[সূর্যের অন্ধকার অর্ধ]
[সূর্যের অন্ধকার অর্ধ]
-অরিত্র দাস
[২৯৬৭ সালের পৃথিবী; আলোর থেকে কয়েকগুণ বেশি দ্রুতগামী নতুন আবিষ্কৃত যানের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপন চলছে। অভিযাত্রীরা সকলেই প্রস্তুত। কি হতে চলেছে তাদের পরিণতি? পড়ুন এই ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব।]
দুপাশের ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কোনমতে দিশা খুঁজে নেওয়া সরু পায়ে চলা পথটি ধরে উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়ে আসছিল কিশোরী মেয়েটি। অত্যন্ত উত্তেজিত দেখাচ্ছিল তাকে; এতটাই যে চলবার পথে একটি উঁচিয়ে থাকা পাথরের টুকরোয় হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে সামনে পড়ে গিয়ে হাত-পা ছড়ে রক্তারক্তি, কিন্তু একবারের জন্যও তাকিয়ে দেখল না সে ক্ষতস্থানগুলিকে, কোনমতে উঠে দাঁড়িয়েই আবার সামনের দিকে দে-দৌড়! আলুথালু পুরোনদিনের গ্রাম্য পোশাকে কোন কারণে উত্তেজিত দেখাচ্ছে মেয়েটিকে, কিন্তু কেন?
জঙ্গল পেরিয়েই একটি খোলা প্রান্তরভূমি, বেশ খানিকটা দূর চলে এই ভূমিটি হঠাৎ ঢালু হয়ে অনেকটা নীচে নেমে গিয়েছে। এই চড়াই-উৎরাইয়ের খেলার মাঝখানে সুস্পষ্ট সীমারেখা রচনা করে দাঁড়িয়ে একসার পাথরের ঢিপি। জঙ্গলের সীমানা অতিক্রম করে অদূরে দাঁড়ানো পাথরের সীমানা লক্ষ্য করে এবারে তীরের মত দৌড়ে গেল মেয়েটি; এক দৌড়ে ঢালু পথটিও অতিক্রম করে গিয়ে এবার নীচের সমতলভূমির ওপর এসে দাঁড়াল সে। এতটা পথ দৌড়ে এতক্ষণে শারীরিক ক্লেশ অনুভব করল মেয়েটি। ক্লান্তিতে আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে এবার জমির ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল সে, মুখ হাঁ করে দম নিতে লাগল মেয়েটি, ফুসফুস পুরো ফাঁকা হয়ে গিয়েছে তার এতটা পথ দৌড়িয়ে আসতে গিয়ে!
বিস্তৃত এই সমতলভূমিতে ইতিউতি পাথরের অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছিল একদল লোক। এরা অবশ্য কেউই শিকারী নয়, রক্ষী। সমতলভূমিটি ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা পথ এগোলেই মানুষদের একটি বসতি পড়ে; মেয়েটি, এবং অন্যান্য রক্ষীরা সকলেই একই বসতির বাসিন্দা, আগত বিপদ থেকে বসতিকে সতর্ক করে দেওয়া এবং শিকার বা অন্যান্য প্রয়োজনে বসতির বাইরে বেরোন লোকজনের ওপর নজর রাখবার জন্যই গ্রামপ্রধানেরা বসতির থেকে বেশ কিছুটা দূরে এই নজরদারী ব্যবস্থাটি চালু করেছেন। খানিকক্ষণ আগে একটি অপ্রত্যাশিত আওয়াজ শুনে টহলদার রক্ষীরা সকলেই জড়ো হয়েছিল একজায়গায়; এখন ঢালু পথটি বেয়ে মেয়েটিকে উদ্ভ্রান্তের মত নীচে নেমে আসতে দেখে সকলেই দৌড়ে গেল তার দিকে; অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শায়িত মেয়েটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেল সকলে।
-"কি হয়েছে?"
মেয়েটি তখনও শুয়ে শুয়ে হাঁফাচ্ছিল, বোধ হয় সদ্য ছেড়ে আসা উত্তেজনার ঘোর তখনও কাটিয়ে উঠতে পারে নি সে; দলপতির প্রশ্নের উত্তরে মাথা একদিকে কাত করে কোনমতে শ্বাস নিতে নিতে সে বলল-
-"জঙ্গলের রাস্তা ধরে যাচ্ছিলাম হ্রদ থেকে জল তুলে আনতে…বিশাল বড় একটা তেকোণা পাহাড়…পশ্চিমদিক থেকে উড়ে এল মাথার ওপর…পিছনে সাদা ধোঁয়া…আছড়ে পড়ল আমার থেকে বেশ কিছুটা দূরে….ভয়ে পালিয়ে এলাম…এতবড় উড়ন্ত পাহাড় আমি জীবনে কোনদিন চোখে…"
ভুঁরু কুঁচকে অদূরে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রইল দলপতি; মুখ চাওয়াচায়ি হল দলের বাদ-বাকি সদস্যদের মধ্যে। মেয়েটি যা বলল তা সত্যি হলেও হতে পারে, একটু আগেই জঙ্গলের দিকে একটা বিকট বিস্ফোরণের শব্দে চমকে উঠে সকলে জড়ো হয়েছিল এক জায়গায়; আলোচনা করছিল বিষয়টা কি হতে পারে তা নিয়ে; শেষে সকলই বিষয়টিকে 'তারা-খসা' ধরে নিয়ে আর সেরকম আমল দেন নি ব্যাপারটিকে। কিন্তু এখন মেয়েটির কথায় বেশ চিন্তায় পড়ে যায় সকলেই, মুখ তুলে তাকিয়ে থাকে তারা ঢালুপথটির ওপরপানে।
জঙ্গলের গাছপালার সারি থেকে বেশ কিছুটা দূরে পিছনদিকের আকাশে তখন দেখা যাচ্ছে সাদা রঙের ধোঁয়ার এক বিশাল কুণ্ডলি!
====================================================================
-"বেস কলিং 'এতাম', 'এতাম', শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা? সাড়া দিন, ওভার!"
-"'এতাম টকিং ব্যাক টু বেস'। আপনাদের কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি, কোন অসুবিধাই হচ্ছে না শুনতে, ওভার!"
-"ধন্যবাদ। কমাণ্ডার সুলিভান, আপনারা এখন পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে ভারতের নির্মাণ করা আন্তর্জাতিক স্পেসস্টেশন 'কণাদ'-এ আছেন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে আমাদের পরীক্ষার দ্বিতীয় পর্যায়-"
-"জানি। আমি এবং আমাদের ক্রিউ-মেম্বাররা মানসিকভাবে প্রস্তুত সকলেই। আমাদের জন্য প্রার্থনা করুন, বেস কমাণ্ডার।"
খানিকক্ষণের নীরবতা। অবশেষে সামনে রাখা রেডিও সেট থেকে ভেসে এল বেস কমাণ্ডারের গলা-
-"বেস এবং বেসের বাইরে পৃথিবীর প্রতিটি অংশ থেকে ভেসে এসেছে আপনাদের জন্য শুভেচ্ছাবার্তা; এই নীলগ্রহের প্রতিটি সদস্যই আন্তরিকভাবে কামনা করে আপনাদের সুস্থদেহে নীরোগ এবং অক্ষত প্রত্যাবর্তন; যদিও আপনারা যখন ফেরৎ আসবেন তখন আমরা কেউই-"
এই পর্যন্ত বলে থেমে গেলেন বেস কমাণ্ডার। ঘরে উপস্থিত প্রতিটি সদস্যই জানেন এই নীরবতার কারণ- তাঁদের দীর্ঘ আনুমানিক একশ বছরের মহাকাশযাত্রা সেরে যখন তাঁরা প্রত্যাবর্তন করবেন পৃথিবীতে তখন সেখানে আজকের কুশীলবদের কেউই আর জীবিত থাকবেন না! কমাণ্ডার সুলিভানের আশেপাশেই ভিড় করে দাঁড়িয়েছিলেন 'এতাম' আন্তর্নক্ষত্র যানের প্রতিটি সদস্য; তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার রেডিওতে বেস-এর সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি-
-"জানি। আপনাদের সাহচর্য্য আমাদের সকলের কাছেই বিশেষ একটি মুহুর্ত্ত, কমাণ্ডার থ্যাচার। মহাকাশযান 'এতাম'-এর প্রতিটি সদস্যের সাথে আমারও আন্তরিক ও সশ্রদ্ধ নমষ্কার গ্রহণ করুন।"
-"বেশ। এবারে কাজের কথায় আসি কমাণ্ডার সুলিভান? সময় অত্যন্ত স্বল্প এবং আমাদের যোগাযোগ যেকোন সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। এই অভিযানের উদ্দেশ্যগুলি সংক্ষেপে একবার বলে দেওয়া যাক?
আপনারা অংশ নিয়েছেন 'প্রোজেক্ট এক্স'-এর দ্বিতীয় পরীক্ষামূলক প্রয়োগবিধিতে। বিগত সহস্রাব্দের শেষের দিকে চল্লিশের দশকে প্রাযুক্তিক মহাবিপ্লবের পর থেকে মানুষের যে অদম্য ইচ্ছা আলোকের থেকে দ্রুতগতিতে মহাকাশে উড়ানের, সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে চলেছেন আপনারা। আপনাদের লক্ষ্য- আলোকের থেকেও দ্রুততর গতিতে পথ চলে চার আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রমণ্ডলী 'আলফা সেন্টৌরি'তে পৌঁছানো, সেখানে খুঁজে পাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ গ্রহটির বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ খোঁজ নেওয়া, এবং একই গতিবেগে পথ চলে পুনর্বার পৃথিবীতে ফিরে আসা।
এই সমগ্র যাত্রাপথটিতে আপনাদের সামনে মুল প্রতিবন্ধকতা একটিই; যাত্রাপথটির সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না! আপনাদের আগেই একটি অভিযাত্রীদল একই পথে এগিয়ে গিয়েছিল আলোকের সমান গতিবেগে, কিন্তু আলোকের সর্বোচ্চ গতিবেগে পৌঁছনোর অনেক আগেই সেই দলটির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দীর্ঘকাল পুনর্বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও শেষটায় আমরা হাল ছেড়ে দিই; আমাদের ধারণা-"
-"ওঁরা মৃত?"- রেডিও ট্রান্সমিটারটির মাউথপীসে প্রায় মুখ ঠেকিয়ে প্রায় উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করলেন কমাণ্ডার সুলিভান।
-"'মৃত' শব্দটি সঠিক নয়, কমাণ্ডার! আলোকের গতিবেগ শব্দের গতিবেগের থেকে বহুগুণে তীব্র; ফলে এক্ষেত্রে যান থেকে নির্গত শব্দতরঙ্গের পৃথিবীতে পৌঁছতে কত সময় লাগতে পারে, আদৌ তা সম্পূর্ণ আকারে আমাদের কাছে পৌঁছবে কি না- তা আমাদের জানা নেই। মহাবিশ্বের রহস্যের কাছে আমরা প্রকৃতপক্ষে শিশু! আমি বরং 'বিচ্ছিন্ন' শব্দটিতেই জোর দেব বেশি।
'কণাদ' থেকে বেরিয়ে এরপরে আপনারা এগিয়ে যাবেন আপনাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে। 'মঙ্গল' গ্রহের কক্ষপথ অতিক্রম করবার পর আপনারা ধাপে ধাপে গতিবেগ বাড়াবেন; 'বৃহষ্পতি' গ্রহের কক্ষপথ অতিক্রম করবার পর আপনাদের গতিবেগ হবে সর্বোচ্চ- প্রায় দুই ট্যাকিয়নের কাছাকাছি। নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনো অবধি এইটিই হবে আপনাদের একমাত্র গতিবেগ।
'আলফা সেন্টৌরি এ' এবং 'আলফা সেন্টৌরি বি'-এর মাঝে সুষম দূরত্বে বহুযুগ আগে আমাদের বিজ্ঞানীরা খুঁজে বার করেছেন একটি গ্রহ যাতে জীবনের মৌলিক উপাদানগুলি পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান, যা দেখে আমাদের বিজ্ঞানীদের আশা, ওখানে জীবনধারণের উপযোগী পরিবেশ থাকা সম্ভব। তবে এ বিষয়ে কোনপ্রকার সিদ্ধান্তে আসবার আগে আপনাদের জানিয়ে রাখা দরকার- পুরো বিষয়টিই কিন্তু দাঁড়িয়ে তত্ত্বের ওপর, এর কোন বাস্তবিক ভিত্তি নেই। তত্ত্বের আলোকে কতটা বাস্তব, তা খুঁজে দেখতেই আপনাদের ওখানে যাওয়া।
উদাহরণস্বরূপ বলা যাক- 'আলোকের গতিবেগ' বোঝানোর প্রতিশব্দ হিসেবে এইমাত্র আমি 'ট্যাকিয়ন' শব্দটির প্রয়োগ করলাম। মজার বিষয়, এটি কিন্তু আলোকের গতিবেগ মাপবার কোন একক নয়, বরং 'ট্যাকিয়ন' কিন্তু পরমানুর একটি উপাদান! এই উপাদান বিপুল পরিমাণে পাওয়া যায় মহাবিশ্বে, যেকোন গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সীমানার বাইরে। এর গতিবেগ আলোকের গতিবেগের সমান, তাই আমরা গতিবেগের একক বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার করলাম। ১৯৬৭ সালে সর্বপ্রথম এই বস্তুটির অস্তিত্বকে থিয়োরির আকারে প্রকাশ করা হয়। আর আজ, প্রায় হাজার বছর পর এর দ্বারা চালিত ইঞ্জিনের সহায়তায় আপনারা আলোকের গতিবেগকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছেন! তত্ত্ব আর বাস্তবের মাঝের ফারাকটি কি বোঝা যাচ্ছে, কমাণ্ডার?
