STORYMIRROR

Madhuri Sahana

Abstract Fantasy Others

3  

Madhuri Sahana

Abstract Fantasy Others

ঠুংরী

ঠুংরী

6 mins
239


রাকা আলপোনা দিতে দিতে আড় চোখে টুকাইকে একবার দেখলো, কাঠের বেঞ্চে বসে সমানে গুলতানি করছে ঠুংরীর সাথে। গতকাল স্কুল খুলেছে প্রায় দু'বছর বন্ধ থাকার পর। বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ ছিল ফোনের মধ্যে সীমাবদ্ধ, মেলামেশা হুটোপুটি, পিছনে ‌লাগা এসব প্রায় বন্ধ ছিল। অনলাইন ক্লাসে ম্যাডামের হোমওয়ার্ক করার‌ পর কথা বলার সুযোগ থাকে না তাই স্কুল খুলেছে এই খবরে সকলেই খুব খুশি। যদিও কোভিড বিধির একটু চাপ আছে। আর স্কুল খুলেই সরস্বতী পূজো। আয়োজনে স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীরা। 

এগারো ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিবার সরস্বতী পূজোর দ্বায়িত্বে থাকে। সানাই স্কুল মাঠে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল রাকার ডাক শুনে এগিয়ে এলো। "কি হয়েছে ডাকছিস কেন? সানাই রাকাকে জিজ্ঞাসা করল। রাকা সানাই কে আলপোনা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল "ঠিক আছে?" 

"তুই একাই আঁকলি বল, ঠুংরী তো গুলতানি করছে" সানাই বললো।

"ম্যাডাম এলে তখন তুলি হাতে বসে পড়বে। ওরা সব কোথায় গেল? রাকা জিজ্ঞাসা করল।

সানাই মাথা নাড়ল "জানি না, কাউকেই তো দেখছি না।"

"এই জন্যই মাথা গরম হয়ে যায়, আমাকে রং-তুলি হাতে বসিয়ে দিয়ে সবাই ভো'কাট্টা" রাকা রেগে গেল।

"দাড়া দেখে আসি কোথায় সব" সানাই উঠে পড়ে বিল্ডিং এর ভিতরের দিকে স্টাফ রুমের দিকে গেল। স্টাফ রুমে দীপালি দি আর অনামিকা দি বসে ছিলেন। স্কুল ছুটি হয়েছে দুঘন্টা আগে বেশির ভাগ টিচার বাড়ি চলে গেছে শুধু সরস্বতী পূজোর দ্বায়িত্বে আছেন কয়েক জন তারাই স্কুলে আছে। নবীনস্যার আর সুব্রতস্যার ছাত্রদের নিয়ে প্রতিমা আনতে গেছেন। মুকুলম্যাডাম কয়েক জন ছাত্রীকে নিয়ে গেছেন দশকর্মা আর ফলমূল আনতে। সানাই কে দেখে দীপালি দি বললেন "গেটে লাইট লাগাতে ইলেকট্রিকের লোক আসার কথা আছে, কেউ এলে দারোয়ানকে দরজা খুলতে বলবে, স্কুলটাকে টুনি লাইট দিয়ে সাজিয়ে দিতে হবে।" সানাই এবার মিউজিক রুমের দিকে গেল সেখানে তন্ময়, বিপ্লব ড্রাম বাজাচ্ছে আর কয়েক জন বসে গুলতানি করছে। সানাই কে দেখে হৈ হৈ করে উঠলো। "তোরা এখানে বসে ওদিকে কিছুই জোগাড় হয়নি, এমনকি ফুলের টব গুলো নামানো হয়নি" সানাই বললো। রূপালি সানাই কে জোর করে বসিয়ে দিল, "সব হবে আগে একটু গল্প করি। কতদিন পর একসঙ্গে হয়েছি কথা শেষ হচ্ছে না"। সানাই ওদের মধ্যে বসে পড়লো।

শনিবার সকালে সরস্বতী পূজো, ঠাকুর মশাইকে সকাল সাড়ে দশটায় আসতে বলা হয়েছে। শুক্রবার রাত আটটা পর্যন্ত ওরা সবাই স্কুলে ছিল। খুব সুন্দর করে ফুল আর আলো দিয়ে স্কুল সাজানো হয়েছে। শনিবার সকাল আটটার মধ্যে ওদের স্কুলে আসতে বলেছেন দীপালি দি।


রাতে রাকা আর সানাই স্মার্টফোনে চ্যাট করে টুকাই আর ঠুংরীকে নিয়ে গসিপ করলো অনেকক্ষন। সরস্বতী পুজো বাঙালি কিশোর কিশোরীদের কাছে ভ্যালেনটাইনস ডে পালনের উৎসব। তাই গসিপের বিষয় অনেক আছে। কিছুক্ষণ গ্রুপ চ্যাটিং করার পর ওরা ঘুমিয়ে পড়লো। রাত জেগে জেগে চ্যাটিং করা এই লকডাউনে ছেলে মেয়েদের অভ্যাস হয়ে গেছে তাই সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেলা গড়িয়ে যায়। রোজ মায়ের বকুনি খেয়ে ঘুম থেকে ওঠে রাকা। 

