SUSHANTA KUMAR GHOSH

Children Stories Inspirational Children

3  

SUSHANTA KUMAR GHOSH

Children Stories Inspirational Children

তুতুন এলো নতুন গাঁয়ে

তুতুন এলো নতুন গাঁয়ে

6 mins
199



তুতুন যাচ্ছে নতুন গাঁয়ে। নতুন গ্রাম ঠিক কেমন দেখতে হয়,তুতুন বুঝে উঠতে পারছে না। নতুন জামা প্যান্ট যেমন সুন্দর হয়,চকচক করে ;একটা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ ছড়ায়। নতুন বই পেলে তো তুতুনের আনন্দের সীমা থাকে না। নতুন নতুন পড়া,নতুন নতুন গল্প, ছবি! নতুন বইয়ের গন্ধটার জন্যই ওটা সব সময় পড়তে ইচ্ছে করে। বই ফেলে খেতে যেতেও ইচ্ছে করে না। নতুন বই পড়ার সময় মা ডাকলে ভীষণ রাগ হয় তুতুনের। মা যেন কি! তুতুন এখন নতুন বই পড়ছে, আর মা দিতে চায় মাটি করে! একদম ভাল্লাগে না মাকে তখন তুতুনের! 


সেই তুতুন এখন দেখতে যাচ্ছে নতুন গ্রাম! গ্রামটা নিশ্চয়ই খুব সুন্দর হবে! ভিতর থেকে বেরবে ফুরফুরে মিষ্টি গন্ধ! দুপাশে ছবির মতো ঘর বাড়ি।আঁকাবাঁকা পথ ধরে লোকজন হাঁটবে।গাছের ছয়ায় বসে থাকবে গরু ছাগল। রাস্তার পাশে কুকুর। মেয়েরা কাঁকালে কলসি ভরে জল নিয়ে যাবে। পিছন পিছন হেঁটে যাবে তার ছেলে। কোথাও মেয়েরা দল বেঁধে পুকুর ঘাটে বাসন মাজবে। নাইতে নামবে পুকুরের জলে। নতুন গ্রামের ছবিটা তো এই রকমই দেখেছে বইতে।আজ সেটাই স্বচক্ষে দেখতে পাবে তুতুন। 


ভাগ্যিস বাঘ মারি দেখতে গিয়ে পোড়ো বাড়িটা চোখে পরেছিল তুতুনের। তখনই দাদু বলেছিলেন - এখানে একটা গ্রাম ছিল। নসীপুর গ্রাম। গ্রামটা আগে যেখানে ছিল, সেটাই এখন নদী খাত।অথচ এই নদীই জড়িয়ে ছিল ওদের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে। নদী ছিল ওদের পরিবারের একজন। নদীর তীরে বাস।নদীর জল পান।নদীর জলে স্নান। নদীর জলে চাষ। পাঁচ বছরের শিশুও নদীকে ভয় পেত না। আদুল গায়ে নেমে পরত জলে। গামছা দিয়ে ছেঁকে ধরত মাছ।হাঁটুর নিচে তিরতির করে বয়ে যেত কাঁচের মতো টলটলে জল।জলের নিচে বালির উপর হামা দিয়ে খেলে বেড়াত আরমাছ।ওরা ধরত পলুই চেপে।আরমাছের নামটা তুতুন আগে কখনো শোনে নাই। দাদুর কাছে জেনেছে ওটা ট্যাংরা মাছের মতো দেখতে। কিন্তু আকারে অনেক বড় হয়।


এই কদিনে নদীটার সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছে দাদুর কাছে। বর্ষা এলেই টলটলে জল কেমন ঘোলা হয়ে উঠত।জলের পরিমাণ যেত বেড়ে। বাড়ত স্রোতের বেগ।নদীতে ভাসত নৌকা। বর্ষা ফুরতেই নদী উঠত সেজে। চরে চরে কাশ ফুলের মেলা। সাদা কাশের বুক চিরে মাঝ বরাবর বয়ে যেত ঘোলা জলের স্রোত। বালি আর দেখা যেত না তখন। জেলেরা নৌকা ভাসিয়ে নদীতে মাছ ধরত।কত রকমারি বড় বড় মাছ সব।তারপর এক সময় ঝরে যেত কাশ।জল যেত কমে। নদী ফিরত চেনা রূপে। টলটলে মিঠেল স্রোত বয়ে যেত কুলকুল করে। পৌষ আসত শীত নিয়ে। কুয়াশার আড়ালে ঢেকে যেত চরাচর। 


বর্ষায় মাঝে মাঝে নদী ফুঁসে উঠত।কখনো ফুঁসত শরতে।ছাড়ত গর্জন। কূল ছাপিয়ে জল ঢুকে যেত ক্ষেতে। কিছু ফসল তাতে নষ্ট হত।কিন্তু নদীর জলে ভেসে আসা পলি জমে ক্ষেত আরও উর্বর হয়ে উঠত।পরের বার ফসল ফলত দ্বিগুণ! পুষিয়ে যেত লোকসান। জলের পরিমাণ বেশি হলে নদীর তীরবর্তী জমিতে বালির চরা পরত।জল শুকাতেই বালি সরিয়ে জমি উদ্ধারের কাজে লেগে যেত সব। তখন মানুষের মধ্যে একতা ছিল। শরীরে ছিল অসুরের শক্তি। আপন পর ভেদ ছিল না। গ্রামের সব পুরুষরাই বেড়িয়ে আসত ঝুড়ি কোদাল হাতে। ওদের হাতের কারসাজিতে জমি ফিরে আসত পূর্বের অবস্থায়।রাশি রাশি বালি পরত তালায়।


কখনো মিতালি, কখনো লড়াই।মিঠে কড়া সম্পর্কেই বাঁধা ছিল নদীর সঙ্গে মানুষ। নদী ছাড়া বাঁচার কথা ওরা ভাবতেই পারত না। সেই নদীই একদিন সর্বনাশী হয়ে উঠল।সকালে ডুবল বকচর। বিকেলের মধ্যে ভেসে গেল সব।নদীর এমন ভয়ংকর রূপ ওরা আগে কখনো দেখে নাই। ঘুর্ণি তুলে গর্জন ছাড়তে ছাড়তে ধেয়ে এল জল।মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নদী ক্ষেত খামার গ্রাম জনপদ সব একাকার হয়ে গেল। আস্ত গ্রামটাই গিলে ফেলল নদী। ওরা এক বস্ত্রে নদীরই বাঁধের একটা অংশে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচাল।ঘর বাড়ি ক্ষেত খামার গবাদি পশু সব ভেসে গেল। একদিকে বন্যা, অন্যদিকে বৃষ্টি।বৃষ্টি আর থামে না। তার মাঝেই দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে গেল। দু'দিন পরে হেলিকপ্টার থেকে ফেলা হল শুকনো খাবার। বেশিরভাগই নষ্ট হল জল কাদায়। খাবার যদি বা জুটল,কিন্তু পানীয় জল কোথায়! চারপাশে এত জল,তবু এক ঘটি পানীয় জলের অভাবে প্রাণ বিয়োগের দশা। তিন দিনের মাথায় এল দুটো নৌকা। জল এল,খাবার এল।উদ্ধার করে নিয়ে আসা হল নিরাপদ জায়গায়।


জল একদিন সরে গেল। ওরা দেখতে এল ঘর বাড়ি। দেখল কেবল নদী আর নদী। গ্রামটা কোথায় ছিল, সেটাই বুঝতে পারত না, যদি রসিদ মোল্লার মস্ত দালান বাড়ির একটা ভাঙা দেওয়াল বালির স্তুপে উঁকি না মারত! গ্রামের মধ্যে রসিদ মোল্লাই দালান বাড়ি তুলেছিল। তারই একটা ভগ্নাংশ এখনো দাঁড়িয়ে আছে। অবশিষ্ট ঘর বাড়ি গাছপালা এমনকি গ্রামের মাটিটাই ভেসে গেছে নদীর জলে। গ্রামের উপর দিয়েই এখন নদী বয়ে যায়। 

ওরা বুক চাপড়ে পরল বালির উপর। সর্বনাশী সব নিয়েছে ।সব খেয়েছে।এমনকি ভিটের মাটিটুকুও। এখন ওরা যাবে কোথায়! এদিকে তো সব জলা।সেখানে তো বসতি গড়া যাবে না। আশপাশে ডাঙা ডহর কিছু আছে। কিন্তু সেও খুব নামাল।বর্ষার জলেই ডুবে যায়। ওরা তবে থাকবে কোথায়! নদী ওদের সব নিয়েছে। পায়ের তলার মাটিটুকুও।ওরা মাটি চায়। 


মাটির হদিশ পাওয়া গেল। নদী থেকে অনেক দূরে পিচ রাস্তার ধারে ছিল মস্ত একটা আম বাগান।আগে ছিল কয়েক হাজার গাছের মস্ত একটা বাগান। সে সব গাছ কাটা পরেছে। কয়েকটি মাত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। লোকে বলে বাবুর বাগান। কোন এক দারোগা বাবু নাকি এই বাগানের মালিক। সমাজ কর্মীরা বিধান দিলেন-এস, ওই বাবুর বাগানেই বসত গড়।আশপাশের মুরুব্বীরা বললেন -সেই ভালো। দারোগা বাবুকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বলা যাবে। ওদের মাটি জুটল।দিন দুয়েকের মধ্যেই গড়ে উঠল আস্ত একটা গ্রাম। বাঁশের খুঁটি পুঁতে ত্রিপল খাটিয়ে তৈরি হল অস্থায়ী বসত বাড়ি। ঠিক হল,পরিবার পিছু যেটুকু জায়গা বরাদ্দ হয়েছে সেখানেই তারা দেওয়াল তুলে বাড়ি বানাবে। দুর্দিন কেটে গেলে সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু কিছু অর্থ তুলে দেবে দারোগা বাবুর হাতে। 


কে কার কথা শোনে! মাটি গিয়েছে ওদের। দারোগা বাবুর কিসের দায় ওদের জন্য মাটি দেওয়ার! ক্ষেপে উঠলেন তিনি! নালিশ করলেন কোর্টে! অভিশাপ মাখা হুংকার দিতে দিতে বললেন -ব্যাটারা ভেসে গেলি না কেন বানের জলে! ঘর দুয়োরের সঙ্গে তোরাও গেলেই জ্বালা চুকত।গাঁ ভাসিয়ে গায়ের জোরে উড়ে এসে জুড়ে বসলি আমার বাগানে! দেখাচ্ছি মজা! সব কটাকে জেলে পুরব! 

ওরা বলল -ও সবের ভয় করিনা বাবু! জেলে গেলে মাথার উপর ছাদ পাব।পেটের ভাত পাব। নিয়ে চলুন না সবাইকে।

আদালতে মামলা চলল অনেক দিন।জীবনের সঙ্গে আইনের যুদ্ধে জীবনই জয়ী হল।এখন সেটা মস্ত একটা গ্রাম! মাটির বাড়ির পাশাপাশি অনেক নতুন নতুন দালান বাড়িও উঠেছে! সেদিনের যোদ্ধাদের অনেকেই আজ আর নাই। তাদের বংশধরেরা এখন স্কুল যায়, কলেজ যায়।চাষের ক্ষেত ছেড়ে অফিস যায়।ঐশ্বর্য আর প্রাচুর্য এখন হাত ধরাধরি করে পথ হাঁটে গ্রামে। সঙ্গে ঘোরে লোভ হিংসা বিদ্বেষ ছায়ার মতো। অন্ন বস্ত্রের সেই ভয়ংকর অভাবটা অনেক দিন আগেই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু সঙ্গে করে নিয়ে গেছে ঐক্য, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, আর নিরবচ্ছিন্ন শান্তি! আর সে সব হারিয়ে গেছে বলেই না তুতুনের দেখতে আসা সাধের মেলাটাই এখন আর দেখা হল না! 


তুতুনরা নতুন গ্রামের মোড়ে এসে পৌঁছল।চওড়া পিচ রাস্তার গায়ে ঘিঞ্জি একটা গ্রাম। রাস্তায় যান চলাচলের বিরাম নাই। ঝড়ের বেগে ছুটছে নামী দামি গাড়ি। দাদু বললেন -" তুতুন ভাই, এই হল নতুন গাঁ!"

তুতুন তো অবাক! এমন গ্রাম আবার নতুন হয় কি করে! ঘর বাড়ি সব তো পুরনো। কত ঘিঞ্জি। সরু সরু রাস্তা। রাস্তাময় আবর্জনা! চারপাশ থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পিচ রাস্তার পাশেও নাকে রুমাল না চেপে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল। একটু অসতর্ক হয়ে পা ফেললেই বিষ্ঠায় পা পরবে।এ কেমন গ্রাম! এমন নোংরাও হয় কখনো! তুতুনের গা গুলিয়ে উঠল।বইয়ের দেখা ছবিগুলোর সঙ্গে এই গ্রামের কোথাও কোনো মিল নাই! তুতুনের ওখানে আর থাকতে ইচ্ছে হল না। দাদুকে বলল-" দাদু,গ্রামটা এত নোংরা কেন? ওরা পরিস্কার রাখতে পারে না! মিস দেখলে ওদের এমন বকা দেবে না, বুঝবে মজা! মাও বকবে। আমি কাগজ ছিড়ে মেঝেতে ফেললেই মায়ের বকা খেতে হয়! চল তো, মাকে গিয়ে বলি! ওদের বকে দিয়ে যাবে! "

দাদু একটু হাসলেন। তারপর তুতুনকে নিয়ে রওয়ানা দিলেন বাড়ির পথে। 



Rate this content
Log in