SUSHANTA KUMAR GHOSH

Abstract Tragedy Inspirational

3  

SUSHANTA KUMAR GHOSH

Abstract Tragedy Inspirational

পচা আলুর গন্ধ

পচা আলুর গন্ধ

7 mins
17



গত বছর আলুর দামটা ভালই পেয়েছিল নিতাই। আলু তোলার সময় দর মন্দ ছিল না। জমির মাথাতেই মেপে দিয়েছিল পাঁচশ টাকা বস্তা। বীজ আলু ছাড়াও অতিরিক্ত যে ত্রিশ বস্তা হিমঘরে রেখেছিল, সেটাও নিতাইয়ের সঙ্গে বেইমানি করে নাই। শ্রাবণ মাসে বণ্ডটাই বিক্রি হয়েছিল বস্তা প্রতি আটশ টাকায়। ওই টাকায় বর্ষার চাষের খরচ চালিয়েও কিছুটা বকেয়া দেনাও শোধ করতে পেরেছিল।

এখন আলুর চাহিদা আছে বাজারে। টন টন আলু চালান হচ্ছে বাইরে। দামটাও মন্দ নয়। আলুর ব্যাপারীরা বলছে দামটা এরকমই থাকবে। নিতাই তাই সিদ্ধান্ত নিল এ বছর আলু চাষের পরিমাণ বাড়াবে।


প্রান্তিক চাষি নিতাই।বিঘা তিনেক পৈতৃক জমি ভাগ পেয়েছে। তার মধ্যে দো জমি মাত্র দশ কাঠা। নিজের দশ কাঠা দো জমি ছাড়াও পাড়াপড়শিদের কাছ থেকে আরও বিঘে দেড়েক ভাগে নিয়ে বিঘা দুই আলু চাষ করে সে।বিঘা প্রতি কুড়ি বস্তা আলুর চুক্তিতে জমি ভাগে পাওয়া যায়।


গত বারের আলুর ভালো দাম পাওয়ায় নিতাই এ বছর আলু চাষের জন্য দো আউশ মিলিয়ে বিঘা চোদ্দ জমি জোগাড় করে ফেলল।ছ বিঘা আউশ জমি। যাদের মালিককে দিতে হবে বিঘা প্রতি দশ বস্তা আলু। বাকি আট বিঘা দো। দো জমির মালিকদের দিতে হবে বিঘা প্রতি কুড়ি বস্তা। 


চার বিঘা জমিতে চাষ করার মতো বীজ আলু নিতাইয়ের মজুত ছিল।বাকি বীজটা সংগ্রহ করল সুভাষ সামন্তের কাছে। সুভাষ সামন্ত এলাকার মস্ত ব্যবসাদার। এলাকার চাষিদের বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশকের জোগান সে-ই দিয়ে থাকে। বেশিরভাগ চাষিই নগদে এসব কিনতে পারে না। ছোট চাষিরা ধারেই নিয়ে যায়। তার জন্য বাজার দরের তুলনায় দাম একটু বেশিই দিতে হয়। আলু তোলার সময় জমি থেকেই আলু মেপে নেয়। ধানের সময় খামার থেকেই মেপে নেয় ধান।

নিতাই সুভাষ সামন্তের দোকান থেকে বীজ এবং রাসায়নিক সারের পুরোটাই ধারে সওদা করল।


এ বছর কেবল নিতাই নয়,গ্রামের বেশির ভাগ চাষিই আলু চাষের পরিমাণ বাড়িয়েছে। যাদের দো জমির পরিমাণ কম, তারা দো আউশ ছাড়িয়ে মেটেলের জমিতেই আলু লাগিয়েছে। মেটেলে আলু তেমন ফলে না। তাছাড়া ওখানে জলের সমস্যাও আছে। কিন্তু আলুর বাজার দরের কথা ভেবে চাষিরা তাদের জমির কাছাকাছি স্যালো সাবমার্সিবল থেকে এক কিলোমিটার অবধি সেচ নালা কেটে জল নিয়ে গেছে। এতে সেচের জন্য খরচ অনেক বেশি হবে ঠিকই, কিন্তু চলতি বাজার দর বজায় থাকলে কাঠায় চার মন আলু ফললেও চাষের খরচ মিটিয়ে লাভের অঙ্ক ঘরে তুলতে পারবে।


