SUSHANTA KUMAR GHOSH

Children Stories Thriller Children

3  

SUSHANTA KUMAR GHOSH

Children Stories Thriller Children

মালা ভূত

মালা ভূত

6 mins
10



এবার ফেরার সময় হল।তুতুন ফিরে যাবে ঘরে। মেলা দেখার জন্য এসেছিল সাতগাঁ দাদুদের বাড়ি। মেলাটা তার দেখা হল না ঠিকই। কিন্তু এই ক'টা দিনে যা সব দেখল, তাতে খুশিতে ভরে গিয়েছে তুতুনের মন। একটা মেলা তাকে এত আনন্দ দিতে পারত না। আনন্দটা কি কেবল তুতুনের! দাদুর প্রাপ্তিটাই বা কম কি! কান্না হাসির দোল দোলান পুরনো স্মৃতির মেলাটা তো তুতুনই বসিয়ে দিল তার সামনে! তুতুনের তালার মেলা দেখা না হলে কি হবে, স্মৃতির সিন্দুক খুলে দাদুর ফেলে আসা দিনগুলোর এলবামটাই থরে থরে সাজিয়ে দিল।সেই তুতুন রাত পোহালেই ফিরে যাবে তাদের শহরের বাড়িতে। স্মৃতির সিন্দটাও বন্ধ হয়ে যাবে। দাদুর মনটাই তাই বেশি ভারাক্রান্ত!

আজ আর দূরে কোথাও গেল না। বিকেলের নরম রোদে তুতুনকে সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে ছিল ক্যানেলের বাঁধে।এ ক্যানেল শূন্য মাঠের বুক চিরে চলে গেছে দিগন্তের দিকে। আগে দুই বাঁধেই গাছপালা ছিল অনেক। ছোট বড় গাছের সারি!দূর থেকে দেখলে মনে হত যেন সবুজ রেলগাড়ী! সে সব এখন নেই আর।খাঁ খাঁ খিন্ন শূন্য মাঠ পরে আছে একা।গাছপালার চিহ্ন কোথাও নাই। তবু গ্রীষ্মের বিকেলে শূন্য মাঠে বাতাস আজও খেলা করে! বাঁধের উপর এসে দাড়ালে ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়। মাঠ থেকে দলে দলে ঘরে ফেরে গোরু। গোধূলির রঙে চারপাশ রেঙে ওঠে। তখন চরাচরকে কেমন মায়া পুরী মায়া পুরী মনে হয়! দাদুদের গ্রামের এই সময়টা তুতুনের খুব ভালো লাগে! মানুষের শরীরের রঙ গুলোও কেমন বদলে যায়! শরীরের ভিতর থেকে একটা লাবণ্য ঠিকরে বেড়িয়ে আসে।তুতুনের নিজের গায়ের রঙটাও কেমন পালিশ পালিশ মনে হয়! নিজেই নিজের শরীরে হাত বোলায়! হাত দুটো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। গাছপালা, মাটি মানুষ, আকাশ - মায়া রঙে শেষ বিকেলে জগতটা যেন মায়া পুরী হয়ে ওঠে। সেই মায়াময় জগতে তুতুন পথ হাঁটছিল দাদুর সঙ্গে। দাদু বললেন -

" বুঝলে ভাই তুতুন, আমরা এটাকে বলি কনে দেখা আলো। অবেলার এই সময়ে কনেকে হলুদ শাড়ি পরিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে হাজির করা হয়।গোধূলির আলোয় কনের জৌলুষ দেখে কেউ আর চোখ ফেরাতে পারেনা। এক দেখাতেই কনে পছন্দ হয়ে যায় তাদের! "

শহরে থেকে গোধূলির এই মায়াবী রূপটা কখনো বুঝতে পারেনি তুতুন।সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে ল্যাম্পপোস্টের বাতি জ্বলে ওঠে। তাই দিন ফুরিয়ে কিভাবে রাত আসে তুতুনের তা দেখা হয়নি কখনো ।

পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসে। কত রকমের পাখি। দিন শেষে বাসায় ফিরছে সব।ওদের ওখানে কাক শালিক ছাড়া অন্য পাখি বিশেষ দেখা যায় না। দু'একটা চড়ুই পাখি আসে মাঝে মধ্যে। বারান্দার লাইটের ব্রাকেটে খড়কুটো এনে বাসা বাঁধে।মা লাঠি উঁচিয়ে তাড়িয়ে দেয়। ভেঙে ফেলে বাসা।এখানে কত রকমের পাখি। কাক,শালিক,বক,দোয়েল, ফিঙে,মুনিয়া,বুলবুলি, শ্যামা,পানকৌড়ি, জলপিপি, সাঁড়ালি,আরও কত কি! তুতুন প্রায় কোন পাখিই চিনত না।দাদু তাকে সব চিনিয়েছেন একেবারে কাছ থেকে!

