মনে পড়ে বই পড়া
মনে পড়ে বই পড়া
রবিবার দুপুর বেলা | টিভির রিমোটের সাথে ঘন্টা খানেক ধ্বস্তাধ্বস্তি করেও দেখার মতো কিছু পেলামনা |
অগত্যা টেবিল এ রাখা একটা বইয়ের পাতা ওল্টাতে শুরু করলাম |
ভালোই লাগছিলো | ভালো বইয়ের বেশ একটা নেশা আছে | বার বার পড়ার ইচ্ছে হয় |অনেকটা পুরোনো প্রেমের মতো | মনে পড়লে বেশ একটা মিঠে মিঠে ভালো লাগা তৈরি হয় | ভালো বইও খানিকটা তাই | পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে দু চার লাইন এখানে ওখানে পড়ার পরে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায় |
ছোট বেলার একটা অমর চিত্র কথা বা একটা পান্ডব গোয়েন্দার যা অদম্য আকর্ষণ, নেটফ্লিক্স, প্রাইম, হট ষ্টার, সব মিলিয়েও তার কাছে কিচ্ছু নয় |
তা বলে সব বই কি আর ভালো লাগার!!! পৃথিবী তে খারাপ লাগার বইয়েরও কোনো অভাব নেই|
যেমন কে সি নাগের অঙ্ক বই | এখনো মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখি - একটা আস্ত অঙ্ক বই নিচে বেত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর আমি একটু তেল চুক চুকে বাঁশ বেয়ে উঠে পালাবার চেষ্টা করছি |
যেইনা ধপাস করে মাটিতে পড়ি, অমনি ঘাম টাম দিয়ে ঘুম টা ভেঙে যায় |
জানিনা ছোটবেলার সেই বাঁদর টা ফাইনালি বাঁশে চড়তে পেরেছে কিনা পেরেছে কি না !! তবে সেই বাঁশ কোনো দিনই আর পেছন ছাড়েনি| বাঁশটার নাম - জীবন|
আমাদের কচি বয়সে, ইস্কুলএর পরীক্ষা পাস করার পরে, রেজাল্ট এর সাথে সাদা কাগজে ছাপা একটা বুক লিস্ট দিতো | আমার বরাবরের অভ্যেস ছিল বাবা রেজাল্ট দেখতে চাইলে আগেই বুক লিস্টটা তড়ি ঘড়ি বাবার হাতে ধরিয়ে দেওয়া, যাতে নতুন বইয়ের ব্যাপারে গুরত্ব পূর্ণ আলোচনার মাঝখানে পরীক্ষায় পাওয়া কম নম্বর এর মতো তুচ্ছ বিষয় গুলো ঢাকা পড়ে যায় | এতে যে সব সময় কাজ হতো তা নয় | মনে পড়লে এখনো পিঠ টা চিন চিন করে ওঠে| যাই হোক - বুক লিস্ট বা বইয়ের ফর্দর কথায় আসি|
নিচু ক্লাসে কিছু বই ইস্কুল থেকেই পাওয়া যেত | যেমন - সহজ পাঠ, কিশলয়, নব গণিত মুকুল ইত্যাদি | অঙ্কের মতো একটা নিরস বিষয়ের এমন কাব্যি করে নাম কে রেখেছিলেন জানতে ইচ্ছে করে | সহজ পাঠ নাম টার মধ্যেই বেশ একটা সহজ সরল ব্যাপার ছিল | আর পাতায় পাতায় সাদা কালো মন ভালো করে দেয়া ছবি | অজান্তেই ওই বইটির সাথে একটা ভালোবাসা তৈরী হয়ে গিয়েছিলো | পরে জেনেছিলাম - সহজ পাঠের ছবি গুলি শ্রী নন্দলাল বসুর আঁকা |
সাদা কালো সহজ পাঠে যে অপূর্ণতা ছিল, সেটা পুরো করে দিতো কিশলয়ের রঙিন পাতা গুলি |
বইটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মনে হতে বাংলা দেশ মানে শুধুই আঁকা বাঁকা নদী, নদীর তীর ঘেঁষে ছোট ছোট গ্রাম. . . . . . আর সেই সব গ্রামের ছবি কিশলয়ের পাতায় পাতায়|
প্রাইমারি ইস্কুলের প্রণতি দিদিমনি জিজ্ঞেস করেছিলেন কিশলয় মানে কি? অন্য কেউ বলতে পারার আগেই আমি তেড়ে ফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম - কিশলয় মানে কচিপাতা | দিদিমনি খুব খুশি হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন| এখন বুঝতে পারি তখন যে অনুভূতি টা হয়েছিল তাকে বলে - আনন্দ |
যদিও এই কবিতা টা কিশলয় তে ছিলোনা, তবুও কিশলয়ের কথা মনে হলেই এই লাইন গুলো আজো মাথায় আসে -
“নমো নমো নমো সুন্দরী মমো জননী বঙ্গ ভূমি
ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়, ছোটো ছোটো গ্রাম গুলি. . . .. “
এতে একটা লাইন ছিল ; মানে এখনো আছে -
“বঙ্গের বধূ বুক ভরা মধু, জল লয়ে যায় ঘরে|”
আমার মনে হয় উপরের লাইন খানি লেখার পরেই কবি গুরু তাঁর অসাধারণ প্রতিভা বলে বুঝেছিলেন - বুঝদার বঙ্গ সন্তান দের হাতে পড়ে এর অর্থ ভবিষ্যতে অনর্থ হতে চলেছে, তাই উনি শেষের দুলাইন জুড়ে দিয়েছিলেন -
“মা বলিতে প্রাণ করে আন চান , চোখে আসে জল ভরে ||“
যাই হোক, নিজে নিজে সহজ পাঠ, কিশলয় এই বই গুলি পড়ে ফেলতে পারা যেত অন্য আরো দুটি বইয়ের কল্যানে; সেদুটি হলো ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণ পরিচয় - প্রথম ভাগ এবং দ্বিতীয় ভাগ|এ দুটি বই তেমন আকষণীয় ছিলোনা, কিন্তু ভীষণ দরকারি | অনেকটা তরকারি তে নুনের মতো|
তবে বইয়ের আসল মাহাত্ম্য টা বোঝা গেলো আরো কয়েক ক্লাস উপরে ওঠার পরে |
সে গল্প পরে কখনো বলবো |