দেখতে দেখতে লকলকে আলু গাছে ভরে উঠলো মাঠ। এবার শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পরেছে। এমন কুয়াশা বিহীন জাঁকালো শীত নিকট অতীতে আসে নাই। পারদ যত নামে, আলুর গাছ ততই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই চাষিদের মুখে চওড়া হাসি। এবার গাছের যা বহর তাতে এদিকের সোনার দোয়ে কাঠায় আট নয় মন ফলন নিশ্চিত। মেটেল মাটিতেও গাছ মন্দ হয় নাই। আনকোরা মাটিতে চার পাঁচ মন ফলন না ছুঁয়ে ফেলে। দিন যত পেরয় বাজারও তত লাফিয়ে বাড়ে। চাষিদের মুখের হাসিটা চন্দ্রকলার মত বাড়তে বাড়তে পূর্ণ চাঁদের আকার নেয়।


নিতাই হিসাব করে দেখে এ বছর তেরশ বস্তা আলু তার নিশ্চিত। দুশো কুড়ি বস্তা যাবে জমির মালিকদের পাওনা মেটাতে। ফেলিয়ে ছড়িয়ে হাজার বস্তা আলু সে পাবেই। বাজার দর যদি বস্তা প্রতি চারশো টাকাও পায়.... ভাবতে ভাবতেই বাঁধভাঙ্গা খুশির প্লাবনে ভেসে গেল তার অন্তর! বিকাশ বাবুর কথাটা তার মনে পড়ে গেল। 


বিকাশ বাবু তার মাস্টার মশাই। তিনি সুপর্ণার জন্য একটি পাত্রের সন্ধান দিয়েছিলেন। বিকাশ বাবু বর্তমানে যে ইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে কাজ করছেন, সেই ইস্কুলে একজন নতুন শিক্ষক যোগ দিয়েছেন। ছেলেটি নম্র, ভদ্র এবং রুচিশীল। ছেলেটিকে দেখার পর নিতাইয়ের মেয়ে সুপর্ণার কথা তার মনে পরেছে। সুপর্ণাও বিকাশ বাবুর ছাত্রী।বিকাশ বাবু প্রধান শিক্ষক হয়ে নতুন ইস্কুলে চলে যাওয়ার আগে পাঁচ বছর সুপর্ণাকে পড়িয়েছেন। মেয়েটি যেমন ভদ্র তেমনি মিষ্টি। কেবল লেখাপড়ায় নয়, সব দিক দিয়েই গুণের। তার এই গুণের জন্যই বিকাশ বাবু তার কথা ভোলেন নাই।


নিতাই আর বিলম্ব করে নাই। তার মতো গরীব ঘরের মেয়ের জন্য এমন একটা পাত্রের কথা তার ভাবনাতেও ছিল না। চাষ টুকুই যা ভরসা। চাষের কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজের সুযোগও নাই। নিজের সামান্য জমির সঙ্গে আরও কিছু ভাগ জমি চাষ করে যেটুকু আয় হয় তাতে সংসার চালিয়ে, মেয়ের পড়াশোনার খরচ মিটিয়ে মেয়ের বিয়ের জন্য বিশেষ কিছু সঞ্চয় করতে পারে নাই নিতাই।এ বছর চোদ্দ বিঘা আলু চাষ করায় অতিরিক্ত কিছু অর্থ আগমনের সুযোগ এসেছে। তাই বিকাশ বাবুর শরণাপন্ন হল নিতাই।


বিকাশ বাবুর মধ্যস্থতায় পাত্রপক্ষ কনে দেখতে এল।সুপর্ণাকে পছন্দও হল তাদের। কোনো দাবিও নাই।কেবল বিয়ের আনুষঙ্গিক খরচ টুকু জোগাড় করতে পারলে মেয়েকে সৎপাত্রে সমর্পণ করতে পারবে। নিতাই ভাবল আলুই তাকে উদ্ধার করবে কন্যাদায় থেকে। তাই সম্বন্ধটা পাকা করে ফেলল।বিয়ের দিনটাও ঠিক হয়ে গেল। ২রা বৈশাখ ধার্য হল দিন।

 স্ত্রী বিভা একটু আপত্তি করেছিল। বলেছিল -" বিয়েটা এ বছর নাই বা দিলে। আমরা তো কেউ ইস্কুলের গণ্ডি পেরতে পারি নাই।মেয়েটা কলেজ অবধি গেল। আর একটা বছর সময় পেলে কলেজ পাশ হয়ে যাবে! তার পরেই না হয়.."