আকশে বক উড়ছে সারি সারি। তারও উপরে অনেক অনেক উঁচুতে সারিবদ্ধ ভাবে কি পাখি যেন উড়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ তুতুনের নজরে পরে নাই। এবার দেখতে পেল।হাজার হাজার পাখি সারিবদ্ধ ভাবে উড়ে যাচ্ছে। ঝাঁকের পর ঝাঁক।সারির পর সারি।যাচ্ছে যত,আসছে তত।অজস্র পাখিকে ওভাবে উড়ে যেতে দেখে উল্লাসে লাফিয়ে উঠল তুতুন।

" ও দাদু, দেখ,কত পাখি! ওই আসছে...উই উই পিছনে... ও দাদু কত পাখি গো!"

সত্যিই পাখির শেষ নাই। সামনে পিছনে হাজারে হাজারে পাখি উড়ে চলেছে। দাদু বললেন -

" ওগুলোকে আমরা বালি হাঁস বলি।শীত পরলেই ওরা দলে দলে চলে আসে এই দিকে। আর গ্রীষ্ম এলেই ওরা ফিরে যায়। পাহাড় দেশে তো খুব ঠান্ডা পরে শুনেছি। জল জমে যায়। তাই খাবারের খোঁজে ওরা দল বেধে এদিকে চলে আসে। আসা যাওয়ার পথে দল বেঁধে নদী খাল বিলে নামে। খাবার পেলে কিছু দিন থাকে। আবার চলে যায়। আমাদের তালায় নামত আগে হাজার হাজার বালি হাঁস।এখন আর নামে না।"

"কেন নামে না?"

" কি করে নামবে! মানুষ যে রাক্ষস হয়ে গেছে! "

মানুষের রাক্ষস হয়ে ওঠার কথা শুনে অবাক হয়ে গেল তুতুন!

"তোমাদের এখানে রাক্ষস আছে! কেমন গো দাদু? রাবণের মত? কই আমাকে দেখালে না তো!"

দাদু হাসলেন।

"না, তেমন রাক্ষস নয়! খুব লোভী হয়ে গেছে মানুষ! ফাঁদ পেতে, বন্দুকের গুলি ছুড়ে হাজার হাজার পাখি মেরে ফেলল! প্রাণের ভয় তো সবার আছে ভাই। কোন ভরসায় আর আসবে বল! ওদের তো তাও হাজারে হাজারে আকাশে উড়তে দেখা যাচ্ছে। জলপিপি, পানকৌড়ি অবরে সবরে চোখে পড়ে। শামুকখোল তো আর আসেই না। জলপিপি, পানকৌড়ি আগে কখনো দেখে নাই তুতুন, এখানেই প্রথম দেখল।তবে বইয়ের ছবিতে দেখেছিল।কিন্তু শামুক খোলের কথা আগে শোনে নাই। সে দাদুকে জিজ্ঞাসা করল -

" শামুক খোল কি দাদু? "

" ওটাও এক ধরনের পাখি। বকের মত দেখতে। তবে বকের থেকে বড়।"

"ও বুঝতে পারছি!তুমি ক্রেণ,অস্ট্রিচদের কথা বলছ!"

" তা তো বলতে পারব না ভাই। তবে শুনেছি তোমার ওই সব পাখি আকারে অনেক বড় হয়। শামুক খোল কিন্তু খুব বড় নয়। "

" তাহলে পাখিটাকে শামুক খোল বলছ কেন? বড় বক বল।"

" আমরা শামুক খোলই বলি।বর্ষার বৃষ্টি শুরু হতেই দলে দলে উড়ে আসত মাঠে। জল কাদায় লুকিয়ে থাকা মাছ,কাকড়া, গুগলি শামুক ধরে খেত।শামুকের খোলা তো খুব শক্ত আর মোটা। ওদের ঠোঁট কিন্তু আরও শক্ত। সেই ঠোঁট দিয়ে শামুকের শক্ত খোলা ভেঙে নরম মাংস বের করে খায়।এই জন্যেই পাখিটাকে শামুক খোল বলা হয়।আমরা তাকে শামকল ও বলি। "

" আমাকে দেখালে না যে!"

" এখন যে ওরা আর এদিকে আসে না ভাই। বন্দুকের গুলিতে কে আর প্রাণ দিতে চায়! "

দিগন্তে ওড়া পাখির সারি তখনো শেষ হয়নি।দাদু বললেন -"ভাই তুতুন, চাকা ডুবে গেল। এবার ফিরতে হবে। "

তুতুন তো অবাক! এখানে চাকা কোথায়! আর ডুবলই বা কোন জলে! ক্যানেলে জল নাই! কাছে পিঠে পুকুরও নাই কোথাও!

" ও দাদু, চাকা কোথায় ডুবল? দেখতে পাচ্ছি না তো?"

তুতুনের কথা শুনে দাদু হো হো করে হেসে উঠলেন। সত্যিই তো, তাদের গ্রাম্য কথা তুতুন বুঝবে কেমন করে।

" দাদু ভাই, আমরা সূর্য ডোবাকে চাকা ডোবা বলি।"

সূর্য ডুবে গেছে। দিগন্তে ওড়া পাখির দল ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়।শূন্য মাঠে রাতের আঁধার নেমে আসে। দেখতে দেখতে শ্রাবণের কালো মেঘের মত অন্ধকার ঝুপ করে ছড়িয়ে গেল চারপাশে। তুতুনের অবাক হওয়ায় ঘটনাটা তখনই ঘটল।ওটা মাঝে মধ্যেই ঘটে। তবে অনেক দিন দেখা যায় নাই। প্রায় দু'বছর পরে দেখা গেল জিনিসটা।হয়তো তুতুনের জন্যই ঘটল।ওটা না দেখলে তুতুনের সফরটাও অসম্পূর্ণ থেকে যেত।ওরা প্রায় গ্রামের কাছাকাছি চলে এসেছিল। তখনই চোখে পরল। তুতুনই দেখল প্রথম।

" দাদু দাদু,দেখ.. আগুন.. ওই.. ওই.."

মাঠের মাঝখানে একটা আগুনের হলকা মালার মত উপরে উঠে যাচ্ছে। মালার পর মালা। মালার মত উপরের দিকে উঠতে উঠতে একটু পরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। দাদু দেখলেন জিনিসটা।এ দৃশ্য তিনি জ্ঞান হওয়া থেকেই দেখে আসছেন। মাঠের মাঝখানে একটা ঢিবি আছে। ঢিবির পাশে একটা জলাশয়। লোকে ওটাকে কাজির আড়া বলে। ওখানেই দৃশ্যটা মাঝে মধ্যে দেখা যায়। কখনো শীতের রাতে, কখনো গ্রীষ্মের রাতে আগুনের হলকা ওঠে মাটি ফুঁড়ে। মাটির উপরে এসে মালার মত ছড়িয়ে পরে। আশপাশের সব গ্রাম থেকেই দেখা যায়। ওটাকে সবাই মালা ভূত বলে।

ভূতের নাম শুনে তুতুন দাদুকে জাপটে ধরে!ভূতকে তুতুনের খুব ভয়! ভূত কখনো দেখে নাই। তবে ভূতের মুখ থেকে আগুন বেরয়, এটা শুনে তুতুন হতবাক হল।ড্রাগন মুখ থেকে আগুন ছোড়ে।দৈত্য দানবরা আগুন বের করতে পারে! ঠাকুরের তো কপাল থেকেই আগুন ছোটে। দাদুদের গ্রামের মালা ভূতকে মুখ দিয়ে আগুন ছুড়তে দেখে তুতুনের সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল! দাদুর গলা জাপটে ধরে সেই যে মুখ ফিরিয়ে নিল,আর ফিরে তাকায় নাই!

এদিকে দৃশ্যটা দেখতে গ্রামের সবাই প্রায় বাইরে বেড়িয়ে এসেছে। ওটা ওদের কাছে অশনি সংকেত! যতবার দেখা দিয়েছে মালা ভূত, ততবারই ডেকে এনেছে বিপদ! মড়কে মারিতে মহামারি ঘটিয়েছে! বানে ভাসিয়েছে ক্ষেত,নয়তো খরায় শুকিয়েছে ধান! ছড়িয়েছে রোগ। কখনো গিয়েছে শস্যের উপর দিয়ে, কখনো পশুপাখি! কখনো বা ঘায়েল করেছে মানুষকে! এবার মালা ভূত কি বিষ ছড়িয়ে দিল কে জানে!

বাড়ি ফিরে দাদুর কোল থেকে মায়ের কোলে গিয়ে উঠল।

"ভূতটা চলে আসবে না তো বাড়িতে! "

দাদু বললেন -" না ভাই, ও ভূত চলতে পারে না! ওর পা দুটো পোঁতা আছে মাটিতে! সেই রাগেই মুখ দিয়ে আগুন ছুড়ছে! "

দাদুর কথায় বিশেষ ভরসা করতে পারল না তুতুন। ভূতকে বিশ্বাস নাই। সবাই বলে যে ভূত বাতাসের সঙ্গে মিশে যেতে পারে! যদি তাই হয়! ভূতটা যদি বাতাস হয়ে চলে আসে এখানে! কে আটকাবে! কেউ দেখতে পাবে না তো! ভয়ে সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল! মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বলল-

"মা,কাল বাড়ি যাব! "

তুতুনের আচরণে মা আর হাসিটা চেপে রাখতে পারলেন না।


Rate this content
Log in