Sayandipa সায়নদীপা

Fantasy

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Fantasy

ময়ূর পেখম

ময়ূর পেখম

30 mins
3.5K


এক

রাজ্যের নাম নিঠুরপুর। মাঠ ভর্তি ধান, গাছ ভর্তি ফল, ঘরে ঘরে কাজ, কোনো কিছুরই অভাব নেই এই রাজ্যে; তবুও প্রজাদের মনে শান্তি নেই। কারণ, রাজ্যের রাজামশাই যে বড়ই নিষ্ঠুর, তাঁর ভয়ে সবসময় তঠস্থ থাকে প্রজারা। পান থেকে চুন খসলেই এমন রেগে যান রাজামশাই যে বলার নয়। তবে শোনা যায় রাজামশাই নাকি চিরকাল এমন ছিলেন না, তিনিও একসময় বড় ভালো মানুষ ছিলেন কিন্তু তারপর হঠাৎ করে কি যেন একটা হয়ে যায় আর রাজামশাই পাল্টে গিয়ে এমন রাগী আর নিষ্ঠুর হয়ে যান। এই রাজ্যের নামও তো আগে এমন বিচ্ছিরি ছিলোনা, আগে এই রাজ্যেরও একটা সুন্দর নাম ছিল, নিঃঝুমপুর, শুনলেই কি সুন্দর মনটা শান্ত হয়ে যেতো যেন। কিন্তু রাজামশাই পাল্টে যাওয়ার সাথে সাথে রাজ্যের নামটাও পাল্টে গিয়ে হয়ে গেলো নিঠুরপুর।

নিঠুরপুরের একপ্রান্তে একটি ছোট্ট কুঁড়েতে বাস করতো দুই ভাইবোন, দিদির নাম ছিল পেখম আর ভাইয়ের নাম ময়ূর। তাদের বাবা মা কেউ ছিল না, বড় দুঃখে দিন কাটতো ভাই বোনের। জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে হাটে বিক্রি করে যে দুটো পয়সা পেতো তারা, সেই পয়সায় খাবার কিনে খেতো দুইজনা। কিন্তু মানুষের জীবনে তো সব দিন সমান যায় না। পেখম আর ময়ূরের জীবনেও একদিন ঘটে গেল এক মারাত্মক ঘটনা। আজ সেই গল্পই বলবো তোমাদের।

পেখম আর ময়ূরদের বাড়ির থেকে কিছুটা দূরেই ছিল বাঞ্ছারামের বাড়ি, বিপদে আপদে এই বাঞ্ছারাম আর তার স্ত্রী যেমন খেয়াল রাখতো ময়ূর পেখমের, তেমনই দুই ভাইবোনের কাছেও তাদের বাঞ্ছা জ্যেঠু আর জ্যেঠিমা ছিল খুবই আপন। তা সে যাইহোক, তো একদিন হলো কি ওরা দুই ভাই বোন জঙ্গলে যাওয়ার সময় দেখলো বাঞ্ছারাম তার দাওয়ায় ব্যাজার মুখ করে বসে আছে, মনে হল কিছু নিয়ে যেন দুশ্চিন্তা করছে। ময়ূর তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “ও জ্যাঠামশাই তোমার মুখ ভার কেন?”

“আর বলিস কেন বাছা, বড় সমস্যায় পড়েছি বুঝলি!”

“কি সমস্যা গো? বলো না আমাদের।” বললো পেখম।

“তোরা তো জানিসই প্রতি শুকুরবার আমি রাজামশায়ের বাগানের ঘাস কেটে আনি, সেইমতো আজও যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু তোদের জ্যেঠিমার আজ সকাল থেকে বড়ই পেট ব্যাথা, বদ্যিমশায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার কিন্তু রাজামশায়ের কাছে না গেলে… কি যে করি!”

বাঞ্ছা জ্যেঠুর দুশ্চিন্তা দেখে পেখম জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা জ্যাঠামশাই তোমার বদলে আমরা গেলে হবে না?”

“যাবি! তোরা যাবি! সত্যি বলছিস?”

“হ্যাঁ গো হ্যাঁ, মিথ্যে কেন বলবো!” হেসে জবাব দিল পেখম।

“উফফ বাঁচালি মা আমার।”

“কিন্তু দিদিভাই আমাকে না দেখতে পেলে যে আমার বনের বন্ধুরা বড়ই কষ্ট পাবে।” চিন্তিত মুখে বলল ময়ূর।

ভাইয়ের কথা শুনে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে পেখম তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “আচ্ছা ভাই তাহলে তুই বরং জঙ্গলেই যা, আর আমি একাই গিয়ে রাজবাড়ির বাগানের ঘাস কেটে আনি।”

রাজবাড়ির মূল ফটকের সামনে এসে বুকটা ধুকপুক করতে লাগলো পেখমের। সে এর আগে কোনোদিনও ভেতরে ঢোকেনি, তবে তার বড় সাধ ছিল একবার ভেতরে ঢোকার। মাঝেমাঝেই সে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে একটা আকাশনীল রঙের লম্বা পোশাক পরে সে অন্য অনেক মেয়ের সাথে রাজবাড়ির বাগানে খেলা করছে। তার পোশাকে কতশত সব মণিমানিক্য বসানো, স্বপ্নের মধ্যেই যেন পেখমের চোখ ঝলসে দেয় তাদের চাকচিক্যে। সেই স্বপ্নের কথা ভাবতে ভাবতে পেখম ভেতরে ঢুকতে যেতেই দারোয়ানরা আটকালো তাকে, যে কেউ তো আর ঢুকতে পারেনা রাজ প্রাসাদের মূল প্রাচীরের ভেতর। পেখম তখন বাঞ্ছা জ্যেঠুর দেওয়া মোহরটা বের করে দেখালো তাদের, রাজমশাইয়ের শীল দেওয়া মোহর দেখালেই একমাত্র ভেতরে ঢোকার অনুমতি পাওয়া যায়। পেখমকেও এবার দারোয়ানরা ভেতরে যেতে দিল। ভেতরে ঢুকে তো পেখমের চক্ষু চড়কগাছ। কি সুন্দর সবকিছু! সাতমহলা বাড়ি, সামনে কত্ত বড় ফোয়ারা, তাতে আবার দুটো রাজহাঁস মনের আনন্দে জলকেলি করছে, এসব ছাড়াও আরও যে কত কি আছে সেখানে সেসব দেখে পেখমের বিস্ময়ের সীমা রইলনা। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবে সে ভেবেই পাচ্ছেনা কিছুতেই। এ যেন এক স্বপ্নপুরীতে এসে হাজির হয়েছে পেখম। মনের আনন্দে বেণী দুলিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে পেখম ভুলেই গেল যে সে কোন কাজের জন্য এসেছিল এই প্রাসাদে। পেখমের সুরেলা গলার গান শুনে যেন গাছের পাখিগুলোও ফল খেতে ভুলে গেল, রাজহাঁস দুটো ভুলে গেল জলকেলি করতে। ঘুরতে ঘুরতে গান গাইতে লাগলো পেখম, এতো সৌন্দর্য সে আগে কখনও দেখেছে কিনা মনেই করতে পারল না।

গান গাইতে গাইতে বেখেয়ালেই বোধহয় বাগানের পথ ছেড়ে অন্য জায়গায় সরে এসেছিল পেখম, এমন সময় আচমকাই একটা তাগড়াই চেহারার সেপাই এসে বললো, “কি চাই মেয়ে? এখানে ঢুকলি কেমনে?”

সম্বিৎ ফিরল পেখমের, সে আমতা আমতা করে বললো, “আজ্ঞে বাঞ্ছা জ্যাঠামশাই আমায় পাঠিয়েছেন বাগানের ঘাস কাটতে।”

“তাহলে বাগানে যা, এখানে ঘুরঘুর করছিস কেন?” এই বলে সেই সেপাই পেখমকে বাগানের রাস্তা দেখিয়ে দিল। বাগানে এসে পেখম তো অবাক, এতো বড় বাগান সে এর আগে কোনোদিনও দেখেনি। একদিকে কতরকম ফুল ফুটে আছে; আর অন্যদিকে ফলের বাগান, কি ফল নেই সেখানে! সব কটা ফুল আর ফলের নামও তো জানেনা পেখম। এই সব দেখতে দেখতেই ফুলের বাগানের ঘাস কাটা শুরু করলো সে, অতো বড় বাগানের ঘাস কাটা কি চাট্টিখানি কথা! ফুলের বাগানটা পরিষ্কার করে আর পারলোনা পেখম, ফলের বাগানে ঢুকে ধুপ করে বসে পড়লো একটা গাছের তলায়। খিদেও পেয়েছে জোর, তাই পুঁটলিতে আনা খাবার বের করে খেতে গেল সে, আর তখনই দেখতে পেলো তার সামনে পড়ে রয়েছে একটা বড়সড় চেহারার লাল টুকটুকে আপেল, এমন সুন্দর তার জৌলুস যে দেখলেই লোভ হয়। পেখম অপেলটা হাতে তুলে ভাবলো ভাইয়ের জন্য নিয়ে গেলে ভাই কত খুশিই না হবে ভাই কিন্তু না বলে কারুর জিনিস কি করে সে নিয়ে যাবে! আচ্ছা মালি কাকাকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? এই ভেবে পেখম অপেলটা নিয়ে সবে উঠে দাঁড়িয়েছে এমন সময় কোথা থেকে যেন মালি রে রে করে তেড়ে এলো, “তবে রে দস্যি মেয়ে রাজামশায়ের বাগানের আপেল চুরি করা হচ্ছে! তোর সাহস তো কম নয়!”

