STORYMIRROR

Aritra Das

Abstract Action Classics

0.3  

Aritra Das

Abstract Action Classics

লেগ্যাসি অফ্ রাম-পর্ব৩

লেগ্যাসি অফ্ রাম-পর্ব৩

8 mins
809


বন্দী:


সাক্ষাৎকার-কক্ষের ভিতর তখন এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। মহারাজ শান্তনু মুখোমুখি আসীন মেজের উল্টোদিকের আসনে, বন্দীর মুখোমুখি। তাঁর দুদিকে দাঁড়িয়ে দুইজন; ডানদিকে দাঁড়িয়ে ভাষ্কর, বাঁদিকে আরেকজন প্রহরী।


সচরাচর বিজিতের মধ্যে একটি স্বাভাবিক আড়ষ্টতা কাজ করে; এই ধরণের সাক্ষাৎকার পর্বগুলিকে তাঁরা যথেষ্ট ভয় পায়। মহারাজ শান্তনু রাজা হওয়ার আগে একজন মূখ্য রাজপ্রতিনিধি ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিভিন্ন উচ্চ রাজনৈতিক বন্দীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর আছে; এমনও ঘটনার তিনি সাক্ষী যেখানে চাপ সহ্য করতে না পেরে বন্দী পরণের কাপড়চোপড় নষ্ট করে ফেলেছে! কিন্তু এবারের এই খাপছাড়া পরিবেশের মত অনাসৃষ্টি পরিবেশ তাঁর কাছেও যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা! ইতিপূর্বে এরকম এক বন্দীর মুখোমুখি যে তাঁকে হতে হয় নি, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।


বন্দী ভয়ে গুটিয়ে নয়, বরং সোজা তাঁর চোখে চোখ রেখে বেশ কিছুক্ষণ তাঁকে নিরীক্ষণ করল। তারপর তার দৃষ্টি ঘুরে গেল প্রথমে ভাষ্করের দিকে, তারপর বামপার্শ্বে দাঁড়ানো প্রহরীটির দিকে; সর্বশেষে প্রহরীর কোমরে গোঁজা আগ্নেয়াস্ত্রের দিকে একপলক তাকিয়েই সে আবার ফিরে তাকাল মহারাজ শান্তনুর দিকে। তার দৃষ্টিতে ভয়ের কোন চিহ্নই ছিল না; দুচোখে বরং এক তীব্র সন্ধানী দৃষ্টি, যেন পারিপার্শিক ভাল করে বুঝে নিতেই তার এই দ্রুত চক্ষু-সঞ্চালন।


প্রাথমিক অস্বস্তি কাটিয়ে উঠলেন মহারাজ শান্তনু। তারপর সোজা হয়ে বসে প্রথম প্রশ্নটি করলেন তিনি-


-“এই মুহুর্তে যদি আপনার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেওয়া হয়, তাহলে আমাকে কি আপনি হত্যা করতে চাইবেন?”


ভাবলেশহীন মুখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন বন্দী; যেন এই ধরণের প্রশ্নে তার কোন আগ্রহই নেই!


মহারাজ শান্তনু এবার ফিরে তাকালেন বাম পার্শ্বে দাঁড়ানো প্রহরীটির দিকে। কিছু একটা ইঙ্গিত ছিল তাঁর চোখে, প্রহরীটি কালব্যায় না করে নিজের আগ্নেয়াস্ত্রটি খুলে নিলেন কোমর থেকে; তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সেটিকে রাখলেন মেজের একেবারে মধ্যিখানে। হাতলটি ঘোরানো থাকল বন্দীর দিকে, নলটি কিন্তু ঘোরানো থাকল মহারাজ শান্তনুর দিকে। ইতিমধ্যেই অবশ্য প্রহরীটি দুই পা পেছিয়ে এসে আবার দাঁড়িয়ে পড়লেন নিজের পূর্বের অবস্থানে।


-“সিদ্ধান্ত আপনার হাতে!”


