SUSHANTA KUMAR GHOSH

Abstract Inspirational Children

3  

SUSHANTA KUMAR GHOSH

Abstract Inspirational Children

বক্রচঞ্চুর বকবকানি

বক্রচঞ্চুর বকবকানি

5 mins
11



ছাদের উপর কম্বল পেতে পৌষের মিঠেল রোদে পিঠ সেকতে সেকতে একাগ্র চিত্তে ছবি আঁকছিল তুতুন। তিতাস ছিল জোগানের কাজে। কাজটা তিতাসেরই,প্রকল্পের কাজ।এবারের বার্ষিক পরীক্ষায় তিতাসের জীবন বিজ্ঞানের প্রকল্পের বিষয় ' খাদ্য-খাদক চক্র।তুতুনের ছবি আকার হাত বেশ ভালো, তাই তিতাস তাকে ডেকেছে। চতুর্থ শ্রেণির খাদক হিসাবে একটা বাজপাখির ছবি আকার পর তিতাস বলছিল তুতুনকে-' দেখ তুতুন, সামান্য একটা ঘুঘুর মত চেহারার পাখি, কিন্তু ভয়ংকর তেজ! ভয়াল গোখরো কেউটেকেও ছিঁড়ে ফেলতে পারে! একবার ভাব তো,ওই টুকু একটা পাখি, কিন্তু কী ভয়ংকর হিংস্র আর রাগী! '


একটা ট্যাঁক ট্যাঁক শব্দ অনেক ক্ষণ থেকেই শোনা যাচ্ছিল। ওরা ভেবেছিল পায়রা,চড়ুই, শালিক কত পাখিই তো ছাদে আসছে যাচ্ছে,তাই ওদিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়নি ওরা; মনোযোগ ছিল কাজের প্রতি। কিন্তু তিতাসের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিলেকোঠার ফোঁকর থেকে একটা কর্কশ কণ্ঠ বলে উঠল- 'অঃ!আমরা ভয়ংকর! তা বেশ, তা বেশ!'

এই অপ্রত্যাশিত কর্কশ কণ্ঠ শুনে দুজনেই চমকে উঠে মাথা ঘোরাতেই চোখে পরল আগুন্তুককে! চিলেকোঠার আলো আঁধারি ঘুলঘুলিতে একটা বাজপাখি কটমট করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে! ঠিক তুতুনের ছবিটার মত,তার চোখ থেকে যেন আগুন ঝরছে। তিতাস ঘাবড়ে গেল! তুতুন সহজে ঘাবড়ে যাওয়ার ছেলে নয়;সেও পাখিটার দিকে ছুড়ে দিল তার চোখের অগ্নি শলা! চার চোখের অগ্নুৎ্পাতে হিমেল আবহাওয়াটা বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। 


" অমন আগুনে চোখে দেখছ কি? তোমরা তো সত্যিই হিংস্র! ভয়ানক, ভয়ংকর, সাংঘাতিক একেবারে! 'তুতুনের কথায় বাজ ধুনুচির মত দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল! 

" খবরদার! মিথ্যে দোষারোপ করবে না! পৃথিবীতে সব থেকে ভয়ংকর তোমরা! "

তুতুন মুখ খোলায় তিতাস কিছুটা সাহস পেল, সে-ই বাজের কথার জবাব দিল- " আমরা কেন ভয়ংকর হতে যাব; আমরা কাউকে তেড়েও ধরি না, আর ছিঁড়েও খাইনা। কেবলমাত্র আমরাই পৃথিবীর সব প্রজাতির প্রাণীকে ভালোবাসতে জানি; তাদের আদর করি,পরিচর্যা করি,রক্ষা করি!"

তিতাসের কথায় বাজ আরও রেগে উঠল-" মিথ্যে কথা! ডাহা মিথ্যে কথা! তোমরা ছোটরা যা বল, তাই কর,কিন্তু তোমাদের বড়রা করে ঠিক উল্টোটা।"

" তুমিই মিথ্যে বলছ।আমাদের বড়দের সম্পর্কে কিছু না জেনে মিছিমিছি তাদের বদনাম করছ।আমাদের এখানে কত কুকুর আছে বিড়াল আছে, কাক পায়রা আছে। আমাদের মায়েরা কত যত্ন করে তাদের খাওয়ায়।নিজের চোখেই দেখনা।(তুতুন ছাদের একটা কোনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে) ওই ওই দেখ,ছাদের ওখানটায় এখনো গমের দানা পরে আছে। মা প্রত্যেক দিন কাক শালিক পায়রাদের খাওয়ার জন্য খাবার দিয়ে যায়। তোমরা ওসব খাওনা তাই আমাদের বড়দের ভালবাসাটা দেখতে পাওনা।"

তুতুনের দৃঢ়তায় তিতাস আরও সাহসী হয়ে ওঠে।


সে এবার বাজের চোখের উপর চোখ রেখে বলে " বুঝবে কেমন করে! ফন্দিবাজ হিংস্ররা ভালোবাসার মর্ম বোঝে নাকি! দেখছিস না, কেমন চুপিসারে এসে ঘুলঘুলির ফাঁকে ঘাপটি মেরে বসে আছে! "

রাগে জ্বলে উঠল বাজ!

" খবরদার! ফন্দিবাজ বলবে না বলে রাখছি! তোমাদের বড়দের ফন্দি ফিকিরের কথা কতটুকু জান তোমরা? প্রত্যেক দিন হাজার হাজার ফন্দি, লাখ লাখ ষড়যন্ত্র আমি নিজের কানে শুনি! "

" কোথায় শোন? তোমরা কি আমাদের সঙ্গে বাস কর নাকি! ওই দেখ,চড়ুই কাক,মুনিয়া, টুনটুনি, শালিক, দোয়েল শ্যামারা আমাদের সঙ্গেই থাকে; খেয়ে যায় আমাদের হাতে।  তোমরা তো থাক কোন গোপন আস্তানায়, আর লোভ লালসার দৃষ্টিতে শুধু শিকার খোঁজ! সুযোগ পেলেই আড়াল থেকে এসে মটকে দাও ঘাড়!"

বাজ কিন্তু এবার আর রাগ দেখাল না, বাঁকা ঠোঁটের ফাঁকে একটু হাসল।তবে হাসিটা বড্ড রহস্যময় আর বিদ্রুপের। তুতুন সব হাসির অর্থ বোঝে; এটাও বুঝল।তবে রাগল না।ক্রোধ তো নয়ই। বিদ্রুপই তো।দেখাই যাক, বাজের এত বিদ্রুপ করার কারণটা কি!

" আচ্ছা বল বল, কি যেন বলছিলে, আমাদের বড়দের নিয়ে? "

" কি আর বলব তোমাদের;তোমাদেরই তো অভিভাবক ওরা। শুনলে তোমরা দুঃখ পাবে,আবার না শুনলেও জানবে না। তোমাদের জানাটাও দরকার। "

" খারাপ লোকের জন্য আর খারাপ বিষয়ের জন্য আমরা ব্যথিত হলেও দুঃখ পাই না।তুমি বল বাজ,আমরা আমাদের বড়দের আসল স্বরূপগুলো বুঝতে চাই।" বলল তিতাস।

বাজ ঘাড় ঘুরিয়ে অনেকটা দূরে একটা মোবাইল টাওয়ার দেখিয়ে বলল-" ওই দেখ,ওটা দেখতে পাচ্ছ?"

দুজনেই বলল -" হ্যাঁ, দেখছি তো,মোবাইল টাওয়ার। আমাদের এখানে অমন অনেক আছে। "

" হ্যাঁ, তোমরা মোবাইল টাওয়ার বল আর যাই বল,আমার কাছে ওটা বসত বাড়ি। আমি ওখানেই থাকি।"

" তুমি ওখানে থাক!" অবাক হল তুতুন।

"হ্যাঁ, আর কোথায় থাকব বল।আমরা একটু উঁচু আর গোপন আস্তানা পছন্দ করি। অনেক উঁচুতে থেকে আড়চোখে নজর না রাখলে খাব কি। বৃক্ষ বলে তো আর কিছু রাখলে না কোথাও। বট অশ্বত্থ তো না-ই, রেললাইনের ধারে ক'টা শিমুল গাছ ছিল; সেও গেল। আমরাও আর হাত গোনা কয়েকটায় এসে ঠেকেছি। ওই টাওয়ারে টাওয়ারেই আস্তানা গেড়েছি সব।"

তিতাস কিছু একটা ভেবে বলল-"ওই টাওয়ারটা তো একবছর আগে বসেছে। আগে কোথায় থাকতে? "

"ওই তো, রেললাইনের পাশে মস্ত একটা শিমুল গাছ ছিল, তারই একটা কোটরে।গাছটাও গেল,আমরাও আস্তানা হারিয়ে পথে বসলাম। এক কালে আমরাই তো এই অঞ্চলের রাজা ছিলাম। "

তুতুন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল -" সে আবার কেমন কথা? রাজারা তো মানুষ হয়।আর এটা তো লোকালয়, তোমরা কি মানুষের থেকেও বুদ্ধিমান নাকি? পশুপাখিরা তো বনের রাজা হয়। যেমন সিংহ। সেখানে মানুষ বাস করে না।"

" হ্যাঁ, তোমরা বুদ্ধিমানই বটে,তবে সুবুদ্ধির থেকে দুর্বুদ্ধিই বেশি। আমি আমার ঠাকুরদার কাছে শুনেছি, সে শুনেছে তার ঠাকুরদার কাছে আমাদের পূর্বপুরুষরা এখানেই থাকত।তোমাদের বাড়ি গুলো যেখানে রয়েছে, বহুকাল আগে ওখানে একটা ঢিবি ছিল -ছোটখাট পাহাড়ের মত।চারপাশে গাছপালা, পাশ দিয়ে বয়ে যেত নদী। এখানে লোকালয় কোথায় তখন। তোমাদের বড়রা বদবুদ্ধি দিয়ে সে সব ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিয়ে পেল্লাই সব ঘর বাড়ি বানিয়ে ফেলল।"

দুজনেই হতবাক হল!  ওরা মানুষ হয়েও এখানকার ইতিহাস বিন্দু বিসর্গ জানে না,অথচ বিশ পঁচিশ বছর জীবন চক্রের একটা বাজপাখি হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের বিবর্তন গড়গড় করে বলে দিল। না না, বাজ মিথ্যে কিছু বলে নি। এই তো, এখান থেকে মাইল পাঁচেক পর থেকেই তো জঙ্গল আর জঙ্গল। যদিও তেমন আকাশচুম্বী বৃক্ষ তেমন নেই, তবুও ছোট ছোট গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ের জঙ্গল তো এখনো আছে। 

তুতুন ভাবল আসল কথাটা শোনা দরকার, কি বলতে চায় ও আমাদের বড়দের সম্পর্কে। তাই বাজের সঙ্গে বেশ ভাবসাব করে মাখো-মাখো গলায় বলল -" আচ্ছা, তুমি আমাদের বড়দের সম্পর্কে কি যেন বলবে বলছিলে,সেটা তো বললে না?"

" কি আর বলব বল,খুব কষ্ট হয় গো,শুনলে তোমরাও কষ্ট পাবে। ছাড় ওসব কথা। তোমাদের দুজনকে খুব ভালো লেগেছে আমার। তোমাদের মত এমন বন্ধু থাকলে আমাদের আর কোনো চিন্তা থাকবে না! "

তুতুন তিতাস নাছোড়বান্দা। তারা বাজের কাছে আবদার করে বসল-" বন্ধু যখন বললে,তখন তো আর কিছু না বলার থাকে না। বল বন্ধু, তুমি যা জান সব বল আমাদের। আমরা তো বন্ধু তোমার। "

তুতুন তিতাসে আন্তরিকতায় বাজের হৃদয় গলে গেল। সে বলল-" মানুষের সংস্পর্শে থেকে তার আদব কায়দা, ভাষা, আভাস ইংগিত সব কিছু রপ্ত করে ফেলেছি আমরা। জান,টাওয়ারের মাথায় বাসা বাঁধায় রাত্রে আমরা ঘুমাতে পারি না। যত রাত বাড়ে,তত ফোনের কলরব বাড়ে। মাঝরাতে সেকি ভয়ংকর কলরব! ঠাট্টা ইয়ার্কি রঙ্গ রসিকতা, প্রেম ভালোবাসার কথায় বেশ আনন্দই পাই।কিন্তু সে সব আর কয়টা! কেবল ষড়যন্ত্র আর ষড়যন্ত্র। সরিয়ে দাও!গুম করে দাও!ফাঁসিয়ে দাও!দানা ভরে দাও! লটকে দাও!... হুমকি শাসানি... বাপরে বাপ! নিজের রক্তের সম্পর্ককেও মানে না গো! বাপ ভাইয়ের জন্যও সুপারি দেয়! "

বাজ থেমে গেল। এতক্ষণ বাজের যে চোখে আগুনের হলকা ছুটছিল,সেখানে চিকচিক করছে জল! তুতুন তিতাসের মনও বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। 


ক্রমশ.. 


'


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract