SUSHANTA KUMAR GHOSH

Children Stories Thriller Children

3  

SUSHANTA KUMAR GHOSH

Children Stories Thriller Children

ভূতের বাগান

ভূতের বাগান

5 mins
12



বাগানটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দাদু বলেছিলেন -" জায়গাটা বিশেষ সুবিধার নয়। বেলা থাকতে ফিরতে হবে। "অসুবিধাটা ঠিক কোথায়, সেটা বলেননি। আর বললেও কথাটা তুতুনের কানে ঢুকত বলে মনে হয় না। কারণ ওর মন তখন নিজের জিম্মায় ছিল না। এমন অবারিত প্রান্তর যাকে চারপাশ থেকে ডাকছে, সে এক স্থানে স্থির থাকবে কেমন করে! অস্থিরতা যার ধর্ম,নিষেধের বন্ধনে তাকে অচল করে রাখলেও, ভিতরের চঞ্চলতাকে দমিয়ে রাখা যায় না। সে প্রতীক্ষায় থাকে! সুযোগ যেই আসে, অমনি জেগে ওঠে।এমন কি স্থবির গুলোও- যেগুলো তার প্রকৃতিতে ছিল এতকাল, সেগুলোও।


তুতুনের মন এখন বাঁধন ছাড়া!সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে শালিকের ঠোঁটে খড়কুটো হয়ে। বকের পাখায় রোদ্দুর হয়ে। কখনো তার মন হাটুরে মেয়েদের মাথায় সবজির ঝাঁকার উপর বসে দোল খেতে খেতে ক্ষেত থেকে ঘরে ফিরছে। কখনো বাবুই পাখির ঠোঁট দিয়ে বাসা বুনছে তাল গাছে। এই কাকের ডাকে উড়ে এল বট গাছে, তো ওই শঙ্খ চিলের ডানায় বসে উড়ে গেল বিলের দিকে! সেও কয়েক মুহূর্ত। ধবলী গাই যেই হাম্বা ডাকল,অমনি তুতুনের মন ধবলির বাছুরের সঙ্গে জুড়ে দিল দৌড় প্রতিযোগিতা।সে এক মস্ত প্রতিযোগিতা। কোনো পক্ষের হার মানার কোন লক্ষ্মণ নাই। কিন্তু গান আছে। বেউল বাঁশিতে গোষ্ঠ পতির গান।রাখালিয়া বাঁশির মেঠো সুরে প্রান্তর জুড়ে নৃত্য করে তুতুনের মন।সুর ওঠে ভাটিয়ালির।ঢেউ জাগে তার মনে। বোঝাই গাড়ি রাস্তা চলে। গাড়োয়ান সেজে গাড়ি চালায় তুতুনের মন। সেই গাড়োয়ান এক সময় রাস্তার ধারে ধোঁয়া উঠতে দেখে গাড়ি ছেড়ে রাখাল বালকদের সঙ্গে পোড়া ছোলার হোড়া খেতে ছুটে যায়। হঠাৎ তাকে হাতছানি দেয় কচি কচি কাঁকুড়।তরমুজ ওঠে মড়মড় করে। ক্ষেতের ফসল তোলায় রত মেয়েদের হাতে কাঁচের চুড়ির টুংটাং শব্দ, খিলখিল হাসি,মৃদু মন্দ মসকারা, শাখা মৃগদের হাঁক ডাক,লম্ফঝম্প- আনন্দ আহরণের এমনতর সহস্র উপকরণ যার চারপাশে ছড়িয়ে, তাকে স্থির রাখার কৌশল মানুষ আজও খুঁজে পায় নাই। বালকের মুক্ত মন তাই সকল পাওয়ার সমারোহে সব কিছুকে কুড়িয়ে নেওয়ার আনন্দ যজ্ঞে হারিয়ে যায়। 


প্রকৃতির এই ধুলোট খেলায় হরির লুটে মেতে থাকা মনটা যখন তুতুনের জিম্মায় ফিরল,দিন ততক্ষণে নিজেকে রাতের জিম্মায় সঁপে শয়ন কক্ষের দিকে রওনা দিয়েছে। সব পাখি বাসায় ফিরেছে। সব গরু গোষ্ঠ থেকে ফিরে জাবর কাটছে গোয়ালে। ক্ষেতের ফসল ঝাঁকায় ভরে হাটুরের দল ফিরে এসেছে ঘরে। মাঠের সবজি ঘরের উঠোনে শিশির শয্যায় ঘুম পারিয়ে দাওয়ার উপর শাড়ির আঁচল পেতে সারাদিনের কর্ম ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে। সাঁঝের আজান থেমে গেছে। একটা তুলসিমঞ্চও আর নিষ্প্রদীপ নাই। পল্লীর শেষ শঙ্খ ধ্বনিটিও বেজে গেছে। তুতুনদের কিন্তু বাড়ি ফেরা হয়নি। তরমুজ দাদুর আমন্ত্রণে চরিপুরের চলমান জগতে এসে সেখানকার গতিময় রূপ রস গন্ধে ছব্দে তুতুন এমন বিভোর হয়েগিয়েছিল, যে তার পুরনো জগতের কথা ভুলেই গিয়েছিল। 


গোধূলির শেষ আভাটুকুও যখন মসিময় হয়ে উঠল, তুতুন চোখে অন্ধকার দেখল! মনে পড়ল মাকে। মায়ের জন্য ব্যকুল হয়ে উঠল তার মন।মায়ের মতো এমন সব পেয়েছির দেশ যে আর কিছু নাই তার কাছে। যার মা নাই,তার গাঁ নাই, ঘর নাই। বাড়ি নাই! আহার নাই! নিদ্রা নাই! সুখ নাই! শুন্য পৃথিবীতে জীবনটাই অর্থহীন। কিন্তু যার মা আছে, সর্ব রিক্তের মাঝেও সে রাজা। নিঃস্বতার মাঝেও তার একটি অলোক সামান্য নিজস্ব জগৎ আছে।

তুতুনকে সেখানে ফিরিয়ে দেওয়ার দায় এখন দাদুর। পথ কিন্তু একটাই।ভুতকুড়ের বাগানের পাশ দিয়েই যেতে হবে। রাতের অন্ধকার নামলে ওদিকে কেউ একটা যায় না। ও বাগান এখন কিংবদন্তি। বছরের পর বছর ধরে তার উপর রঙ পালিশের প্রলেপ পরে সেটা এমনই বর্ণময় হয়ে উঠেছে যে সেই বহুস্তরীয় বর্ণের প্রলেপ সরিয়ে কেউ আর হাড় কংকালটা খুঁজতে যায় না। সমকালের কুটিলত, কুশ্রীতার বে আব্রু ছায়া ওদের নিস্তরঙ্গ গ্রাম্যজীবনে প্রভাব ফেললেও, ভূতকুড়ে বাগানের প্রাগৈতিহাসিক মিথ কিন্তু আদিম যুগের অন্ধকারের মতই ওদের জীবনে এখনো জেঁকে বসে আছে। 

কেউ বলেন ওটা ফাঁসুরেদের আখড়া ছিল। কেউ বলেন ওটা জমিদারের বাগান বাড়ি। কেউ বলেন ওটা নীলকর সাহেবদের প্রমোদ কানন! তবে ওটা যে বধ্যভূমি, শতশত নর নারীর প্রাণ গিয়েছে ওখানে, সে বিষয়ে নবীন প্রবীণ সকলেই একমত! 


সেদিনের সেই পিশাচ ঠগী, নিষ্ঠুর জমিদার কিম্বা বর্বর নীলকর সাহেবরা আজ আর নাই। কিন্তু তাদের হাতে নিহত হওয়া নরনারীর প্রেতাত্মা গুলো এখনো মানুষ জাতটার উপর নাকি ভয়ংকর ক্ষেপে আছে! তাই সুযোগ পেলেই ঘাড় মটকে দেয়! ওরা এখনো সুর তুলে কাঁদে! গাছে গাছে দোল খায়! এবং দুপেয়ের প্রতীক্ষায় ওঁত পেতে থাকে! এই বিশ্বাসের অবশ্য বাস্তব ভিত্তিও কিছু আছে। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি মৃত দেহ ওই বাগান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সে সব প্রেতাত্মার কাজ নাকি দুপেয়ের কাজ, তা অবশ্য রহস্যাবৃত।


সে যাই হোক না কেন, তাতে আশু সমস্যার সমাধান হয় না। সমাধানটা তরমুজ দাদুই করলেন। বিশেষ করে তার আমন্ত্রণেই হরিপুর এসেছে তুতুন। নির্ঝঞ্ঝাটে ফেরার ব্যবস্থাটা অতএব তাকেই করতে হবে। তরমুজ দাদু দুজন পড়শীকে সঙ্গে নিয়ে তুতুনদের ভূতকুড়ের বাগানটা পার করার ব্যবস্থা করলেন। রওনা দেওয়ার আগে মন্ত্র আউরে বেঁধে ফেললেন সবার শরীর! এই মন্ত্রের বর্ম্য ভেদ করে মানুষের শরীর স্পর্শ করার শক্তি নাকি ভুতের নাই,এটাই ওদের বিশ্বাস। চিরাচরিত লোক জীবনের আধার থেকে প্রাপ্ত এই সব সংস্কারের বর্ম্যই ওদের পুরুষানুক্রমে বিপদতারণের ভূমিকা পালন করে আসছে। আজ সেই বর্ম্যেই শরীর মুড়ে ওরা রওনা দিল।


গ্রামের সীমানা পেরতেই একটা অদ্ভুত শব্দ কানে এল। এমন শব্দের সঙ্গে তুতুনের আগে পরিচয় ঘটেনি।কেবল অশ্রুতপূর্বই নয়,বেশ অভিনব তার অনুরণন! সঙ্গের লোকজন একটা জমাট গল্প ফেঁদে তুতুনকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল।কিন্তু শব্দটা তার নিজের চমৎকারিত্বেই তুতুনের মগ্নতা ভেঙে তাকে কৌতূহলী করে তুলল।

" কি দাদু!কিসের শব্দ ওটা?"

" কিছু না! ও এমনিই! "

কথা পাল্টে ওরা তুতুনকে গল্পের মধ্যে ফেরাতে চাইল! পথ চলার বেগ বেড়ে গেল। আবার একটা শব্দ! এটা আগের মত নয়।ভিন্ন রকম। ওরা যত বাগানের কাছাকাছি আসে,বহুমাত্রিক শব্দের বৈচিত্র ততই বাড়ে! তবে অনর্গল নয়, থেমে থেমে। কেটে কেটে! কখনো নুপুরের ধ্বনি, কখনো বা ঘুঙুরের শব্দ! কখনো তরোয়ালের ঝনঝনানি! কখনো পীড়িতা নারীর চাপা কান্না! কখনো বা শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি! 


মন্ত্রের বর্ম্যে শরীর যতই বাঁধা থাকুক, তাতে শিহরণ আটকায় না! ওরা শিউরে ওঠে! হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়।বেড়ে যায় হাটার গতি। আর এই সবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তুতুনের কৌতূহলও ঊর্ধ্বমুখী হয়!

"ও কিছু নয়---ও এমনই... শেয়াল ডাকছে মনে হয়... শুকনো পাতা পরছে গাছ থেকে..ওই মেঠো পাড়ায় কেউ ঝগড়া করছে..ও কারোর ছেলে কাঁদছে " এই সব বলে তুতুনকে বোঝানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে। 

" ও দাদু! গ্রাম তো অনেক দূরে। কান্না তো কাছেই মনে হচ্ছে! "

" রাতের শব্দ ওইরকমই হয়।দূরের হলেও কাছেই মনে হয়। " 

তুতুন এই নিয়ে আর কিছু বলল না।অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও গ্রাম গুলো যে দূরে সেটা তুতুন বুঝতে পারছে দু'একটা মিটমিটে আলো দেখে। কিন্তু তাও দূরের আওয়াজ, কেবল কান্না নয়,আরও সব অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ বেশ স্পষ্ট শোনা যায়! মনে একটা খটকা লাগল তুতুনের। কিন্তু আর বিশেষ কৌতূহল দেখাল না।দাদুরা তো এখানকার লোক। জানে সব কিছু। দাদু কি আর মিথ্যে বলবে। এইসবই ভাবল তুতুন। 


বাগান পার করে তরমুজ দাদুরা ফিরে গেলেন।তুতুনের দাদুও তুতুনকে নিয়ে প্রায় অর্ধেক সময়ে বাকি পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরলেন। গ্রামে ঢুকে ঘাম দিয়ে যেন ভয় নামল! কিন্তু মনে একটা খটকা জেগে রইল! ফুলকি! আগুনের ফুলকি " প্রেতাত্মারা মানুষের ঘাড় না হয় মটকায়! কিন্তু বিড়ি সিগারেট কিম্বা গঞ্জিকা ফোঁকে এমন কথা তো কোনো গুণিনের মুখেও শোনে নাই কখনো! তাহলে!!! 


চলবে...


Rate this content
Log in