কেটে কেটে বললেন মহারাজ শান্তনু।


কেটে গেল উৎকন্ঠার চরম কয়েকটি মুহুর্ত। সকলেই তাকিয়ে রইলেন বন্দীর দিকে গভীর আগ্রহের সঙ্গে। বন্দী কি করেন, সেটা দেখাই যেন তাঁদের উদ্দেশ্য।


এদিকে যাকে ঘিরে এত কাণ্ড, সেই বন্দীর কোন বিষয়ে যেন কোন হেলদোল নেই! তিনি শান্ত চোখে পর্যবেক্ষণ করলেন গোটা প্রক্রিয়াটি; অলস চোখে তাকিয়ে দেখলেন ঘরের ভিতরে থাকা প্রতিটি চরিত্রের গতিবিধি শান্তভাবে, তারপর হঠাৎ হাতে তুলে নিলেন ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রটিকে!


উপস্থিত সকলেই হতচকিত হয়ে গেলেন বন্দীর স্বাভাবিক আচরণের এই হঠাৎ পরিবর্তনে! আড়চোখে বামদিকে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীকে একবার দেখে নিলেন মহারাজ শান্তনু; কোমরের পিছনদিকে হাত চলে গিয়েছে তার!


বন্দীটির অবশ্য কোনদিকেই যেন কোন খেয়াল নেই; উল্টে পাল্টে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখে নিলেন ক্ষুদে, অথচ মারাত্মক এই আগ্নেয়াস্ত্রটিকে। তারপর আলগোছে তা বাড়িয়ে ধরলেন প্রহরীটির দিকে।


-“বড্ড বেশি আওয়াজ করে, আর হাতে প্রবল ঝাঁকুনি পড়ে”- কক্ষে উপস্থিত সকলকেই বিস্মিত করে দিয়ে কথা বলে উঠলেন বন্দী – “আমার হাতে পাশাটাই ভালো চলে, এইসব আগ্নেয়াস্ত্র আমার হাতে ভালো সরে না!”


মহারাজ শান্তনু একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন ভাষ্করকে; তারপর তিনি আবার তাকালেন বন্দীর দিকে-


-“তোমার স্বাভাবিক কন্ঠস্বর শুনে আশ্বস্ত হলাম; আমরা ভেবেছিলাম ঘটনার আকষ্মিকতায় তুমি বুঝি বা স্বাভাবিক মস্তিষ্কের- যাক সে কথা। কি নাম তোমার?”


-“রাজরক্ত বেশি কথা বলে না।”- একপলক ভাষ্করের দিকে তাকিয়েই আবার কথা বলে উঠলেন বন্দী – “বিশেষ করে চাকর-বাকরদের সঙ্গে বেশি কথা বলা আমাদের শোভা পায় না, মহারাজ! আমার নাম চন্দ্রবর্মা; তবে…”


-“তবে?”


-“শেষ কয়েকদিন মহারাজের দাক্ষিণ্যে ও আতিথেয়তায় আপ্লুত হয়ে অনেক ভেবে আমি নিজেই নিজের একটা নতুন নামকরণ করেছি; ভাবছি এখন থেকে এই নামটাই সর্বত্র ব্যবহার করব। বর্তমানে আমিই হিমালয়ের অপর পারে অবস্থিত গন্ধর্ব রাজ্যের শেষ জীবিত পুত্র, পিতার অবর্তমানে আমিই আপাতত রাজা।”


-“ও! তা, তোমার একটি বোন আছে না, চন্দ্রবর্মা?”


খানিক্ষণ চুপ করে রইলেন চন্দ্রবর্মা। তারপর নিষ্পৃহ গলায় বললেন-


-“আমি উল্লেখ করেছি ‘শেষ জীবিত পুত্র’, ‘শেষ জীবিত সন্তান’কথাটি তো উচ্চারণ করি নি, মহারাজ! যাই হোক, আচমকা এই প্রশ্ন কেন? আমার বোনটাকেও কি না খাইয়ে মারতে চান?”


বন্দী চন্দ্রবর্মার তির্যক কথায় সামান্য আহত হলেন মহারাজ শান্তনু। তিনি তড়িঘড়ি বলে উঠলেন-


-“না না, আমার কথার মানে তা ছিল না; আমি অত্যন্ত লজ্জিত ও ব্যথিত এই ভেবে-”


-“আপনার লজ্জা বা ব্যথার আর কোন আবশ্যিকতা নেই, মহারাজ!”- ধীরে ধীরে, নিষ্পৃহ গলায় বলে উঠলেন বন্দী চন্দ্রবর্মা – “আমার নিরানব্বই জন ভ্রাতা আপনার জবাবদিহী শোনবার জন্য আজ এই সংসারে অনুপস্থিত। যাইহোক, আমার ভবিষ্যত এখন কি? আমাকে নিয়ে আপনারা কি করতে চান?”


নীরবে মাথা নীচু করে খানিক্ষণ বসে রইলেন মহারাজ শান্তনু। তারপর সোজা হয়ে বসে চন্দ্রবর্মার দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন-


-“আমি…আজ সকলকে মুক্তি দিতে এখানে এসেছিলাম। তুমিই যখন একমাত্র জীবিত ব্যক্তি তখন তোমাকে মুক্তি দিতে কোন বাধা নেই; তবে, দুটি শর্তে।”


-“কুরুবংশের বিশাল পরাক্রমের কাছে আমরা সম্পূর্ণ পরাভূত, তবে আর শর্ত কিসের, মহারাজ? যা ইচ্ছে হয় তাই করুন না হয়-”


-“মন দিয়ে শোন। প্রথমতঃ তুমি কোনদিন, প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে, কুরুবংশের বিরুদ্ধে কোন অস্ত্রধারণ করবে না। এটা মূল শর্ত, এ বিষয়ে কোন তর্ক আমি শুনব না।”


-“আগেই বলেছি মহারাজ, অস্ত্র আমার হাতে ভালো সরে না! কাজেই অস্ত্রধারণের কোন প্রশ্নই উঠছে না এখানে, আপনি নিশ্চিত থাকুন, অস্ত্র হাতে কোনদিনই আপনি আমায় দেখতে পাবেন না। দ্বিতীয় শর্ত?”


-“আমার পুত্র ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তোমার ভগিনীর বিবাহ দিতে হবে।”


একথায় সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া হল বন্দী চন্দ্রবর্মার মধ্যে; কোন কথা না বলে সম্পূর্ণ চুপ হয়ে একদৃষ্টে তিনি তাকিয়ে রইলেন মহারাজ শান্তনুর দিকে, যদিও সেই দৃষ্টিতে যথারীতি কোন রাগ বা আবেগ খুঁজে পাওয়া গেল না।


মহারাজ শান্তনুও বেশ কিছুটা সময় দিলেন এই প্রসঙ্গে। তিনিও ভালো করেই জানেন বন্দী চন্দ্রবর্মার এ হেন আচরণের পিছনে কারণ কি। সবাই জানে, তাঁর পুত্র ধৃতরাষ্ট্র – জন্মান্ধ! একথা সর্বজনবিদিত। একজন অন্ধের সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব – সময় তো লাগবেই। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মহারাজ শান্তনুর বুক চিরে। তাঁর অপর দুটি পুত্রের মধ্যে প্রথমটি, পান্ড্র্যু, আজ বহু বছর ধরে নির্বাসিত। মহারাজ দর্পের কোন একটি সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করায় সপত্নীক তাকে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সসাগরা এই ভূমির কোথায় তারা আছেন, আদৌ তারা আছেন কিনা, তা শান্তনুর জানা নেই। অনেক খোঁজ করেছিলেন তিনি নিজের পুত্রের, কিন্তু তাঁদের কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি। হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছেন পান্ড্র্যু, তার পরিবার সমেত।


দ্বিতীয় পুত্র দ্যূহ। মহারাজ শান্তনুর মধ্যম সন্তান;

সর্বাধিক শক্তিশালী, অব্যর্থ লক্ষ্যভেদকারী, দোর্দণ্ডপ্রতাপ এই যোদ্ধা পুত্রটি তাঁর পিতার ভুলে এক ভীষণ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ। তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এই বলে যে তিনি কোনদিন বিবাহ করবেন না। ফলস্বরূপ, পুত্র দ্যূহের বিবাহের প্রস্তাবও তিনি আনতে পারছেন না। এই মতাবস্থায় একমাত্র অন্ধ, কনিষ্ঠ পুত্রটি ছাড়া তাঁর আর কোন উপায় নেই।


-“তুমি কি রাজি?”- বন্দী চন্দ্রবর্মার দিকে তাকিয়ে অবশেষে জিজ্ঞাসা করলেন মহারাজ শান্তনু।


চন্দ্রবর্মাকে দেখে মনে হল তিনি একটু ধাতস্থ হয়েছেন। মেঝের দিকে তাকিয়ে একমনে কি একটা যেন ভাবছিলেন তিনি; এখন মহারাজের প্রশ্ন তুলে চোখ মেলে তিনি তাকালেন মহারাজ শান্তনুর দিকে।


-“চন্দ্রবর্মা! আমার পুত্র ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তোমার ভগিনীর বিবাহ দিতে তুমি কি ইচ্ছুক?”


-“আপনার এই সর্বকনিষ্ঠ পুত্রটি তো জন্মান্ধ, তাই না মহারাজ?”


-“হ্যাঁ।”- ম্রিয়মান স্বরে উত্তর দিলেন মহারাজ শান্তনু। তিনি ধরেই রেখেছিলেন- এরকম একটি বেয়াড়া প্রস্তাবে যত হীন বিজিতই হোক না কেন,কিছুতেই সে রাজি হতে পারবে না। কিন্তু চন্দ্রবর্মার পরবর্ত্তী উত্তরে বিস্মিত হলেন তিনি!


-“এরকম সৌভাগ্য…আমি তো কল্পনাও করতে পারি নি!”


-“তুমি…রাজি??”


-“আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ। আমি সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। আশা করি গান্ধারীও দ্বিমত হবে না এই প্রসঙ্গে।”


-“বাঃ!”- উত্তেজনায় হাত ঘষতে শুরু করলেন মহারাজ শান্তনু- “তবে তো ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’! তাও, এ বিষয়ে একটি লিখিত চুক্তি সম্পাদন হওয়া দরকার। তুমি এই ‘সংঘর্ষবিরোধী চুক্তিপত্র’-এ স্বাক্ষর করলেই-”


-“ঠিক যে মুহুর্তে আমি আমার প্রদেশে যাওয়ার ব্যোমযানে উঠব, ঠিক সেই মুহুর্তেই নাহয় স্বাক্ষর করে দেব, মহারাজ-” – বন্দী চন্দ্রবর্মাও মনে হল এই প্রস্তাবে আন্তরিকভাবে খুশি।

-“অ্যাঁ – তা বেশ! কখন যেতে চাও তুমি?”


-“আপনার অনুমতি সাপেক্ষে এখনই, মহারাজ!”


সদলবলে সাক্ষাৎকার-কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন মহারাজ শান্তনু। এখানে তাঁদের কার্য শেষ। চন্দ্রবর্মাকে প্রস্তুত হতে বলা হয়ে গিয়েছে; এবার মহারাজ শান্তনুর নির্দেশে তোড়-জোড় শুরু হল চন্দ্রবর্মাকে নিজ রাজ্যে ফেরৎ পাঠানোর উদ্দেশ্যে। ব্যোমযান প্রস্তুত রাখা হল; প্রহরীরা সার বেঁধে এসে দাঁড়াল চন্দ্রবর্মাকে রাজকীয় সন্মানে ব্যোমযানে ওঠবার সময় সামরিক অভিবাদন জানাবার উদ্দেশ্যে। নিজ শিবিকা থেকে সে দৃশ্য দেখাশোনা করছিলেন মহারাজ শান্তনু স্বয়ং। আয়োজনে কোথাও কোন ত্রুটি থাকল না তো? পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর অনুচর- ভাষ্কর।


-“মহারাজ! অনুমতি দেন তো একটি প্রশ্ন করি?”


-“কর।”


-“শত্রু পাঞ্চালদের বন্দী চন্দ্রবর্মার ভগিনীর সঙ্গে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পুত্রের বিবাহ প্রস্তাব- বিষয়টা ঠিক বোধগম্য হল না!”


একথায় মহারাজ শান্তনু ফিরে তাকালেন ভাষ্করের দিকে। একপলক তাকে দেখে নিয়ে অদূরে অবতরণ ক্ষেত্রে দাঁড়ানো ব্যোমযানের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন-


-“বন্দীর বয়সের দিকে তাকিও না ভাষ্কর; তাকাও তাঁর বুদ্ধির প্রখরতার দিকে। সদ্য সদ্য নিরানব্বই জন ভ্রাতাকে হারিয়েছে যে বালক; নিজের ওপর কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকলে পরে তবে নিজের আবেগকে লাগাম পরিয়ে রাখতে পারে সে? এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পেয়েও- ভালো কথা, ওতে কোন শর ছিল না তো?”


-“আজ্ঞে না মহারাজ! প্রহরীর ওপর নির্দেশ ছিল, আপনার দিকে অস্ত্র তাগ করলেই-”


-“ও ওসবের ধার দিয়েও গেল না; উল্টে অস্ত্রটি ফেরৎ দিয়ে দিল প্রহরীকে! অসাধারণ মানসিক পরিপক্কতা! আন্দাজ করেছিল হয়তো যে ওটি খালি। গোটা সময়টাতে নিজের আবেগের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রেখে একান্ত শত্রুর সঙ্গে বন্ধুভাবে কথা বলে যাওয়া- এই বয়সে এই ক্ষমতা বিরল বললে ভুল বলা হবে; এ বিরলতম ঘটনা!”


-“কিন্তু বিবাহের প্রস্তাব – বিষয়টি ঠিক বুঝতে পারলাম না মহারাজ!”


-“অঙ্কুরেই একটি ভাবীকাল-বিদ্রোহকে গলা টিপে হত্যার সামান্য প্রয়াস, ভাষ্কর! আমি এই বালকের বহিরাবরণকে সরিয়ে ওঁর আত্মায় উঁকি মেরে দেখেছি; চুপচাপ থেকে নিজের জীবন বাঁচিয়ে ও চলে যেত ওর প্রদেশে; সুযোগের অপেক্ষায় থাকত, মোক্ষম সময়ে ও ঠিক পাল্টা প্রহার করতই! এই বিষয়ে আমি একশ শতাংশ নিশ্চিত। এই কারণেই সংঘর্ষবিরতি চুক্তিপত্রে অন্যান্য চুক্তিগুলির সঙ্গে দুটি মৌলিক চুক্তি সংযোজন করা – ও আমাদের বিরুদ্ধে কোন অস্ত্রধারণ করবে না, আবার আমাদের সঙ্গে আত্মীয়তার চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার ফলে ও নিজের বোনের শ্বশুরবাড়ির কোন ক্ষতিসাধন করবে না। তবে দুটি বিষয়ে খটকা লাগছে।”


-“কোন দুটি বিষয়, মহারাজ?”


-“প্রথমতঃ- ‘আমার হাতে পাশা ভালো চলে’বলে কি বোঝাতে চাইল চন্দ্রবর্মা? এই কথার মানে আমি ঠিক উপলব্ধি করতে পারলাম না। দ্বিতীয় প্রশ্নটি অবশ্য আরো জটিল; চন্দ্রবর্মাকেই জিজ্ঞেস করব ভেবেছিলাম, কিন্তু ওর বয়স আর বর্তমান মানসিক অবস্থার কারণে আর জিজ্ঞেস করলাম না। সেটা হল, এত স্বাধীন, উৎকর্ষ রাজ্য থাকা সত্ত্বেও পিতৃদেব এরকম একটা শুষ্ক, নীরস, নিষ্ফলবতী রাজ্যের ওপরে আক্রমণ চালালেন কিসের অভিপ্রায়ে? পিতৃদেবের মত এমন কড়া হিসেবি ও যুক্তিবাদী মানুষ কোন কারণ ছাড়া এমন একটি কঠিন, হঠকারী সিদ্ধান্ত তো নেবেন না! তাহলে? ভালো কথা, ছোঁড়া চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দিয়েছে?”


-“প্রভাকরের ওপর নির্দেশ ছিল চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের বিষয়টি- ঐ যে, উনি এসে গিয়েছেন মহারাজ!” দ্বারের দিকে ইঙ্গিত করলেন ভাষ্কর; সেখানে তখন চুক্তিপত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন প্রভাকর। নির্দেশ পেয়ে ভিতরে ঢুকে মহারাজ শান্তনুর হাতে সেটি তুলে দিলেন তিনি; তারপর প্রণাম করে নতমস্তকে বেরিয়ে গেলেন ঘরের বাইরে।


চন্দ্রবর্মার বাহনও তখন উড়ানের জন্য তৈরি; তার ঈন্ধন তখন পূর্ণমাত্রায়; তার দুপাশের উড়ান-চক্রগুলি তখন পূর্ণবেগে ঘূর্ণায়মান, মাটির থেকে বেশ কিছুটা উঠেও গিয়েছে ব্যোমযানটি, এই অবস্থায় চুক্তিপত্রটি মুখের সামনে খুলে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন মহারাজ শান্তনু। চুক্তির শর্তগুলি তো তাঁর জানাই ছিল, শুধু দেখবার ছিল তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী মৌলিক শর্তগুলি তাতে লিপিবদ্ধ হয়েছে কিনা – হ্যাঁ, দুটিই আছে। তারপর তিনি তাকিয়ে দেখলেন নীচের স্বাক্ষরের জায়গাটি। থমকে গেলেন তিনি, চোখ আটকে গেল তাঁর স্বাক্ষরকারীর নামটি দেখে।


সেখানে তখন জ্বলজ্বল করছে একটি অদ্ভুত নাম – ‘শকুনি’!


ভাষ্কর নিশ্চুপ হয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলেন মহারাজের অভিব্যক্তি; এবার সুযোগ পেয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন-


-“কোন সমস্যা, মহারাজ?”


হাত থেকে চুক্তিপত্রটিকে গুটিয়ে সেটিকে জায়গায় রাখলেন মহারাজ শান্তনু; তারপর বললেন-


-“নাঃ! পুত্র দ্যূহকে প্রস্তুত হতে বল, ওকে গান্ধাররাজ্যে যেতে হবে। বিবাহের পাকা কথাবার্তা বলে আসবার জন্য। তবে সঙ্গে করে ওর নিজস্ব দেহরক্ষীরাও যেন যায়; বর্তমান পরিস্থিতিতে ওখানে একা যাওয়ার কোন কারণ নেই।”


দূরের আকাশে ব্যোমযানটি তখন মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তে; সেদিকে তাকিয়ে নিজের মনে বলে উঠলেন মহারাজ শান্তনু- -“’শকুনি’, না? এখন দেখি আমার এই পাশার দানকে তুমি ঠেকাও কিভাবে! তোমার সমস্ত অভিপ্রায়ে আজ জল ঢেলে দিলাম এই একটিমাত্র চালে!!”


অদূরে কোথাও, তিমিরবরণ অন্ধকারে সকলের অলক্ষ্যে নিঃশব্দে, নিষ্ঠুর এক হাসি হাসলেন অন্তর্যামী। সে হাসির কোন আওয়াজ নেই বটে, তবে তার অভিঘাত কিন্তু সুদূরপ্রসারী।


-- Aritra Das


[From the new Novel: The Legacy of Ram- Prologue]


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract