SUSHANTA KUMAR GHOSH

Children Stories Thriller Children

3  

SUSHANTA KUMAR GHOSH

Children Stories Thriller Children

কুমির খেল লাঙ্গল গিলে

কুমির খেল লাঙ্গল গিলে

7 mins
172


কুমির খেল লাঙল গিলে 

সুশান্ত কুমার ঘোষ 


মাছ ধরার আনন্দে রাতে আর বাঘ কুমিরের কথা তুতুনের মনেই ছিল না। সকাল হতেই কিন্তু কুমিরের কথা মনে পড়ে গেল তার। ডাক পরল দাদুর -

" ও দাদু, আমাকে কুমির বাড়ি দেখাবে বললে যে? চলো চলো, কুমির বাড়ি দেখাবে চলো!"

দাদু বললেন -

" এখন অনেক রোদ্দুর হয়ে যাবে ভাই। এই রোদের সময় গেলে কুমির বাড়ি ভালো করে দেখা যায় না। ও সব দেখতে বিকেলে যেতে হয়।"

" বিকেলে কেন! তোমাদের বাড়িতে ছাতা নাই! আমাকে একটা ছাতা দাও।রোদ্দুরে আমার কিচ্ছু হবে না! কুমির বাড়ি দেখব,বাঘের বাসা দেখব।বিকেলে গেলে দেরি হয়ে যাবে তো! একটা দেখতে না দেখতেই বলবে তুতুন বাড়ি চল,সন্ধ্যা হয়ে গেছে! "

" দুটো এক সঙ্গে দেখা যাবে না ভাই। আলাদা আলাদা দেখতে হবে। আর ওগুলো বিকেলের আলোতেই দেখতে হয়।খটখটে রোদে দেখলে বুঝতেই পারবে না ওটা কুমির বাড়ি। "


তুতুনের মনে হল দাদু ঠিক কথাই বলেছে। দাদুরা তো এখানকার লোক, সব কিছু জানে।কুমির বাড়ি, বাঘের বাসা এ-সব কখন ভালো দেখা যায়, দাদু ছাড়া আর কেই বা ভালো জানবে। দাদুর কথা মেনে চলাই ঠিক।এতে ভালোই হবে। 


বিকেলে সাইকেলে চড়ে তুতুন এলো কুমির বাড়ি দেখতে। তালার দহের কাছাকাছি এসে নেমে পড়ে সাইকেল থেকে। এবার আল পথ ধরে হেঁটে যেতে হবে। দাদু সাইকেলটা এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে বললেন -

" তুতুন ভাই, এবার তো আমাদের হাঁটতে হবে। "

তুতুন দেখল তার দুপাশে প্রায় সব জমিতেই ফসল রয়েছে। ঝিঙে,শশা, কাঁকুর, তরমুজ, খেরো,কুমড়ো, পটল, তিল এই সব।তুতুনের বেশ ভালোই লাগছিলো। চারদিকে হলুদ ফুলের মেলা। ফুলে ফুলে প্রজাপতি। এই সব দেখতে দেখতেই আল পথ ধরে হেঁটে যায়।কিন্তু মুশকিল হল এখানকার আল পথ এতটাই সরু যে সে পথে তুতুনের চলাই মুশকিল। দুপা না চলতেই টাল খেয়ে পরতে হচ্ছে খালে।তার পালগা দাদুদের আলপথ এমন নয়।আর বন্দী পুরের দাদুদের আলপথ ধরে তো লোকজন সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যায়। ওই পথ ধরে তুতুন কত দৌড়েছে।পরে যায়নি কখনো। কিন্তু এখানকার আলপথ খুব সরু।দাদুর পাই পিছলে যাচ্ছে। সে তো তুতুন, দাদুর থেকে অনেক ছোট, সে কেমন করে হাঁটবে।


দাদু মনে হয় তুতুনের মনের কথাটা শুনতে পেলেন। তাকে তুলে নিলেন কোলে। তুতুন জিজ্ঞাসা করল -

" দাদু,তোমাদের আলপথ এত সরু কেন গো?"

" আর ভাই, কি দিনকাল যে এল! এ জীবনে আর কি কি দেখব কে জানে।মানুষ ভাবে আল কাটলেই বুঝি জমি বেড়ে যায়!  তাই এ জমির মালিক কাটছে এধার, ও জমির মালিক কাটছে ওধার! আলের আর কি দোষ।কোন রকমে টিকে আছে এই যথেষ্ট! "


কিছুটা এগিয়ে আসার পর তুতুনকে একটা জমি দেখিয়ে বললেন -

"ঐ দেখ ভাই, ওই যে জমিটা দেখছ,ওটাতেই বেঁধেছিল কুমিরের সঙ্গে আমার লড়াই! "

কুমিরের সঙ্গে লড়াইয়ের কথা শুনে তুতুন চোখ বড় বড় করে দাদুকে জিজ্ঞাসা করে -

" তুমি কুমিরের সঙ্গে লড়াই করেছ! কুমির তোমাকে খেয়ে ফেলেনি? "

" খেয়ে ফেললে তো আর তোমাকে দেখাতে পারতাম না। এই জন্যই কুমিরটা আমার কাছে হেরে গেল! "

তুতুন বিষ্ময় ভরা চোখে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি বলবে ভেবে পায়না। 


" এই যে দেখছ এদিকের জমি গুলো, এগুলো তখন আমাদের ছিল। "

তুতুন দেখল দহ ঘেঁষা বেশ কিছু জমি দাদু তাকে হাতের ইশারায় দেখাচ্ছে।সে জিজ্ঞাসা করল -

" তখন ছিল বলছ।এখন তোমাদের নেই?"

"না ভাই, এখন আর আমাদের নাই। এখন অন্যজনের হয়ে গেছে! "

"অন্য জনের কি করে হল দাদু?"

" সে অনেক কথা ভাই। ওসব তুমি বুঝবে না এখন।পরে শুনবে। এখন আমরা যে জমিটার উপরে দাঁড়িয়ে আছি,এটাই কুমির বাড়ি! এখানেই হয়েছিল যুদ্ধটা!"

" কুমিরটা খুব বড় ছিল নয় দাদু?"

" বড় খুব বেশি ছিল না। তালায় বড় কুমির তো আসে না। এখানে ছিল মেছো কুমির! ওরা জলে খেত মাছ, ডাঙায় পোহাতো রোদ! ডিম পাড়ার সময় হলে উঠে আসত ডাঙায়! মাটিতে গর্ত খুঁড়ে ডিম পেড়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিত।এই জমিটাতেই কুমিরটা ডিম পেড়েছিল! "

 "ডিমগুলো তুমি দেখেছিলে?"

"কুমিরের ডিম আমি অনেকবার দেখেছি। কিন্তু যার সঙ্গে আমার লড়াই হল, তার ডিম আমি দেখি নাই।"

" তাহলে কুমিরটা তোমার সঙ্গে লড়তে এল কেন? "

" সেদিন হয়েছে কি... অনেক ভোর ভোর লাঙল নিয়ে এসেছি মাঠে... "

"তুমি লাঙল চালাতে! "

" হ্যাঁ, চালাতাম তো! অনেক ছোট থেকে লাঙল চালাতাম। "

" আমার মতো ছোট থেকে! তুমি স্কুল যেতে না?"

"না,তোমার মতো ছোট থেকে নয়।আরও একটু বড় হওয়ার পর। ইস্কুল তো ভাই বেশি দিন যাওয়া হয় নাই। গ্রামের ইস্কুল শেষ হওয়ার পর বাবার কাজে সাহায্য করতে লেগে গেলাম। বাবা তো একলা তখন। মাঠে খাবার আনতাম।বাবা লাঙল চালাতো।লাঙলের পাকে পাকে উঠত মাছ,কাঁকড়া, শামুক। সেগুলো ধরে বাড়িতে নিয়ে যেতাম। "

" জমিতে চাষ দিলে মাছ বেড়য় বুঝি? "

" মাছ বলে মাছ! কই ট্যাংরা,ল্যাঠা, মাগুর, সিঙ্গ,পুটি কত রকমারি মাছ সব।ধরে শেষ করতে পারতাম না। বাটি ভরে উঠত।গামছায় বেঁধে মাথায় তুলে নাচতে নাচতে ফিরে যেতাম ঘরে। "

" দাদু,এবার যখন তুমি লাঙল চষবে, আমাকে নিয়ে আসবে বেশ।আমি মাছ ধরব।"

" সে দিন কাল আর নাই ভাই। এখন আর কোনো জমিতেই মাছ ওঠে না! "

" কেন দাদু? "

"এখন চাষের ধরণ বদলেছে ভাই। নানা ধরনের রাসায়নিক সার,কীটনাশক ছড়ানো হয় জমিতে। ওগুলো তো সব বিষ।তাই মাছ, শামুক, কাঁকড়া সব উধাও হয়ে যাচ্ছে। অথচ তখন মাঠে মাঠে কি মাছটাই না হোত।চাষ শেষ হলে চলত ঘুনি আড়ার পালা! "

"ঘুনি কি দাদু? "

" এখন তো আর ঘুনি দেখাতে পারবনা ভাই। বাশের সরু কাঠি দিয়ে বোনা চ্যাপ্টা বাক্সের মতো। জমির জল বের হওয়ার আলে এড়ে দেওয়া হত বিকেলে। বয়ে চলা জলের সঙ্গে ভেসে আসা মাছ ওই ঘুনির মধ্যে ঢুকে যেত। ঘুনির ঢোকার পথটা বেশ গোলোক ধাঁধার।ভিতরে একবার ঢুকলে আর বেরবার পথ খুঁজে পায়না। সকালে তুলে আনতাম ঘুনি। সে কি মাছ ভাই। খেয়ে শেষ করতে পারতাম না। ঝাল,চচ্চড়ি, অম্বল -গ্রাসে গ্রাসে মাছের মুড়ো।এই চলত সেই আশ্বিন মাস পর্যন্ত। সাধে কি বলে মাছে ভাতে বাঙালি। বাঙালির ঘরে মাছের অভাব কোন দিন ছিল না। ভাতের অভাব হয়েছে, কিন্তু মাছের অভাব কোনো দিন হয় নাই। "

" ভাতের অভাব কেন বলছ দাদু? তোমাদের তো জমি আছে! " 

" জমি থাকলে কি হবে ভাই, কোনো বছর বানের জলে ভেসে যেত,কোনো বছর শুখায় যেত মরে! গায়ে গতরে খেটে এক বিঘায় ফলত মোটে বস্তা চারেক ধান।এখনকার মতো বিঘায় আঠারো কুড়ি বস্তা ধান তখন স্বপ্নেও কল্পনা করা যেত না। "

তুতুন বিজ্ঞের মতো জবাব দিল-

" অ- বুঝেছি! "

" শোন এবার কুমিরের কথাটা বলি।আগের দিন আমাদের পাড়ারই স্বপন কাকা জমিটা চাষ দিয়ে গিয়েছিল। তখনই লাঙলের ফালে কুমিরের ডিমগুলো সব ভেঙে গেছে। স্বপন কাকা দেখে নাই। মাটি চাপা ছিল তো।দেখলে হয়তো পাশে সরিয়ে রাখত।"

দাদুকে মাঝ পথে থামিয়ে তুতুন জিজ্ঞাসা করল -

"তোমাদের জমি, তাহলে স্বপন কাকু চাষ দিতে এল কেন? "

" তখন ও রকমই ছিল ভাই। মানুষের সঙ্গে মানুষের সদ্ভাব ছিল খুব। সবাই সবার কাজ করে দিত।কেউ আসত তার লাঙল নিয়ে, কেউ আসত ধান রোয়া গাড়া করতে। অল্পস্বল্প জমির চাষিরা এই ভাবে একে অন্যের কাজ করে দিত। কম বেশির হিসাব কেউ করত না।সবার চাষ হওয়া নিয়ে কথা। এই তো সেবার নদীর বাঁধ ভেঙে সব মাটির বাড়িই প্রায় ভেঙে পড়ল। অনেকের চাষের জমিতে পরল বালির চরা। বানে ক্ষেত খামার গেল, ঘর বাড়ি গেল। কিন্তু মানুষ তো ছিল। আবার সব গড়ে উঠল। যারা দেওয়াল তুলতে জানতো, তারা লেগে গেল দেওয়াল তুলতে। কেউ এসে বেঁধে দিল চালের কাঠামো। বারুইরা এলো চাল ছাওয়াতে। কেবল ঘরামীর বাড়িতে দুবেলা ভর পেট খেয়ে রঙ্গ রসিকতা করে গায়ে গতরে খেটে বছর না ঘুরতেই গড়ে উঠল আস্ত একটা গ্রাম। মানুষের সেই মনগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেল ভাই! "