শনিবার সকালে রাকার মায়ের একডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। সকালে স্নান করার অভ্যাস একেবারে নেই তবু নিয়ম মেনে স্নান করে শাড়ি পরার জন্য তৈরী রাকা। জিন্স টপে অভ্যস্থ রাকা শাড়ি পরে বেজায় নাকাল। শাড়ি সঙ্গে ম্যাচিং এক্সেসারিজ গতকাল বিকেলে গিয়ে মা কিনে এনেছে। সুন্দর করে সেজেছে রাকা। 

সানাই তো স্কুলে এসে অবাক; আজকে প্রায় সকলেই শাড়ি পরেছে, ছেলেরা পাজামা পাঞ্জাবী পরে বেশ কাকু কাকু হয়ে স্কুলে এসেছে। এই নিয়ে আবার একচোট মজা হলো। শাড়ির আঁচল মোবাইল সামলে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া হলো। পুজো শেষে প্রসাদ বিতরণ করলো ছেলেরা বেশ পরিপাটি করেই। এবং যথারীতি অসংখ্য সেল্ফি তোলা হলো বিভিন্ন পোজে। শাড়ির কুঁচিতে পা বেঁধে দুবার হোঁচট খেয়েছে সানাই, অনিক ওকে আছাড় খাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে।


পুজো শেষে বন্ধুরা সব একে একে চলে গেছে। রাকা ইচ্ছে করেই দেরি করে বেরিয়েছে তমাল আসবে তিনটের সময় মেসেজ করেছিল। স্কুল গেট থেকে একটু দূরে বাইক নিয়ে তমাল অপেক্ষা করছে রাকা বন্ধুদের চোখ এড়িয়ে তমালের কাছে এসেছে এবং তমাল রাকাকে পিছনে বসিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে সোজা হাইওয়ে ধরেছে। গঙ্গার ধার ঘেষে একটু নিরিবিলি দেখে ওদের বাইক দাঁড়ালো। রাকা তমালের সাথে প্রথমবার বাইরে এসেছে এতোদিন মোবাইল ফোনে চ্যাটের মাধ্যমে ওদের কথাবার্তা হয়েছে। তমাল কথা বেশি বলে না, তা ছাড়া যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, রাকার খুবই নার্ভাস লাগছিল। তমাল দিয়ার মামা, ছোটকাকিমার নিজের ভাই।

 ছোটকাকার বিয়ের সময় রাকা খুবই ছোট ছিল আর তমাল তখন ক্লাস এইটে। দিয়ার জন্মের সময় তমালের সাথে পরিচয় হয়েছে ছিল রাকার। দিয়ার অন্নপ্রাসনে একটা ছোট গেট টুগেদার করেছিল ছোটকাকা, কোভিডের কারনে বড়ো করে কোনো অনুষ্ঠান করা যায়নি। তমাল আর রাকা পরস্পর পরিচিত হয়েছিল তখন। 

গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া লেগে শীত করছিল রাকার, তমাল বললো "তোমার ঠান্ডা লাগছে? এখানে বেশ হাওয়া দিচ্ছে।" রাকা একটু হেসে বললো"একটা কম্বল হলে বেশ হতো। বেশ মুড়িসুড়ি দিয়ে বসা যেত।" তমাল বললো "কোথায় যাবে বলো? এখানে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে।" রাকা বললো "কোথায় আর যাব, এবার ফিরে যাব।" তমাল বললো "ভয় পেলে নাকি?" রাকা বললো "বাড়িতে জানাজানি হলে কপালে দুঃখ আছে।" তমাল বললো "ঠিক আছে চলো ফিরে যাই"। রাকা বললো "তাহলে আসতে বললে কেন?" তমাল হেসে বললো "দেবী দর্শন।" রাকা চোখ পাকালো, "কেমন দেখলে?" 

"একটু বোঁচা"! 

রাকা খিল খিল করে হেসে উঠলো। কিছুক্ষণ পর তমাল রাকাকে স্কুলের সামনে ছেড়ে দিয়ে গেল। রাকা একটা টানা রিকশা করে বাড়িতে ফিরলো। সানাই অনিকের সঙ্গে কফিসপে আড্ডা দিয়েছে। সরস্বতী পূজোর দিনটা ওদের বেশ মজা করেই কাটলো। যথারীতি রাতভোর গ্রুপ চ্যাটিং আর মিম্ সেয়ার করে ওদের গসিপ চললো।

ঠুংরী লকডাউনের সময় ফেসবুকের এক ফ্রেন্ডের ভার্চুয়াল প্রেমে পরেছে। টুকাই ঠুংরীকে বুঝিয়েছে একটা ম্যারেড লোকের সঙ্গে বেশি চ্যাটিং করিসনা। লোকটা ঠুংরীকে কুরিয়ারে একটা দামী রিষ্টোয়াচ গিফট পাঠিয়েছে। ঠুংরী সেটা টুকাইকে দেখিয়েছে। ঠুংরীর মা বাবা দুজনেই সার্ভিস করে। একজন মাঝবয়সী আয়া ঠুংরীকে ছোট থেকে দেখাশোনা করছেন। ঠুংরী টুকাইকে বলেছে যে ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে ও দূর্গাপুর যাবে কিন্তু কবে যাবে সেটা টুকাইকে বলেনি। সরস্বতী পূজোর দিন সকাল সকাল ঠুংরী স্কুলে যাওয়ার নাম করে বেরিয়েছে কেউ কিছু সন্দেহ করেনি। হাত ব্যাগে নিজের জমানো টাকা গুলো আগেই ভরে নিয়েছে, স্টেশনে এসে শিয়ালদহ যাওয়ার ট্রেনে চেপে‌ বসেছে ঠুংরী। শিয়ালদহ থেকে ট্যাক্সি করে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দূর্গাপুরগামী ট্রেনে উঠে জালনার ধারে সিটে নিশ্চিন্তে বসেছে। ঘড়িতে প্রায় একটা বাজে, ট্রেন যথা সময়ে ছেড়ে দিল। হাওড়া থেকে দূর্গাপুর পৌঁছতে ঘন্টা চারেকের বেশি সময় লাগবে না ঠুংরী শুনেছে। 

একা কখনও কোথাও যাওয়া হয়নি ঠুংরীর,  ও এখন বেশ বড় হয়েছে তাই ও একাই যেতে পারবে দূর্গাপুর। গুগল সার্চ করে সব রকম ইনফরমেশন ঠুংরী জেনে নিয়েছে। মা ফোন করেছিল তখন বলেছে স্কুলে আছে ফিরতে দেরি হবে। উত্তেজনায় কিছু খাওয়ার কথা মনে ছিলনা। এখন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, একটা জলের বোতল কিনে খানিকটা জল খেল। আসেপাসের সহযাত্রীদের দেখে নিয়েছে, কেউ ওকে লক্ষ করছে কিনা।  দুর্গাপুরের বন্ধুকে জানিয়ে দিয়েছে যে ও যাচ্ছে দেখা করতে। মনে মনে একটা মুক্তির আনন্দ তবু একটা ভয় লাগছে। আকাশ কুসুম চিন্তা হচ্ছে, মা জানতে পারলে খুব রাগ করবে বাবা হয়তো আর কথাই বলবে না। আয়ামাসীর উপর রাগ করবে সবাই। ঠুংরী আয়ামাসীকে খুব ভালোবাসে। ট্রেন চলছে, পাসে বসা লোকগুলো সব ঝিমোচ্ছে আর ঢুলছে দেখে হাসি পাচ্ছে ঠুংরীর। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে ভালো লাগছে ঠুংরীর। টুকাই এখন কি করছে কে জানে? স্কুলে নিশ্চয়ই খুব মজা হচ্ছে। ফোন বাজছে, মা ফোন করেছে, কলটা রিসিভ করলোনা ঠুংরী‌। এখন কথা বললে ট্রেনের শব্দ শুনতে পাবে মা।

হঠাৎ একটা ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গলো সানাইয়ের, মা খুব উত্তেজিত, ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছে। ধরফর করে উঠে ঘড়ি দেখলো সাড়েদশটা বাজে। গতকাল সরস্বতী পূজোর দিনটা খুব হৈচৈ করেছে তাই আজকে একটু বেশি দেরি পর্যন্ত ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু হলোটা কি? মাকে সে এতো বিচলিত লাগছে কেন? সানাই কিছু বুঝতে পারছে না। মা এবার জিজ্ঞেস করলো "গতকাল ঠুংরী স্কুলে ছিল তোদের সাথে?"‌ সানাই জানালো ও ঠুংরীকে দেখেনি ওদের সাথে ঠুংরী গতকাল স্কুলে ছিল না। 

ঠুংরী গতকাল স্কুলে যায়নি বাড়িতেও ছিল না। পুলিশ জানিয়েছে ওকে দূর্গাপুর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ঠুংরী লুকিয়ে দুর্গাপুরে ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গেছে। মোবাইলে লোকেশন ট্র্যাক করে জানাগেছে ও দুর্গাপুরে সেখান থেকে পুলিশ ওকে উদ্ধার করেছে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract