পাশাপাশি বসাবসি
পাশাপাশি বসাবসি
এই ঘটনাটা তখনকার পৃথিবীর যখন উইনডো বলতে বোঝাতো জানালা আর আপেল বা ব্ল্যাকবেরী মানে ছিল ফল ৷ দুনিয়াটা তখনো ইন্টারনেটের জালে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে পড়েনি ৷
তখন বাংলার আনাচে কানাচে যেসব আধাশহর বা মফঃস্বল শহরগুলি স্বমহিমায় বিরাজ করত, তার প্রায় প্রতিটিতেই একটি করে বাস স্ট্যান্ড থাকতো আর তার আশে পাশে থাকতো চায়ের দোকান ৷
এবং যদি সাকুল্যে তিনটিও চায়ের দোকান থেকে থাকে, তার একটির অন্তত মালিকের নাম স্বপন হতেই হতো |
এই রকম বঙ্গ সন্তান খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর, যে কোনো না কোনো স্বপন দার চায়ের দোকানে কখনো না কখনো চা খায়নি; বিশেষ করে যারা শহরতলী বা মফঃস্বল শহরে ছোঁড়া থেকে ধেড়ে হয়েছে |
তা যা বলছিলাম, এরকম একটি শহরের এরকমই একটি স্বপন দার চায়ের দোকানে দুপুর নাগাদ আমাদের গল্পের মূল চরিত্র পিকলুর প্রবেশ ৷
আজ্ঞে হ্যাঁ ৷ মূল চরিত্র, কিন্তু নায়ক নয় ৷ কারন, বত্রিশ বসন্ত পার করে আসা আমাদের পিকলু এখনো অব্দি নায়কোচিত এমন কিছুই করে উঠতে পারেনি, যার সুবাদে তাকে নায়ক বলা হবে ৷
পড়াশুনো, চাকরী বাকরী তো দূরস্ত! এমনকি একটা প্রেম পর্যন্ত পিকলু করতে পারেনি, নিদেন পক্ষে একটা ব্যর্থ প্রেম ; তাও পিকলুর দ্বারা হয়নি ৷ কারন? কারন পিকলুর কিম্ভূত রকমের কুঁড়েমি আর অতলান্ত আলস্য ৷
হ্যাঁ, পিকলু অতি বিচ্ছিরি রকমের কুঁড়ে, এতটাই, যে গায়ে মশা বসলেও সে তাড়িয়ে বা চাপড় দিয়ে মেরে উঠতে পারেনা, সেটাও অন্য কেউ করে দিলে ভালো হয় ৷
নেহাত, প্রাতঃকৃত্য আর দিনে তিন বার উদর পূরণ; এ দুটি কাজ অন্য কারো করার জো নেই, তাই, অগত্যা, নিতান্ত নিরুপায় হয়ে, এই কাজ গুলি নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও পিকলু কেই করতে হয় |
আর এই সুকঠিন দৈনিক ক্রিয়া গুলি সম্পাদন করতে গিয়ে যখনি পিকলু ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখনি ক্লান্ত শ্রান্ত শরীর আর মনটাকে কোনোরকমে টানতে টানতে হাজির হয় স্বপন দার চায়ের দোকানে; একটু শান্তির খোঁজে !!
এই জন্যই তো পিকলুর একটা প্রেম অথবা ব্যর্থ প্রেম পর্যন্ত হয়নি ৷
প্রেমে ব্যর্থ হওয়াটা হল তৃতীয় ধাপ, এর আগে অন্তত দুটি ধাপ পেরোতে হয়৷ প্রথমটি হল একটি সম্ভাব্য প্রেমিকা খুঁজে বার করা এবং পরের ধাপটি হল তাকে প্রেম নিবেদন করা ৷
এখন ঘটনাটা হল, এই দুটি ধাপ পেরোনোর পরিশ্রমও পিকলু বাবু করতে নারাজ ৷
অতএব প্রেম, পড়া শুনো, চাকরি বাকরি এবং ব্যর্থ প্রেম - পিকলুর জীবনে এই চারটির কোনো টিই হয়নি ৷তবে হ্যাঁ, পিকলু নাকি গান টান গায় আবার কবিতা টবিতাও লেখে !!
তা , চলুন দেখি, কি মতলবে পিকলু চায়ের দোকানে টুকলো ৷
পিকলু স্বপনদার চায়ের দোকানে ঢুকে বেন্চে বসতে বসতে বলে, ও স্বপন দা, এক কাপ চা আর একটা গোল্ড ফ্লেক দাও। সকাল থেকে বসে বসে মেজাজ টা বিগড়ে আছে।
স্বপন দার দোকানে ছ ফুটে দু গজ হয়ে যাওয়া চা খেয়ে খদ্দেরের মুখ খানি যেরকম হয়ে যায়, স্বপন দা তার নিজের মুখখানিও খানিকটা সেইরকম করেই বললো - তুমি খরিদ্দার। লক্ষী। কিছু বলা উচিত নয়। কিন্তু তোমার কি কোনো কাজ কম্মো নেই । দিন রাত বসে বসে শুধু চা খাও আর সিগারেট ফোঁকো। এভাবে কি জীবন কাটবে?
পিকলু দার্শনিকের মতো নির্বিকার চিত্তে জবাব দেয়, তা যা বলেছো। তোমার কথাটা বেশ বসে ভাবার মতো। দাও লাইটার টা দাও। দুটো টান দিয়ে বেশ জুৎ করে পা ছড়িয়ে বসে ভাবি।
স্বপন দা মাথা নাড়তে নাড়তে বিড়বিড় করে কিছু বলে| ঠিক কি বললো মালুম হয়না, তারপর গুমটির বাইরের দিকে পেরেকে সুতলি দড়ি দিয়ে বাঁধা সবজে রঙের লাইটার টি খুলে পিকলুর দিকে এগিয়ে দেয়।
পিকলু সিগারেটটা ধরিয়ে বেশ আয়েশ করে গোটা কতক টান দেয়, তারপরে খালি বেঞ্চে পাদুটো তুলে দিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আধ শোওয়া হয় ৷
স্বপনদা হতাশ হয়ে পিকলুর দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে নিজের কাজে মন দেয় ৷কিছুক্ষন নির্বিকল্প সমাধিতে কাটানোর পর পকলু হঠাৎ করে তেড়ে ফুড়ে উঠে বলে -
আচ্ছা স্বপনদা তোমাকে একটা কথা জিগ্গেস করি?
স্বপনদাকে সচরাচর কেউ কিছু জিগ্গেস করেনা, বরং চা বিড়ি সিগারেট বেচে বলে, একটু তুচ্ছ তাচ্ছিল্যই করে; তাই সে খুব উৎসাহ নিয়ে উত্ত দ্যায়, — হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো বলো , কি জানতে চাও বলো?
পিকলু বলে, তুমি তো জানো আমার জীবনে কিছুই হয়নি ৷ কিন্তু আমি শিল্পী মানুষ ৷ আমি মন দিয়ে গানটা গাওয়ার আর কবিতাটা লেখার চেষ্টা করি ৷ কিন্তু আমার ট্যালেন্ট তা কেউ ঠিক ধরতে পারেনা ৷ তুমি বলতো কোনটাতে ফোকাস করলে আমার বেশী নাম ডাক হবে?
স্বপনদা সসপ্যান ভর্তি গজে যাওয়া চায়ের মধ্যে চামচে দিয়ে নাড়তে থাকে, মুখে কোনো কথা নেই ৷ আরো খানিকখন চুপ করে থেকে বলে, তুমি মন দিয়ে কবিতাটাই লেখো ৷
পিকলু চাগিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে জানতে চায়—
তুমি আমার কবিতা পড়েছো? পিকলুর গলার স্বর আহ্লাদে বিগলিত |
না ৷ তবে কিনা, তোমার গান আমি শুনেছি ৷ স্বপনদা জবাব দেয় ৷
এরপর আর কথাবার্তা বিশেষ এগোলোনা ৷ পিকলু আবার বেঞ্চে বসে পড়ে ৷
ঠিক এই সময়টাতেই স্বপনদার চায়ের দোকানে বৈকুন্ঠ মেসোর প্রবেশ। ইনি সবারই মেসো। ছেলে মেয়ে, বাপ মা, ভাই বোন, ট্যাঁপা টেঁপি, জগাই মাধাই, বিয়াই বোনাই, পাড়ার সক্কলে এঁকে মেসো বলে ডাকে। যদিও ইনি অকৃতদার। মাসি ছাড়াই কি করে প্রজন্ম, লিঙ্গ এবং সম্পক্ক নির্বিশেষে সব্বার মেসো হয়ে উঠলেন, সেই গপ্পো পরে কখনো বলবো। তা উনি দোকানে এলেন, বসলেন এবং বললেন ---
কি রে
পিকলে !!! আচ্ছা, হ্যাঁ রে , তোর কি কোনো কাজ কম্মো নেই?? দিন রাত দোকানে বসে বসে সময় নষ্ট করছিস? পড়া শুনো চাকরি বাকরি না হয় নাই হলো, তা বলে কি করার কিছুই নেই?
স্বপনের দোকানে বসে বসে গুলতানি করার চেয়ে তো বাড়ি বাড়ি খবরের কাগজ ফিরি করতে পারিস! দেশের পাঁচটা খবর আর পাঁচটা দেশের খবরও পাওয়া গেল হলো আবার ইনকামও হলো।
স্বপনদা বলে ওঠে, আমিও তো সেই কথাই কৈছিলাম মেসো। বয়স কি আর থেমে থাকবে। রক্তের তেজ থাকতে থাকতে কিছু তো করার দরকার !!
মেসো খেঁকিয়ে ওঠে, তুই থাম। সারা জীবন ধরে বিড়ি বেঁচে উনি আবার জ্ঞান দিতে এয়েচেন। দে এক বান্ডিল নীল সুতো বিড়ি দে আর লাইটার টাও দে।
এবারমেসো পিকলুর দিকে ফিরে, কিরে ? বসে বসে আর কত দিন কাটাবি ?
পিকলু আড়মোড়া ভেঙে বলে, বল্লে বিশ্বাস করবেনা মেসো !! আমিও না ঠিক এই কথাটাই ভাবছিলাম। ছোঁড়া থেকে বুড়ো হতে চললাম, এবার তো কিছু করা দরকার. . .
স্বপনদা বিড়ির কাঠা গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলে ওঠে, দেখলে তো মেসো, আমিও তো সেই কথাই বললুম।
মেসো কটমট করে স্বপনের দিকে তাকায়। স্বপন আরো কিছু একটা বলতে গিয়েও গিলে ফেলে।
বিড় বিড় করে যা বলে তা আর শোনা যায়না।
পিকলু বলে চলে - - -
সত্যি আমার বোধয় জীবনে আর কিছুই হবেনা, বসে বসে সারা জীবন নষ্ট করলাম।
বকুন্ঠ মেসো সহানুভূতির সুরে বলে, আরে না। না। এত হতাশ হোসনা। এইযে তুই নিজের ভুল টা বুঝতে পেরেছিস, এটাই আসল।
স্বপনদা বিড়ি গোছানোতে থুক্কুম দিয়ে মেসোর সামনে এসে দাঁড়ায় ৷
এই যে তোর আত্ম উপলব্ধি হলো; এইটেই হচ্ছে ঘুরে দাঁড়াবার মূল মন্ত্র। 'উত্থিস্ঠত জাগ্রত . . .'
বাকিটা আর মেসো মনে করতে পারে না; বিড়ি ধরানোতে মন দ্যায় |
বিড়িতে দুটো সুখটান দিয়া মেসো বলতে থাকে - - -
আর দেরি নয় পিকলু, এবার চরৈবেতি বলে এগিয়ে যাওয়ার পালা।
আবেগে মেসোর গলা কাঁপতে থাকে। স্বপন সসম্মানে কপালে হাত ঠ্যাকায় . . .
মেসো বলে চলে -
'আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে. . . '
এর পর আর মেসোর বিদ্যেতে কুলোয়না,
স্বপন পাদ পূরণ করার চেষ্টা করে,
এখন আর দেরি নয়, ধরে গো তোরা- - - হাতে - - হাতে - - -
মেসো আবার কটমট করে তাকায়; স্বপনের আর বাকিটা বলা হয়ে ওঠেনা- - -
পিকলু এতক্ষন পরে বলার সুযোগ পায়, হক কথা বলেছো মেসো । সত্যি তো, আমার সাথে যারা ইস্কুলে পড়তো, বা মাঠে খেলতো বা লুকিয়ে বিড়ি ফুঁকতো. . . তারা সবাই আজ কোথায় চলে গাছে; কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ জাল জোচ্চুরি করে জেলে, কেউ মিথ্যে বুলি আউড়ে নেতা, কেউ আবার পাড়ার মাথা। আর আমি বসে বসে হাত পায়ের গাঁট পাকিয়ে ফেললাম।
মেসো কোচ নইমুদ্দীনের মত তাতিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, এইতো জেগে উঠছিস !!! এবার জয় মা কালী বলে লেগে পড়—
স্বপনদা বলে ওঠে, এগিয়ে যাও কমরেড, আমার তোমার পেছনে . . .
এই বলে থমকে যায় ৷
মেসো কটমট করে তাকানোর ফলে পিছনে থাকার বিষয়টা আর পুরো করতে পারেনা ৷
পিকলু বলে চলে, আমিও ঠিক এইটাই ভাবছিলাম— যে এবার জাগতে হবে। আমার মতো নিষ্কর্মা, অকর্মন্য, অকম্মার ঢেঁকি ভূ ভারতে আর কেউ নেই . . . আমি একমাত্র ওয়ান পিস অপদার্থ. . . বসে বসে নিজের সম্বন্ধে এই সব ভেবে ভেবে নিজের প্রতি ঘেন্না ধরে যাচ্ছিলো মেসো . . . আমার মতো তো আর একজনও এইরকম অকেজো মানুষ আমি দেখিনাই. . .
মেসো উঠে দাঁড়িয়ে পিকলুর দিকে তাকিয়ে নেতাজির চলো দিল্লি মার্ক পোজ দিয়ে বলে,
তাহলে আর দেরি কিসের ?
স্বপনও আর পিকলুর বসে থাকাটা কোনো মতেই মেনে নিতে পারছেনা; মেসোর সুরে সুর মিলিয়ে বলে, আমিও তো তাই বলি. . .
পিকলু বলে, বসে বসে আমি যখন আমার মতো আর একজনের কথাও মনে করতে পারলামনা, যে কিনা আমার মতোই অপদার্থ; তখনি আমি উঠতে যাচ্ছিলাম মেসো. . .
মোসো উত্তেজনায় বসে পড়তে গিয়েও আবার উঠে দাড়ায় ৷
স্বপনের উনুনে জল মেশানো দুধ ফুটে উথলে উঠে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু ওর ভ্রুক্ষেপ নেই ৷ সে পিকলুর উথ্থানে বিভোর. . .
পিকলু উদাত্ত কন্ঠে বলতে থাকে—বললে বিশ্বাস করবেনা মেসো- - - ঠিক সেই মুহূর্তে, ঠিক সেই ব্রাহ্ম মুহূর্তে. . . .
তুমি এসে বসলে আমার পাশে।
ভগবান মুখ রেখেছেন !
আছে !! আছে !!! আমার মতো আরো আছে !!! ঈশ্বর আমাকে চিনিয়ে দিয়েছেন -
তাই উঠতে গিয়েও আবার বসে পড়লাম !!!!
এই বলে পিকলু পা দুটি বেঞ্চে তুলে দিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বেশ জুৎ করে গেড়ে বসে, সহজে উঠবে বলে আর মনে হয়না ৷
মেসোও ওদিকে লুঙ্গি সামলে, দুই পা বেঞ্চের উপর তুলে নিভে যাওয়া বিড়িটা বেশ মন দিয়ে জ্বালাবার চেষ্টা করতে থাকে ৷ বোঝাই যায়, বসে থাকার পরিকল্পনাটা বেশ দীর্ঘ মেয়াদী ৷
স্বপন দা গজে যাওয়া চা খাবার মতো মুখ খানি কর বলে, ও আবার কি অলুক্ষুনে কথা !! আমি বলি কি, মেসোর সঙ্গে কি আর তোমার তুলনা !!! মেসো হলেন আমাদের. . . .
মেসো কটমট করে তাকায়. . .
স্বপন বাকি কথাটা গিলে ফেলে . . . .