প্রবর্তন (১)
প্রবর্তন (১)
ভবেন্দ্রনাথ ছোট মেয়ে তুলসীর বিবাহ দিয়েছিলেন বৈষ্ণব পরিবারে। তার নিজের বাড়িতে কালিমন্দির আছে। নিয়মিত সেখানে শিব এবং কালির পুজো হয়। ননীবালা এক পরম বৈষ্ণব পরিবারে তুলসীর বিয়ে দিয়েছিলেন বিজয়শংকর এবং গঙ্গার মধ্যস্থতায়। ননীবালার গুরুদেব এই বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন।
বিজয়শংকরের এক নিকট বন্ধু কৃষ্ণদাস গোস্বামীর সাথে তুলসীর বিবাহ হয়। ওদের পরিবারের কেউ মাছ মাংস খেতেন না। বিয়ের পর তুলসীও নিরামিষ খাবার খেতে অভ্যস্ত হয়েছিল। কর্ম সুত্রে দুর্গাপুরে থাকত কৃষ্ণদাস। ওদের আদি নিবাস ছিল নবদ্বীপ।
বিজয়শংকর উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বেড়াচাপায় চন্দ্রকেতুগড়ে গবেষণার কাজে কিছুদিনের জন্য গিয়েছিলেন। কৃষ্ণদাসের সাথে সেখানে পরিচয় হয় বিজয়শংকরের। ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ খননকার্য চালিয়ে একটি প্রাচীন জনপদের সন্ধান পেয়েছে বিদ্যাধরী নদীর পাড়ে। বেশ কিছু টেরাকোটা বা পোড়ামাটির মূর্তি, শিলমোহর , মাটির পাত্র পাওয়া গেছে চন্দ্রকেতুগড়ে। মৌর্যদের আমল থেকে পাল রাজাদের এবং সেন রাজাদের আমল পর্যন্ত নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে এই ধ্বংসাবশেষে। বর্তমানে এই এলাকা ঘন জনবসতি পূর্ণ এবং লোকমুখে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। সার্ভেয়ার কৃষ্ণদাস সরকারের কর্মচারী হিসেবে সেখানে নিযুক্ত ছিলেন। বিজয়শংকর মুগ্ধ হয়েছিলেন কৃষ্ণদাসের বিনয়ী ব্যবহারে। পরে ওদের বন্ধুত্ব আত্মীয়তায় বদলে ছিল।
কৃষ্ণদাস নবদ্বীপের কবিরাজ গোস্বামীর ছেলে। নবদ্বীপ নদীয়া জেলার এক পুণ্য ভুমি। শ্রীচৈতন্যের জন্মস্থান। বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে এই স্থানের নাড়ীর যোগ। শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের পর গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মে বহু গোষ্ঠী তৈরী হয়। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে এরা মঠ মন্দির স্থাপন করেন। কবিরাজ গোস্বামীর বাড়িতে মঠ না থাকলেও এরা বংশ পরম্পরায় রাধাকৃষ্ণের পুজারী। ভবেন্দ্রনাথ খুশি মনেই তুলসীকে সম্প্রদান করেছিলেন কৃষ্ণদাসের হাতে।
ওদের নবদ্বীপের বাড়িতে দোল উৎসব এবং রাস উৎসব খুব ঘটা করে উদযাপন করা হতো। সেই উপলক্ষে গঙ্গা এবং শান্তিবালা ছেলেদের নিয়ে তুলসীর বাড়িতে যেত। তিনদিন ধরে উৎসবে রাধাকৃষ্ণের পুজো এবং হরিনাম সংকীর্তন হতো। তুলসীর দু' ননদ বর্ধমান থেকে আসতো। খুব আনন্দ করতো ওরা সবাই। কবিরাজ গোস্বামী পন্ডিত মানুষ ছিলেন। রামায়ণ মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনীর বর্ণনা শুনিয়ে ছিলেন ওদের। পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলো বলতেন এবং নীতি শিক্ষার জন্য কি করা উচিত বা উচিত নয় বুঝিয়ে দিতেন।
ওদের গ্রামে একটি বড় দীঘি ছিল অনেক অলৌকিক ঘটনার জনশ্রুতি ছিল সেই দীঘি নিয়ে। লোকে বলতো দীঘিতে পূর্ণিমার সময় শ্রীকৃষ্ণ এবং তার অষ্টসখি জাগ্রত হন এবং লীলা করেন। সেই সময় সেখানে যাওয়া নিষিদ্ধ। একটি বড় সাপ দীঘি পাহারায় থাকে কোন জীবিত মানুষ সেখানে গেলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। দীঘিটি খুব গভীর আর নির্জন। দিনের বেলাতেও দীঘির ধারে গেলে গা ছমছম করে।
নদীয়ার মাটি সুজলা সুফলা প্রায় সবার বাড়িতেই আম, কাঁঠাল, সফেদা, পেয়ারা, বেল, কুল, নারকেল,সুপারি, গাছের মেলা। কবিরাজ গোস্বামী যখন কথকথা করতেন তুলসী ধামা ভোরে মুড়কি নাড়ু সামনে রেখে দিত। সকলে সেই ধামা থেকে মুড়কি নাড়ু খেতে খেতে কথা শুনত। কীর্তনের আসরেও তুলসীর হাতে তৈরী মুড়কি নাড়ুর সমাদর ছিল।
দোল পুর্ণিমার সময় মন্দিরের মাঠে মেলা বসতো। সারারাত যাত্রার আসর বসতো। সেই যাত্রা দেখার জন্য সারাবছর অপেক্ষা করতো ওরা। বেশ হৈচৈ করে কেটে যেত তিনদিন। উৎসব শেষ সকলে নিজের নিজের জায়গায় ফিরে যেত।
কৃষ্ণদাস ভুমি জরিপের কাজের সাথেই কার্টোগ্রাফি এবং কার্টোগ্রাম নিয়ে পড়াশোনা করতেন। কৃষ্ণদাস মনে করতেন মানচিত্র মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মানচিত্র হলো ব্যাবিলনীয় মানচিত্র। পৃথিবী পরিমাপের জন্য জ্যোতির্বিদ টলেমি প্রথম একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন। আমাদের ভারতে মুঘল সম্রাটরা রাজস্ব আদায়ের একক হিসাবে মৌজা তৈরি করেছিলেন। কতগুলো মৌজা মিলে তৈরি করা হতো পরগণা।
মানচিত্র থেকে কোনো দেশের স্থলভাগ, নদীপথ, সমুদ্রসীমা ইত্যাদি জানতে পারা যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জনসংখ্যার ঘনত্ব, গড় বৃষ্টিপাতের তারতম্য, সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে বিভিন্ন অঞ্চলের উচ্চতার পার্থক্য ইত্যাদি বোঝাতে মানচিত্র প্রয়োজন হয়। জরিপের কাজের জন্য কৃষ্ণদাস বিভিন্ন অঞ্চলে যেতেন। ভারতের আদমশুমারি মৌজা ভিত্তিতে তৈরি করা হয়। মৌজা হলো ছোট ছোট ব্লক বা উপজেলাতে কতটুকু পরিমাণ জমি আছে তার পরিমাপ।
কবিরাজ গোস্বামী তার এক শিষ্য বাড়িতে গিয়ে অসুখে পড়েন ভেদবমি শুরু হয় এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর শোকে কৃষ্ণদাস অস্থির হয়ে পড়লে সেই সুযোগে কৃষ্ণদাসকে ঠকিয়ে ওদের জমি বাড়ির দলিল ওর কাকা হস্তগত করে। ভবেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন মামলা করে সেসব উদ্ধার করতে কিন্তু কৃষ্ণদাস রাজি হয়নি। কৃষ্ণদাস পাকাপাকি ভাবে পরিবার নিয়ে দূর্গাপুর চলে যায়।
প্রমথনাথ বেশ সৌখিন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। ভবেন্দ্রনাথের মতো তার ব্যবসা বুদ্ধি না থাকলেও দোকানের কর্মচারীদের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় তাকে কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। থিয়েটারের নেশা ছিল প্রমথনাথের। নিজেও অভিনয় করতেন, বন্ধুদের নিয়ে একটা নাটকের দল খুলে ছিলেন। নাটকের দলের নাম ছিলো "সখের মঞ্চ"। বড়োদিনের ছুটির সময় টানা সাতদিন সখের মঞ্চের উদ্যোগে নাটকের উৎসব হতো টাউন হলে। বিজয় শংকর, কৃষ্ণদাস সপরিবারে আসতো এই নাটকের উৎসব দেখতে। দাসবাড়িতে ভীড় লেগে যেত। প্রমথনাথ নাটকের দলের সাথে দেশ ভ্রমণে যেতেন মাঝে মাঝে। ভবেন্দ্রনাথের কড়া ধাঁচের জন্য প্রমথনাথ বাবাকে সমীহ করতেন। বাড়ির বাইরে বন্ধুদের আড্ডায় বিলিতী মদ অল্পস্বল্প খেলেও বাড়িতে গোপন করতেন। একবার মধুপুর গিয়ে নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশে একটা বাংলোবাড়ি খুব পছন্দ হয় ওর, ঠিক করেন বাড়িটা কিনবেন কিন্তু ভবেন্দ্রনাথের অমতে তার সে ইচ্ছে পুরন হয়নি। একটা বড় থিয়েটার হল বানানোর ইচ্ছাও ছিল সেখানেও ভবেন্দ্রনাথ অমত করেছিলেন।
"সখের মঞ্চ" নাটকের দলের ছেলেরা সামাজিক নাটক করতো। পৌরাণিক কাহিনীর চরিত্রদের মুখে বর্তমান সময়ের নানারকম কুনাট্য নিয়ে সংলাপ তৈরি করা হতো। নাটকের সেট বানানোর জন্য নিজেরা রাত জেগে পরিশ্রম করতো। নাটক মঞ্চস্থ করা বেশ খরচ সাপেক্ষ ব্যাপার বেশিরভাগ খরচই প্রমথনাথ করতেন। টিকিট কেটে নাটক দেখার লোক বেশি নেই মফস্বল শহরে। হলে প্রবেশ অবাধ রাখার জন্য অনেক লোক নাটক দেখতে আসতো। নাটকের দলের তপন, হরি, দেবু, কার্তিক, সোমনাথ এরা খুব কর্মঠো সদস্য ছিল। প্রমথনাথ এদের খুব প্রশংসা করতেন। কলেজ পাস করে চাকরি না পেলে ছেলেদের একধরনের হীনমন্যতা গ্রাস করে। সেই হীনমন্যতা থেকে বেরিয়ে আসতে এই সময় এরা কেউ রাজনীতি করে কেউ নানা অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু সখের মঞ্চের সদস্যরা একটা সুস্থ সংস্কৃতির সাথে থেকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।
গিরিশ চন্দ্র ঘোষের "প্রফুল্ল" নাটকটি অভিনয়ের জন্য "সখের মঞ্চ" প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়ে ছিল । প্রফুল্ল নাটকে যোগেশের ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন প্রমথনাথ। মেয়ে চরিত্রে প্রফুল্ল চরিত্রটি খুব সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছিল বন্দনা সেন। বন্দনা বিদ্যাসাগর কলেজে বাংলায় অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করত এবং কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারের সাথে যোগাযোগ ছিল। বন্দনা সেন তপনের অনুরোধে প্রফুল্ল চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হয়ে যায়। উমাসুন্দরী চরিত্রটির জন্য তপন বেছে নিয়েছিল হরির বৌদিকে। হরিদের বাড়ির নীচের তলায় হতো নাটকের রিহার্সাল। জগমনি আর জ্ঞানদা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুমিতা আর নমিতা দুই বোন ওরা হরিদের পাসের বাড়িতে থাকতো। রমেশের চরিত্র করেছিল কার্তিক। কাঙ্গালীর চরিত্রে সোমনাথ অভিনয় করেছিল। উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার নাগরিক জীবনের চিত্রটি ওরা অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিল। "সখের মঞ্চ" নাটকের দল তপনের পরিচালনায় বেশ কয়েক বছর নাটক করেছিল। তপন কাজ নিয়ে মুম্বাই পাড়ি দিলে দলটা একপ্রকার ভেঙে যায়। দেবু হরি এরাও চাকরি এবং সাংসারিক জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রমথনাথ একা আর নাটকের জন্য কিছু করে উঠতে পারেনি।
ভবেন্দ্রনাথের লরির ব্যবসায় অনেক ঝক্কি ঝামেলা ছিলো। একবার ওদের এক লরি ড্রাইভার এক্সিডেন্ট করে একজন সাইকেল আরোহীকে পিসে দিয়ে চলে যায়। লরিটা ভাড়া নিয়ে ছিল একটা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি। পুলিশ লরিটি আটক করলে ভবেন্দ্রনাথকে থানা থেকে ডেকে পাঠায় কিছু টাকা পয়সা পুলিশকে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। থানায় মৃত ব্যক্তির স্ত্রী তার শিশুপুত্রকে নিয়ে বসে ছিল ওরা ভবেন্দ্রনাথের পা জড়িয়ে ধরে সাহায্য চায় কিন্তু ভবেন্দ্রনাথ ওদের কিছু সাহায্য করার প্রয়োজন অনুভব করেন না। এরপর মহিলাটি ওদের দাস ভিলায় এসে পৌঁছলে গেটে দারোয়ান ওদের আটকায় ভিতরে ঢুকতে বাধা দেয়। নিরুপায় বিধবা দাস ভিলার দরজার সামনে ওর শিশুটিকে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। সেই সময় প্রমথনাথ ওদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন এবং অর্থ সাহায্য করেন।
শান্তিবালা তার স্বামীর এই নরম মনটিকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। নাটকের দলের ছেলেদের সাথে কথা বার্তা বলার সুযোগ হতো না শান্তিবালার কিন্তু স্বামির কাছে সকলের কথা শুনে শুনে প্রত্যেকেই চিনে নিয়েছিলেন। প্রমথনাথকে উৎসাহ যোগাতেন নাটকের কাজে। নাটকের দল ভেঙে যাওয়ায় প্রমথনাথ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন এই সময় দাস ভিলাতেও বিপর্যয় শুরু হয় বিশ্বাবসুর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর ভবেন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ভবেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। ভবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর লরির ব্যবসা একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায় এবং টাকা পয়সার ক্ষতি হয়। প্রমথনাথ লরির ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব বুঝে সরে আসতে বাধ্য হন। ননীবালা অসুস্থ হয়ে পড়লে শান্তিবালার কাঁধে সংসার এসে পড়ে।