বেলা গড়াবার আগেই কালো করে বৃষ্টি নেমেছে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশ গর্জন করছে। যতিন মিতালী খুব কাছাকাছি। গত ছয় বছরে ওরা কখনো পরস্পরকে ছেড়ে কোথাও যায়নি। যতিন উত্তরাখণ্ড পাড়ি দেবে। একটা ব্রিজ তৈরি করার জন্য কিছু শ্রমিক সোমবার ঠিকাদার উত্তরাখণ্ড পাঠাচ্ছে যতিন সেই দলের সঙ্গে যাবে। আপাতত ছয়মাসের চুক্তি। যতিন আর মিতালী স্বপ্ন দেখছে দুই জন গতরে খেটে কিছু টাকা জমাতে পারলে নিজেদের একটা স্থায়ী ঠিকানা তৈরী করা যাবে, এই অনিশ্চিত জীবন থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
সোমবার যতিন চলে গেছে। মিতালী কাজের খোঁজ করছে। বিন্দুমাসী দীর্ঘ দিন ধরেই সুভাষ কলোনীর দাসবাড়িতে পরিচারিকা। শেখর দাসের মা বিছানায় পড়েছেন কিছু দিন হলো, তার মায়ের দেখাশোনা করার জন্য সারাদিনের মহিলা দরকার। মিতালী বিন্দুমাসীর সঙ্গে দাসবাড়িতে হাজির এসেছে কাজ চাইতে। শেখর দাসের গিন্নী মাসিক ছয়হাজার টাকায় খাওয়াপরার কাজে মিতালীকে কাজে রাখলেন শাশুড়ির দেখাশোনার জন্য।
শান্তিবালাদেবী শ্বশুর বাড়িতে এসেছিলেন চোদ্দবছর বয়সে প্রায় বাহান্ন বছর আগে। এতোদিন গুছিয়ে পরিপাটি করে সংসার চালিয়েছেন। গত বৈশাখী পুর্ণিমার দিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন স্ট্রোকে। কোমরের নীচের অংশ পড়ে গেছে তাই বিছানা শোয়া প্রায় দুই মাস নার্সিংহোমে ছিলেন। দুই ছেলে, ছেলেবৌ, নাতি, নাতনী নিয়ে ভরা সংসার। নার্সিংহোমে থাকতে ভালো লাগছিলো না তাই ছেলেরা বাড়িতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। বেশ বড় দোতলা বনেদি বাড়ি "দাস ভিলা"। শান্তিবালাদেবীর শ্বশুর মশাই ছিলেন ডাকসাইটে লোক। বাজারে একটা বড় হার্ডয়ারের দোকান ছাড়াও লরির ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। এবাড়ি তারই তৈরী। বড়ো লোহার ফাটকে বড়ো বড়ো করে লেখা ভবেন্দ্রনাথ দাস ও ননীবালা দাস। লোহার ফাটক পেরিয়ে বাগানের ভেতর দিয়ে এসে সদর দরজা। বাগানে আম জাম কাঁঠাল নারকেল সুপারি বেল গাছ আর ফুলের মধ্যে জবা শিউলি পদ্ম টগর নিত্ পুজোর ফুলের জন্য। এবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত পাথরের শিব আর কালিমন্দির আছে। প্রতি পুর্ণিমা ও অমাবস্যায় অবনীঠাকুর পুজো করে যান। ননীবালাদেবী শেখর দাসের ঠাকুমা, তার সময় থেকেই এই ব্যবস্থা চলছে। ননীবালাদেবী শান্তিবালাকে নিজের বাবার বাড়ির গ্রাম থেকে পুত্রবধূ করে নিয়ে এসেছিলেন। নিজের মেয়েদের মতোই স্নেহ করতেন। ননীবালাদেবীর দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন দুর্গাপুরে গুরুদেবের পছন্দ করা পাত্রদের সঙ্গে।
দাসবাড়ির বসার ঘরে সন্তকবি সুরদাসের একটা ছবি আছে। ভবেন্দ্রনাথ দাসের বড় জামাই বিজয় উত্তরপ্রদেশের থেকে ছবিটা নিয়ে এসেছিলেন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিজয়শংকর পাল সুরদাসের ছবিটা শান্তিবালাকে উপহার দিয়েছিলেন। জন্মান্ধ সুরদাস হিন্দিভাষায় পদরচনা ও সংগীত রচনা করতেন। বৈষ্ণব ধর্মগুরু বল্লভাচার্যের অনুরাগী সুরদাস কথিত ভক্তিমার্গটি হল পুষ্টিমার্গীয় ভক্তি। সুরদাসের কাহিনী শান্তিবালাকে বলেছিলেন বিজয়। শান্তিবালার সাথে তার দুই ননদের সম্পর্ক ছিল মধুর। ছোটননদ তুলসী আর শান্তিবালা সমবয়সী ছিলেন। উত্তমকুমারের বাংলা সিনেমা তুলসীর প্রিয় মনোরঞ্জন ছিল। ভবেন্দ্রনাথ বায়োস্কোপের ভক্ত ছিলেন তাই এবাড়িতে সিনেমা থিয়েটারের চলন ছিল। ভবেন্দ্রনাথ তার ঘরে কাননদেবী, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যালদের ছবি টাঙিয়ে রেখেছিলেন। রাইচাদ বড়াল ও পঙ্কজ মল্লিকের গানের রেকর্ড আছে এবাড়িতে। নিউ থিয়েটার হলে সপ্তান্তে একবার ভবেন্দ্রনাথ যেতেনই। এটাই ছিল তার নেশা । ১৯৫১ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া মারা যান সেই বছরেই ওর পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছিল। ভবেন্দ্রনাথ ছেলের নাম রেখেছিলেন প্রমথনাথ দাস। প্রমথনাথের সঙ্গে শান্তিবালার বিবাহ হয়। শান্তিবালা বিয়ে হয়ে এসে ছোটননদ তুলসী ও বড়ননদ গঙ্গাকে বন্ধু মতোই পেয়েছেন। বড়ননদের দেড়বছরের ছেলে বিশ্বাবসু তখন একপা দুপা করে হাঁটতে শিখেছে। দাসবাড়িতে তখন বিশ্বাবসুর ভীষণ আদর সকলেই ওকে নিয়ে আনন্দে আত্মহারা। ভবেন্দ্রনাথ দাস ও ননীবালা বিশ্বাবসুকে নিজেদের কাছে রেখে বড় করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বিশ্বাবসুর বাবা বিজয় ছেলেকে মামারবাড়ীতে রাখতে রাজি হননি। নিজের মনের মতো করে বড় করেছিলেন বিজয় বিশ্বাবসুকে। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের রিপোর্টার হয়েছিল বিশ্বাবসু। তরুণ সাংবাদিক বিশ্বাবসু শ্রীলঙ্কায় তামিল জঙ্গিদের সাথে সেনাবাহিনীর যুদ্ধের সময় দুইপক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যায় এবং নিহত হয়। ওর তোলা যুদ্ধের ছবি আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কয়েক দিন নিখোঁজ থাকার পর জানা যায় সাংবাদিক বিশ্বাবসু নিহত হয়েছে। বিশ্বাবসুর মৃতদেহ রেড ক্রসের সহায়তায় ওদের পরিবার হাতে পৌঁছে ছিল। সে এক মর্মান্তিক ঘটনা।
বিশ্বাবসুর মৃত্যু ভবেন্দ্রনাথ সইতে পারেননি ছয়মাসের মধ্যে পরলোকে যাত্রা করেছিলেন। শেষের কয়েকমাস একেবারেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর ননীবালাও বেশি দিন বেঁচে থাকেননি। একবছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন। প্রমথনাথ বাবা বেঁচে থাকাকালীন ব্যবসার কিছুতেই মাথা ঘামাতেন না, শুধু দোকানে বসতেন। হার্ডয়ারের দোকান ছাড়াও ভবেন্দ্রনাথে অনেক বড় ব্যবসা ছিল। ভবেন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতে সেসব বেহাত হয়ে যায়। প্রমথনাথের দুই ছেলে শেখর ও প্রখর তখন কলেজে পড়ছে। ভবেন্দ্রনাথ প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন সেই কারণে প্রমথনাথ কোনো সমস্যায় পড়েননি আজীবন স্বচ্ছল ও স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন করেছেন। বছর সাতেক আগে হঠাৎই স্ট্রোকে মারা গেছেন প্রমথনাথ। বাজারে হার্ডয়ারের দোকানটা এই অঞ্চলে বেশ নামকরা বড় দোকান। শেখর পড়াশোনা শেষ করে ব্যবসার হাল ধরেছিল তবে রাজনীতি শেখরকে দলে টেনে নিয়েছে বর্তমানে প্রখর ব্যবসা দেখাশোনা করে। প্রখর ঠাকুরদা ভবেন্দ্রনাথ দাসের ধাঁচে গড়া। দোকানের সাথে সাথে ঠিকাদারি ব্যবসায় উন্নতি করেছে। শান্তিবালা তার ছেলের বৌদের গৃহবধুই রেখেছেন। ব্যবসা বা রাজনীতি কোনো কিছুতেই ছেলেবৌদের অংশ নিতে দেননি। বড় ছেলে শেখরের বৌ কমলা এবং ছোট ছেলে প্রখরের বৌ অতসী দুজনেই শিক্ষিতা বিএ পাস। তুলসীর ননদের মেয়ে কমলা। তুলসী নিজের ভাইপো শেখরের সাথে কমলার বিয়ে ঠিক করেছিল। প্রখর অতসী ভালোবাসা করে বিয়ে করেছে।
কমলা দাস বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছে বাইশ বছর হলো। একটা দুটো করে চুলে রূপালী রং লাগছে। নীলাদ্রি এগারো ক্লাসের ছাত্র ICSE board পরীক্ষায় 97% নাম্বার নিয়ে পাস করেছে। সামনের বছর ISC পরীক্ষা দেবে। নীলাদ্রির স্কুল ও লেখাপড়ার জন্য সারাদিন কমলার সময় চলে যায়। ছেলের স্কুল এবং টিউশন সবকিছুই কমলার দায়িত্ব। বাড়িতে ঠাকুর চাকর আছে তারা এতদিন শ্বাশুড়ি শান্তিবালার নির্দেশে কাজকর্ম করেছে কিন্তু শান্তিবালা অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যা নিয়েছেন এখন কমলা আর অতসীকে সবদিকে নজর রাখতে হচ্ছে। অতসীর ছেলে হিমাদ্রী ক্লাস সেভেনে আর মেয়ে তিয়াসা ক্লাস টু তে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে তুলে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে কমলা আর অতসী হিমসিম খায়। প্রখর নিজের গাড়িতে বাচ্চাদের স্কুলে ছেড়ে দিয়ে কাজে বেরিয়ে যায়। ফেরার সময় কমলা বা অতসী গিয়ে ওদের স্কুল থেকে নিয়ে আসে। তিয়াসার স্কুল ছুটি হয় দুপুর সাড়ে বারোটার সময় নীলাদ্রি আর হিমাদ্রী, ছোট করে নিলু আর হিমুর স্কুল ছুটি হয় দুপুর দেড়টার সময়। স্কুল থেকে ফিরে একটু রেস্ট নিয়ে নীলাদ্রি টিউটোরিয়াল ক্লাসে যায়। হিমাদ্রীকে একজন প্রাইভেট টিউটর বাড়িতে পড়াতে আসে। তিয়াসাকে অতসী নিজেই পড়ায়। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার জন্য নিলু আলাদা করে টিউটোরিয়াল ক্লাসে কোচিং নিচ্ছে। নিলু আর হিমু দুই ভাই লেখাপড়ায় বেশ ভালো স্কুলে ওদের সুনাম আছে। নিলুর বোর্ডের রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছে । কমলা আর অতসী সন্তানদের নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকে। ওদের সংসারের জন্য বেশি সময় নেই এমনকি টিভি সিরিয়াল বা সিনেমা কিছুই দেখা হয় না। ছেলের স্কুলের বন্ধুদের মায়েদের একটা গ্রুপ আছে, সময় পেলে টেলিফোনে তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করে। এই গ্রুপের মায়েরা সবাই হাউজ ওয়াইফ। প্রথম দিকে স্কুলের পড়াশোনা নিয়েই কথা বার্তা হত, এতো বছর ধরে একই স্কুলে ছেলেরা পড়াশোনা করছে ধীরে ধীরে মায়েদের মধ্যে একটা গাঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। সংসারের বাইরে ওরা নিজেদের সুখ-দুঃখ সেয়ার করে। জন্মদিন বা বিবাহ বার্ষিকীতে ছোটখাটো পার্টি খাওয়া দাওয়া হৈচৈ আনন্দ করে। কমলার বান্ধবী শান্তা আর তপতী। শান্তার ছেলে অনিকেত নিলুর সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে আর তপতীর ছেলে রক্তিম কমার্স নিয়েছে তবে নিলুর সাথেই ICSE পাস করেছে। রক্তিমের জন্মদিনে তপতীর বাড়িতে কমলা আর হিমাদ্রীর নেমন্তন্ন রবিবার সন্ধ্যায়। শান্তিবালা সুস্থ থাকাকালীন এসব নিয়ে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি কমলাকে। তবে বর্তমানে বাড়িতে কমলাকে অনেকটাই সংসারের চাপ নিতে হচ্ছে। অতসী আছে তবে কমলাই এখন বকলমে গৃহকর্ত্রী। শাশুড়ির দেখাশোনার জন্য মিতালীকে নিয়োগ করে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়েছে কমলা। একটা পছন্দ মতো গিফট্ কিনতে হবে রক্তিমের জন্য। আগে হলে অতসীকে নিয়ে কোনো মলে গিয়ে পছন্দ করে কেনাকাটা করা যেত কিন্তু এখন অতসী বা কমলা কাউকে না কাউকে বাড়িতে থাকতেই হবে। একটুখানি পার্লারে যাওয়ার দরকার কমলার কিন্তু সুযোগ করে উঠতেই পারছে না। আত্মীয় স্বজনদের ফোন আসে, তারা শান্তিবালার অসুস্থ শরীরের খোঁজ নেয়, কখনো দেখা করতে আসে, তাদের আপ্যায়ন করতে হয় তাই কমলার এখন একেবারেই সময় নেই। এতোদিন শান্তিবালা নিজেই সংসার দেখাশোনা করে এসেছেন ছেলে বৌদের তেমন দায়িত্ব নিতে হয়নি।
ভবেন্দ্রনাথ যখন মারা গেলেন তখন শেখর কলেজ ছাত্র। কলেজে থাকাকালীন রাজনীতিতে হাতেখড়ি ছাত্রনেতা শেখর দাস। ধীরে ধীরে রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরা। সর্বভারতীয় কেতন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য শেখর দিল্লির নেতাদের ম্যানেজ করে স্থানীয় প্রার্থী হয়ে নির্বাচন জিতে বিধায়ক হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলার উদ্বাস্তুদের তেমন কিছু উন্নতি হয়নি। রেললাইনের ধারে জলাবাদায় দীন দরিদ্র সর্বহারা উদ্বাস্তুদের সরকারি সুফল বিতরণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের বৈতরণী পার করার কাজটি ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে বর্তমানে। রাজ্যের নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রের নেতাদের সমীকরণ বদলেছে একাধিক নেতা নেতৃ বিদ্রোহী হয়েছে। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে শেখর দাস দলের টিকিট পায়নি। রাজ্য জেলা সম্পাদক রাজ্য কমিটির ভাষণে অনুরোধ করেছেন দলের হয়ে প্রচার পরিচালনা করতে। এলাকায় দীর্ঘদিন রাজনীতি করেন শেখর, দলের হয়ে নির্বাচন লড়ার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছেন এই নির্বাচনে কেতন পার্টির ভোটে জেতার সম্ভাবনা কম তাই এই অপসারণ হজম করতে পেরেছেন।
সকালে শেখর পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রীর সাথে একটা মিটিং ঠিক করেছেন। গণেশ টকিজের কাছে ভেঙে পড়া উড়ালপুলের বাকি অংশ ভেঙ্গে ফেলার কাজ শুরু করেছে সরকার। ডায়মন্ড কাটার দিয়ে একে একে উপরের লোহার বিমগুলো নীচে নামিয়ে আনা হবে। পুল ভাঙ্গার কাজে শ্রমিক নিয়োগ করেছে প্রখরের ঠিকাদারি সংস্থা। কাজ চলাকালীন কোনো শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ দেয়ার সরকারি নিয়মে ব্যবস্থা করতে হবে।
রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে শেখর ত্রিফলার জল খায়। তারপর স্নান সেরে ঠাকুরঘরে যায় । প্রতিদিন বাড়ির মন্দিরে মা'য়ের পুজো করে শেখর। মন্দির দেখাশোনা করার জন্য একজন উড়ে ব্রাক্ষণ আছে। সেই সকাল সকাল মন্দির পরিস্কার করে পুজোর জোগাড় করে রাখে। অমাবস্যায় আর পূর্ণিমাতে অবনীঠাকুর পুজো করে, ঐদিন ভোগে খিচুড়ি পাঁচ রকমের ভাজা পায়েস নিবেদন করা হয়। প্রতিদিনের পুজোয় ফল মিষ্টি দিয়ে পুজো করা হয়। পুজো সেরে শেখর দুধ রুটি কলা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারে। কমলা তিনটে রুটি গরম দুধে ভিজিয়ে রাখে তাতে কলা দিয়ে শেখর ব্রেকফাস্ট করা শেখরের প্রতিদিনের অভ্যেস।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে প্রখরের সাথে আর একপ্রস্থ আলোচনা করে নিল শেখর। প্রখর সব কাগজপত্র একটা ফাইল করে শেখরকে দিয়ে দিয়েছে। খাওয়া শেষ করে শেখর শান্তিবালার ঘরে ঢুকে মায়ের পাসে বসে খানিক মায়ের সাথে কথা বার্তা বললো। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে মিটিং এ যাওয়ার জন তৈরি হয়ে নিল।
এক সপ্তাহ হলো মিতালী দাসবাড়িতে কাজ করছে। শান্তিবালা বেশি কথা বলেন না তবে মিতালীকে তার পছন্দ হয়েছে। দাস ভিলায় চাকরদের দোতলায় প্রয়োজন ছাড়া প্রবেশ নিষেধ মিতালীই প্রথম কাজের লোক যে শান্তিবালার ঘরে থাকে। সকালে শান্তিবালা ঘুম থেকে উঠলে মিতালী তাকে মুখ ধুয়ে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিল। সকালে কিছু ওষুধ খেতে হয় অতসী সেগুলো বার করে রেখেছ। মিতালী ওষুধ গুলো শান্তিবালার হাতে দিয়ে জলের গেলাস এগিয়ে দিল। ওষুধ গিলে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন শান্তিবালা। এসময় কমলা এসে শাশুড়িকে দেখে গেল। গুটি গুটি পায়ে তিয়াসা এসে দাঁড়িয়েছে, এখন স্কুলের পোশাক পরে রয়েছে, ঠাম্মামকে অসুস্থ দেখতে একটুও ভালো লাগছে না তিয়াসার। ঠাম্মামের সঙ্গে থাকতে তিয়াসা খুব ভালোবাসে। গল্প শোনা হয়নি কতদিন। শান্তিবালার চোখে জল এসে গেল। মিতালী শান্তিবালার চোখের জল মুছে দিল। এই পরিবারটি মিতালীর বেশ ভালো লেগেছে। মনে মনে মিতালী দক্ষিণরায়কে প্রণাম জানায়। সুন্দরবন অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষের আরাধ্য দেবতা দক্ষিণরায়। মিতালী ওর শ্বশুরভিটেতে রোজ দক্ষিণরায় আর বনবিবির পুজো করত। সুন্দরবনের অধিবাসীরা দক্ষিনরায়কে সুন্দরবন অঞ্চলের অধিপতি বলে মনে করে। বনবিবি, পীর বড়খা গাজী আর দক্ষিণরায়ের কাহিনীর পালাগান এদের সংস্কৃতির অংশ। মিতালী সুর করে এই সব গান গাইতে পারে। মিতালী তিয়াসাকে দক্ষিণরায়ের গল্প শোনায়।