এত কথা তুতুনের ভালো লাগছিল না।সে কুমির নিয়ে ব্যস্ত। তাই কথার মাঝেই জিজ্ঞাসা করল -

" কুমিরের ডিমগুলো কি হল দাদু? "

"স্বপন কাকা তো কুমিরের ডিম ভেঙে ফেলেছে। তাই দেখে কুমির উঠলো খেপে! সারারাত তক্কে তক্কে ছিল। ভোর বেলায় আমি এলাম লাঙল নিয়ে। কুমির ব্যাটা তার ডিম পাড়ার জায়গাটিতেই ঘাপটি মেরে বসেছিল।লাঙল নিয়ে যেই এসেছি ওখানে, সে ব্যাটা কামড়ে ধরেছে গরুর একটা পা।গরুটাও ছিল ভীষণ তেজি।যেমনি পায়ে কামড়ে ধরা, অমনি পা দিয়ে মারল কষে একটা লাথি! কুমির ব্যাটা ছিটকে দশ হাত দূরে গিয়ে পরল। ঝপাৎ করে একটা শব্দ হল বটে , তবে আবছা অন্ধকারে কিছু ঠাওর হল না। আমি ভাবলাম গরুর পায়ে লেগে কাদার চাঙর বুঝি ছিটকে গেল! ফিরতি পাকেই ভুলটা গেল ভেঙে। লাথি খেয়ে কুমির তখন আরও খেপে উঠেছে। ফিরতি পাকে লাঙলটা ওখানে আসতেই কুমিরটা হামলে পরল লাঙলের উপরে। হা করে কাদায় মুখ গুঁজে গিলে ফেলল লাঙলের ফলাটাই! আর যায় কোথায়! ধারালো ফলা কুমিরের গলা অবধি গেঁথে গেল। ঘষটে ঘষটে কিছুটা গিয়ে লাঙলটা আটকে গেল। কুমির ব্যাটা তখন যন্ত্রণায় এমন ল্যাজের ঝাপটা শুরু করেছে, গোটা জমির কাদা ছিটকে দহের জলে পরার অবস্থা। বেগতিক বুঝে আমি লাঙলটা একবার পিছনে টানি,একবার কুমিরের লেজ ধরে টেনে ছাড়ানোর চেষ্টা করি।কিন্তু কুমিরের ল্যাজে তখন হাত দেয় কার সাধ্য! তবে কুমিরের লড়াইটা বেশিক্ষণ চলল না।কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ছটফটানি থেমে গেল। তারপর লাঙলের ফলা থেকে টেনে বের করলাম তাকে। সে কি কম কসরত ভাই! লাঙলের ফলা থেকে ব্যাটাকে বের করতে আমার তো কালঘাম ছোটার অবস্থা! অনেক কষ্টে তাকে উদ্ধার করে তুলে আনলাম আলে!সকাল হতেই ছড়িয়ে পরল খবর। পুরো গ্রাম ভেঙে পরল তাকে দেখার জন্যে। বাড়ির বউরা,যারা কোনোদিন মাঠের মুখ দেখে নাই, তারাও এলো ঘোমটায় মুখ ঢেকে। তোমার এখানকার ঠাকুমাও এসেছিল ওদের সঙ্গে। "

" কুমিরটা কোথায় রেখেছো দাদু?"

" ওই তালার ধারে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে দিয়েছিলাম। "

" তুমি কুমিরটা সবাইকে দেখালে। তাহলে আমাকে ডাকলে না কেন? তুমি কি জানতে না,গুসকরায় তুতুন আছে? "

দাদু তুতুনের চিবুক ধরে একটু হাসলেন।উত্তর খোঁজার জন্য চারপাশে একবার তাকালেন। শেষে বললেন -

" খুব ভুল হয়ে গেছে ভাই। আর হবে না এমন ভুল। এবার যখন কুমির ধরব,তোমাকে ঠিক ডেকে নোবো।"



Rate this content
Log in