বিভার কথা শুনে নিতাই কিছুটা অবাকই হয়েছিল। তাদের পরিবারে মেয়েদের বয়স তেরোর গেরো পেরতে না পেরতেই মা ঠাকুমাদের মাথায় বিয়ের ভূত চেপে যায়।বাড়ির পুরুষদের উঠতে বসতে পাত্র সন্ধানের তাগাদা দেয়। মেয়ে যেন ভূতের বোঝা। সে বোঝা ঘাড় থেকে না নামা পর্যন্ত শান্তি পায় না। ছাদনা তলায় সাত পাক ঘুরিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে উলু দিয়ে খই ছড়াতে ছড়াতে বর কনে বিদেয় করতে পারলে তবেই ওদের শান্তি। সেই ঘরানার মেয়ে হয়েও বিভার আপত্তিটা নিতাইয়ের মনকে একটু নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু পিছিয়ে আসে নাই নিতাই।

বিভা যখন বলেছিল -" একটা তো বছর। পাকা কথা হয়ে থাক। মেয়ে কলেজ পাশটা তো করতে পারবে। সারা জীবনের খেদ!"

জবাবে নিতাই বলেছিল-" না গো বিভা, শুভকাজে দেরি করা ঠিক হবে না। শেষে সম্বন্ধটা যদি ভেঙে যায়! এমন পাত্র হাত ছাড়া হলে শেষে.. "

বিভা আর আপত্তি করে নাই। আপত্তি করে নাই সুপর্ণাও। বাবা যখন বলেছিল - " তোকে ভালো ছেলের  সঙ্গে বিয়ে দোব বলেই তো লেখাপড়া শিখিয়েছি।সংসারের অবস্থা তো সবই জানিস মা। বিনা পয়সায় এমন গুণের ছেলে আর কোথায় পাব বল।তাছাড়া ছেলে নিজে যখন মাস্টার, তোকে কলেজ পাশ নিশ্চয় করাবে, দেখে নিস!"


মিথ্যা বলে নাই নিতাই। ভাবী জামাতা অনিকেত তেমনটাই জানিয়েছে। অনিকেত এক বছর পরেই বিয়ে করতে চেয়েছিল। রাজি ছিল পাত্রের পরিবারও। ভরসা করতে পারে নাই নিতাই। প্রায় বিনা পণে এমন যোগ্য পাত্র হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয় তাকে তাড়া করেছে। ছাদনা তলায় চার হাত এক করে না দেওয়া পর্যন্ত সে স্বস্তি পাচ্ছিল না। 

তার মনে হয়েছিল এ বছর ভাগ্য দেবতা তার প্রতি সুপ্রসন্ন। আবার ঋষি প্রজাপতির ইচ্ছায় মেয়ের বিয়ের ফুলও ফুটে গিয়েছে। কাজেই মণিকাঞ্চনকে একত্র করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এবং ২ রা বৈশাখই উপযুক্ত দিন।


দেখতে দেখতে শীত বিদায় নিল।বসন্ত এল দ্বারে। মুকুলে মুকুলে আম গাছ ছেয়ে গেল। ডাঁটার ভারে নুয়ে পরল সজনে ডাল। এবার শেষ মাঘে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল, আর তাতেই রবি ফসল থেকে আমের মুকুল, জামের মুকুল, সজনে ডাঁটার এমন বাহার! মাঘের বৃষ্টি অমৃত প্রায়, ফাগুনে তা বিষ! বিষ তার প্রত্যেকটা ফোঁটায়! এখন চাষিদের ভাবনা আকাশ যেন গোমড়া না হয়! আকাশ মেঘে মুখ ঢাকলে চাষীদের মুখও ঢেকে যাবে অন্ধকারে!


হাতে মাত্র দুটো মাস।যদিও ভাবী জামাতার কোনো দাবি নাই, কিন্তু খালি হাতে তো আর কন্যা সম্প্রদান করা যায় না। ভরি পাঁচেক গয়না অন্তত দিতে হবে মেয়েকে। জামাইয়ের জন্য হার, আঙটি। সে সবের বরাত দিতেই নিতাই দশ কাঠা আলু ভাঙল।আলু বেরল সত্তর মণ! দামও মিলল ভালই - চারশ টাকা বস্তা। আলু পাকতে এখনো মাস খানেক বাকি! অসময়ে কাঁচা গাছেই যদি কাঠায় সাত মণ ফলন পাওয়া যায়, পাকা গাছে ফেলিয়ে ছড়িয়ে ন'মণ ফলন পাওয়া যাবে! 


আলু বিক্রির টাকা ক'টা নিয়ে সেদিন বিকেলেই অনন্ত স্যাকরার কাছে গেল নিতাই। 

ফাল্গুন মাস শুরু হলেও এখনো সকাল সন্ধ্যায় ঠাণ্ডা ঠান্ডা ভাব আছে। সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই ঠান্ডাটা বিদায় নিল।দু'মাইল রাস্তা সাইকেল চালিয়ে ঘেমে উঠলো নিতাই। আবহাওয়ার হঠাৎ পরিবর্তনে রাতে ঠিক মতো ঘুমও হল না নিতাইয়ের! 


ভোরের দিকে ঘুমটা জাঁকিয়ে এসেছিল।একটা দমকা বাতাসে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল জানালার খোলা পাল্লা। তারপরেই শব্দ! পাশের মুখুজ্জে বাড়ির টিনের চালে চড়বড় শব্দ! যেন পাড়ার দামাল গুলো বেপরোয়া ঢিল ছুঁড়ছে ! নিতাই দরজা খুলে বেড়িয়ে এল দাওয়ায়।মুহুর্মুহু শব্দ! কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যেন! চক্রব্যূহে আবদ্ধ করে অবরুদ্ধ অভিমন্যুর উপর চারদিক থেকে বর্ষিত হচ্ছে শেল। চিকড় হানছে বজ্র! সেই মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ ঝলকে চারপাশে ধবধব করছে শিলা! নির্ভেজাল শিলাবৃষ্টি! শুকনো শিলার অবিশ্রান্ত পতনে নিতাইয়ের উঠোনটাই অমরনাথ উপত্যকা হয়ে গেল। 


রাত কাটল। কেটে গেল মেঘও। যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা আর সাদা। শেষ রাতে পুষ্পের মত ঝরঝর করে ঝরে পড়া শিলা তখনও গলে নাই। সকালের ঝলমলে রোদে শ্বেত পাথরের উদয় পুর যেন খিলখিল করে হাসছে! এ যেন শরত ঋতুর অকাল বোধন। রাতের বৃষ্টিতে এমনিতেই মাঠঘাট জলে ভরে গিয়েছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আল পগারে, ডাঙা ডহরে জমে থাকা শিলা জল হয়ে ভাসিয়ে দিল ক্ষেত। মাত্র দিন চারেকের মধ্যেই মেটেলের আলু মিশে গেল মাটিতে। দোয়ের আলু জমির ভ্যাট ভ্যাটে কাদার সঙ্গে সন্ধি করে দুর্গন্ধে ভরিয়ে তুলল চারপাশ।


মাঠের আলু ঘরে বিশেষ এল না। যাদের জমি খুব উঁচু ধরনের, তারা কাদার দলা ঘেঁটে নিয়ে এল ঝুড়ি কতক।নিতাইয়ের পৈত্রিক জমিটা একটু উঁচু। সহজে জলে ডোবে না। প্রতি বছর এ জমিতে আলু ফলে কাঠায় আট মণ। সারাদিন ভিলি ভেঙে আলু কুড়িয়ে রাশ করে জমির মাথায়। 

ছাউনি বেঁধে রাত পাহাড়া দিয়ে পরদিন তুলে আনে ঘরে। এবারও ডাঁই হল পচা আলুর রাশ! তবে ছাউনি বাঁধা হল না। নিতাই শুয়ে পরল পচা আলুর গাদায়।এ বড় মায়ার শয্যা! মহাজনের ঋণ,জমির মালিকের পাওনা, মেয়ের বিয়ের দায়, তারপর সারা বছরের সংসার - এমনতর হাজার পাটির তোশক তার নিচে! ঘুমিয়ে গেল নিতাই!পচা আলুর স্তুপে বহু স্তরীয় তোশকের ওপরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেল। সে ঘুম আর ভাঙল না।পচা আলুর গন্ধটা সহ্য হল না তার!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract