SUSHANTA KUMAR GHOSH

Children Stories Inspirational Children

3  

SUSHANTA KUMAR GHOSH

Children Stories Inspirational Children

ভয় আছে, ভূত নাই

ভয় আছে, ভূত নাই

5 mins
8



গণ্ডগোলটা পাকল টুকুসকে নিয়ে। সেই যে ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিল, আর থামল না।টুকুস থেকে গুজু ফুচু হয়ে কান্নার ঢেউ ছড়িয়ে পরল গোটা ইস্কুলে। একটা হলে তাও হয়! দু'দুটো ভূত! তুতুন দাদার মালা ভূত আর তিতাস দিদির পয়া ভূতের দাপটে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে কচিকাঁচা মহলে। কেন হবে না! অমন যে বাহাদুর তুতুন, যে কিনা বুক ফুলিয়ে হানা দিল বাঘের আস্তানায়! চোখে চোখ রেখে গল্প করে এল এক কালের ত্রাস জব্বল ডাকুর সঙ্গে! একটা আলোর ঝলক দেখে সেই বাহাদুরের কেরামতিই যদি ভ্যানিশ হয়ে যায়, তাহলে টুকুসদের কি দোষ!


মালা ভূত দেখার পরে সে রাতে তুতুনের মুখে আর একটা বুলিও ফোটে নাই। মায়ের কানের কাছে একবার ফিসফিস করে সেই যে মুখ বন্ধ করেছিল, আর নড়েনি ঠোঁট। মুখ খুলল সকালে।তুতুনের মনের মধ্যে মালা ভূত জাকিয়ে বসলেও মগজ কিন্তু ঝিমিয়ে পরেনি।বাসে ওঠার পর থেকে তার সদা ব্যস্ত মস্তিষ্ক আরও ব্যস্ত হয়ে উঠল। মনের মধ্যে ভয় থাকলেও, ভয় থেকে পালিয়ে বাঁচার পাত্র সে নয়।ঘটনার আকস্মিকতায় না হয় একটু চুপসেই গিয়েছিল! তাই বলে লড়াই করবে না! তুতুন ভাবছিল ঠিক কিভাবে ভূতের সঙ্গে লড়াই করা যায়! তখনই তার মনের মধ্যে উদয় হল ব্যাপারটা।আগুন! হ্যাঁ, আগুনই তো! ভূত তো আগুনকে ভয় করে! আগুন দেখলে ভূত পালিয়ে যায়! তেমনটাই জেনেছে তুতুন। তাহলে আগুন কিভাবে ভূত হতে পারে!তুতুন চঞ্চল হয়ে উঠল। জিজ্ঞাসা করল মাকে। কিন্তু ভীড় বাসের হট্টগোলে তুতুনের কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে না পেরে মা তাকে ধমকে দিলেন। ধমক খেলেও তুতুনের মাথা কিন্তু তাতে থমকে গেল না। মনে পড়ল তিতাসের কথা। তিতাস! একবার তিতাসের কাছে পৌঁছাতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান মিলে যাবে। মা থাকুক তার মেজাজ নিয়ে! মার সাথে আলোচনা করতে তার বয়েই গেছে! 


বাড়ি ফিরেই তুতুন ছুটল তিতাসের কাছে। ভূত চেপেছে মাথায়। মনের মধ্যে জেঁকে বসা ভয়টা এখন মাথার ভিতরে কিলবিল করছে! ওটাকে মাথা থেকে না নামানো পর্যন্ত স্বস্তি নাই। একাজে তিতাস ছাড়া আর কে-ই বা আছে! মায়ের তো ওই বিশ হাজারি মেজাজ! আর বাবা? তিনি সেই যে বললেন - দেখেছ তুমি, আর জবাব চাইছ আমার কাছে? আর কিচ্ছুটি বললেন না! শুধু হাসি আর হাসি! 


তুতুনকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে তিতাস উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠল। সেও যে তুতুনের জন্য হাপিত্যেশ অপেক্ষা করে বসে আছে! তুতুন এলে তবেই না পয়া থেকে ভূতটা বের করতে পারবে! তুতুনের বিচার বুদ্ধির উপর তার অগাধ আস্তা! দৌড়ে এল তিতাস -" আয় তুতুন আয়! একটা রহস্য জনক ব্যাপার আছে! "

" রাখ তোর রহস্য জনক ব্যাপার! আমি একটা অদ্ভুত জিনিস দেখে এলাম।আমারটা আগে শোন!"

কথার পিঠে কথা চলতেই থাকে। দুজনেই চায় নিজের কথাটা আগে শোনাতে। তবে কথার পিঠে কথা বলতে গিয়ে দুজনের কথাই শোনা হয়ে গেল দুজনের! তুতুন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল তিতাসের দিকে। তিতাসের চোখে মুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট! তিতাস ভেবেছিল তুতুন ফিরলেই ভূত বেরবে পয়া থেকে! ওদিকে তুতুন ভেবেছিল তিতাসের কাছে গেলেই মাথা থেকে নেমে যাবে মালা ভূত! কিন্তু সব কিছু তালগোল পাকিয়ে গেল! পয়ার সঙ্গে মালার লুটোপুটিতে পুরো বিষয়টাই জটিল হয়ে গেল। গভীর সংকটে পড়ল ওরা।


হঠাৎ তুতুনের চোখ দুটো ঝলমল করে উঠল।ঠোঁট উঠল কেঁপে। শরীরে একটা ঢেউ খেলে গেল। তুতুন অতি ক্ষিপ্রতায় নিথর তিতাসকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে উঠল- " এই তিতাস! আমি তো দাদুদের বাড়িতে পয়া দেখে এলাম! ইয়া বড় পয়া! সেই পয়ার ভিতর থেকে ঠাম্মি রান্নার জন্য চাল বের করছিল। পয়াটা বড়। কিন্তু মুখটা যে খুব ছোট! চাল মাপার সময় মাপের সেই পাত্রটাই আটকে আটকে যাচ্ছিল! তাহলে বামুন বউ ওই সরু মুখ দিয়ে পয়ার ভিতরে ঢুকল কেমন করে!! "

তিতাস এতক্ষণে বলার মতো কথা পেল।

" হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই তো! আমিও তো দেখলাম রাঙা দিদুনের বাড়িতে পয়া! পয়ার ভিতর থেকে চাল নিয়ে চাল ভর্তি পাত্রটা রাঙা দিদুন ঠিক মত বের করতেই পারছিল না! সত্যিই তো, ওই সরু মুখ দিয়ে বামুন বউ ঢুকেছিল কিভাবে!! "


ভূতের সঙ্গে আগুনের অহিনকুল সম্পর্কটা তুতুন আগেই আবিষ্কার করে ফেলেছিল। এখন পয়ার মধ্যে আস্ত একটা মানুষ প্রবেশের অসম্ভবতার দিকটিও আবিষ্কার করে ফেলল।কিন্তু ভূত রহস্যের জট ওরা খুলতে পারল না! 


তিতাসই দিল প্রস্তাবটা। স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করবে। সেই মত টিফিনের সময় বসেছিল আলোচনা সভা।বকুল গাছের ছায়ায় বাঁধানো শানের উপর তুতুন আর তিতাসকে মাঝখানে রেখে বিলু,অংকন,শুভম,শ্রেয়া, দেওয়ালি,রুপু সবাই তখন ভূত নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন! বিচার বিশ্লেষণে প্রত্যেকেই এক একটা দিকপাল হলেও জোড়া ভূতের দাপটে ওদের ভিতরের বীরপুরুষ গুলো যে ময়দান ছেড়ে খানাখন্দে সেঁদিয়ে গিয়েছে সে ওদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ঠিক তখনই টুকুস এল শ্রেয়ার কাছে জল চাইতে। শ্রেয়ার নিজের গলাই তখন শুকিয়ে কাঠ! টুকুসের কথায় চমকে উঠে নিজেই ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলল এক বোতল জল!

ওদিকে রুপু, অরণ্য আর দেওয়ালির মধ্যে শুরু হয়েছে গুঞ্জন! রুপু এমনিতেই ভীতু! ভূতের কথা শুনে তার তখন থরহরি কম্পমান অবস্থা! কাঁপা গলায় বলেই ফেলল-

" পয়া ভুতটা যদি গড়াতে গড়াতে আমাদের স্কুলে চলে আসে, তাহলে তো আমাদের সবাইকে গিলে ফেলবে! "

কথাটা যেই না বলা, অমনি টুকুস''ভূ -উ- উ- ত" বলে জুড়ে দিল কান্না! টুকুস থেকে গুজু,টুনি,রিকু হয়ে ছড়িয়ে পরল স্কুলময়! ভ্যাঁ ভ্যাঁ রবে স্কুল উঠল ছমছমিয়ে!


কচিকাঁচাদের এভাবে কাঁদতে দেখে শিক্ষক শিক্ষিকারা তো হতভম্ব! শিক্ষা বর্ষের সূচনায় নবাগত কচিকাঁচার দল ভ্যাঁ ভ্যাঁ রবে সপ্তাহ খানেক শ্রেণিকক্ষ মাতায় বটে। কিন্তু এমন বারোয়ারী কান্না আগে কখনো ঘটেনি।তারা বেশ ঘাবড়ে গেলেন। পরে গণ ক্রন্দনের কারণ জানা গেল।শেষে রঞ্জন বাবু সবার কাছে খোলসা করলেন ব্যাপারটা।


রঞ্জন বাবু স্কুলে বিজ্ঞান পড়ান।তিনি সবাইকে ডেকে নিলেন কাছে। প্রথমে ডাক পড়ল তিতাসের। তিনি তিতাসকে জিজ্ঞাসা করলেন -" তুমি যেখানটায় পয়া ভূত গড়াতে দেখেছ,সেখানে কি আছে? "

তিতাস ঝটপট উত্তর দিল-" ও দিকটায় রেললাইন আছে। "

রঞ্জন স্যার বললেন -  " তবে শোন,তুমি যেটাকে পয়া ভূত বলে জেনেছ সেটা আসলে ভূতই নয়।ওটা রেললাইন পরিদর্শকদের গাড়ির আলো। তোমরা তো জান, রেললাইন চব্বিশ ঘন্টাই পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। পর্যবেক্ষকরা রেললাইনের উপর ঠেলা গাড়িতে যাতায়াত করেন। " 

রঞ্জন স্যারের কথা শুনে অনেকেই বলল হ্যাঁ স্যার, দেখেছি। অরণ্য বলল-"আমি স্যার প্রায় দেখি দুজন গাড়িটা রেললাইনের উপর দৌড়ে দৌড়ে ঠেলা দিতে দিতে এক সময় উঠে পরে! গতি কমে গেলে আবার নেমে ঠেলা দিতে থাকে! "

" ঠিক তাই। দিনে যেমন দেখেছ,রাতেও তেমনি রেললাইন পর্যবেক্ষণ করা হয়। তখন সঙ্গে আলো থাকে। ওই আলোটাকেই তিতাস পয়া ভূত ভেবেছে।"

সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল তিতাস -" কিন্তু স্যার, ওটা যে কিছুক্ষণ পরে আবার ফিরে এল!"

" ওদের নির্দিষ্ট একটা এলাকা থাকে। সেই পথ টুকুই তিনশ পঁয়ষট্টি দিন চব্বিশ ঘন্টাই ওরা পর্যবেক্ষণ করে! "

রঞ্জন বাবু থামতেই টুকুস হাততালি দিয়ে নাচতে নাচতে বলল-" বুঝে গেছি বুঝে গেছি। ভূত নয় রেলের আলো। "

টুকুসের কাণ্ড দেখে সবাই হো হো করে হেসে উঠল।


হাসি থামলে রঞ্জন বাবু তুতুনের কাছে মালা ভূতের গল্পটা শুনলেন। সবটা শোনার পর বললেন -" তুতুন যেখানে মালা ভূত দেখেছে, সেখানে একটা জলাভূমি আছে। পাশে একটা পুরনো দিনের ঢিবিও আছে। জলের উপর গাছের পাতা, ডালপালা, আবর্জনা এই সব পড়লে সে সব পচে মিথেন গ্যাস তৈরি হয়।ওই গ্যাস বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলেই জ্বলে ওঠে। আবার মাটির নিচেও অনেক জায়গায় মিথেন গ্যাস থাকে। শুষ্ক শীত কিম্বা রুক্ষ গ্রীষ্মে এঁটেল জাতীয় মাটিতে বড় বড় ফাটলের সৃষ্টি হয়।সেই ফাটল দিয়ে গ্যাস বেরলেই বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের সংস্পর্শে দপ করে জ্বলে ওঠে। শ্মশান, কবর স্থান কিম্বা ভাগাড়েও এমন ঘটনা ঘটে থাকে। মনে রেখ,আগুন কখনো ভূত হয় না। "


তুতুনের মুখে তখন বিশ্বজয়ের হাসি। আগুন যে ভূত হয় না, সেটা তার মাথাতেও এসেছিল। তবে আজকের চ্যাম্পিয়ন কিন্তু টুকুস।ভাগ্যিস সে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিয়েছিল! তবেই না তুতুনের ধারণাটা এত তাড়াতাড়ি স্বীকৃতি পেল!


Rate this content
Log in