কোয়েলের কাছে, বুদ্ধদেব গুহ আর এঁচোড়ে পাকা আমি
কোয়েলের কাছে, বুদ্ধদেব গুহ আর এঁচোড়ে পাকা আমি
প্রায় তিন দশকের বেশি আগের কথা, তখন আমি ঝাড়গ্রাম শহরের কুমুদ কুমারী স্কুলের ছাত্র | ছোটনাগপুর মালভূমির দক্ষিণ দিকে শাল পিয়ালের জঙ্গলে ঘেরা এক আধা শহর হলো ঝাড়গ্রাম | শহুরে বদ রক্ত তখনও এই আধা শহরটির শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে পড়েনি | জীবন জীবিকা, আমোদ, আল্হাদ সবই ছিল আড়ম্বর হীন, সাদা মাটা, তবে খাঁটি |
তখন বয়স টা ছিল ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার বা সাদা বাংলায় এঁচোড়ে পাকার | সেই সময়, বাকি পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বলতে - ঘরে সাদা কালো টিভির দূরদর্শন, খবরের কাগজ আর গল্পের বই |
কার্বাইড যেমন সবুজ কাঁচা কলাকে পাকিয়ে হলদে করে ফেলে, আমার জীবনে গল্পের বইয়ের ভূমিকা খানিকটা তেমনি | গল্পের বই - তা সে যাই হোক, সাদা কালো, মন্দ ভালো, লম্বা খাটো, কচি ডাঁটো - সবই গোগ্রাসে গিলে ফেলতাম | ফল হলো - যা বলতাম তা ভাবতামনা, যা ভাবতাম তা বুঝতামনা আর যা বুঝতাম সে আর বলে কাজ নেই | মানে বয়ঃসন্ধির সন্ধেবেলায় সব মিলিয়ে ঘেঁটে ঘ |
এই রকমই কোনো এক সন্ধেতে - পাড়ার এক পাকা দিদি, যে আমাকে আরো পাকিয়ে ফেলার দায়িত্ব নিয়েছিল, তার থেকে একটা বই পেলাম - কোয়েলের কাছে | লেখক বুদ্ধদেব গুহ |
বোধি বৃক্ষের তলায় বসে, যেমন বুদ্ধদেবের জ্ঞান চক্ষু উন্মীলিত হয়েছিল, বুদ্ধদেব গুহর ওই বইটি পড়ে আমারও চোখ খুলে গেল |খুব বড় বই নয়, বর্ণনার ছটা, বা ঘটনার ঘনঘটা তেমন নেই | কিন্তু চরিত্র গুলো যেন আশ্চর্য রকমের জীবন্ত | জঙ্গল, জঙ্গলে থাকা মানুষ আর জঙ্গলে ঘুরতে যাওয়া শহুরে প্রাণীদের নিয়ে লেখা আগেও পড়েছি | কিন্তু কোনোটাই যেন এইরকম খাঁটি জংলী নয় |
আরণ্যক পড়ে মনে হয়েছে একজন সাংঘাতিক রকমের অনভূতিশীল প্রকৃতি প্রেমিক মানুষ খুব দরদ দিয়ে প্রকৃতি আর জঙ্গলের কথা বলেছেন, কিন্তু কোয়েলের কাছে পড়তে পড়তে বার বার মনে হয়েছে জঙ্গলেরই কেউ তাদের ভাষায় তাদের অভিব্যক্তিতে নিজেদের কথা বলছে |
একবার দুবার তিনবার - যতবার পড়েছি ততবার মনে হয়েছে - এভাবেও লেখা যায় !!! যশোবন্তের বেপরোয়া স্বভাব, লালতীর সোহাগ, সুনিতা বৌদির কামনা - সবই যেন ভীষণ খাঁটি, জঙ্গলে নিজের মতো করে বেড়ে ওঠা গাছের মতোই স্বতঃস্ফূর্ত |
প্রতিটি চরিত্রই যেন মেনেছে একটি নিয়ম - সেটি হলো প্রকৃতির নিয়ম, এবং সম্মান করেছে একটি আইন কে — সেটি হলো জঙ্গলের আইন |এর পর বয়স বেড়েছে, সাথে সাথে বুদ্ধদেব গুহর আরো অনেক লেখা পড়ার সৌভাগ্যও হয়েছে |
আজ সেই জংলী মানুষটা ভালোবাসার 'মাধুকরী' করতে করতে জঙ্গলের পথে হারিয়ে গেলেন |
তোমার আমার মধ্যে সাড়ে অসাড়ে রয়ে গেলো — রিভু, রিজু, পৃথু, কুর্চি, টিটির মতো নিয়ম না মানা ভণ্ডামো হীন কিছু চরিত্র |
ভালো থাকবেন বুদ্ধদেব গুহ |