“নাগো মালিকাকা আমি চুরি করিনি, এটা এখানে পড়েছিল দেখে আমি তোমার কাছেই নিয়ে যাচ্ছিলাম।”

“চুপ করে মিথ্যুক মেয়ে, চল মন্ত্রীমশায়ের কাছে।”

“না না দোহাই মালি কাকা এই আপেল তুমি নাও, আমায় ছেড়ে দাও।”

“ছেড়ে দিতে বললেই তো আর দিতে পারিনা, চল আমার সঙ্গে।”

দুই

সন্ধ্যে নেমে গেছে কখন টেরই পায়নি ময়ূর, খিদেয় তার পেটে ইঁদুরেরা সব দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে এতক্ষণে। সেই যে জঙ্গল থেকে ফিরে দিদির জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল কে জানে! তখন থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি তার। কিন্তু দিদি এখনো ফিরলো না কেন! খানিক ভয়ে ভয়েই বাইরে বেরিয়ে এলো ময়ূর। আকাশে গোল হয়ে চাঁদ উঠেছে আজ, সব তারারাও ঝিকিমিকি করছে, পাখি বন্ধুরাও নিশ্চয় অনেক্ষণ বাসায় ফিরে গেছে। কিন্তু তার দিদি ফিরছে না কেন! হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল ময়ূরের, মা বাবার মত দিদিও যদি আর কোনোদিনও না ফেরে তখন কি হবে! মা বাবাকে তো ময়ূরের ভালো করে মনেও পড়ে না, তার কাছে তার দিদিই তো সব। সে এখন কি করবে! এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ময়ূর দেখলো বাঞ্ছারাম ছুটে ছুটে আসছে তার দিকে, “সব্বনাশ হয়ে গেছে রে ময়ূর… সব্বনাশ...”

বুকটা ধক করে উঠলো ময়ূরের, ভয়ার্ত গলায় সে শুধোলো, “কি হয়েছে গো জ্যেঠু?”

“পেখমকে রাজামশাই কারাগারে বন্দি করেছেন রে বাবা।”

আঁতকে উঠলো ময়ূর, “সেকি কথা! কেন?”

“শুনলাম পেখম নাকি রাজার বাগানে ফল চুরি করেছিল।”

“মিথ্যে কথা। আমার দিদি কক্ষনো চুরি করতে পারেনা। দিদিই তো আমাকে শিখিয়েছে চুরি করা পাপ।”

“সে তুই আমি বললে কে শুনবে রে ময়ূর! রাজামশায়ের রাগ তো শুনেছি ভয়ংকর…”

“আমি কিচ্ছু জানিনা, আমি শুধু জানি আমার দিদি চোর নয়। আমি এক্ষুনি রাজামশায়ের কাছে যাবো।”

“বোকা ছেলে, এখন রাজামশাইয়ের দেখা পাবি কোথায়! সকালে সভা বসার আগে কিচ্ছু করতে পারবিনা।”

“তারমানে দিদিকে সারারাত ওই কারাগারে কাটাতে হবে!”

“হ্যাঁ রে বাবা।”

বাঞ্ছারামের কথা শুনে কেঁদে ফেললো ময়ূর, বাঞ্ছারাম তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো সকাল হলেই তাকে নিয়ে যাবে রাজসভায়। কিন্তু মন মানলো না ময়ূরের, বাঞ্ছারাম বাড়ি চলে যেতেই সেও হাতে লন্ঠন নিয়ে অন্ধকারেই বেরিয়ে পড়ল রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। সে ঠিক করেছে সারারাত রাজবাড়ির ফটকের সামনেই অপেক্ষা করবে, তারপর সকাল হলেই সবার আগে সভায় যাবে বিচার চাইতে।

রাজবাড়ীতে ঢোকার বিশাল ফটকের সামনে অপেক্ষা করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল ময়ূর। লোকজনের কোলাহল আর পাখির কলতান কানে আসতেই ঘুম ভাঙলো তার। সে বুঝলো সকাল হয়ে গেছে, যে যার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কাজে। ময়ূর তাড়াতাড়ি করে উঠে গায়ের ধুলো ঝেড়ে নিয়ে রাজসভার উদ্দেশ্যে পা বাড়াল, কিন্তু বাধ সাধলো প্রহরীরা। এমনিতে রাজ সভায় যে কেউ বিচার চাইতে ঢুকতেই পারে অথচ ময়ূরকে তারা কিছুতেই ঢুকতে দিতে রাজি নয়। প্রহরীরা বলল এতো ছোটো ছেলেকে কিছুতেই রাজসভায় ঢুকতে দেওয়া যাবে না। তাদের কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করলো ময়ূর, কিন্তু তারা শোনার পাত্র নয়। কান্না পেয়ে গেল ময়ূরের, কি করবে সে যখন কিছুই ভেবে পাচ্ছে না তখন হঠাৎ দেখলো বাঞ্ছারাম আসছে ছুটতে ছুটতে। সে এসেই বললো, “তোকে বলেছিলাম না সকাল হলে আমার সঙ্গে আসবি কিন্তু তুই শুনলি না। বাড়িতে তোকে না পেয়ে ঠিক বুঝেছি, তাই তো ছুটতে ছুটতে এলাম।”

বাঞ্ছারামকে দেখে আর ময়ূরকে বাধা দিলো না প্রহরীরা, এবার অনাসায়েই ভেতরে ঢুকে পড়ল ময়ূর। রাজসভার অন্দরে আসতেই চমকে উঠলো সে, এতো বড় বাড়ি এর আগে কখনও চোখে দেখেনি সে। ভেতরের সুন্দর পাথরের কার্যকলাপে চোখ ধাঁধিয়ে গেল তার। মাথা ঘুরিয়ে চারিদিকটা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতেই হঠাৎ মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল ময়ূরের, এতো উজ্জ্বল বাড়িতে যারা থাকে তাদের মনের ভেতরটা এমন অন্ধকার কেন!

এসব ভাবতে ভাবতেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল ময়ূর, তখনই ভেতরের দিকের দরজার কোণে বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে থাকা পেয়াদা জোর গলায় হেঁকে উঠল, “রাজামশাই সভায় আসছেন, সবাই স্থির হোন।”

বাঞ্ছারাম চোখ টিপে ইশারা করল ময়ূরকে। ময়ূর দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল রাজামশাইকে; গায়ে উজ্জ্বল পোশাক, মাথায় রত্নখচিত মুকুট পরে থাকলে কি হবে যে মানুষটা সৈন্যসামন্ত পরিবেষ্টিত হয়ে ঢুকলেন তাঁর চেহারা শীর্ণকায়, চোখ দুটো যেন কোটরাগত, চোখের তলায় জমেছে পুরু কালি, ঠোঁটদুটোর রংও যেন কালচে। চুল দাঁড়িতেও লেগেছে সাদা রং, আর সর্বোপরি তাঁর চোখ দুটোয় যেন কেমন এক উদাস ভাব। মানুষটাকে দেখে বেশ অবাক হল ময়ূর, এর আগে সে রাজামশাইকে না দেখলেও তাঁর ধারণা ছিল রাজামশাই কোনো বলিষ্ঠ গুরু গম্ভীর চেহারার মানুষ হবেন, কিন্তু তার জায়গায় এই মানুষটাকে দেখে রাজা বলে মেনে নিতে যেন কষ্ট হল খানিক। তার ওপর ছোটোর থেকে ময়ূর রাজামশায়ের এতো নিষ্ঠুরতার কাহিনী শুনেছে কিন্তু এইমুহূর্তে কিছুতেই তার মন মানতে চাইছে না যে এই মানুষটা ওরকম নিষ্ঠুর হতে পারে বরং মানুষটাকে দেখে তার মায়াই লাগছে খানিক।

যাইহোক, যথাসময়ে অভিযোগ শোনার জন্য ডাক পড়লো ময়ূরদের। কিন্তু রাজামশায়ের সামনে গিয়ে কেমন যেন ঘাবড়ে গেল সে, ভুলেই গেল কি বলতে হবে তাকে। ময়ূরকে চুপ করে থাকতে দেখে বাঞ্ছারামই সবার সামনে বিস্তারিত ভাবে বললো সব কিছু। আর ময়ূর শুধু অবাক হয়ে দেখলো রাজামশাইয়ের চোখে এক অদ্ভুত নিস্পৃহতা, যেন কোনো কিছু কানেই যাচ্ছে না তাঁর। ময়ূরদের অভিযোগ শুনে একজন সভাসদ মালিকে ডাকার হুকুম দিলো। ময়ূরের আশা ছিলো মালির কাছে সবটা শুনলেই ব্যাপারটা নিশ্চয় পরিষ্কার হবে; কিন্তু মালি কিছু বললো কই! মালি শুধু এসে যেই বললো যে পেখমকে নাকি মন্ত্রীমশায়ের নির্দেশে কারাগারে বন্দি করা হয়েছে অমনি মুখ শুকিয়ে গেলো সবার। ময়ূর কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল তাদের দিকে। এর মধ্যেই একজন সভাসদ বাঞ্ছারামকে বললেন, “মন্ত্রীমশাই যখন হুকুম দিয়েছেন তখন আমরা কিছুই করতে পারবো না, মন্ত্রীমশাই তো আজ আবার সভাতে আসেননি। আপনারা ফিরে যান।”

এতক্ষণ চুপ করে ছিল ময়ূর কিন্তু ফিরে যাওয়ার কথা শুনেই চমকে উঠলো সে, তারা ফিরে গেলে কি হবে পেখমের! গর্জে উঠলো ময়ূর, “আমার দিদিকে না নিয়ে কিছুতেই ফিরবো না আমি।”

ময়ূরের এই হুঙ্কারে প্রথমে সবাই চমকে উঠলেও পরক্ষণেই বাচ্চা ছেলের কান্ড ভেবে হাসাহাসি করতে লাগলো তারা। একজন রসিকতা করে বলে উঠলেন, “তা খোকা আমরা তো তোমার দিদিকে ছাড়তে পারবো না তাহলে তুমি কি করে নিয়ে যাবে তাকে?”

এবার হাত জোড় করে কেঁদে ফেললো ময়ূর, “বিশ্বাস করুন আমার দিদি চুরি করতে পারেনা, ও খুব ভালো। ওকে দয়া করে ছেড়ে দিন।”

ময়ূরের কথা শুনে একজন বিদ্রুপ করে উঠলেন, “ছেড়ে দিন বললেই হলো! কেন ছাড়বো?”

ময়ূর আবার হাত জোড় করে বললো, “আপনারা যা করতে বলবেন আমি তাই করবো কিন্তু দোহাই আপনাদের, আমার দিদিকে মুক্তি দিন।”

“এই টুকু পুঁচকে ছেলে তুই আবার কি করবি রে?”

“যা বলবেন…”

“যা বলবো সত্যিই যদি করতে পারিস তাহলে কথা দিলাম ছেড়ে দেবো তোর দিদিকে।” কথাগুলো বলতে বলতে সভায় প্রবেশ করলেন এক যুবক। বাঞ্ছারাম ময়ূরের কানে কানে বললো, “এ হলো মন্ত্রিমশাইয়ের ভাইপো।”

ময়ূর মন্ত্রিমশাইয়ের ভাইপোর দিকে তাকিয়ে কাতর স্বরে বললো, “কি করতে হবে আমায় একবার নির্দেশ করুন হুজুর...”

“পারবি আমাদের রাজামশাইকে হাসাতে?” দাঁতে দাঁত চিপে কথাগুলো বললেন মন্ত্রিমশাইয়ের ভাইপো। তাঁর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা সভা জুড়ে নেমে এলো এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। ময়ূর কিছুই বুঝতে পারলো না এর কারণ। বাঞ্ছারাম ময়ূরের হাত ধরে টেনে বলল, “চল এখন।”

মন্ত্রিমশাইয়ের ভাইপো এবার ব্যাঙ্গের স্বরে বলে উঠলেন, “বাচ্চা ছেলে বলে সাতদিন সময় দিলাম। সাতদিনের মধ্যে রাজামশাইকে হাসাতে পারলে তোর দিদির মুক্তি। যা এবার…”

সবাইকে নমস্কার করে বাঞ্ছারাম একপ্রকার টানতে টানতেই সভা থেকে বের করে আনলেন ময়ূরকে। ময়ূর অনুযোগ করে উঠলো, “আমায় তুমি এভাবে টেনে আনলে কেন জ্যাঠামশাই? আমি গান শোনাতাম রাজামশাইকে। আমার গান করলে পশু পাখিরা অবধি হেসে ওঠে তাহলে রাজামশাই কি হাসতেন না?”

ময়ূরের মাথায় হাত বুলিয়ে বাঞ্ছারাম বললো, “ধুরর বোকা ছেলে তুই কি ভাবলি এতদিন সে চেষ্টা কেউ করেনি? দেশ বিদেশে থেকে কত নাচিয়ে গাইয়ে, জাদুকর, খেলোয়াড় এলো কিন্তু রাজামশাইয়ের মুখে কিছুতেই হাসি ফোটাতে পারেনি কেউ।”

“এমন কেন?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ময়ূর।

“আমি ঠিক করে কিছুই জানিনা রে বাবা তবে এর উত্তর একজন দিতে পারে।”

“কে?”

“ভেলকি বুড়ি।”

বাঞ্ছারামের মুখে নামটা শুনেই চমকে উঠলো ময়ূর। জঙ্গলে যাওয়ার পথে ভেলকি বুড়ির কুঁড়ে সে অনেকবার দেখেছে কিন্তু তারদিকে পা বাড়াবার সাহস কখনও হয়নি, কেননা লোক বলে ভেলকি বুড়ি নাকি অনেক রকম ভেলকি জানে। সে নাকি রেগে গেলে মানুষকেও পাথর বানিয়ে দিতে পারে।

তিন

ভেলকি বুড়ির বাড়ির সামনে এসে একটা ঢোঁক গিললো ময়ূর। আজ এতদিন বাড়িটাকে দেখছে কিন্তু সামনাসামনি এই প্রথম এলো। দরজার কড়া নাড়ার আগে বেশ জোরে একটা শ্বাস নিয়ে নিলো ময়ূর, মনে মনে একবার ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো কি বলতে হবে ভেতরে গিয়ে। রাজসভায় ঢোকার আগেও বোধহয় তার এতোটা ভয় লাগেনি যতটা লাগছে এখন। সবাই তো বলে ভেলকি বুড়ির রাগ নাকি মারাত্মক, একটু বেফাঁস কথা বললেই সঙ্গে সঙ্গে পাথর বানিয়ে দেবে সে। তবু যাইহোক, পেখমের মুখটা মনে করে দরজায় কড়া নাড়ল ময়ূর। কিন্তু একি দরজা তো খোলাই রয়েছে। ভেজানো দরজাটা একটু ঠেলতেই ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ করে খুলে গেল সেটা।

“ভেতরে আসবো?” জিজ্ঞেস করলো ময়ূর, কিন্তু কোনো জবাব এলো না।

এক পা দু’পা করে এগিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি মারল ময়ূর, গোটা ঘরটা এক অদ্ভুত রকমের আলো আঁধারিতে চেয়ে আছে, স্থানে অস্থানে জড়িয়ে আছে মাকড়সার জাল। ময়ূর আবার ডাকলো, “কেউ আছেন?” এবারেও উত্তর দিলো না কেউ। ময়ূর আরেকটু এগোতেই একটা মাকড়সার জাল এসে জড়িয়ে গেল তার মুখে, চমকে উঠে সেটা ছাড়াতে ব্যস্ত হল সে। কিন্তু জালটা ছাড়ানো মাত্রই ময়ূর দেখতে পেলো দৃশ্যটা। মাটির ওপর এক বৃদ্ধা অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছেন, তার পায়ের ওপর একটা গভীর ক্ষত, একরাশ মাছি ভনভন করছে সেটার ওপর। এই দৃশ্য দেখে চমকে উঠলো ময়ূর। সে চটজলদি ভেতরে ঢুকে ভালো করে দেখলো বৃদ্ধাকে, বুকটা ওঠানামা করছে, তার মানে প্রাণ আছে! একছুটে ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো ময়ূর। ভেলকি বুড়ির কুঁড়ের পর থেকেই শুরু হয়েছে জঙ্গল, আর এই জঙ্গলের বেশ খানিকটা ময়ূরের হাতের তালুর মত চেনা। তাই সে ঠিক পৌঁছে গেল নির্দিষ্ট জায়গায়, তারপর কোমরে কাপড়ের ভাঁজ থেকে বের করে আনলো তার সর্বক্ষণের সঙ্গী চুরিটা, দিয়ে সে কেটে ফেললো দু রকমের দুটো গাছের কিছু অংশ। তারপর আবার এক ছুটে পৌঁছে গেল ভেলকি বুড়ির বাড়িতে। বৃদ্ধা এখনও সেই আগের মতোই অচেতন। কেটে আনা দুটো গাছের মধ্যে গন্ধযুক্ত গাছটার কাটা অংশটা সে ঠেকিয়ে দিল বৃদ্ধার নাকের ফুটোয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটু যেন নড়ে উঠলেন বৃদ্ধা। খুশি হয়ে ময়ূর এবার বৃদ্ধার ঘরের কোণে রাখা হামানদিস্তা নিয়ে কুটতে বসলো আরেকটা ঔষধি, এটা লাগাতে হবে ওই পায়ের ক্ষতে। যখন মন দিয়ে ঔষধিটা পিষতে ব্যস্ত ময়ূর তখনই আচমকা দাঁত বের করে তার ঘাড়ের কাছে আচমকা এসে নিশ্বাস ফেললেন সেই বৃদ্ধা। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে গিয়ে চিৎকার করে উঠলো ময়ূর আর তাতেই খিলখিল করে হেসে উঠলেন বৃদ্ধা। ময়ূর অবাক হয়ে দেখলো তাঁর পায়ের ক্ষতটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। বেশ খানিকক্ষণ হাসার পর থামলেন বৃদ্ধা, তারপর খোনা গলায় বললেন, “ভয় পাসনি বাপ। তোকে একটু পরীক্ষা করেছিলুম।”

“পরীক্ষা?”

“হুঁ পরীক্ষা। সব লোক দেখি আমার নামে নিন্দা করে বেড়ায় আর দরকার পড়লেই তখন সুড়সুড় করে এসে হাজির হয় আমার কাছে, তাই আমি পরীক্ষা করে নিই কার মনটা কেমন। তোর মনটা সত্যিই ভালো, তোকে অবশ্যি আমি আগেই দেখেছিলুম জঙ্গলের পশু পাখিগুলোর সঙ্গে গপ্পো করতে। কারুর মন ভালো না হলে তো ওরা সহজে মানুষের সাথে গপ্পো করেনা… তা সে যাইহোক, বল কি চাই বাবা?”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলেন ভেলকি বুড়ি, পুরো ঘটনায় ময়ূর এতটাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে নিজেকে সামলাতে তার আরও কিছুক্ষণ লাগলো। তারপর আস্তে আস্তে সে সব ঘটনা খুলে বললো ভেলকি বুড়ির কাছে। বৃদ্ধা সব শুনে দুদিকে মাথা নাড়লেন, দিয়ে বললেন, “রাজাকে কি করে হাসাতে হয় সে উপায় আমি জানি বাবা কিন্তু সে পথ যে বড় কঠিন। তুই এই বাচ্চা ছেলে কি করে পারবি!”

বৃদ্ধার কথায় খানিক আশার আলো দেখতে পেলো ময়ূর। সে উত্তেজিত ভাবে বললো, “তুমি একবার সে উপায় বলো বুড়িমা, আমি আমার দিদির জন্য সব করতে প্রস্তুত তা সে যতই কঠিন হোক না কেন।”

“হুমম।” একটুক্ষণ কিছু ভাবলেন বৃদ্ধা, তারপর বললেন, “শোন বাবা রাজাকে হাসানোর একটাই উপায় আর সেটা হলো তার দুঃখের কারণকে নির্মূল করা।”

“রাজামশাইয়ের দুঃখের কারণ! সেটা কি গো বুড়িমা?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো ময়ূর।

“আছে রে আছে। সে এক ভারী দুঃখের ঘটনা আছে।”

“কি ঘটনা গো? আমায় বলো না...”

“তুই কি জানিস এই রাজ্যের নাম আগে নিঠুরপুর ছিলো না, ছিলো নিঃঝুমপুর?”

“হ্যাঁ গো বুড়িমা কোথায় যেন একবার শুনেছিলাম এ কথা।”

“হুমম… তখন এ রাজ্যের অবস্থাও এমন ছিলো না রে। নিঃঝুমপুর ছিলো এক সোনার রাজ্য, এতো আনন্দ এতো খুশি ছিলো চারিদিকে যে কি বলবো! আর রাজামশাই তো ছিলেন দেবতুল্য একজন মানুষ। এই মানুষটা আর তাঁর দেবীর মত রানীমার কোল আলো করে জন্ম নিয়েছিল এক সোনার ছেলে, রাজকুমার গৌরব। সত্যিই সে এক সোনার টুকরো ছেলে ছিলো, যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনি কোমল হৃদয় তার। আবার সেই সঙ্গে প্রয়োজনে সে হয়ে উঠতে পারতো মস্ত বীর। কিন্তু…”

“কিন্তু কি বুড়িমা?”

“রাজকুমার অস্ত্র পরিচালনায় পারদর্শী হলে কি হবে তার মধ্যে জ্ঞানার্জনের আকাঙ্খা ছিলো দেখার মতন। বিভিন্ন দেশে গিয়ে গিয়ে সেখানকার বড় বড় শিক্ষাগুরুদের সান্নিধ্যে থেকে জ্ঞান লাভ করতো সে।এইভাবে অল্প বয়সেই হয়ে ওঠে এই নিঃঝুমপুরের সব থেকে জ্ঞানী ব্যক্তি।”

“ওরে বাবা…! তারপর?”

“তারপর… তারপর একবার হলো কি বিদেশে গিয়ে অনেকদিন থাকার পর রাজ্যে ফিরে এলেন কুমার, সঙ্গে এলেন তাঁর এক বিদেশী বন্ধু আলোককুমার। এই আলোককুমারও কিন্তু ছিলেন দক্ষ যুদ্ধবাজ আর পন্ডিতও। তো নিঃঝুমপুরে এসে আলোককুমার একদিন বন্ধুর কাছে আব্দার করে বসলেন শিকারে যাবেন তিনি। বন্ধুর আব্দার রাখতে তো হবেই, এই ভেবে রাজকুমার গৌরব আলোককুমারকে নিয়ে চললেন শিকারে। জানিসই তো আমাদের এই কাছের জঙ্গলে কোনো হিংস্র প্রাণী নেই, হিংস্র প্রাণী সব আছে ওই উত্তরের পাহাড়ের নিচের জঙ্গলে।”

“তাই নাকি? আমি তো এমনটা জানতাম না!”

“হুমম… এ কথা খুব কম লোকই জানে। তা সে যাইহোক, রাজকুমার ওই যে দলবল নিয়ে গেলেন পাহাড়ের দিকে আর কিন্তু তিনি ফিরে এলেন না।”

“মানে?”

“মানে রাজকুমার গৌরব, আলোককুমার সহ যতজন সঙ্গে গিয়েছিল তাঁদের তারা যেন বেমালুম উধাও হয়ে গেল শিকারে গিয়ে।”

“কোনো বন্য জন্তু কি তাদের খেয়ে ফেলেছিল?”

“লোকে তেমন বললেও আমার কেন না জানি ঠিক বিশ্বাস হয়না এ কথা। অত বড় বীর দুজন থাকতে কি এমন জন্তু জঙ্গলে আছে যে সবাইকে একবারে শেষ করে ফেললো!”

“কেউ খুঁজতে যায়নি ওনাদের?”

“যায়নি আবার! কত লোক গেল খুঁজতে কিন্তু ফিরে আর এলো না কেউ…”

“সেকি?”

“হুমম রে বাপ, তারপর থেকেই তো আমাদের রাজামশাই এমন হয়ে গেলেন। সবাই বলে নিঠুরপুরের রাজামশাই বড়ই নিষ্ঠুর কিন্তু আমি তো জানি কত ভালো মানুষ ছিলেন উনি। পুত্রশোকে কাতর মানুষটার উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে এখন ওই দুষ্ট মন্ত্রী আর তার ভাইপো প্রজাদের ওপর যত জোর জুলুম করছে। সবাই বলে রাজামশাই নিষ্ঠুর কিন্তু আসলে তো ওই দুই

জনা রাজামশায়ের নামের আড়ালে সব গন্ডগোল করছে।”

“তাহলে এখন আমি কি করি বুড়িমা?”

“সেটাই তো ভাবছি। তুই এই টুকু পুঁচকে ছেলে… যাইহোক তোর যখন এতো জেদ তখন আমার বিশ্বাস তুই ঠিক পারবি রাজকুমারকে খুঁজে পেতে, অন্তত তার কোনো খবর আনতে। যদি তুই সফল হোস তাহলে তোর দিদিই শুধু ছাড়া পাবে না রে এই গোটা রাজ্যের প্রজাদের মধ্যেও শান্তি ফিরে আসবে আবার। নিঠুরপুর আবার হয়ে উঠবে নিঃঝুমপুর।”

“কিন্তু বুড়িমা কোথা থেকে শুরু করব আমি? আমার হাতে যে সময় বড্ড কম!”

“জানি রে বাবা। আমি তো তোর সঙ্গে যেতে পারবো না তবুও বলি আমার কুঁড়ের পেছনের জঙ্গল ধরে সোজা উত্তর মুখে হাঁটতে থাকবি। হাঁটতে হাঁটতে ঠিক পৌঁছে যাবি সেই পাহাড়ে, তবে তারপর কি করতে হবে সেটা আমি তোকে বলতে পারবো না। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি তোকে যে সবসময় উপস্থিত বুদ্ধিকে কাজে লাগাবি আর যত যাই ঘটুক সামনে মনকে একদম দুর্বল হতে দিবিনা। দুর্বল মনকে অশুভ শক্তি সহজে কাবু করে ফেলে।”

“আমি তবে এবার আসি বুড়িমা?”

“দাঁড়া” এই বলে ভেলকি বুড়ি একটা কাঁচের মত স্বচ্ছ পাথর তুলে দিলো ময়ূরের হাতে। ময়ূর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এ পাথর দিয়ে কি হবে বুড়িমা?”

“রাখ সঙ্গে, এ পাথর ভেলকি দেখাবে সঠিক সময়ে।”

আর কোনো প্রশ্ন করলো না ময়ূর, ভেলকি বুড়িকে প্রণাম করে বেরিয়ে এলো বাইরে। সূর্য অস্ত যেতে এখনও বেশ খানিক দেরি, ময়ূর তাই স্থির করলো আলো থাকতে থাকতেই সে যাত্রা শুরু করবে কেননা নষ্ট করার মত সময় যে তার নেই।

চার

ভেলকি বুড়ির নির্দেশ মত টানা দেড় দিন জঙ্গলের পথ ধরে উত্তর দিশায় হাঁটার পর পাহাড়টা দেখতে পেলো ময়ূর। আকাশে ভাসমান নীল নীল পেঁজা তুলোর মত মেঘ ছুঁয়ে ফেলা বাদামি পাহাড়টাকে দেখে কিছুক্ষণ সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। পাহাড় যে এতো সুন্দর হতে পারে এ তার কল্পনারও অতীত ছিল, ময়ূরের মনে হলো একবার ওই পাহাড়টার মাথায় চড়লেই সে স্বর্গকে ছুঁতে পারবে। মন্ত্র মুগ্ধের মত এগিয়ে চলল ময়ূর। এখানে জঙ্গলটাও যেন এক অন্য রূপ নিয়েছে, সবুজঘেরা গাছগাছালির মধ্যেই রং বেরঙের কত নাম না জানা ফুল ফুটে আছে চারিদিকে, সেই ফুলের ওপর কত প্রজাপতি মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে পাখিদের গান, মাঝে মাঝেই আবার দু’চারটে খরগোশ দুস্টুমি করে ময়ূরের সামনে এসে কান নাড়িয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। একটা হরিণকেও মনের আনন্দে ঘাস খেতে দেখলো ময়ূর। বহুক্ষণ পর এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখে ওর মনটা একটু ভালো লাগছিলো কিন্তু সেই ভালোলাগা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা। মুহূর্তের মধ্যে ওর মনে পড়ে গেল এই সৌন্দর্যেরই কোনো এক ফাঁকে নিশ্চয় লুকিয়ে আছে এক গভীর রহস্য, যে রহস্যের কারাগারে বন্দি রাজকুমার গৌরব, আলোক কুমার আর আরও কত শত মানুষ কে জানে!

মনটাকে আবার শক্ত করে নিয়ে এগোতে লাগলো ময়ূর। কিছুদূর যাওয়ার পরেই হঠাৎ করে তার মনে হল জঙ্গলের সেই সৌন্দর্য যেন আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসছে। গাছগুলো সব সবুজ রং হারিয়ে কেমন কালচে হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সেই ফুলের বাহার আর পাখির গানও হারিয়ে গেছে এখানে, পরিবর্তে একটানা কানে ভেসে আসছে একটা কর্কশ ডাক। কিসের ডাক এটা ময়ূর জানেনা তাই ও কান পেতে ভালো করে শোনার চেষ্টা করলো আওয়াজটা। এই করতে গিয়েই বোধহয় খানিক অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল কিন্তু আচমকা খুব কাছে একটা হিসহিস আওয়াজ শুনতে পেয়ে সম্বিৎ ফিরল ওর। তাকিয়ে দেখলো ওর সামনে বিশাল বড় ফণা তুলে তাকিয়ে আছে একটা বিষধর সাপ, একবার ছোবল দিলে আর রক্ষে নেই। একটা ঢোক গিলল ময়ূর, ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে কাঠ। কি হবে এবার! এক পা দু পা করে পেছাতে শুরু করল ও, ভাবলো ছুটতে শুরু করবে। কিন্তু পরক্ষণেই ওর মনে পড়ে গেল ভেলকি বুড়ির সাবধানবানী, যত যাই হোক মনকে দুর্বল হতে দিলে চলবে না, উপস্থিত বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে হবে। একটা জোরে শ্বাস নিলো ময়ূর, নিজেকে সম্পূর্ণ স্থির রেখে আত্মরক্ষার জন্য জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে পাওয়া লাঠিটাকে সজোরে ছুঁড়ে দিলো পাশে। সেটা গিয়ে ধাক্কা খেলো একটা গাছের গুঁড়িতে সেখান থেকে সেটা পড়ল নীচের ঝোপে। উভয়ক্ষেত্রেই দু’রকম আওয়াজ তুললো লাঠিটা আর সেই আওয়াজে সাপটাও সরসর করে সরে চলে গেল সেদিকে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ময়ূর। তারপর পা টিপে টিপে এগোতে থাকলো, পথেই কুড়িয়ে নিলো আরেকটা লাঠি। ও বুঝলো এখানের জঙ্গলটা তার মানে আর আগের মত নিরাপদ নয়, সাবধানে এগোতে হবে ওকে।

জঙ্গলের সর্বত্র এখন যেন কিলবিল করছে সাপ, স্থানে অস্থানে বিভিন্ন বিষাক্ত পোকার বাসা। খুব সন্তর্পণে এগোতে লাগলো ময়ূর। মনটা মাঝে মাঝেই যেন ভয়ে খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়তে চাইছে কিন্তু ময়ূর সেই সময়গুলো চোখ বন্ধ করে পেখমের মুখটা মনে করে নিচ্ছে একবার করে, যে করেই হোক দিদিকে তাকে উদ্ধার করতেই হবে। পেখমের নিষ্পাপ মুখটা নিরন্তর সাহস জুগিয়ে চলেছে ময়ূরকে, সে এগোচ্ছে এক পা এক পা করে, অতি সাবধানে। সাপ আর পোকার বাসা পেরোতে পেরোতেই একটা ফাঁকা মতন জায়গায় এলো ময়ূর। এখানে গাছগাছালির প্রাচুর্য খুব একটা নেই, বরং বেশ খানিকটা ফাঁকাই বলা যেতে পারে। আশপাশটা দেখে ময়ূরের মনে হল সে বোধহয় পাহাড়ের একেবারে পাদদেশে এসে উপস্থিত হয়েছে। এখানেও কোনো পাখি ডাকছেনা কিন্তু কানে একটানা একটা শব্দ ভেসে আসছে, ঠিক যেন কোথাও প্রচন্ড গতিতে জল পড়ে চলেছে নিরন্তর। কৌতূহল হতেই আরেকটু এগোলো ময়ূর। এক জায়গায় দেখলো অনেক লতা পাতা একসঙ্গে জড়িয়ে কেমন যেন গুহার মত জিনিস সৃষ্টি করেছে। সেটার দিকে তেমন আমল দিলো না ময়ূর। সেই লতার গুহা পেরোতেই ওর চোখে পড়ল দৃশ্যটা, অনতিদূরেই পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে এক বিশাল ঝর্ণা, যে ঝর্ণার জল আলকাতরার মত কালো। সেই জায়গার পাথর গুলোও কালো কালো শ্যাওলাতে ঢাকা, ঝর্ণার জল যেখানে পড়ছে সেখানে মাছের বদলে কিলবিল করছে কালো কালো সব সাপ। এই দৃশ্য দেখে শিউরে উঠলো ময়ূর। এ জায়গাটা এমন কেন! এতক্ষণে তার আরও খেয়াল পড়লো আশেপাশের পরিবেশটাও কেমন যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন। এমনিতে জঙ্গলে সূর্যের আলো ঢুকতে পারেনা ঠিকই কিন্তু এ জায়গায় তো গাছ গুলো ততটা ঘন নয়, তাহলে এমন অন্ধকার কেন? কথাটা মনে হতেই একবার ঢোঁক গিলল ময়ূর, তারমানে কি সব রহস্য এখানেই রয়েছে! কিন্তু কোথা দিয়ে সে শুরু করবে কিছুই তো বুঝতে পারছে না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চারিদিকটা একবার ভালো করে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করলো ময়ূর; আর তখনই আচমকা ওর পায়ের উপর দিয়ে কি যেন চলে গেল সরসর করে। চমকে উঠে ময়ূর দেখলো একটা গিরগিটি। বোধহয় বিষাক্ত ছিলো তার শরীর, ময়ূরের পায়ের পাতার খানিকটা নিমেষে লাল হয়ে ঘায়ের মত হয়ে গেল, সেই সঙ্গে জ্বালা করে উঠলো প্রচন্ড ভাবে। এবার হঠাৎ করে কান্না পেয়ে গেল ময়ূরের, এতক্ষণ আসার পথে শরীরের অনেক জায়গাতেই গাছের কাঁটা লেগে ছড়ে গিয়েছিল, এবার সেই ক্ষতগুলোও যেন হঠাৎ করে আবার জ্বালা করতে আরম্ভ করল। এতক্ষণ যা কিছু হচ্ছিল সব মনের জোরের সাথে মোকাবিলা করছিল ময়ূর কিন্তু এখন কি যেন হয়ে গেল তার মধ্যে, সব শক্তি যেন ফুরিয়ে আসতে লাগলো নিমেষে। পায়ের ক্ষতটা ধরে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল ময়ূর, আর তৎক্ষণাৎ কোথা থেকে যেন একটা চিল উড়ে এসে আঁচড়ে দিলো ময়ূরের মুখ। আর্তনাদ করে সেখান থেকে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে পালাবার চেষ্টা করলো সে, কিন্তু চিলটাও নাছোড়বান্দা। কোনোক্রমে দু’হাত দিয়ে চিলটাকে প্রতিরোধ করতে করতে উঠেই ছুট লাগলো ময়ূর, কিন্তু বেশিদূর যাওয়ার আগেই পায়ে কি একটা জড়িয়ে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল সে। চিলটাও এই সুযোগে প্রবল আক্রোশে ধেয়ে এলো তার দিকে কিন্তু সেটা আক্রমণ করার আগেই কে যেন ময়ূরকে টেনে নিলো সেই লতাপাতার গুহার মধ্যে। কিছুই আর তাকিয়ে দেখতে পারলো না ময়ূরের, শরীরের সব শক্তি এবার ফুরিয়ে এলো তার।

পাঁচ

অচৈতন্য অবস্থায় কত সময় কেটে গেছে ময়ূর জানেনা। যখন জ্ঞান ফিরলো তার তখনও দু’চোখের পাতা ভারী হয়ে আছে। সে কোনোক্রমে তাকিয়ে দেখলো একটা লতা বিছানো বিছানায় শুয়ে আছে সে, তার পরনের পোশাক খুলে কেউ যেন সব জড়িবুটি লাগিয়ে দিয়েছে তার ক্ষতগুলোয়। এবার ধড়পড় করে উঠে বসল ময়ূর। তার মানে কি এখানে কোনো মানুষ থাকে! দুরুদুরু বুকে ময়ূর ডেকে উঠলো, “কেউ আছেন এখানে? কেউ কি…”

ময়ূরের ডাকা শেষ হওয়ার আগেই কেউ একজন সাড়া দিল, “খোকার ঘুম ভেঙেছে তাহলে?” কথাগুলো বলতে বলতে যিনি ঘরে ঢুকলেন তাঁকে ময়ূর এর আগে কোনোদিনও দেখেনি। উচ্চতা ময়ূরের চেয়ে সামান্য বেশি হবে হয়তো, তাঁর মাথা ভর্তি টাক কিন্তু শনের মত সাদা গোঁফ দাড়ির জঙ্গলে ঢাকা মুখটা দেখে বয়স অনুমান করা বেশ কঠিন। এই গভীর জঙ্গলে লোকটাকে দেখে ভারী অবাক হল ময়ূর; সে জিজ্ঞেস করল, “কে আপনি?”

“আমি! আমি এক অভাগা লোক বাবা, সব হারিয়ে জঙ্গলে বেঁধেছি বাসা।”

“আপনার ভয় করে না এখানে? ভয়ঙ্কর জন্তু জানোয়ারে তো ভর্তি এখানে!”

“আমি একলা মানুষ বাবা। আমার ওসবে ভয় করে না। কিন্তু তুমি এখানে কি করছো বলো দেখি?”

“আমি!” ঢোঁক গিলল ময়ূর, “আপনি জানেন নিঠুরপুরের মানে ওই নিঃঝুমপুরের রাজকুমার গৌরব আর তাঁর সঙ্গীরা কোথায়?”

“রাজকুমার! কে জানে বাবা… কত লোক তো এখানে আসে কিন্তু ফিরতে পারে কই!”

লোকটার কথা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো ময়ূরের, “ফিরতে পারে না কেন?”

“ফিরবে কি করে! এই জঙ্গলেই যে এক ভয়ানক নেকড়ের বাস, তার কবলে পড়লে আর রক্ষে নেই। তর ভাগ্য ভালো যে এতক্ষণে তার সামনে পড়িসনি।”

“নেকড়ে আছে এই জঙ্গলে? তাহলে আপনি কি করে থাকেন এখানে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ময়ূর।

লোকটা একগাল হেসে উত্তর দিলো, “বললাম না আমার ভয় করেনা ওদের থেকে। আর তাছাড়া নেকড়েটা থাকে আরও ওইদিকে, আমি তো আমার আস্তানা থেকে বেশি বেরোইনা তাই নেকড়েটা কখনও আমার ক্ষতি করতে আসেনি।”

“কিন্তু এখন আমি কি করব! আমাকে যে রাজকুমারকে নিয়ে ফিরতেই হবে!”

“আহা বাছা অধৈর্য হোস না, তুই বিশ্রাম কর আমি বরং ততক্ষনে তোর জন্য কিছু খাবারের বন্দোবস্ত করি।” এই বলে লোকটা চলে গেল ঘরটা ছেড়ে, ময়ূর এতক্ষণে খেয়াল করলো গুহাটা যতটা ছোট মনে হচ্ছিল ততটা ছোটো আদৌ নয় এটা। এই ঘরটা ছাড়াও অন্য ঘর আছে আরও। জঙ্গলের মধ্যে এমন গুহার মত লতায় ঢাকা বাড়ি আছে চিন্তা করে অবাক হলো ময়ূর। শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগেছে তার, যে উদ্যম নিয়ে সে তার যাত্রা শুরু করেছিলো সেই উদ্যম যেন থিতিয়ে আসছে ক্রমে। হতাশায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ময়ূর আর তখনই লতা ঘেরা ছোট্ট জানালাটার ওপর থেকে যেন শিস দিয়ে উঠলো কেউ। চমকে উঠলো ময়ূর, এইখানে আসা অবধি এমন মিঠে পাখির শিস তো সে একবারও শোনেনি! জানলার দিকে ঘুরে তাকালো ময়ূর, দেখলো লতার আড়ালে বসে একটা ছোট্ট সবুজ পাখি। ময়ূর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল তার দিকে, কিন্তু পাখিটা ভয় পেয়ে উড়ে তো গেলই না বরং আবার শিস দিয়ে উঠলো। সে শিস শুনে আরও একবার চমকে উঠলো ময়ূর; দিনের অনেকটা সময় জঙ্গলে থাকার সুবাদে সে পশুপাখিদের ভাষা অনেক ছোটোর থেকেই বুঝতে পারে, তাই সে এখন স্পষ্ট বুঝতে পারলো পাখিটা শিস দিয়ে তার কাছে জানতে চাইছে যে সে রাজকুমারকে খুঁজতে এসেছে কিনা। ময়ূর মাথা নেড়ে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ আমি রাজকুমারকে খুঁজছি। তুমি জানো তিনি কোথায়?”

“তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো?” আচমকা জিজ্ঞেস করে উঠল পাখিটা; ময়ূর বললো, “হ্যাঁ গো আমি তোমাদের সবার ভাষা বুঝতে পারি।”

ময়ূরের জবাব শুনে আনন্দে নেচে উঠলো পাখিটা, অবাক হয়ে ময়ূর জিজ্ঞেস করলো, “তুমি নাচছো কেন?”

“নাচবো না! আজ যে আমার ভারী আনন্দের দিন। কত লোক এলো কিন্তু কাউকে বোঝাতে পারলাম না আমার কথা, সবাই শয়তান জাদুকরের ফাঁদে পা দিয়ে দিলো।” উত্তর দিলো পাখিটা।

“শয়তান জাদুকর!” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ময়ূর, “সে কে?”

“যে বুড়োটার বাড়িতে তুমি আছো এখন।”

“কি বলছো কি তুমি? ওই দাদু তো খুব ভালো, আমাকে দুষ্ট চিলের হাত থেকে বাঁচালেন।”

“আহ আস্তে কথা বলো”, সাবধান করল পাখিটা, “ওই দুষ্ট চিল তো আসলে ওর পোষা। চিলটা তো ইচ্ছে করে তোমাকে ওর ডেরায় পৌঁছে দিলো।”

“মানে!”

“হ্যাঁ গো হ্যাঁ। আর যে গিরগিটিটা তোমায় কামড়েছে ওটাও জাদুকরের জাদু গিরগিটি, ওর লালায় যে রস ছিলো তা ঢুকিয়ে দিয়েছে তোমার শরীরে তাই তো শরীর মন সবেতেই হঠাৎ করে এতো দুর্বল হয়ে পড়েছো তুমি।”

“সেকি!” চমকে উঠলো ময়ূর।

“তবে আর বলছি কি, ওই জাদুকর একটু পরেই তোমাকে নিয়ে যাবে ওর ডাইনি দেবীর নৈবেদ্য হিসেবে। দেবী নৈবেদ্য পেলে ওর শয়তানি কার্য সিদ্ধিতে সাহায্য করবেন।”

“কি বলছো কি তুমি! তাহলে আমি কি করবো এখন?” ভয় পেয়ে গেল ময়ূর।

“তুমি কি পারবে ওকে শেষ করতে? ওকে শেষ করলে তবে রাজকুমারকেও ফিরে পাবে তুমি।”

“কি বললে রাজকুমারকে ফিরে পাবো!”

“হ্যাঁ গো। রাজকুমারকে দুষ্ট জাদুকর বন্দি করে রেখেছে। ও চায় বিনা পরিশ্রমে পৃথিবীর সব জ্ঞান অর্জন করতে আর তাই তো রাজকুমার সহ আরও কত জ্ঞানী ব্যক্তিকে জাদু করে ভুলিয়ে ভালিয়ে টেনে এনেছে ওর ডেরায় আর তারপর শুষে নিয়েছে তাদের সব জ্ঞান।”

পাখির কথা শুনে চমকে উঠলো ময়ূর, “জ্ঞান শুষে নিয়েছে! কি কান্ড! জ্ঞান অর্জন করতে তো অনেক পরিশ্রম লাগে!”

“হুমম সেই জন্যই তো দুষ্ট জাদুকর চেষ্টা করছে কিভাবে ফাঁকতালে অপরের কষ্ট করে অর্জন করা জ্ঞান শুষে নিয়ে পৃথিবীর সব থেকে জ্ঞানী ব্যক্তি হতে আর তারপর পৃথিবী জুড়ে রাজত্ব করতে।”

“ওরে বাবা কি ভয়ানক! তা জ্ঞান শুষে নিয়ে সে কি ওই মানুষগুলোকে মেরে ফেলে?”

“না মারেনি তাদের বিভিন্ন রকমের পশু পাখি বানিয়ে ছেড়ে দেয় জঙ্গলে। আর যাদের সেরকম জ্ঞান নেই তাদেরকে ওর উপাস্য ডাইনি দেবীর চরণে নৈবেদ্য হিসাবে অর্পণ করে। ডাইনি দেবী মাঝেমাঝে নৈবেদ্য না পেলে রুষ্ট হবেন যে আর তখন ওর জাদু বিদ্যা কাজ করবে না।”

“রাজকুমারও কি পাখি হয়ে গেছেন?”

“নাহ, রাজকুমারের বিপুল জ্ঞান আজ এতো বছরেও ও পুরোপুরি আয়ত্ত করতে পারেনি, তবে শীঘ্রই করে ফেলবে যদি না তুমি তাঁকে বাঁচাও।”

“আমি? কিন্তু কিভাবে!”

পাখিটা কোনো জবাব দেওয়ার আগেই ঘরের দরজায় দেখা গেল সেই বৃদ্ধের মুখ। চোখ ছোটো ছোটো করে সে জিজ্ঞেস করল, “কার সাথে কথা বলছিস বাছা?”

একটা ঢোঁক গিলল ময়ূর, তারপর আমতা আমতা করে বলল, “কারুর সাথে নয় দাদু, কার সাথে কথা বলবো এখানে তুমি ছাড়া! আমি তো নিজের মনেই বিড়বিড় করি অনেকসময়।”

আগের মতোই চোখ ছোটো করে ময়ূরকে ভালো করে দেখলো জাদুকর, তারপর গম্ভীর গলায় বললো, “ঠিক আছে এখন পাশের ঘরে খাবি চল।”

মাথা নাড়ল ময়ূর আর তখনই পাখিটা শিস দিয়ে উঠলো আবার। ময়ূর বুঝতে পারলো সে বলছে, “খুব সাবধান… খুব সাবধান… জাদু থালা… খুব সাবধান…”

পাখিটা আর কিছু বলার আগেই দুষ্ট জাদুকর তাকে দেখতে পেয়ে হ্যাট হ্যাট করে তাড়িয়ে দিলো। তারপর প্রায় জোর করেই ময়ূরের পিঠে ধাক্কা দিয়ে ওকে নিয়ে চললো পাশের ঘরে।

পাশের ঘরে ঢুকতেই ময়ূরের প্রথম নজরে পড়ল ঘরের এক কোণায় সার বেঁধে রাখা পাঁচটা বড় বড় পুতুল, সেগুলো এতোটাই নিখুঁত ভাবে তৈরি যে প্রথমবার তাকালে মনে হয় যেন জীবন্ত। বিচিত্র সব পোশাক পুতুলগুলোর গায়ে, তার মধ্যে একটা পুতুলের মুখের দিকে তাকাতেই ভীষণ চেনা চেনা ঠেকলো ময়ূরের কিন্তু সে কিছুতেই মনে করতে পারলো না কোথায় দেখেছে সে এমন পুতুল। ময়ূরকে অমন হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখেই বোধহয় জাদুকর কর্কশ গলায় বললেন, “কি দেখছিস অমন করে?”

সম্বিৎ ফিরল ময়ূরের, সে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “দেখছি ওই পুতুলগুলোকে। কি সুন্দর… এক্কেবারে নিখুঁত…”

“মনে হচ্ছে যেন জীবন্ত, তাই না?” ময়ূরের কথাটা সম্পূর্ণ করে দিলো জাদুকর নিজেই।

চমকে উঠে ময়ূর বললো, “হ্যাঁ একদমই তাই। কিন্তু এই জঙ্গলের ভেতর এমন পুতুল তুমি আনলে কি করে দাদু? আর এই তিনটে পুতুলের পোশাকও যেন কেমন অন্যরকম!”

“হুমম… এগুলো সব বিভিন্ন রাজ্যের পুতুল তো তাই এদের পোশাক এমন। আমার আসলে পুতুল বানানোর শখ খুব। কত পুতুল এ নিয়ে বানালাম আর ভাঙলাম তার ইয়ত্তা নেই…” শেষ কথাগুলো খানিকটা নিজের মনেই যেন বিড়বিড় করে বলে ফেললো জাদুকর।

“ভাঙলে! বানিয়ে আবার ভাঙলে কেন?” ময়ূরের প্রশ্নে আবার সতর্ক হলো জাদুকর। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বললো, “ভাঙলাম মানে ভেঙে গেল আর কি। এই জঙ্গলে কি আর সব ঠিক থাকে!

তা চল চল তাড়াতাড়ি খাবি চল। বড্ড বকবক করিস তুই। এতটা পথ এসে এখন কিছুই মুখে না করলে যে বল পাবি না শরীরে! চল চল…”

এই বলে ময়ূরের হাত ধরে টেনে জাদুকর নিয়ে গেল ঘরের এক কোণায়। সেখানে রাখা পাথরের মূর্তিটা দেখেই ভয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল ময়ূর। এ কেমন মূর্তি! দেহটা মানুষের মত, কালো পোশাক দিয়ে মোড়া সে দেহ। গলায় ঝুলছে নানান রকমের রঙিন পাথরের হার কিন্তু ওই মূর্তির মাথাটা…! সে যেন এক ক্ষুধার্ত নেকড়ে, জ্বলজ্বল করছে তার চোখ, মুখের ভেতর থেকে লকলকে জিভটা খানিকটা বেরিয়ে এসেছে, হলদেটে দাঁতগুলো যেন কাউকে ছিঁড়ে খেতে প্রস্তুত। ভয়ার্ত গলায় ময়ূর বলে উঠল, “এ কি রকম পুতুল দাদু!”

“ধুর বোকা এ পুতুল কেন হতে যাবে! এ তো এই জঙ্গলের দেবী।”

“জঙ্গলের দেবী! কিন্তু ইনি তো বনদেবী নন!”

“না বনদেবী নন কিন্তু ইনি এই জঙ্গলের দেবী।

এবার বেশি কথা না বলে তাড়াতাড়ি থালার খাবারটা খা।” এবার আদেশের সুরেই কথাগুলো বলে উঠলেন জাদুকর।

ময়ূর এতক্ষণে খেয়াল করলো ওই ভয়ঙ্কর দেবীর পায়ের সামনের বেদীতেই রাখা একটা রুপোর থালা। অদ্ভুত রকমের চকচক করছে সেটা, এমনই তার রূপ যে ওর কাছে মুখ নিয়ে গেলে আয়নার মত স্পষ্ট ভাবে ভেসে উঠবে মুখের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু থালাটা তো ফাঁকা!

“দাদু এ থালায় তো কোনো খাবার নেই!”

“বোকা ছেলে এ হলো আমাদের দেবীর আশীর্বাদের থালা, এর কাছে মুখ নিয়ে যা দেখবি থালায় ভরে উঠবে খাবার। নে চল খা...” এতক্ষণে আবার নরম সুরে কথা বলল জাদুকর। তারপর ময়ূরের ঘাড়টা ধরে খানিক জোর করেই থালার কাছে ওর মুখটা নিয়ে যেতে গেল সে; আর তখনই ময়ূরের মনে পড়ে গেল পাখিটার সাবধানবানী… জাদু থালা থেকে সাবধান… তাহলে এই নিশ্চয় সেই জাদু থালা! চমকে উঠে আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ময়ূর, আর তাতে এবার প্রচন্ড রেগে গেলে জাদুকর, “কি হলোটা কি! মুখ তুললি কেন?” জাদুকরের কথা শেষ হওয়ার আগেই ময়ূরের মনে হল সেই অদ্ভুত দর্শন দেবী মূর্তি যেন একটু নড়ে উঠলো। চমকে গেল ময়ূর, সে আসার পরেই জাদুকর বলেছিল যারাই আসে তারা নাকি কোন নেকড়ের পেটে যায়, তাহলে কি…!

খানিক বুদ্ধি করেই ময়ূর উত্তর দিলো, “নাকটা ভারী সুড়সুড় করছিল দাদু।”

“উফফ নে নে তাড়াতাড়ি খা এবার..” বিরক্ত মুখে বলল দুষ্ট জাদুকর।

“হ্যাঁ হ্যাঁ খাচ্ছি দাদু…” কথাগুলো বলতে বলতে জাদুকরের অলক্ষ্যে জামার থেকে ময়ূর বের করে ফেলল ভেলকি বুড়ির পাথরটা। তারপর আস্তে আস্তে থালাটার দিকে মুখটা নিয়ে গেল কিন্তু থালার ওপর ওর মুখের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠার ঠিক আগেই ময়ূর ভেলকি পাথরটাকে ধরল এমনভাবে বাঁকিয়ে ধরল যে তার ওপর জাদুকরের ছবি প্রতিফলিত হয়ে গিয়ে পড়ল সেই জাদু থালার ওপর। আর সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত জ্যোতি বেরিয়ে এলো সেই থালার থেকে। আর্তনাদ করে উঠলো জাদুকর, “এ কি করলি রে....” কিন্তু তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ভয়ঙ্কর ভাবে কাঁপতে শুরু করলো ঘরটা আর জাদুকরের শরীরটা ঘূর্ণি ঝড়ের মত গোল গোল করে ঘুর পাক খেতে খেতে ঢুকে গেল সেই থালার মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যেকার কাঁপুনিও সব শান্ত হয়ে গেল।

সব কিছু এতো দ্রুত হয়ে গেল যে নিজেকে আর সামলাতে পারলো না ময়ূর, ধপ করে সে শুয়ে পড়ল মেঝেতে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তার। চোখ দুটো বন্ধ করল ময়ূর কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না এভাবে। একটা শব্দ পেয়ে চোখ খুলল সে, আর দেখলো দেবীর বেদীটা খটখট করে নড়তে আরম্ভ করেছে। চমকে উঠে বসলো ময়ূর। সেই কম্পনের মধ্যেই এবার দেবী নেমে সটান চলে এলেন ময়ূরের সামনে। ওই ভয়ঙ্করী দেবীকে দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো ময়ূরের, সে বুঝতে পারলো না এই মুহূর্তে তার ঠিক কি করা উচিৎ। হাত পাও যেন পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে তাই ছুটে পালাবারও উপায় নেই। সে ভয়ে চোখ বন্ধ করে কাঁপতে শুরু করল, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে দেবী গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, “তোর নৈবেদ্যে আমি খুশি হয়েছি। বল তোর কি চাই? যে কোনো তিনটি ইচ্ছার কথা বল তুই তা আমি পূর্ণ করবো।”

দেবীর এহেন কথা শুনে হতভম্ব ময়ূর আস্তে আস্তে চোখ খুলল কিন্তু তার মাথা যেন খালি খালি লাগছে, আতঙ্কের চোটে কিছুতেই যেন মনে পড়ছে না কি চাওয়ার ছিলো তার। ময়ূরকে আবার রক্ষা করতেই বোধহয় কোথা থেকে যেন উড়ে চলে এলো সেই ছোট্ট পাখিটা। সে বলল, “শিগগির দেবীকে বলো জাদুকর যেসব পন্ডিতদের পশু পাখি আর পুতুল বানিয়ে দিয়েছে তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে।”

পাখির নির্দেশে একটু চমকালেও চটজলদি ওই কথাগুলোই আওড়ে গেল ময়ূর।

“তাই হোক।” এই বলে ওপরের দিকে নিজের তর্জনীটা তুলে ধরলেন দেবী, তার থেকে বিদ্যুৎ শিখার মত কিছু যেন বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো চারিদিকে। ময়ূর অবাক হয়ে দেখলো শিখার একটা অংশ এসে স্পর্শ করলো ওই ছোট্ট পাখিটাকে, আর বাকি অংশ গিয়ে লাগলো ঘরের কোণে থাকা সেই পুতুলগুলোর গায়ে। আরও কিছু অংশ বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে জঙ্গলের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ চললো ওই অদ্ভুত আলোর খেলা, আর তারপরে ময়ূর দেখলো পুতুলগুলোর মধ্যে আস্তে আস্তে প্রাণের সঞ্চার হল। এদিকে ওই ছোট্ট পাখিটাও নিমেষের মধ্যে তার রূপ পরিবর্তন করে হয়ে উঠল এক পূর্ণ দৈর্ঘ্যের যুবক। হতভম্ব ময়ূর তাকে দেখে কথা বলতেও ভুলে গেল যেন, ময়ূরের অবস্থা দেখে সে নিজেই পরিচয় দিলো, “আমার নাম আলোককুমার, তোমাদের নিঃঝুমপুরের রাজকুমারের বন্ধু আমি। আমার সমস্ত জ্ঞান শুষে নিয়ে ওই দুষ্ট জাদুকর আমায় পাখি বানিয়ে দিয়েছিল।”

আলোককুমারের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওই পুতুলগুলোর মধ্যে একজন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। আলোককুমারও তাকে আলিঙ্গন করে বললো, “আমরা আবার ঠিক হয়ে গেলাম বন্ধু আর সবই হয়েছে এই ছোট্ট ছেলেটির জন্য।” নিজের বন্ধুকে কথাগুলো বলে আলোককুমার ময়ূরের দিকে ঘুরে বললেন, “এই তোমাদের রাজকুমার গৌরব, যার সন্ধানে এসেছিলে তুমি।” ময়ূর তো এবার আনন্দে লাফিয়ে উঠলো, সে দেখলো রাজকুমার আর কেউ নন সেই পুতুলটাই যাকে দেখে ময়ূরের চেনা চেনা ঠেকেছিল। হয়তো রাজামশায়ের সাথে মুখের মিল আছে বলেই এমনটা হয়েছিল। কিন্তু এই আনন্দের মধ্যেও হতাশা ঝরে পড়ল কুমারের গলায়, “সবই তো হলো কিন্তু বন্ধু আমাদের জ্ঞান যে সব ওই দুষ্ট শুষে নিলো। তোমার পূর্ণ জ্ঞান নিয়ে নিয়েছে আর আমারও বেশিরভাগটাই নিতে সক্ষম হয়েছিল, আজকেই হয়তো বাকিটুকু নিয়ে নিতো যদি না…”

রাজকুমার গৌরবের কথা শেষ হওয়ার আগেই দেবীর দিকে ঘুরল ময়ূর, সে জানে এবার তার দ্বিতীয় ইচ্ছে কি হওয়া উচিত - “হে দেবী আপনি দয়া করে সব পন্ডিতদের জ্ঞান ওই দুষ্ট জাদুকরের থেকে পুনরায় ফিরিয়ে দিন।”

“আচ্ছা, তবে তাই হোক।” এই বলে দেবী মস্ত এক হাঁ করলেন। ওরা দেখলো সেই হাঁ এর মধ্যে এতটুকু হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে দুষ্ট জাদুকর, তার শরীর থেকে এবার জ্যোতির ন্যায় কিছু যেন বেরিয়ে এসে মিশে যেতে লাগলো রাজকুমার, আলোককুমার আর অন্যদের শরীরে। সেই জ্যোতি বেরোনো বন্ধ হতেই আনন্দে রাজকুমারকে আবার আলিঙ্গন করলেন আলোককুমার, “আমরা সব ফিরে পেয়ে গেছি বন্ধু!”

“হ্যাঁ সত্যিই তাই। যে দেবীর আশীর্বাদে ওই দুষ্ট জাদুকরের এতো বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল সেই দেবীর গ্রাসেই আজকে গেল সে।”

ওদের কথার মাঝেই দেবী ময়ূরকে বলে উঠলেন, “শিগগির বল তোর তৃতীয় ইচ্ছে, আমার আবার ধ্যানে যাওয়ার সময় হয়ে আসছে।”

দেবীর কথা শেষ হওয়া মাত্রই সবাই উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকালো ময়ূরের দিকে, ময়ূর নিজেও জানেনা কি চাওয়া উচিৎ তার। কয়েক মুহূর্ত ভাবতে সময় নিলো সে। একবার ভাবলো মা বাবাকে ফিরিয়ে দিতে বলে, আরেকবার ভাবলো প্রচুর ধন দৌলত চাইবে তার আর তার দিদির জন্য… কিন্তু অনেক ভাবার পর শেষমেশ সে বলে উঠলো, “হে দেবী আপনি আমায় আজ যা দিয়েছেন তাতেই আমার সব প্রাপ্তি হয়ে গেছে। এবার শুধু শেষ একটা অনুরোধ আছে আপনার কাছে।”

“কি অনুরোধ?” জিজ্ঞেস করলেন দেবী।

শান্ত গলায় ময়ূর বললো, “এবার আপনাকে চলে যেতে হবে এই জঙ্গল ছেড়ে, আর কথা দিতে হবে আপনি আর কোনোদিনও কারুর কোনো অসৎ কাজে সাহায্য করবেন না, কারুর কোনো অনিষ্টের অংশীদার হবেন না।”

“বড় আশ্চর্য ছেলে তো তুই, নিজের জন্য কিছুই চাইলি না!” অবাক গলায় বলে উঠলেন দেবী, “তবে তুই যা চেয়েছিস তাই হবে। চলে যাবো আমি।” এই বলে নিমেষের মধ্যে একটা ঘূর্ণি ঝড়ের মত সেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সুদুরে মিলিয়ে গেলেন দেবী।

ছয়

রাজকুমার গৌরব, আলোককুমার সহ বিভিন্ন রাজ্যের পন্ডিতদের নিয়ে হইচই করতে করতে রাজসভায় ফিরল ময়ূর। এতদিন পর রাজকুমারকে দেখে চমকে উঠলো সবাই। রাজামশাই তো আনন্দে কেঁদেই ফেললেন, রাজকুমারও গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন বাবাকে। গোটা রাজ্যজুড়ে এক আনন্দের হিল্লোল শুরু হলো, যদিও মন্ত্রিমশাই আর তাঁর ভাইপো রাজকুমারের প্রত্যাবর্তনে মোটেও খুশি হতে পারলেন না তাও সবার সামনে মুখে হাসিহাসি ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করলেন। এদিকে রাজকুমার আর তাঁর সঙ্গীদের মুখে পুরো ঘটনা শুনে সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগলো ময়ূরের। রাজামশাই হুকুম দিলেন পেখমকে মুক্তি দেওয়ার। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েই পেখম ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল তার ভাইকে, ভাইবোনে মিলে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলো খানিকক্ষণ। তারপর পরম যত্নে ময়ূরের ক্ষতগুলোয় হাত বুলিয়ে দিলো পেখম।

এদিকে পেখমকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন রাজকুমার, তাঁর মনে হলো এতদিনে তিনি অনেক জায়গা ঘুরে দেখেছেন, অনেক বিদুষী নারীর সান্নিধ্যে এসেছেন ঠিকই কিন্তু এমন নিষ্পাপ, মায়া জড়ানো মুখশ্রী এর আগে কখনও দেখেননি। তাই কুমার মনে মনে স্থির করলেন তিনি যখন রাজা হবেন তখন পেখমই হবে তাঁর রাণী। কিন্তু রাজকুমার নিজের মনের ইচ্ছা প্রকাশ করার আগেই রাজামশাই স্বয়ং ঘোষণা করলেন এবার থেকে ময়ূর আর পেখম দুজনেই থাকবে এই রাজবাড়িতে, পেখম হবে রাজ্যের যুবরানী। রাজমশাইয়ের এই ঘোষণায় আরেকবার আনন্দে নেচে উঠলো রাজ্যের প্রজারা। রাজবাড়ীর দাস দাসীরা সব ব্যস্ত হয়ে পড়ল বিবাহের তোড়জোড় করতে…

তারপর একদিন শুভ দিন দেখে ধুমধাম করে বিবাহ হয়ে গেল রাজকুমার গৌরব আর পেখমের। নিজের স্বপ্নের আকাশ নীল রঙের ঝলমলে পোশাক পরে পেখম হয়ে উঠলো নিঠুরপুর থুড়ি নিঃঝুমপুরের যুবরানী। এরপর আর কোনো কষ্ট থাকলো না দুই ভাই বোনের। মহা আনন্দে রাজপ্রাসাদে একসঙ্গে দিন কাটাতে লাগলো ময়ূর পেখম।

শেষ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy