SUSHANTA KUMAR GHOSH

Children Stories Inspirational Children

4  

SUSHANTA KUMAR GHOSH

Children Stories Inspirational Children

ডালে ডালে বাদুড় ঝোলে

ডালে ডালে বাদুড় ঝোলে

7 mins
26


ডালে ডালে বাদুড় ঝোলে

সুশান্ত কুমার ঘোষ 


ঘুম থেকে উঠেই খোঁজ পরে রাঙা দাদুর। "ও দিদুন,দাদু কোথায়? "

"দাদু মাঠে গিয়েছে ভাই। "

ব্যাস! আর যায় কোথায়! তিতাস যেই না শুনল দাদু একা একাই মাঠে গিয়েছে, অমনি জুড়ে দিল কান্না! 

"আমাকে এক্ষুনি রাঙা দাদুর কাছে নিয়ে চলো! আমাকে ডেকে দাওনি কেন! দাদু আমাকে বাদুড় দেখাবে বলেছে। আমার আর বাদুড় দেখা হল না। সব তোমার জন্যে! সব তোমার জন্যে... " বলতে বলতে মায়ের পিঠে বসিয়ে দিল কয়েকটা কিল! তার সব রাগ গিয়ে পরেছে মায়ের উপর। ঠিকই তো, মা ডেকে দেয় নি কেন! রাঙা দাদুর আর কি দোষ! সে তো আর রাঙা দাদুর কাছে ঘুমায়নি! ঘুমিয়েছিল মায়ের কাছে। সব মায়ের দোষ।মায়ের কোনো কথাই শুনবে না সে!


রাঙা দিদুন তাকে কোলে তুলে নিয়েছে। দিদুনের কাধে মুখ লুকিয়ে তখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে তিতাস। রাঙা দিদুন বললেন -

" দিদি ভাই, তুমি ব্রাশ করে চা খেয়ে নাও, তার মধ্যেই দাদু এসে যাবে। দাদু মাঠে গিয়েছে। কেমন ঝুড়ি ভর্তি সবজি আনবে দেখো। কেবল বয়ে আনতে পারলেই হল।দাদু কত কত সবজি আনছে দেখো না। ঝিঙে, উচ্ছে,পটল,ঢেঁড়স,বেগুন, কুমড়ো, শশা, খেঁড়ো,ডাঁটা, কুমড়ো ফুল। তুমি তো কুমড়ো ফুলের বড়া খেতে ভালোবাসো।কুমড়ো ফুলের বড়া তো হবেই।আর কি কি খেতে চাও আমাকে বলে দাও। আমি সব নিজের হাতে রান্না করে দোবো। মামীমাদের আজ রান্না শালায় ঢুকতেই দোবো না।আমার দিদি ভাই খাবে বলে কথা। সব আমি নিজের হাতে করব।"


রাঙা দিদুনের কথা শুনতে শুনতে তিতাস কাঁদতেই ভুলে গেল। রাঙা দিদুন যে খুব ভালো রান্না করতে পারে, তিতাস সে কথা মায়ের কাছেই শুনেছে।মা প্রায়শই বলেন , রাঙা পিসির হাতের রান্না একবার যে খাবে, সে আর ভুলতে পারবেনা কোনো দিন। রান্নার স্বাদ যেন জিভে লেগে থাকে

। ঝাল,ঝোল,চচ্চড়ি,অম্বল -রাঙা পিসি যা-ই রাঁধবে সবই যেন অমৃত।


রাঙা দিদুনের রঙে নয়,তার গুণেই নাকি রাঙা দাদু মুগ্ধ হয়েছিল। নব সম্বন্ধের দিন কুমড়ো খোসা আর চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি খেয়ে হবু বর তো খুশিতে ডগমগ একেবারে! পরে যখন শুনলেন স্বয়ং পাত্রীই রেঁধেছে চচ্চড়ি,আর যায় কোথায়! এক দেখাতেই পাকা হয়ে গেল সব। মা বলেন - রাঙা দিদুনের বয়স নাকি তখন বার তের বছর! তিতাস মাকে জিজ্ঞাসাও করেছিল  মা সেই চচ্চড়ি খেয়েছিল কিনা। মা তো হেসেই খুন! 

"আমি!!!আমি তখন কোথায় তিতাস! আমার বাবারই তখন তোমার মতো বয়স! "

তাই তো! মা তাহলে ছিল কোথায় তখন! তিতাস জিজ্ঞাসাই করে বসেছিল মাকে -

"তাহলে তুমি ছিলে কোথায়? "

মা একটু ভেবে উত্তর দিয়েছিল -"আমার বিয়ের আগে তুমি যেখানে ছিলে,আমিও সেখানেই ছিলাম! "

তিতাস বিজ্ঞের মতো ঘাড় নেড়ে বলেছিল -" অ- বুঝে গেছি! " যেন কত কালের অভিজ্ঞ সে!


ইতিমধ্যে রাঙা দাদু ক্ষেত থেকে ঝুড়ি ভর্তি সবজি নিয়ে ফিরে এল! সবজির ঝুড়িটা তিতাসের সামনে নামিয়ে বলল-

" এই দেখো দিদি ভাই, আমাদের ক্ষেতের সবজি। কোনো ওষুধ নাই, কোনো রঙ নাই।গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা টাটকা সবজি সব।" তিতাস দেখল ঝকঝকে তাজা সব! বাবা বাজার থেকে যে সব পুঁই শাক ডাঁটা নিয়ে আসে সেগুলো কেমন নেতিয়ে থাকে। আলু বেগুন পটলে হাত দিলে হাতে কেমন রঙ লেগে যায়! দাদুর আনা সবজিগুলো শিশির ধোয়া টাটকা একেবারে। কুমড়োর ফুলগুলো বেশ বড় বড়। বাবা তো বাজার থেকে এমন ফুল কোনো দিন আনে নাই। সবই কেমন নেতিয়ে যাওয়া শুকনো শুকনো,পুজোর বাসি ফুলের মতো!


" কি দিদি ভাই, তুমি তৈরি তো? এবার আমরা বাদুড় তলা যাব। চল বেড়িয়ে পড়ি। দেরি করলে খুব রোদ হয়ে যাবে। " 

রাঙা দাদুর কথায় খুব লজ্জা পেয়ে গেল তিতাস। তৈরি হওয়া তো পরের কথা, এখনো ব্রাশ করাই হয় নাই তার! কেন যে মিছিমিছি মায়ের উপর রাগ করতে গেল! তার থেকে ব্রাশ করে চা খেয়ে তৈরি হয়ে থাকলে এক্ষুনি বেড়িয়ে পড়া যেত। তিতাস সবজির ঝুড়ি ছেড়ে প্রায় লাফ দিয়ে ব্রাশ হাতে কলতলায় চলে গেল। কোনো রকম দাঁতটা মেজে একটু হরলিক্স আর বিস্কুট খেয়েই একটা রঙচঙে ছাতা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল দাদুর সাথে। 


 নদীর বাঁধ ঘেষা রাস্তা ধরে যাচ্ছে ওরা। "এ তো পিচ রাস্তা। চকচক করছে। নতুন মনে হচ্ছে। "


" রাস্তাটা এ বছরই হয়েছে দিদি ভাই। একেবারে নতুন।দুমাসও হয়নি। আগে মাটির রাস্তা ছিল। তারও আগে এদিকে কোনো রাস্তাই ছিল না। সরু আল পথ ধরে যাওয়া আসা করতে হত।একটা সাইকেল যেত কোনো রকমে। তাও বর্ষাকালে সাইকেলে যাওয়া যেত না। একেবারে চটচটে কাদা। পায়ে হেঁটে গেলেও পিছল খেতে হত।"


একটু এগিয়ে যেতেই একটা কার্লভাট পরল। কার্লভাটটা কেমন ভাঙা ভাঙা মনে হচ্ছে। তিতাস দাদুকে জিজ্ঞাসা করল -

"ও দাদু, এটা তো নতুন বলছ! তাহলে ভাঙা কেন? "

রাঙা দাদু বললেন -"এটা এক বছরের পুরনো। তার আগে এখানে বড় বড় পাইপ বসানো ছিল। পিচ রাস্তা করার সময় কার্লভাটটা বানানো হল।আবার ভেঙেও গেল! "

" ভাঙলো কেন? "

" কি করে জানব দিদি ভাই! হয়তো যেমন শক্ত করে তৈরি করার প্রয়োজন ছিল, তেমন করে তৈরি করা হয় নাই। সব উপকরণ পরিমাণ মতো দেওয়া হয় নাই। ভালো তদারকি হয় নাই। যেখানে যেমনটা প্রয়োজন, সেখানে তেমনটা না হলেই যে বিপত্তি! এই ধর, তোমার এক গ্লাস হরলিক্স খেলে তবে পেট ভরবে। তোমাকে এক গ্লাসের বদলে এক কাপ হরলিক্স দিলে তোমার পেট ভরবে কি! পেট তো ভরবেই না, উল্টে শরীর দুর্বল হয়ে যাবে। অসুখে পড়বে!"


তিতাস অবাক হয়ে গেল! সে কত বড় বড় ব্রিজ দেখেছে। কলকাতায়, দিল্লিতে। এই তো কিছু দিন আগেই ফারাক্কা ব্রিজ দেখে এলো! নিচ থেকে দেখল, উপর দিয়ে হাঁটল।কত বড় ব্রিজ!তার উপর দিয়ে কত বাস লরি ছুটছে, ট্রেন ছুটছে। নিচে দুরন্ত স্রোতে আছড়ে পরছে জল।কত পুরনো। অথচ কি মজবুত। হাওড়া ব্রিজ, বালি ব্রিজ, বিদ্যাসাগর সেতু- এগুলোর উপরে তো পিঁপড়ের সারির মতো বিজবিজ করছে যান বাহন।আর দাদুর এখানে! এই একটু খানি ব্রিজ! মাসে একটা গাড়িও চলে না।তাও ভেঙে পড়ছে এক বছরেই! তিতাসের অবাক হওয়ার আরও কিছু বাকি ছিল! ব্রিজ ছেড়ে একটু এগিয়ে যেতেই রাস্তার ভাঙন চোখে পরল! এরই মধ্যে পিচ রাস্তা ফেটে চৌচির! 

" ধুত্তেরি! এরা সব পিচ রাস্তা বানাতেই পারেনা! কেন যে বানাতে যায়! যারা ভালো বানাতে পারে তাদের দিয়ে বানালেই তো পারতো!"

তিতাস দাদুকে বলল কথাটা। দাদু কিছু বললেন না।কেবল হাসলেন! 


গল্প করতে করতেই ওরা বাদুড় তলায় পৌঁছে যায়। পাশাপাশি দুটি বিরাট বটগাছ। বটের শাখা প্রশাখা অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ডালে ডালে ঝুলে আছে হাজার হাজার বাদুড়। এত বাদুড়ের জন্যই জায়গাটাকে বাদুড় তলা বলে। আঁকশার মতো গাছের ডালে পা লাগিয়ে সারি সারি ঝুলছে বাদুড়! অসংখ্য বাদুড়! দু'শ না পাঁচশ না পাঁচ হাজার বুঝতে পারে না তিতাস!

সে হাত নেড়ে ওদের ওড়াতে যায়। কিন্তু একটা বাদুড়ও ওড়ে না। তিতাস বুঝতে পারে না বাদুড়ের মাথা গুলো কেন নিচের দিকে ঝুলে আছে। পা দিয়ে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে আছে! তিতাসের ভয় করছে। মনে হচ্ছে যদি পরে যায়! সে তো জানালার রড ধরে একবার ঝুলতে গেলেই হাঁপিয়ে যায়। হাত ধরে যায়। হাতের তালু লাল হয়ে ওঠে। কেমন জ্বালা করে। অথচ বাদুড় গুলো পায়ের নখে ডাল আঁকড়ে ধরে ঝুলে আছে। 

দাদু বললেন -" ওরা কেবল ঝুলেই থাকে না। দিনের বেলা ঝুলতে ঝুলতে ঘুমায়।ওরা সবাই এখন ঘুমাচ্ছে। নিশাচর তো।"


নিশাচর কথাটা তিতাস শুনেছে। যারা রাতের বেলায় খাবারের সন্ধানে বেড়য়, তাদের নিশাচর বলে। 

"ওরা কি খায় তাহলে? "

" বাদুড় ফলাহারী। যে সময়ে যে ফল পায় সেই ফল খায়।এই যেমন আম জাম কাঁঠাল পেঁপে পেয়ারা তাল খেজুর আতা বড়াল। এছাড়াও বিভিন্ন বুনো ফল যা পায় তাই খায়।আগে তো এদিকে অনেক ফলের গাছ ছিল। এখন আর সে সব নাই। রাত হলেই ওরা খাবারের খোঁজে অনেক অনেক দূরে চলে যায়। তবে যত দূরেরই যাক সূর্যোদয়ের আগে কিন্তু ঘরে ফিরে আসে।"

" গাছে তো কোথাও বাসা দেখছি না? বৃষ্টি হলে কোথায় থাকে? কোথায় ডিম পাড়ে?"

" ঝড় বৃষ্টি যাই হোক, ওরা গাছের ডালেই ঝুলে থাকে। আর অন্য পাখিদের মতো বাদুড় ডিম পাড়ে না। মায়ের পেট থেকেই বাচ্চার জন্ম হয়।মায়ের স্তন পান করে। জন্মের পরে মায়ের কোলেই ঝুলতে থাকে। "

তিতাস অবাক হয়ে যায়! মায়ের পেট থেকে বাদুড়ের জন্ম হয়! আবার মায়ের দুধও পান করে! তাহলে তো ওরা ম্যামালস! বাড়ি ফিরেই সে তুতুনকে প্রশ্ন করে অবাক করে দেবে!


তিতাস এতক্ষণ উপরের দিকে তাকিয়ে বাদুড় দেখছিল!চোখ নিচে নামেই নাই।গাছের তলাটা তাই খেয়াল করে নাই।জুতোয় চটচটে কিছু একটা লাগতে খেয়াল হল।ও -মা-গো! পুরো গাছ তলাটা কালো কালো হলুদ হলুদ কি সব যেন ছড়িয়ে আছে! 

"ও দাদু, এগুলো কী গো!!"

"বাদুড়ের মল দিদি ভাই! "

" মল! মানে পায়খানা!! "

"হ্যাঁ, তাই! তবে ওরা কিন্তু মুখ দিয়ে মল ত্যাগ করে! "

শুনে তিতাসের শরীর কেমন ঘিনঘিন করে উঠলো! 

" ছিঃ! মা গো!"

"ছিঃ করছ বটে তবে ওদের মল কিন্তু মানুষ বা অন্য প্রাণীদের মতো অত নোংরা নয়! তুমি দেখেই বুঝতে পারছ।এতক্ষণ এখানে আছো, কোনো দুর্গন্ধ পেয়েছ কি?"


আর কত অবাক হবে তিতাস! তার যে অবাক হওয়ার শেষ নাই! যে মুখে খায়, সেই মুখেই মল ত্যাগ করে! আর সত্যিই তো! কোনো দুর্গন্ধ তো নাই! 

" আচ্ছা দাদু,ওরা পালিয়ে যায় না? "

" পালিয়ে আর কোথায় যাবে! এত বড় গাছ তো এ তল্লাটে আর কোথাও নাই! বড় গাছ ছাড়া ওরা থাকতে পারেনা! তাই হাজার অত্যাচার সয়েও এই গাছ দুটো আঁকড়ে পরে আছে! "

" অত্যাচার! ওদের উপর কারা অত্যাচার করে? "

" মানুষ, প্রকৃতি, সভ্যতা -সবাই! ওই রেলপথ ধরে দিন রাত ঝমঝম করে ট্রেন ছুটছে। ইঁট ভাঁটার চিমনি ধোঁয়া ছাড়ছে। ইঁট,মাটি, কয়লা ফেলার শব্দ হচ্ছে দিন রাত। বোম ফাটছে,পটকা ফাটছে। লোকজনও মারছে ঢিল! আর কত সইবে ওরা! একে তো খাবারের আকাল।খাবার খুঁজতে ছুটতে হয় তেপান্তরে! তার উপর এই অত্যাচার! কোন দিন হয়তো দেখবো গাছ দুটোই কেটে ফেলা হয়েছে! সেদিন ওরাও হারিয়ে যাবে! আর ফিরবে না কখনো! "

 গাছ কাটার কথা শুনে তিতাসের বুকের ভিতরটা টনটন করে উঠলো! একটু আগেই সে ভাবছিল পরের বার তুতুনকে সঙ্গে আনবে। ওরা যদি হারিয়ে যায়, তাহলে তো তুতুনের আর দেখা হবে। সেও তো আর কখনো দেখতে পাবে না! তিতাস মনে মনে ভাবল তা যেন না হয়। গাছ যেন কাটা না হয় কখনো।


ক্রমশ...


Rate this content
Log in