মঙ্গল অতিক্রমণের পর আপনাদের সাধারণ জ্বালানি কোষের কার্যক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে গিয়ে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে আপনাদের আন্তর্নক্ষত্র যান থেকে; যান এরপর চলবে সম্পূর্ণভাবে ট্যাকিয়নের শক্তি দ্বারা চালিত হয়ে। এই বিশেষ ধরণের ঈন্ধনকে আপনাদের যান স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংগ্রহ করে নিতে পারবে মহাবিশ্ব থেকেই, আপনাদের এই বিষয়ে আলাদা করে আর কিছু করবার প্রয়োজন নেই। দুটি বিষয় মাথায় রাখবেন; প্রথমত, কোন গ্রহের অভিকর্ষ শক্তির মধ্যে থেকে ট্যাকিয়ন ইঞ্জিন চালু করবেন না, ঈন্ধনের অভাবে আপনাদের যান ভূপৃষ্ঠে আছড়ে পড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, গ্রহে নামা-ওঠার জন্য যে তৃতীয় জ্বালানি কোষ আপনাদের যানে রয়েছে তা সর্বোচ্চ চারবার ওঠানামা করতে আপনাদের সাহায্য করবে, তারপর এই কোষের জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে যাবে। এই দুটি প্রয়োজনীয় তথ্য মাথায় রাখবেন!
'এতাম' মহাকাশযানটিকে স্বয়ংনির্ভর করে তোলা হয়েছে যাতে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আপনাদের কোন অসুবিধা না হয়। সকল প্রকার চিকিৎসা সামগ্রী, আধুনিক ও উন্নত যুদ্ধাস্ত্র, খননকার্য ও নির্মানে সহায়তাকারী অতি-উন্নত প্রযুক্তি, বিভিন্নপ্রকার পরিগণক ও কৃত্রিম মেধাসম্পন্ন সহায়ক, যান মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণের উপযোগী সকলপ্রকার যন্ত্র আপনাদের যানে দেওয়া রয়েছে। সংক্ষেপে একে একটি 'চলমান শহর' বলে ডাকলে বিষ্মিত হওয়ার কোন কারণ নেই। আশা করি এগুলি ব্যবহারের কোন প্রয়োজন পড়বে না।
এটিই আপনাদের সঙ্গে আমাদের শেষ কথোপকথন, কমাণ্ডার! যান চলমান অবস্থায়, বিশেষ করে আলোকের গতিবেগে চলাকালীন সঙ্গত কারণেই আপনাদের সঙ্গে আমাদের আর কোন যোগাযোগ হবে না। তবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনোর পর আপনাদের প্রেরণ করা বার্তা আমরা একটি নির্দিষ্ট সময় পর লাভ করতে থাকব। সেই বার্তা শোনবার জন্য অবশ্য আমি আর তখন-"
-"জানি, বেস কমাণ্ডার। তরঙ্গের গতিবেগ আলোকের গতিবেগের থেকে অনেকটাই কম। আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ ও শুভরাত্রি।"
-"শুভরাত্রি, কমাণ্ডার সুলিভান! বিদায়!"
মুখ থেকে মাউথপীসটিকে একপ্রকার জোর করে সরিয়ে নিলেন 'এতাম' মহাকাশযানের সর্বাধিনায়ক কমাণ্ডার সুলিভান। যাত্রার পূর্বে এর থেকে বেশি কথা বাড়িয়ে বোধহয় পৃথিবীর আকর্ষণ জোর করে কাটাতে চাইলেন তিনি; বিশেষত এই অভিযাত্রী দলের প্রতিটি সদস্যই যেখানে জানেন যে পৃথিবীতে ফেরৎ এলেও তাঁরা প্রত্যাবর্তন করতে চলেছেন আনুমানিক একশ বছর পরের পৃথিবীতে; কাজেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সেই নীলগ্রহে বর্তমানের বেস অপারেশান কেন্দ্রের কোন কর্ম্মীই যে এগিয়ে এসে তাঁদের অভ্যর্থনা জানাবেন না একথা তো বলাই বাহুল্য! সেক্ষেত্রে মানবিক দূর্বলতা বাড়িয়ে আর লাভ কি? এ কথাই বোধহয় নতমস্তকে দাঁড়িয়ে ভাবছিলেন সকলে।
-"কি নির্দেশ, কমাণ্ডার?"
বেশ কিছুক্ষণের অস্বস্তিকর নীরবতা কাটিয়ে অবশেষে প্রশ্নটি ভেসে এল অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন থটের কাছ থেকে; এই যানের সবচেয়ে অভিজ্ঞতম ব্যক্তি তিনি, জাহাজের প্রতিটি খুঁটিনাটি তথ্য তাঁর নখদর্পণে।
-"আপনারা সকলেই নিজ নিজ আসন অধিগ্রহণ করুন। আমরা এক্ষুণি রওয়ানা দেব।"
একটু পরেই 'কণাদ' স্পেসস্টেশন থেকে বেরিয়ে এল ত্রিভুজাকৃতি, সুবিশাল অন্তরীক্ষ যানটি। এগিয়ে চলল তা লক্ষ্যের দিকে। সামনে একটানা অবিরাম গতিতে সুদীর্ঘ কয়েকটি ঘন্টা পথ চলে অবশেষে মঙ্গলের সামনে এসে কিছুক্ষণের জন্য স্তিমিত হয়ে এল 'এতাম'-এর গতি; নীচের দিকে একটি কোষ খুলে এল মহাকাশযানের গা থেকে; তারপর আরও কিছুটা সময় একভাবে প্রায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে-
হঠাৎ যেন মনে হল- প্রায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা 'এতাম'-এর গা থেকে একটি তীব্র আলোর ঝলকানির সাথে সাথেই যেন সৃষ্টি হল দুটি পরিষ্কার অর্ধের! প্রথম অর্ধটি সৃষ্টি হয়েই সপাটে বেরিয়ে গেল সামনের দিকে; ভালো করে তাকে দেখতে পাওয়ার আগেই একটি বিন্দু হয়ে অন্তরীক্ষে মিলিয়ে গেল সেটি! দ্বিতীয় অর্ধটি যেন আবছায়া প্রতিচ্ছবির মত কিছু; প্রথম অর্ধটির আলোকবেগে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তাল রাখতেই যেন প্রথমে কিছুটা পেছিয়ে এল সেটি কোন বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বলের প্রত্যক্ষ কারণে; পরক্ষণেই আবার দূর্মদ গতিবেগে সামনের দিকে এগিয়ে মিলিয়েও গেল তা বিশাল অন্তরীক্ষে!
চোখের পলকে হারিয়ে গেল 'এতাম', মসীকৃষ্ণ মহাকাশের অন্ধকারের নিশ্চিত আশ্রয়ে, মঙ্গলকে পিছনে ফেলে রেখে!
=================================================================
পাথুরে ঢিপিগুলির আড়ালে ইতিউতি বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একদল মানুষ, প্রত্যেকেই একাগ্রমনে পাথরের আড়াল থেকে সামনের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত। এরই মাঝে চুপিসাড় গলায় দুজন মানুষ নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত আলাপচারীতায়-
-"অ্যাঁই আকিলা, তোর পাদুটো থেকে বড্ড দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে- ওগুলিকে আমার পাশ থেকে সরা-"
-"বাস্তেটচাচা নাকি? জানতাম, আমাদের মনে একইসঙ্গে একই চিন্তা চলে আসে! আমিও ভাবছিলাম তোমায় বলি- তোমার সারা গা থেকে পচা ডিমের খোশবু ছড়াচ্ছে; তুমি সরে গেলে সামনের পাহাড়টা একটু ভালো করে মনোযোগ দিয়ে দেখবার চেষ্টা করতাম-"
-"অ! তা দেখেই বা কি করবি শুনি? তার থেকে কাছে আয়, এক রদ্দায় তোর ধড়-মূড়ো এক করে-"
-"কি হচ্ছেটা কি এসব?"- চাপা গলায় ধমক ভেসে এল দলপতি আটেনের গলা থেকে- "বাস্তেট, আকিলা! তোমরা দুজনই আমার দলের দুই নির্ভরযোগ্য যোদ্ধা; তোমাদেরই যদি এরকম কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ হয় তবে বাকিরা কি শিখবে?"
দলপতির কাছ থেকে এরকম বকা খেয়ে আকিলা চুপ করে গেল বটে, কিন্তু বাস্তেট একটু মাথামোটা, ষণ্ড প্রকৃতির লোক; খানিকক্ষণ একটু গজগজ করে অবশেষে সে সরে গেল সামনে থেকে, অদূরে একটা বড় পাথরের আড়ালে গিয়ে একাই বসল সে। এবার দলপতি আটেনসহ বাকিরা সকলেই মনোযোগ দিল সামনের 'হঠাৎ উড়ে আসা' পাহাড়টার পানে।
পাহাড়টি অবশ্য তখনও একইরকম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, কোন হেলদোল নেই তার মধ্যে। আটেনরা খবর পেয়ে এখানে এসে একটু আগে যে গাঢ়, সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখেছিল পাহাড়টিকে ঘিরে, তা এখন অদৃশ্য। এখন পাতলা কুয়াশার মত একটা হালকা ধোঁয়ার আবরণ ঘিরে রয়েছে পাহাড়টিকে; ঐটি এবং এর সামনে অনেকখানি গভীর ঘষটে যাওয়ার দাগখানি বাদে অন্য কোন উপায় নেই, যা দেখে বহিরাগতরা বুঝবে যে এটি প্রাকৃতিক কোন পাহাড় নয়- এত সুন্দর আশেপাশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে গিয়েছে এটি!
আর একটি কথা, সবাই এটিকে 'পাহাড়' বলছে বটে- তার কারণ এর পাহাড়ের মত ত্রিকোণ আকৃতি। এই অবধি নাহয় বিলক্ষণ বোঝা গেল; কিন্তু প্রচলিত পাহাড়গুলির সঙ্গে এর প্রভেদই তো বেশি চোখে পড়ছে যেন! পাহাড়ের মাথা তো এরকম ছোট, এতটা সমতল আকৃতির হয় না! পাহাড়ের গা এরকম মসৃণ হয় কি? আর এরকম সাদা পাহাড়ই বা কোথায় হয়? সব মিলিয়ে এটি এতটাই খাপছাড়া, স্বতন্ত্র্য প্রকৃতির যে ইচ্ছে না থাকলেও এর দিকে নজর পড়তে বাধ্য।
ঐ তো, পাহাড়ের সামনের দিকের এই জায়গাটি দরজার মত খুলে যাচ্ছে না? আরে তাই তো! ঐখানে মনে হয় যেন ভারি পাথরের কোন গুপ্ত দরজা মত ছিল, এখন সেটা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে! ভিতরটা এতদূর থেকে মনে হচ্ছে যেন গাঢ় অন্ধকার। দলপতি আটেন একবার পাশে তাকিয়ে দেখল তার দলের নির্ভরযোগ্য 'লড়াইয়ে-মোরগ' বাস্তেটের দিকে; সেও তখন একদৃষ্টে তাকিয়ে তার দিকেই। দুই প্রবীণ যোদ্ধার মধ্যে নিঃশব্দে দৃষ্টি-বিনিময় হল কিছুক্ষণ, কেউই কোন কথা বলল না মুখে। এরপর বাস্তেট গুঁড়ি মেরে কিছুটা এগিয়ে গেল সামনের দিকে একা। বাকিরা প্রত্যেকেই বসে রইল যার যার নিজের জায়গায়।
এবার দেখা গেল- পাহাড়ের ভিতর থেকে দুজন প্রাণীকে বাইরে বেরিয়ে আসতে। বেশ ভালোই লম্বা এরা দুজনই; পরণের আঁটোসাঁটো, সাদা বর্ণের পোশাকের মধ্যেও ভালো বোঝা গেল এদের সুগঠিত পেশি। সামনের জন দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ চেহারার; দ্বিতীয়জন একটু রোগাটে বর্ণের বটে, কিন্তু তার ছিপছিপে, মেদহীন, বেতের মত একহারা চেহারা দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় যে সে যথেষ্ট সাবলীল ও ক্ষিপ্র গতির অধিকারী। দুজনেই আবার মানুষদের মত দুপায়েই হাঁটে, তাদের চোখমুখ অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না কিছুই- নারকেলের খোলের মতই কিছু একটা দিয়ে ঢাকা ছিল তাদের মাথা, হাতের আঙুলগুলি দীর্ঘতর! সে তো না হয় হল, কিন্তু কি চায় এরা?
প্রাণীদুটি হেঁটে বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল পাহাড়টির সামনে; ইতিউতি নজর ঘুরিয়ে দেখতে লাগল চারপাশ- যেন তারা বোঝবার চেষ্টা করছে কোথায় এসে পড়ল তারা। পিছনের প্রাণীটির হাতে একটি দড়ির মত সরু পাকানো কোন বস্তু, যার একদিকে একটি ধুতুরা ফুলের মত আকৃতিবিশিষ্ট কিছু, আর অপর দিকটি লাগানো একটি ছোট বাক্সের মধ্যে। দড়ির আগায় লাগানো এই ধুতুরা ফুলটিকে প্রাণীটি বারংবার ঠেকাচ্ছিল আশেপাশে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন বস্তুগুলির গায়ে- নুড়ি-পাথরে, জংলা গাছ বা ঘাসের গায়ে, এদের ছোট ছোট ডালগুলিতে! শেষমেষ যখন উবু হয়ে বসে প্রাণীটি এক খাবলা মাটি তুলতে গেল সামনের থেকে, ঠিক তখনই-
-"বাস্তেট-!"
হঠাৎ স্থান-কাল-পাত্র ভুলে জোর গলায় চিৎকার করে উঠল দলপতি আটেন, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে! গুঁড়ি মেরে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল বাস্তেট; এবার মাটি তোলবার জন্য প্রাণীটি নিচু হয়ে বসতেই একটি বড় প্রস্তরখণ্ডের ওপর থেকে পেল্লাই লাফ মারল সে, ঠিক তার নীচেই বসে থাকা প্রাণীটির মাথা লক্ষ্য করে, নিজের পেল্লাই হাড়ের মুষলখানা বাগিয়ে ধরে! কিন্তু সজাগ ছিল নীচে শিকারও; বিন্দুমাত্র দেরি না করে তার হাতে কোথা থেকে কে জানে, উঠে এল নাতিদীর্ঘ আকৃতির একটি লাঠি; মুহুর্তের মধ্যে সেই লাঠি থেকে একটি অগ্নিশিখা বেরিয়ে এসে যখন ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল বাস্তেটকে, তার দেহ তখনও মাঝ-আকাশে! ধপাস্ করে নীচে পড়ে গেল তার নিশ্চল দেহ, মুহুর্ত্তের মধ্যে মারা পড়ল বাস্তেট- দলপতি আটেনের অন্যতম নির্ভরযোগ্য যোদ্ধা!
জায়গায় বসে থর থর করে কাঁপতে লাগল সকলেই, এই অজ্ঞাত অস্ত্রটির বিধ্বংসী ক্ষমতা তাদের একেবারে শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে! এদিকে আরেক কেলেংকারি- উত্তেজনায় দলপতি আটেনের সুতীব্র চিৎকার ধরিয়ে দিয়েছে তাদের সকলকে; বাস্তেটের দিক থেকে দুটি প্রাণীরই দৃষ্টি ঘুরে গিয়েছে তাদের সকলের দিকে; দুজনেরই হাতের অস্ত্র এখন লক্ষ্য করে আছে তাদের দিকেই! এখন তবে কি করণীয়?
হাতের তীর-ধনুক মাটিতে ফেলে দিয়ে সদলবলে বাইরে বেরিয়ে এল দলপতি আটেন, তার সাথে বাকিরাও। দুহাত মাথার ওপর তুলে অজ্ঞাতকুলশীল প্রাণীদের দিকে এগিয়ে এল সকলে, তারপর তাদের সামনে নতজানু হয়ে বসে দুহাত পর্যায়ক্রমে ওপরে তুলে এবং নামিয়ে, মাথা বারবার মাটিতে ঠেকিয়ে বশ্যতা স্বীকার করতে চাইল তারা! এই অজ্ঞাত প্রাণীগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করবার ক্ষমতা তাদের নেই- এ কথার সারমর্ম বুঝে গিয়েছে আটেনসহ দলের সকলেই। এখন তাদের জীবন-মরণ এই প্রাণীগুলির হাতেই। দুহাত তুলে নতজানু হয়ে বসে নিজেদের আশু পরিণতির কথা ভাবতে লাগল সকলেই…
====================================================================
-"কি হল মিস স্টিফেনি, যান এরকম অসম্ভব দুলছে কেন? হাতলটা মুঠো করে ধরুন-"
-"এই যান আর এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, কমাণ্ডার সু!"- যান-নিয়ন্ত্রক হাতলটিকে শক্তভাবে চেপে ধরে থাকতে থাকতে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে উত্তর দিলেন কো-পাইলট ও জৈব-প্রাণ বিশারদ স্টিফেনি তেরেস্কোভা, কমাণ্ডার সুলিভানকে উদ্দেশ্য করে- "কিছু একটা প্রবল বেগে টানছে যানটিকে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে অন্য দিকে! প্রতি সেকেণ্ডে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এই যান-"
-"'কিছু একটা'? কি সেই 'কিছু একটা'? কেউ কি দেখতে পাচ্ছেন কি সেটা?"
-"আমরা এখন আলোকের থেকেও দ্রুত গতিবেগে চলেছি, কমাণ্ডার-"- বলে উঠলেন ক্যাপ্টেন থট- "এই অবস্থায় আপনি আশা করছেন কি করে যে বাইরের দৃশ্য আগের মতই পরিষ্কার দেখা যাবে? যানের দুলুনি দেখে আমার সন্দেহ- আমরা কোন 'চৌম্বক-ঝড়'-এর মধ্যে পড়ে গিয়েছি; যে কারণে আমরা এরকম মাত্রাতিরিক্তভাবে দুলেই চলেছি! এই কারণেই সম্ভবতঃ আমাদের প্রত্যেকটি ন্যানো-টেকনোলজিক্যাল গিয়ার কাজে ইস্তফা দিয়েছে, চুম্বকটি উম্মত্তের মত আচরণ শুরু করেছে, আর…"
-"তালিকায় এখনও কিছু ভালো খবর রয়েছে নাকি, ক্যাপ্টেন থট?"- জিজ্ঞেস করলেন কমাণ্ডার সুলিভান। এ কথায় নিজের শুকনো ঠোঁটদুটি একবার চেটে নিয়ে পাইলট-কক্ষে উপস্থিত সকলের দিকেই তাকিয়ে নিলেন একবার তিনি; তারপর হাতের আইপ্যাডখানির দিকে একপলক তাকিয়ে নিয়ে বললেন-
-"যানের দুলুনি আরম্ভ হওয়ার ঠিক আগেই আমাদের যানের বহির্ত্বকে বসানো বিশেষ ক্যামেরায় শেষমুহুর্ত্তে এই রেকর্ডিংটা হয়েছিল; আমি ওটার স্ক্রিনশট তুলে রেখেছি। প্রক্ষেপক-পর্দার দিকে একবার দেখুন সকলে-"
সামনেই বসানো বিরাট পর্দায় ভেসে উঠল একটি স্থিরচিত্রের ছবি; সকলেই নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। পর্দায় ফুটে উঠেছে একপাশের তারার মধ্যে হঠাৎ একটুকরো বিরাট এক অন্ধকার, আর তার সামনে পরিষ্কার, রঙ-বেরঙের বাহারি বর্ণের এক আলোর স্রোত- পুরো স্রোতটাই ঢুকে কার্যত অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ঐ অন্ধকারের মধ্যে! কমাণ্ডার সুলিভানও একবার তাকিয়ে দেখে নিলেন ছবিটা ভালো করে, তারপর জিজ্ঞাসু চোখ মেলে তাকালেন ক্যাপ্টেন থট-এর দিকে।
-"আমার ধারণা আমরা একটি কৃষ্ণগহ্বরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওর অভিকর্ষ বলের আঁওতায় চলে এসেছি! আপনারা ভালো করেই জানেন যে কৃষ্ণগহ্বর এতটাই প্রবল অভিকর্ষবলসম্পন্ন যে ওর আঁওতাধীন কোনকিছুই একে এড়িয়ে যেতে পারে না; সবকিছুকেই জীবন্ত গিলে নেয় এই গহ্বর, এমনকি আলোকেও। ঐ যে সামনে যে রঙবাহারি আলোর খেলা দেখছেন, ওটি প্রকৃতপক্ষে কোন একটি অপর নক্ষত্র যা সম্পূর্ণ বিশ্লিষ্ট হয়ে এখন ঢুকে যাচ্ছে ওর গর্ভে! আর ঐ এনার্জি স্রোতের মধ্যে অজান্তে ঢুকে পড়েছি আমরাও, ফলশ্রুতিস্বরূপ-"
আমরাও কি বিশ্লিষ্ট হয়ে যাচ্ছি? - সজোরে চেঁচিয়ে উঠলেন ডাঃ থিয়োডর নিজের জায়গায় বসে, আতঙ্কে বিকৃত হয়ে উঠেছে তার চোখমুখ! ঘরে উপস্থিত প্রত্যেকের অবস্থাও তথৈবচ, আতঙ্কে স্থির হয়ে গিয়েছেন সকলেই, কেউই মুখে কোন কথা বলছেন না! ডাঃ থিয়োডরের প্রশ্নের উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন থট, এমন সময়-
হঠাৎ যানের দুলুনি ভীষনভাবে বেড়ে গেল; যেন এক্ষুণি ভেঙে পড়বে যান! বেশ কয়েকটি মুহুর্ত্ত অতিক্রান্ত হল, কিন্তু দুলুনির প্রাবল্য না কমে বরং উত্তরোত্তর বেড়েই চলল তা! একটা পর্যায়ে এসে সকলেরই মনে হল যেন যানটির গতি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে; তা সামনের দিকে এগোচ্ছে না মোটেও, বরং ধীরলয়ে সেটি এগিয়ে চলেছে বাঁপাশটি লক্ষ্য করেই। অবশেষে একটা সময় পরে হঠাৎই শরীর হালকা হয়ে গেল সকলের, প্রচণ্ড তন্দ্রা এসে আচ্ছন্ন করল সকলের অনুভূতিগুলিকে। চেতনা হারালেন প্রত্যেকেই; পরক্ষণেই সমস্ত যানের আলোগুলি একসাথে গেল নিভে!
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
তারকাখচিত অসীম মহাশূণ্যের মধ্য দিয়ে একটানা ছুটেই চলেছে 'এতাম' নামক আন্তর্নক্ষত্র যানটি, আলোকের গতিতে সামনের দিকে।
ভিতরের এগারোজন যাত্রীর চেতনা ফিরছে তখন অল্প অল্প করে। সবার আগে জ্ঞান ফিরে পেয়ে উঠে বসেছেন কমাণ্ডার সুলিভান; নিজের আসনে বসে আধো-চোখে চারদিকে তাকিয়ে চোখ সম্পূর্ণ খুলে গেল তাঁর; অবাক বিষ্ময়ে স্থির চোখ মেলে তিনি তাকিয়েই রইলেন বোবা হয়ে! এ কিভাবে সম্ভব? চেতনা হারাবার আগের মুহুর্ত্তে তিনি নিজের চোখে দেখলেন তাঁদের যানটিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনু-কণায় বিশ্লিষ্ট হয়ে যেতে, আর জ্ঞান ফিরে পেয়ে এখন দেখছেন যে গোটা যানটি স্বাভাবিক, কোথাও কোন ভাঙাচোরার চিহ্নমাত্র নেই, আর তিনি সুস্থ ও জীবিত! ঘরে উপস্থিত বাকি সদস্যদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তিনি; সকলেই অল্প-বিস্তর নড়ছেন আধো-তন্দ্রার মধ্যে, যার অর্থ- জীবন রয়েছে এদের সকলের শরীরেই! এ কি করে সম্ভব? আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলেন কমাণ্ডার সুলিভান, কিন্তু কোন থই খুঁজে পেলেন না তিনি এই দূর্জ্ঞেয় রহস্যের।
-"কমাণ্ডার সু!"
পাশ থেকে চেনা গলায় ডাক পেয়ে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন তিনি। মিস স্টিফেনি! তিনিও চোখ মেলে তাকিয়েছেন তার কমাণ্ডারের দিকে। পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন কমাণ্ডার, নড়ে-চড়ে উঠে বসেছেন প্রায় প্রত্যেকেই! এবারে মিস স্টিফেনির দিকে ফিরে তাকাতেই প্রশ্ন করলেন তিনি-
-"আমরা এখন কোথায়, কমাণ্ডার?"
মাথা নাড়লেন কমাণ্ডার সুলিভান, বাদ-বাকিগুলির মতই এই প্রশ্নেরও উত্তর নেই তাঁর কাছে। ক্যাপ্টেন থটকে দেখে মনে হল বেশ কিছুটা ধাতস্থ হয়েছেন তিনি; এখন তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন দুজনেই, কিন্তু মাথা নাড়লেন তিনিও। এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছেও নেই।
মূর্ত ও হতবাক যাত্রীদের বুকে নিয়ে মহাবিশ্বের অন্ধকারের মধ্য দিয়ে জায়গা করে আলোকের গতির থেকেও দ্রুততর বেগে ছুটে চলল 'এতাম', অবিরাম সামনের দিকে ধেয়ে চলে। আর পাঁচটি প্রশ্নের মত এটিও তাদের কাছে একটি বিরাট প্রশ্নচিহ্ন- তাদের যান সর্বোচ্চ গতিবেগে চলছে কি করে?
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
-"মিস স্টিফেনি…আপনার পাশের ঐ লাল বোতামটা চিপুন…" – দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে স্টিয়ারিং চেপে ধরে কোনমতে নির্দেশ দিলেন কমাণ্ডার সুলিভান।
-"তিনবার চেষ্টা করেছি কমাণ্ডার, কোন লাভ হয় নি! 'ট্যাকিয়ন-এঞ্জিন' কোনমতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না-"
-"সর্বনাশ! এখনই যদি 'ট্যাকিয়ন-এঞ্জিন' বন্ধ না করা যায়, তবে আমরা সামনের গ্রহটির অভিকর্ষ বলের আঁওতায় চলে এসে প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে যাব ভূপৃষ্ঠের দিকে; কপাল ভালো থাকলে আগুনে ফ্রাই না হয়ে যদি মাটি অবধি পৌঁছতে পারি তবে গতিবেগজনিত কারণে এমনিতেই ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে- আচ্ছা, দাঁড়াও দেখছি!"
কমাণ্ডার সুলিভান সামনের কন্ট্রোল প্যানেলে থাকা সুইচ-গিয়ারে পরপর বোতামগুলিতে কিসব খুটখাট করলেন কে জানে; বেশ খানিকক্ষণ পর হাতের কাজ শেষ করে তিনি বললেন-
-"নিন। এবারে চেষ্টা করে দেখুন তো-"
কপাল ঠুকে আরও একবার মিস স্টিফেনি পাশে থাকা লাল বোতামটিতে দিলেন এক মোক্ষম চাপ! এবারে কাজ হল; যান থেকে বেরোন মৃদু মৌমাছির গুঞ্জণের মত আওয়াজটি কিছু সময়ের জন্য থেমে গেল, তারপর অপেক্ষাকৃত তীব্র, চাপা একটা গর্জ্জন ভেসে এল প্রত্যেকের কানে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন সকলে; এর অর্থ- বিকল্প এঞ্জিন, যা স্বাভাবিক জ্বালানিতে চলে সেটি এইমাত্র কাজ করা শুরু করেছে, যানের এই তীব্র গতি এবারে আস্তে আস্তে অনেকটাই নীচে নেমে আসবে।
যাত্রা শুরু করবার পর থেকে দূর্ভোগ যেন আর পিছু ছাড়তেই চাইছে না অভিযাত্রী দলটির!
কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসবার পর একটানা বেশ দীর্ঘ একটি সময় মহাকাশে ভেসে বেরিয়েছেন সকলে। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি; সময়ের কোন মাপজোঁক নেই এই অসীম অন্ধকার প্রাঙ্গণে! ওদিকে চৌম্বক ঝড়ের প্রভাবে অনেকগুলি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যায়; তার মধ্যে অন্যতম বিকল যন্ত্রটি ছিল পৃথিবীর সময় নির্দেশকারী পরিগণকটি; ফলে সময়ের মাপজোঁক কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে বসেন প্রত্যেকেই। শেষমেষ যন্ত্রবিদ স্টিমসন দুজন সহকারীর সাথে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সারিয়ে তোলেন 'এতাম'-এর ক্ষত; যন্ত্রগুলি ফেরৎ আসে তাদের স্বাভাবিক পর্যায়ে।
-"আচ্ছা কমাণ্ডার, কৃষ্ণগহ্বর থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম কি করে বলুন তো? যদ্দুর জানি ওর অভ্যন্তরে প্রবল চাপে তো আমাদের চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার কথা, তাহলে আমরা বেঁচে আছি কি করে?"- অবাক মেনে একদিন প্রশ্নটি করেই বসলেন পরিবেশবিদ ডাঃ সুনীতা হ্যারিস; বোঝাই গেল এই প্রশ্নটি তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনেই, কারণ প্রশ্নটি করবার সাথে সাথে যে কয়জন উপস্থিত ছিলেন আশেপাশে, সকলেই সাগ্রহে তাকালেন তাদের কমাণ্ডারের দিকে। মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ ভাবলেন কমাণ্ডার সুলিভান, তারপর বললেন-
-"থিয়োরি তো তাই বলে সুনীতা, কিন্তু বাস্তবে আমরা তো ওর মধ্যে ঢুকে বেরিয়েও এলাম…ভাবতে হবে।"
এর পর হঠাৎ অপর কোন একটি সময়ে উত্তেজিত ভাবে এগিয়ে আসেন ক্যাপ্টেন থট; কমাণ্ডারের হাতে ব্যস্ত হয়ে নিজের আইপ্যাড তুলে দেন তিনি, আঙুল রাখেন বিশেষ একটি অংশে। নির্দেশিত অংশটি ভালো করে দেখে নিয়ে এবারে থটের দিকে ভুঁরু কুঁচকে তাকান কমাণ্ডার সুলিভান।
-"আপনি কি নিশ্চিত যে এই গ্রহটিতে প্রাণ থাকতে পারে?"
-"আজকে খানিকক্ষণ আগেই আমাদের উচ্চশক্তিসম্পন্ন দূরবীক্ষণে ধরা পড়েছে এই গ্রহটি; আমাদের পৃথিবীর মতই এটিও তৃতীয় গ্রহ…একে ঘিরে এই হালকা নীলচে-সবুজ আলোর আভাটা দেখছেন? নীল আর সবুজ, কমাণ্ডার! এর অর্থ-"
-"জল ও সবুজ অরণ্যে ঘেরা স্থল…নীল রঙের অর্থ বায়ুমণ্ডলের উপস্থিতি- এই গ্রহের বর্ণালীর স্পেকট্রাম অ্যানালিসিসের রিপোর্টটা কি-"
-"কাজ এখনও চলছে কমাণ্ডার। তবে যতটুকু জানা গিয়েছে তাই যথেষ্ট; আমাদের একবার গিয়ে দেখা উচিৎ।"
-"আপনি ঠিকই বলেছেন, এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। সকলকে একত্র করুন। ভালো কথা- এটিই কি আমাদের লক্ষ্যবস্তু?"
-"এখানেই তো ডজনখানেক গোল খেয়ে বসে আছি আমরা, কমাণ্ডার! এই গ্রহটি কিন্তু একটিইমাত্র নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তন করছে, প্রস্তাব অনুযায়ী অপর উজ্জ্বল নক্ষত্রটি বা আশেপাশে থাকা লাল বর্ণের বামন নক্ষত্রটিকে আমরা এখনও খুঁজে পাই নি!"
-"হুমম…এমনও হতে পারে এদুটি হয়তো এদের আবর্তন-কক্ষের সবচেয়ে দূরবর্ত্তী অংশে রয়েছে…অনুসন্ধান চালিয়ে যান। আর…আমরা এই গ্রহে নামতে চলেছি। গতিবেগ হ্রাস করবার নির্দেশ দিন।"
তার পরই এই দূর্ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছিল; 'ট্যাকিয়ন-এঞ্জিন' কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছিল না! শেষে কমাণ্ডার সুলিভানের উপস্থিত বুদ্ধিতে রিষ্টি কাটল সকলের; যানের গতিকে নিয়ন্ত্রন করা গেল একজন মানুষের একক আসুরিক প্রচেষ্টায়! নির্দিষ্ট গতিবেগে যান এগিয়ে চলল সদ্য-আবিষ্কৃত নতুন গ্রহটির দিকে।
-"তাহলে কি বলা যেতে পারে যে আমরা এবারে নির্বিঘ্নে নতুন গ্রহটিতে নামতে চলেছি?"
'এতাম'-এর ভিতরে হর্ষধ্বণি থামতেই হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর লী। কিন্তু কমাণ্ডার সুলিভানের উত্তরটি নিষ্প্রভ করে দিল তার হাসিকে, এবং ঘরের ভিতরের হাস্যমুখরিত পরিবেশটিকেও-
-"'ট্যাকিয়ন-এঞ্জিন' চালু থাকবার সময় আমি যানের গতিবেগ সর্বনিম্ন মানে নামিয়ে এনেছিলাম বটে, কিন্তু তাও প্রয়োজনীয় গতিবেগের থেকে তা বহুগুণ উর্দ্ধে ছিল; ওদিকে স্বাভাবিক জ্বালানির এঞ্জিন চালু করতে দেরি হয়ে গিয়েছে। ফলে আমরা যখন ঐ গ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করব, আমাদের গতিবেগ তখন এমনিতেই একটু বেশি থাকবে, ঐ অবস্থাতেই চেষ্টা করতে হবে নীচে নামবার- বাকিটা ভাগ্য!"
আবার একটি দীর্ঘকালীন নীরবতা নেমে এল পাইলট-ঘর জুড়ে-
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
-"কমাণ্ডার সু- যানের পিছনদিকের ফ্ল্যাপের কাছটিতে আগুন ধরে গিয়েছে, গতিবেগ এখনও অনেক বেশি, আমরা দ্রুতবেগে মাটির কাছাকাছি নেমে আসছি-"- আর্তনাদ করে উঠলেন মিস স্টিফেনি, তার মুখ তখন লাল হয়ে গিয়েছে আতংক ও উত্তেজনায়।
-"ডেনহ্যাম আর ফরেস্টকে পাঠিয়ে দিন আগুনের মোকাবিলা করতে। মধ্যিখানের আপৎকালীন ফ্ল্যাপগুলিকে সক্রিয় করুন। আপাতত আমরা সোজাসুজি ভেসে এগোব। এইভাবে উচ্চতা কমিয়ে এনে তারপর চেষ্টা করব পিছনদিকের অ্যান্টি-থ্রাস্ট রকেটগুলিকে কাজে লাগাবার। জলদি!"
কমাণ্ডার সুলিভানের কথাগুলি সম্পূর্ণ মিলে যাচ্ছে! এঞ্জিন-বিভ্রাটে পড়ে গতিবেগ কমানোয় দেরি হয়ে যাওয়ায় নতুন গ্রহটির অভিকর্ষ বলের আঁওতায় চলে আসবার আগে যানের গতিবেগ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ছিল; ফলশ্রুতি- বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণে সৃষ্ট নতুন বিপত্তি!
প্রথমদিকে সরাসরি সোজাসুজি মাটির দিকে না এসে কমাণ্ডার সুলিভানের ইচ্ছে ছিল যানকে পাক খাইয়ে নামাবার; এতে যানটিতে আগুন ধরে যাওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায় বহুলাংশে। কিন্তু এতে আবার দেখা দেয় নতুন বিপত্তি- যানের স্বাভাবিক জ্বালানি এতে দ্রুত খরচ হচ্ছিল। তায় গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া- হঠাৎ পিছনদিকের ফ্ল্যাপে আগুন ধরে যাওয়ায় ঘুরপাক খেয়ে নীচে নামবার পরিকল্পনাটি বাতিল করতে হয়। তাই আপাতত এই বিকল্প পরিকল্পনা কার্যকর করতে নির্দেশ দেন কমাণ্ডার সুলিভান- যানকে সরাসরি নীচে না নামিয়ে বুকে ভাসিয়ে সোজাসুজি বেশ খানিকটা এগিয়ে তারপর গতি কমিয়ে যেখানে সুবিধা হবে সেখানে অবতরণ করা। মৃত্যুকালে খড়কুটো ধরেও তো লোকে ভাসবার চেষ্টা করে, নাকি?
যানের দুটি পাশ দিয়ে সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলি বেরিয়ে আসছে; বৈমানিকের সামনে রাখা মনিটরে পরিষ্কার ধরা পড়েছে তা। মরীয়া হয়ে যানের সর্বনিম্ন গতিবেগের দিকে লিভারকে ঠেলে দিলেন কমাণ্ডার সুলিভান- কিছুটা সময় লাগবে বটে যানটির গতিবেগ হ্রাস হতে, কিন্তু একবার তা হলেই যানকে সোজা ক্র্যাশ-ল্যাণ্ডিং করিয়ে দেবেন তিনি। এছাড়া আর কিছু করণীয় নেই- যানের নিজস্ব 'ল্যাণ্ডিং-সিস্টেম' কাজ করছে না!
এরই মাঝে হঠাৎ পিছন থেকে ক্যাপ্টেন থট বলে উঠলেন-
-"কমাণ্ডার সুলিভান! উত্তর-পূর্বে আমি একটি বিপুল হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সম্মিলিত যৌগের সম্ভার খুঁজে পেয়েছি; আমার ধারণা-"
-"কমাণ্ডার একটু ব্যস্ত, ক্যাপ্টেন!"- দাঁতে-দাঁত চিপে বলে উঠলেন কমাণ্ডার সুলিভান- "বাংলায় বলুন দয়া করে; আর সংক্ষেপে-"
-"জল, কমাণ্ডার! জলের একটি বিপুল সম্ভার! উত্তর-পূর্বে একশ-পঁচাত্তর কিলোমিটারের দায়রায়! ওখানে কিন্তু যানকে নামানোর চেষ্টা করা যেতে পারে; এতে পতনজনিত ক্ষয়ক্ষতি কম-"
-"যানের মুখ ঐদিকে ঘোরাচ্ছি, আপনি রি-ক্যালিব্রেট করুন, অ্যান্টি-থ্রাস্ট রকেটগুলিকে তৈরি করুন। আর…ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন থট!"
সকলে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলেন আসন্ন মুহুর্ত্তটির জন্য; ক্রমশঃ যানের উচ্চতা ও গতিবেগ- দুইই কমে এল। একটি নির্দিষ্ট মুহুর্ত্তের পর কমাণ্ডার সুলিভান চেঁচিয়ে নির্দেশ দিলেন অ্যান্টি-থ্রাস্ট রকেটগুলিকে সক্রিয় করতে; মুহুর্ত্তে যানের পিছনদিক থেকে অভিকর্ষ বলের বিপরীত দিকে একটি চাপ অনুভব করে স্বস্তি অনুভব করলেন সকলে- এর অর্থ, রকেটগুলি কাজ করছে। তারপর ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ক্রমশঃ কমে এল; এরপর-
সবেগে ঝাঁকুনি খেতে খেতে নীচে নেমে বুকের ওপর দিয়ে অনেকটা পথ ঘষটে এগিয়ে অবশেষে থেমে গেল 'এতাম'; একদম নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেটি, একটি ত্রিকোণাকৃতি পাহাড়ের মত! পৃথিবী ছেড়ে অনিশ্চিত উড়ানের পর এই প্রথম কোন গ্রহের শক্ত ভূমির ওপর দাঁড়াল শক্তপোক্ত এই যানটি…
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
-"ক্যাপ্টেন থট সাহেব- যদ্দুর আমার মনে পড়ছে আপনি বলেছিলেন আমরা কোন জলস্তরে নামতে চলেছি; কিন্তু নীচের পরিবেশ ও অনুভূতি তো সে কথা বলছে না!"
চালকের সীট থেকে কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলে উঠলেন কমাণ্ডার সুলিভান; প্রবল ঝাঁকুনিতে ঘাড়ে ব্যথা পেয়েছেন তিনি। ক্যাপ্টেন থটের অবস্থাও তথৈবচ; কোনমতে সীটবেল্ট খুলতে খুলতে তিনি বললেন-
-"আমরা জলস্তরের ওপর দিয়ে উড়ে পুরো জায়গাটি অতিক্রম করে শুকনো ডাঙায় ল্যাণ্ড করেছি কমাণ্ডার; কৌণিক অবস্থানের হিসেবে কোন ভুল হয়ে থাকবে…ভালো কথা, আমাকে একটু অনুমতি দিতে হবে; মনে হয় ঝাঁকুনির চোটে…প্যান্টটাকে পাল্টে চলে আসছি এখুনি।"
তার দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে ঘাড় নাড়লেন কমাণ্ডার সুলিভান; এক হিসেবে তিনি খুশি সবাইকে নিয়ে নিরাপদ ও প্রায় অক্ষত অবস্থায় নীচে নামতে পেরে। 'প্রায় অক্ষত' ভাববার নেপথ্য কারণটি হল- তিনি এখনও জানেন না তাঁদের যান কেমন অবস্থায় রয়েছে- তবে ভিতরের যাত্রীরা সকলেই যে নিরাপদ এ কথা ভেবেই তিনি খুশি।
-"যে গ্রহটিতে আমরা নামলাম তার একটি বিশদ বিবরণ আমার চাই!"- হেঁকে উঠলেন কমাণ্ডার সুলিভান- "ডেনহ্যাম, আপনার বিশ্লেষক ড্রোনগুলিকে নিক্ষেপ করুন; প্রোফেসর চাওলা, আপনি এই গ্রহের বায়ুমণ্ডলের বিশদ বিবরণগুলি পর্যবেক্ষণ করতে থাকুন। আঃ, গিলবার্টবাবু! কতবার বলেছি মনিটরিং প্ল্যাটফর্মটি আপনার বিছানা নয় যে যখন খুশি ওখানে শুয়ে পড়বেন; দয়া করে নেমে আসুন আর ক্যামেরাগুলি পর্যবেক্ষণ করতে থাকুন। সুনীতা, আপনি…ওহো! আপনার তো কিছু নিদর্শন লাগবে, না? দাঁড়ান…মিস স্টিফেনি, আপনি আমার সঙ্গে আসুন সম্পূর্ণ সশস্ত্র, এবং পুরো স্যুট পরা অবস্থায়; বাইরে কি রয়েছে তা আমরা জানি না। আপৎকালীন অবস্থায় দুইশ মিটারের মধ্যে আমরা যা কিছু জৈব ও অজৈব নমুনা পাব তাই তুলে নিয়ে আসব। তারপর আপনি আর সুনীতা দুজনে মিলে আপনাদের পর্যবেক্ষণগুলি নিয়মিতভাবে আমায় জানাতে থাকবেন। এখন আসুন আমার সঙ্গে। গিলবার্ট, আপনার সঙ্গে আমার বেতারে যোগাযোগ থাকবে কিন্ত! কোনরকম বিপদ হলেই আপনি আমাদের জানাতে থাকবেন।"
ক্যাপ্টেন থটও ফেরৎ এসেছেন ততক্ষণে; তাঁর হাতে আস্ত যানটির সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পণ করে বেশ কিছুক্ষণ পরে সম্পূর্ণ স্যুট পরিহিত অবস্থায় যানটি থেকে নেমে এলেন দুজনে- কমাণ্ডার সুলিভান ও সেকেণ্ড ইন-চার্জ – স্টিফেনি তেরেশকোভা। তাঁরা বেরিয়ে আসতেই যানের প্রবেশদ্বারটি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল।
-"বাঃ!"
বাইরের জগতে বেরিয়ে এসে চারদিকে একবার তাকিয়ে প্রথম অভিব্যক্তিটি বেরিয়ে এল মিস স্টিফেনির মুখ দিয়ে। হাজার হোক তিনি মেয়েমানুষ; কাঠখোট্টা প্রটোকলের মধ্যেও নির্মলতার ছোঁয়া তার স্বভাব-কোমল মনকে টানবে বেশি। আর বাইরের এই অদ্ভুত সুন্দর জগৎটি, যা এতক্ষণ ঢাকা পড়েছিল 'এতাম'-এর বন্ধ জানালার ওপারে, তা এখন চোখের সামনে উম্মোচিত হতেই মুখ উৎফুল্ল হয়ে উঠল তার; আনন্দিত হয়ে পারিপার্শ্বিক ভুলে তিনি একটানা চেয়েই রইলেন মুক্ত প্রকৃতির দিকে।
তাদের সুবিশাল আন্তর্নক্ষত্র যানটি এসে ঠেকেছে একটি ছোট পাহাড়কে পিছনে রেখে, পাহাড়ের ঢালের পাথুরে জমির পুরোটা বুকে ঘষটে উঠে অনেকটা পথ অতিক্রম করে শেষমেষ সাবলীলভাবে সামঞ্জস্য রেখে আটকে গিয়েছে যানটি সুন্দরভাবে, একেবারে নট-নড়নচড়ন হয়ে! সে তো না হয় হল, কিন্তু বেরিয়ে এসে এরকম অবাস্তব স্বপ্নের মত দৃশ্যটি যে সত্যি হতে পারে, তা বিন্দুমাত্র ধারণায় ছিল না দুজনের কারোরই।
তাদের অদূরে তখন সবুজ একটুকরো গালিচা পাতা, যার পরেই শুরু বি-শাল একটি হ্রদ! আকারে-কলেবরে এতই বড় সেটি যে প্রথমে তা দেখে সাগর বলে ভ্রম হয়েছিল দুজনের; কিন্তু দূরবীক্ষণ যন্ত্রে আশেপাশে ঘন গাছপালা সমৃদ্ধ অরণ্যের বিস্তার দেখে ক্রমশঃ সে ভুল তাদের ভেঙে যায়। বেশ কিছুক্ষণ জায়গা থেকে নড়তে পারেন নি দুজনের কেউই- আশেপাশের সৌন্দর্য্য তাদের বিমোহিত করে তুলেছিল। তার সাথে যোগ হয়েছিল হ্রদের ধারে এবং আশেপাশে অজস্র পাখিদের কলতান। যাক, খেচর শ্রেণীর প্রাণীদের উপস্থিতি মানে এখানে জীবন রয়েছে, তা যথেষ্ট জটিল ও উন্নত কোষসমৃদ্ধ এবং এই সূত্র ধরেই আশা করা যায় যে এখানে নিশ্চই বাস্তুতন্ত্রও যথেষ্ট সক্রিয়!
-"যাক!"- অবশেষে কোনমতে কথা বলে উঠলেন কমাণ্ডার সুলিভান- "এর অর্থ এখানে জীবন আছে! তা ক্যাপ্টেন থট কিন্তু ভুল কিছু বলেন নি দেখছি মিস স্টিফেনি; অদূরেই জলের একটি বিরাট ভাণ্ডার রয়েছে, ঐ হ্রদটি। কৌণিক গতিবেগটি আর একটু নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই- এখন আমাদের যানটি এমন জায়গায় এসে ঠেকেছে যেখান থেকে তাকে উৎক্ষেপণ করানো বেশ শক্ত ব্যাপার হতে পারে-"
-"আপনি কোন চিন্তা করবেন না, আমাদের কমাণ্ডার ভদ্রলোকটি যথেষ্ট দক্ষ ও পারদর্শী; তিনি চোখ বন্ধ করে এই যানকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন বলেই আমাদের বিশ্বাস!"- হাসতে হাসতে বললেন মিস স্টিফেনি।
-"যানের তলার দিকটির কি খবর তা এখনও দেখা হয় নি, কিছু বলা এখনই সম্ভব নয়। আপাতত যে কাজটি করতে এসেছি তা করা যাক?"
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আপাতত শিকেয় তুলে এগিয়ে গেলেন মিস স্টিফেনি, হাতে বিশ্লেষক যন্ত্রটি নিয়ে। এই যন্ত্রের সাহায্যে যেকোন বস্তুর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সেই বস্তুর গঠনকারী উপাদানগুলি সম্পর্কে বিশদে জানা যায়। এখন যন্ত্রের নলটি দিয়ে আশেপাশে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন প্রকার জৈব-অজৈব – সকলপ্রকার বস্তুগুলিকেই পরখ করে নিচ্ছিলেন উনি; আর তা করতে করতেই বিষ্মিত হয়ে ওঠে তার চোখ-মুখের অভিব্যক্তি!
-"কমাণ্ডার সুলিভান! এদিকে একবার দেখে যান কমাণ্ডার!"
-"কি হল মিস স্টিফেনি?"
-"এই বস্তুগুলির উপাদান, মৌলের গঠন, তাদের বিন্যাস ও অনুপাত- সব হুবহু পৃথিবীর মতন!"
-"অ্যাঁ! সে কি?"
বিশ্লেষক যন্ত্রের পর্দায় চোখ রেখে চমকে উঠলেন কমাণ্ডারও- তাই তো! এ তো তাই! অজ্ঞাত এই গ্রহ থেকে প্রাপ্ত নমুনাগুলির উপাদান পৃথিবীতে পাওয়া একই নমুনার উপাদানের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাদৃশ্যযুক্ত; আণবিক গঠন থেকে শুরু করে মৌলের অনুপাত- কোনকিছুতেই ব্যতিক্রম নেই যে! এ কি করে সম্ভব?
দুজনেই বেবাক হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, এমন সময় তাদের কানে লাগানো ইয়ারফোনে ভেসে এল ক্যাপ্টেন থটের গলা-
-"মিস স্টিফেনির বিশ্লেষণ একেবারে সঠিক, কমাণ্ডার। এখানে অবতরণ করে আমরা যে বিশ্লেষক ড্রোনগুলি ছেড়েছিলাম, সেগুলি সংকেত ছাড়তে আরম্ভ করেছে। এই গ্রহের বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে আমাদের গ্রহের কোন তফাৎ নেই। আমাদের গ্রহের মত এখানেও সম অনুপাতে রয়েছে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন, যা জীবনধারণের অনুকূল শর্ত। এখানে যে জটিল কোষগুলি আপনি দেখেছেন তার অন্যতম কারণও এটি-"
-"'জটিল কোষ'?"- জিজ্ঞাসা করলেন কমাণ্ডার।
-"হ্রদের ধারে আপনি যে পাখিগুলিকে দেখতে পাচ্ছেন; এছাড়া এখানে নিশ্চই পোকা-মাকড়, অন্যান্য পশুপাখি থাকবে…আমি বাস্তুতন্ত্রের সকল জৈবভরকে বোঝাতে চেয়েছি-"
-"বুঝলাম!"- মনে মনে এই পণ্ডিতটির ওপর খাপ্পা হয়ে উঠতে উঠতে বললেন কমাণ্ডার সুলিভান- "আর?"
-"এছাড়া এখানকার বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ও অন্যান্য যৌগের উপস্থিতি প্রায় পৃথিবীর অনুপাতেই। বাতাসে জলীয় বাষ্পের প্রাচুর্য্য প্রমাণ করে যে এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমান ভালোই। লক্ষণীয় বিষয়, এখানে ওজোন স্তর রয়েছে যা পৃথিবীর মত এখানকার প্রাণীদেরও ক্ষতিকর রশ্মির হাত থেকে রক্ষা করে। হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও অন্যান্য গ্যাসগুলির উপস্থিতি…কমাণ্ডার, আপনি সংক্ষেপে এই গ্রহটিকে 'পৃথিবীর যমজ বোন' বলতেই পারেন! আর একটি কথা, এখানকার অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গে আমাদের মোলাকাতের সৌভাগ্য হয় নি, তাই আমার মনে হয় বাইরে আপনাদের সতর্ক থাকা উচিৎ।"
দুজনেই তাঁদের কোমরের কাছে পিস্তলের হোলস্টারের বোতাম খুলে রাখলেন। উচ্চশক্তির আলোকরশ্মি বিকিরক মারণাস্ত্র এটি; এখন এর সামনে ডাইনোসোরাসও যদি চলে আসে তবে তারও রক্ষা নেই। বলা যায় না, ক্যাপ্টেন থট বর্ণিত 'সৌভাগ্য' যদি আচমকা তাদের সামনে চলে আসে-
-"কি করবেন মিস স্টিফেনি? থাকবেন, না কি ভেতরে চলে যাবেন?"
-"এক মিনিট কমাণ্ডার! মোটামুটি আশেপাশের সবকিছুর নমুনা সংগ্রহ হয়েছে- বিশুদ্ধ মাটি ছাড়া। ঐটি করে নিলেই ভূস্তর সম্পর্কে মূল্যবান কিছু তথ্য-"
-"বেশ তো, সামনের ঐ বড় পাথরটি দেখছেন তো? ওর সামনের মাটিটা মনে হচ্ছে পাথুরে নয়; ওখান থেকেই নাহয়-"
-"ঠিক বলেছেন কমাণ্ডার। এক মিনিটে আসছি…"
ঢালের গড়ানে দুজনের থেকে একটু দূরে একটি প্রকাণ্ড বড় পাথরের সামনের অংশের মাটিটি বোধহয় বৃষ্টির জল জমে জমে সামান্য নরম হয়ে থাকবে; এখন নমুনা সংগ্রহ করবার জন্য মিস স্টিফেনি এগিয়ে গেলেন সেদিকে। উবু হয়ে বসে এবার হাত দিয়ে ওপরের আলগা মাটি সরিয়ে নিয়ে আসতেই-
হঠাৎ তার মনে হল যেন একটি ছায়া নড়ে উঠল ঠিক তার পাশেই; তারপরই তিনি দেখলেন ছায়াটা যেন বিদ্যুৎগতিতে নেমে আসছে তার মাথার ওপরেই! চমকে উঠে পুরোন অভ্যাসে কোমর থেকে তার হাতে উঠল আলোক-উদ্গীরণকারী ক্ষুদে, অথচ মারাত্মক অস্ত্রটি; মাথার ওপর সেটিকে তুলে নিয়ে একবারই তা ফায়ার করলেন তিনি। পরক্ষণেই তার পাশে এসে ধপাস করে পড়ল একটি মৃতদেহ! কিন্তু…এটি কিসের দেহ?
মৃতদেহটির অঙ্গসংস্থানটি এতটাই অদ্ভুত যে পারিপার্শ্বিক বিপদ ভুলে মিস স্টিফেনি হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন সেদিকে। নৃতত্ত্বের অধ্যায়গুলিতে বহুযুগ আগে প্রাচীন মানবগোষ্ঠীর যে চেহারা পড়ানো হয়েছিল তাদের, সেই চেহারার সঙ্গে এই চেহারার হুবহু আদল রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না? মাথার খুলি আয়তনে অন্যান্য শিকারী প্রাণীদের থেকে বড়, পরিষ্কার সমকোণী আয়তাকার, মুখ সূঁচোল নয়, বরং তা যেন ভিতরে ঢোকানো; পরিষ্কার চোখ-নাক-কান; গায়ে লোমের বিশেষ উপস্থিতি নেই, হাত-পা আলাদা আলাদা; পা দেখে মনে হয় এরা দ্বিপদ- কি এরা? পাশে আবার একটি ভারি মুগুর মত পড়ে রয়েছে- পরিষ্কার পাথর কুঁদে তৈরি করা হয়েছে এই অস্ত্র; গায়ে পোশাকও রয়েছে বলে মনে হচ্ছে যেন- এর অর্থ এরা উন্নত জীব?
বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে মিস স্টিফেনি তাকিয়ে ছিলেন মৃতদেহটির দিকে, তবে বিষ্ময়ের আরও কিছু বাকি ছিল!
দুজনেই খেয়াল করেছিলেন যে মৃতদেহটি মাটিতে পড়বার সাথে সাথে তীক্ষ্ণ গলায় একটি চিৎকার ভেসে এসেছিল অদূরে সারিবদ্ধভাবে পাশাপাশি দাঁড় করানো পাথরখণ্ডগুলির পাশ থেকে; কমাণ্ডার সুলিভানের চোখের দৃষ্টি আর হাতের বন্দুকের নল- দুটিই ঘুরে গিয়েছিল আওয়াজের উৎসের দিকে সাথে সাথে। এবারে মুখ তুলে মিস স্টিফেনি সেদিকে তাকাতেই দেখতে পেলেন- পাথরের সারির পিছনে দাঁড়ানো একসার কৌতুহলী মুখ। গুলি চালাতে যাচ্ছিলেন কমাণ্ডার সুলিভান; বাধা দিলেন মিস স্টিফেনি।
-"গুলি চালাবেন না!! এরা প্রত্যেকেই মনে হয় উন্নত বুদ্ধির প্রাণী, কমাণ্ডার। অস্ত্রের, বিশেষতঃ পাথরের তৈরি অস্ত্রের ব্যবহার জানে, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম বলেও মনে হল। এরা মনে হয় ঐ প্রাণীটির নাম ধরে ডেকেছিল-"
অদূরে শায়িত প্রাণীটির মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে ঈঙ্গিত করলেন মিস স্টিফেনি।
-"তাই নাকি? আর কোন ভাষায় এই নাম ধরে ডাকবার কার্যটি হয়েছিল বলে আপনার মনে হয়?"
-"দোহাই কমাণ্ডার! আপনাকে অনুরোধ করছি গুলি চালাতে যাবেন না; তার থেকে এদের কাছে ডাকা যাক বরং-"
-"তা করুন…কিন্তু বেগড়বাঁই দেখলেই এদের সবকটাকে কিন্তু একইসাথে-"
অজ্ঞাত গ্রহটির তুলনামূলকভাবে উন্নত বুদ্ধির প্রাণীগুলি বোধহয় তাদের অস্ত্রের জোর দেখে ব্যোমকে গিয়ে থাকবে; এবার ইশারায় কয়েকবার তাদের কাছে ডাকতেই আর দেরি না করে হাতের অস্ত্রগুলি ফেলে দিয়ে তারা উঠে এল নিজ নিজ লুকোনোর জায়গা থেকে। মিস স্টিফেনির ধারণাটি সঠিক ছিল; এরা দোপেয়ে, চারপেয়ে নয়! সর্বোপরি, যে ভঙ্গীতে এরা দুহাত মাথার ওপর তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গীতে কাছিয়ে এল তাতে বোঝাই গেল যে এদের বুদ্ধিবৃত্তির স্তর যথেষ্ট সংগঠিত।
-"কমাণ্ডার! আপনার আদেশ পেলেই আমরা প্রত্যেকে সশস্ত্র হয়ে যান-এর বাইরে বেরিয়ে আসব"-ক্যাপ্টেন থটের গলা ভেসে এল বেতার যন্ত্রে। উত্তরে শান্ত গলায় কমাণ্ডার সুলিভান বললেন-
-"কোন দরকার নেই ক্যাপ্টেন থট; আমরা সংখ্যায় কতজন তা এদের সামনে উম্মোচিত না হওয়াই ভালো। আপনি 'থ্যানোটোস'কে বাইরে পাঠিয়ে দিন, ও এসে দেহটিকে সংগ্রহ করে নিয়ে যাক। ততক্ষণে আমরা বরং এদের সঙ্গে একটু বাতচিৎ করবার চেষ্টা করে দেখি-"
'থ্যানোটোস' নামটি নেওয়া গ্রীক পুরাণ থেকে; পুরাণ অনুযায়ী তিনি ছিলেন রাত্রির দেবী 'নিক্স'-এর সন্তান এবং 'হিপনোস' নামক ঘুমের দেবতার আপন ভাই। বেস কমাণ্ডার থ্যাচার আবার দেশ-বিদেশের পুরাণের বিষয়ে অত্যন্ত উৎসাহী; স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তিনি এই প্রোজেক্টের বিভিন্ন অংশের নামকরণ করেছিলেন। 'এতাম'-যানের 'থ্যানোটোস' অবশ্য কোন মানুষ নন, কৃত্রিম মেধাসম্পন্ন নিতান্তই একটি সাইবর্গ, যাকে নেওয়া হয়েছিল দুরূহ অভিযানগুলিতে কাজে লাগাবার জন্য, বা অভিযাত্রীরা যাতায়াতের সময় কোনভাবে যদি 'শীতঘুম'-এ চলে যান, তবে অন্যান্য সাইবর্গগুলির সহযোগিতায় যানকে স্বাভাবিক ছন্দে পরিচালনার জন্য। তার মত বেশ কয়েকটি সাইবর্গ রয়েছে 'এতাম'-এ, তবে গুণগত মানের দিক থেকে 'থ্যানোটোস' অনেকটাই এগিয়ে।
নির্দেশ দিয়ে এবার সামনে বসা বন্দীদের দিকে তাকালেন কমাণ্ডার সুলিভান।
বন্দীরা সকলেই মনে হল সম্পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করেছে- কারণ তিন-চারটি পৃথক সারিতে পাশাপাশি বসে এরা ক্রমাগত দুহাত মাথার ওপর তুলে পরক্ষণেই হাতসমেত মাথাটি আভূমি নত করছে সামনের দিকে। এখন দরকার এদের সঙ্গে যোগসাধন করা, কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন মিস স্টিফেনি; সবচেয়ে সামনে বসা দলপতিটির দিকে এগিয়ে নিজের বুকের ওপর একটি হাত রেখে তিনি বললেন-
-"স্টিফেনি।"
পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কমাণ্ডার সুলিভান; এবার তাঁর কাঁধে আলতো করে একটি হাত রেখে তিনি বললেন-
-"সুলিভান!"
অদূরে দাঁড় করানো নিজেদের যানটির দিকে হাত ঘুরিয়ে তিনি বললেন-
-"এতাম!"
তারপর হাত দিয়ে দলপতির দিকে একটি ইশারা করলেন তিনি, যার মানে দাঁড়ায়- 'আপনার নাম কি?' পর্যায়ক্রমে বেশ খানিকক্ষণ চলল এই প্রক্রিয়া; বেশ কিছুক্ষণ পর সাড়া পাওয়া গেল তার কাছ থেকে। প্রথমে কমাণ্ডার সুলিভানের দিকে হাতের ইশারায় ভাঙা গলায় অশুদ্ধভাবে তিনি উচ্চারণ করলেন- 'সু'; তারপর হাতের আঙুল মিস স্টিফেনির দিকে নির্দেশ করে ততোধিক ভাঙা গলায় তিনি উচ্চারণ করলেন- 'টেফনাৎ'। এরকম বার-দুয়েকবার নামোচ্চারণের পর এবার দলপতি নিজের বুকে হাত রেখে বললেন-
-"আটেন!"
বোঝা গেল এই প্রাণীগুলি সত্যিই বুদ্ধিমান। এরা কথা বলতে জানে, ইশারায় লুকিয়ে থাকা ভাষ্যটি পড়ে ফেলতে সক্ষম এবং নিজেদের গোষ্ঠীর প্রতিটি প্রাণীকে এরা আলাদা আলাদা নামে শনাক্ত করতে সমর্থ। এতক্ষণে একটু আশ্বস্ত হলেন কমাণ্ডার সুলিভান; যাক, অন্তত ইশারায় হলেও এদের সঙ্গে যোগস্থাপনে কোন সমস্যা হবে না; দরকার শুধু একটু ধৈর্য্য আর পরিশ্রম।
মুখ খুলে কিছু একটা বলতে যাবেন সুলিভান, এমন সময় যানের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন থ্যানোটোস, তার কুকুরের মত বর্ধিত মুখমণ্ডল নিয়ে। সাইবর্গগুলির গায়ের চামড়া জৈব-কোষ নির্মিত, ফলে এগুলিকে তরতাজা রাখতে অবিরাম বায়ুপ্রবাহের প্রয়োজন হয়; সেই ব্যবস্থাটি করা এদের মাথায়। এই কারণেই মুখের সামনেটি এরকম শিয়াল-কুকুরের মত বিবর্ধিত। এখন যান থেকে বেরিয়ে অদূরে পড়ে থাকা মৃতদেহটি দেখতে পেয়ে লম্বা লম্বা পায়ে থ্যানোটোস এগিয়ে গেলেন সেদিকে; তারপর অবলীলাক্রমে সেটিকে কাঁধে তুলে নিয়ে যানের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন পরবর্ত্তী নির্দেশের জন্য।
গোটা ব্যাপারটি বন্দীরা পর্যবেক্ষণ করলেন ভয়ার্ত চোখ মেলে; তাদের চোখে-মুখে প্রতিফলন ঘটল মাত্রাতিরিক্ত 'ভয়' ব্যাপারটি। যানের দরজার সামনে থ্যানোটোস এসে দাঁড়িয়ে পড়তে উশখুশ শুরু করে দিলেন সকলে। বিষয়টি বুঝে অবশ্য আর দেরি করলেন না কমাণ্ডার সুলিভান; হাত নেড়ে চলে যাওয়ার ইশারা করতেই আর দেরি হল না কারোর- কোনমতে একটি প্রণাম ঠুকে পড়ি-কি-মরি করে দৌড়লেন সকলেই উল্টোদিকে। তাদের গমনপথের দিকে চেয়ে রইলেন দুজনে।
-"আপনি ওদের যেতে দিলেন কমাণ্ডার, কিছু জিজ্ঞেস না করেই?"
-"'ভয়' জিনিষটি সংক্রামক, মিস স্টিফেনি! ভয় পেয়ে হঠাৎ যদি পুরো দলটি আক্রমণ করে বসত আমাদের তবে কি হত তা বলা মুশকিল, যেহেতু আমরা ওদের সঠিক সংখ্যা জানি না। তাছাড়া প্রথমদিনের আলাপের পক্ষে এইটুকু সৌজন্যতাই যথেষ্ট। এরপর ওরা ফেরৎ এলে বাকি বিষয়টি নিয়ে ভাবব। এখন আসুন, আমরাও আমাদের যানে ফেরৎ যাই।"
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
-"ডাক্তার থিয়োডর ও ডাঃ লি! আপনারা দুজনেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে উচ্চপ্রতিষ্ঠিত এবং সমাদৃত; আপনাদের ক্ষেত্রটিতে বহু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। আপনারা এরকম অসম্ভব কথা বলছেন কেমন করে- যাই হোক, আমি আপনাদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নই। আপনারা আরও একবার না হয় পরীক্ষাগুলি করে দেখুন; মনে হয় কোথাও কিছু ভুল থেকে যাচ্ছে-"
-"কোথাও কোন ভুল নেই কমাণ্ডার! পর্যবেক্ষণগুলি একেবারে নিখুঁত। যে দেহটি আজ আপনারা তুলে আনলেন তার ওপর বারংবার পর্যবেক্ষণ করেই আমাদের এই সিদ্ধান্ত। এতে ভুল হওয়ার কোন কারণ নেই।"
-"আপনি নিশ্চিত?"
-"একশ শতাংশ। তাছাড়া…ক্যাপ্টেন থটকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন; উনি আমাদের বিশ্লেষনের সঙ্গে সহমত।"
কমাণ্ডার সুলিভান এই কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন ক্যাপ্টেন থটের দিকে; তার নীরবতা বোঝাল যে এই বক্তব্যের সঙ্গে তিনি একমত। হতাশায় মাথা নীচু করে ঘাড় নাড়তে লাগলেন কমাণ্ডার সুলিভান, এরকম আশ্চর্য সমাপতন তিনি আশা করতে পারেন নি।
সন্ধ্যাবেলায় ডাকা এই গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশে একত্র হয়েছিলেন সকলে; নতুন আবিষ্কৃত গ্রহটির সম্পর্কে চুলচেরা বিশ্লেষনের জন্য। সেখানে স্বাভাবিক নিয়মেই উঠে এল 'এতাম'-এর ভবিষ্যৎ, আর সেখানেই শোনা গেল দুঃসংবাদ! মহাকাশ পরিক্রমা ও অবতরণের বিভিন্ন পর্যায়ে শোচনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অভিযাত্রীদের একমাত্র ভরসাস্থল এই যানটি; পুনরায় উড়তে গেলে যে শ্রম ও সময় দরকার এর মেরামতির জন্য, তা এই স্বল্পসংখ্যক যাত্রীদের পক্ষে একা কার্যত অসম্ভব! 'এখন কি হবে'- কার্যত এই প্রশ্নে বিধ্বস্ত ছিলেন সকলে; এরই মধ্যে বোমা ফাটালেন অ্যানাটমিস্ট প্রোফেসর লী ও ডাঃ থিয়োডর- সকলের সামনে তারা ঘোষণা করে বসেন-
-"এই মৃতদেহটি নিছক কোন প্রাণীর নয়, এই দেহটি আদিম কোন বুদ্ধিমান প্রজাতির মানুষের!"
'এতাম'-এর ভগ্নদশার সংবাদে রীতিমতন মুষড়ে পড়েছিলেন কমাণ্ডার সুলিভান, এখন ডাঃ লী ও থিয়োডরের মুখে এই অনুসিদ্ধান্ত ঘোষণা হতেই কার্যত তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন তিনি।
-"আপনারা কি রসিকতা করছেন আমার সাথে? আপনারা বলতে চান আমাদের বিশ্ব থেকে প্রায় চার আলোকবর্ষ দূরে সম্পূর্ণ নতুন ও আনকোরা এক বিশ্বে অনেক আগে থাকতে এসে বসবাস করছে আমাদের পূর্বসূরী একদল আদিম মানব, কারণ নতুন এই গ্রহটির পরিবেশ ও প্রকৃতি আমাদের গ্রহের মত, অথচ পৃথিবীর তুলনায় ঠাণ্ডা ও বেশি সবুজ! এই আদিম মানবরা আন্তর্নক্ষত্র যান আবিষ্কার করতে পারে যার গতিবেগ আলোর চেয়ে দ্রুতগামী, অথচ তারা পাথর, হাড়, বা তামা-কাঁসার অস্ত্রের বাইরে বেরোতে পারে না? বাঃ! ধন্য আপনাদের বিচার! আপনারা কি আশা করেন যে এই বিদঘুটে তত্ত্বটি আমায় বিশ্বাস করতে হবে?"
সকলেই চুপ করে যান; একটি অস্বস্তিসূচক নীরবতা নেমে আসে গোটা ঘর জুড়ে। বেশ খানিকক্ষণ পর গলা খাঁকড়িয়ে বলতে শুরু করেন ডাঃ লী-
-"কমাণ্ডার, বিষয়টি অদ্ভুত হলেও ধ্রুব সত্য; আপনি যদি একটু ধৈর্য্য ধরে শুনতে পারেন তবে বিষয়টি আপনার কাছেও পরিষ্কার হবে আশা করি।"
বিরক্তিসূচক মুখ করে চেয়ারটি সমেত বোঁ করে একশ আশি ডিগ্রী ঘুরে গেলেন কমাণ্ডার সুলিভান; এইসব বাল্যখিল্য কথা যেন কানেও তুলতে চান না তিনি। কিন্তু ডাঃ লি ছাড়তে চান না বিষয়টি, শোনাতে বদ্ধপরিকর তিনিও; গলাটা আবার পরিষ্কার করে নিয়ে বলতে শুরু করলেন-
-"কমাণ্ডার, বিষয়টি বুঝতে গেলে আপনাকে আমাদের, অর্থাৎ মানবজাতির অতীত একটু জানতে হবে। সেইটিই আগে বরং একটু বলে নিই।
বিশ্বের ইতিহাসের প্রারম্ভে 'মানব' বলে কোন জাতি আগে ছিল না, ছিল 'কিলার-এপ' বলে বিশেষ প্রজাতির একটি বাঁদরগোষ্ঠী। এই বাঁদররা সকলে একত্রে থাকত, একত্রে শিকার করত। কালক্রমে বিবর্তন হয়ে এরাই জন্ম দেয় বিশ্বের প্রথম মানবগোষ্ঠী- 'কেনিয়াপিথেকাস'। বিবর্তনের সুদীর্ঘ পথে সেই প্রথম পথ চলা আরম্ভ।
মানুষদের বিবর্তনের ধারায় দ্বিতীয় যে গোষ্ঠীটি উঠে আসে, তাদের পোশাকি নাম 'অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যাফারেন্সিস'। আর এর পর, পরপর নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে উঠে আসতে থাকে শৃঙ্খলের অন্যান্য মানবগোষ্ঠীগুলি- 'হোমো হাবিলিস', 'হোমো ইরেকটাস', 'নিয়াণ্ডারথাল', 'ক্রোম্যাগনন', 'হোমো সেপিয়েন্স'। প্রত্যেকটি মানবগোষ্ঠীই তার পূর্বতনদের থেকে উন্নততর, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বেশি কার্যকর।
সবচেয়ে নীচের সারিতে যে মূল গোষ্ঠীটির উল্লেখ করলাম, তা হল 'হোমো সেপিয়েন্স'। কিছু বলবার আগে একটি বিষয় আমি আগেই বলে নেব- বিবর্তনের সারিতে যত নীচের দিকে নামবেন, তত দেখবেন বিবর্তনের সময় কম লেগেছে। যেমন- 'হোমো ইরেকটাস' থেকে 'নিয়াণ্ডারথাল' পর্যায়ে যেখানে আসতে সময় লেগেছে প্রায় কুড়ি লাখ বছর, সেখানে 'নিয়াণ্ডারথাল' থেকে 'ক্রোম্যাগননে' আসতে সময় লেখেছে অবিশ্বাস্য কম সময়- সত্তর থেকে চল্লিশ হাজার বছর মাত্র! আরও কম সময় লাগে আধুনিক মানুষের বিবর্তনে, মাত্র বিশ থেকে ত্রিশ হাজার বছরের ব্যবধানে জন্ম নেয় 'হোমো সেপিয়েন্স' গোষ্ঠী। এই বিষয়টি কিন্তু চোখে পড়ার মতই।
এই হোমো সেপিয়েন্স গোষ্ঠী থেকে কালক্রমে যে আধুনিকতর উপগোষ্ঠীর জন্ম হয়, তা হল 'হোমো সেপিয়া সেপিয়েন্স' গোষ্ঠী। এরাই হল বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে আমাদের সার্থক পূর্বপুরুষ।
কমাণ্ডার, শেষ এক হাজার বছরে মানবগোষ্ঠী সর্বমোট পাঁচবার বিবর্তিত হয়ে বর্তমান ধারায় এসে দাঁড়িয়েছে; আমরা হলাম মানবগোষ্ঠীর শেষতম বিবর্তন- 'হোমো উবের সেপিয়েন্স'। আমাদের চেহারা বাহ্যিক দিক দিয়ে আমাদের জনক 'হোমো সেপিয়া সেপিয়েন্স' গোষ্ঠীর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বিবর্ধিত মস্তক, হাতের পাঞ্জা ছোট, আঙুলগুলি দীর্ঘায়ত, কানের বহির্পত্র ব্যাপারটি উধাও, নাকের জায়গায় ছোট দুটি ফুটো- এককথায় আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের থেকে সম্পূর্ন আলাদা ভিন্ন একটি মানবগোষ্ঠী; কিন্তু মাথায় রাখতে হবে আমাদের পূর্বপুরুষ কিন্তু বিবর্তনের তালিকায় থাকা শেষ গোষ্ঠীটি- 'হোমো সেপিয়েন্স'। এই গোষ্ঠীটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, শেষ তিনশ বছরে এর কোন অস্তিত্ব মেলে নি।
কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম দেখে, যখন দেখলাম যে সেই বিলুপ্ত গোষ্ঠীটি আবার ফেরৎ এসেছে সম্পূর্ণ অনাবিষ্কৃত, অজানা এই গ্রহটিতে যাতে এর আগে মানুষের কোন গোষ্ঠীরই পা পড়ে নি- তাও সম্পূর্ণ সতেজ ও জীবন্ত অবস্থায়! আমরা আমাদের রিডিংগুলি আপনাকে বললাম, কিন্তু এই গোষ্ঠীগুলি এখানে কেমন করে এল, কিভাবে এল- তা আমি বলতে পারব না কোনভাবেই, কোন পাকাপোক্ত প্রমাণ ছাড়া। এ বিষয়ে আমি অপারগ, আমায় ক্ষমা করবেন।"
ডাঃ লীর বক্তব্যের মাঝে আবার চেয়ার ঘুরিয়ে তার মুখোমুখি হয়েছিলেন কমাণ্ডার সুলিভান; নিজের হাতের তর্জ্জনীটি কপালে ঠেকিয়ে অন্যমনষ্কের মত কিছু একটা চিন্তা করতে করতে কথাগুলি শুনছিলেন তিনি। এবারে ডাঃ লীর কথা শেষ হতে গম্ভীর মুখে তিনি বললেন-
-"হুঁমম…ঠিক আছে, অধিবেশন আজকের মত সমাপ্ত; এখন আপনারা আসতে পারেন।"
গম্ভীর মুখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন সকলে; বোঝা গেল এই আজব থিয়োরির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউই। ক্যাপ্টেন থটও বেরোতে যাচ্ছিলেন, পিছনে ডাকলেন কমাণ্ডার সুলিভান।
-"শুনুন!"
কমাণ্ডার সুলিভানের মুখোমুখি দাঁড়ালেন এসে ক্যাপ্টেন থট।
-"গোটা সময়টায় দেখলাম আপনি সম্পূর্ণ চুপ; মুখে কোন কথা ছিল না আপনার। আপনাকে যদ্দুর চিনি, এরকম চুপ থাকবার পাত্র আপনি নন। কি হয়েছে একটু খুলে বলবেন কি?"
কিছু একটা বলতে গেলেন ক্যাপ্টেন থট, কিন্তু পরক্ষণেই আবার নীরব হয়ে গেলেন তিনি। খানিকক্ষণ অন্যমনষ্কের মত কিসব চিন্তা করে বললেন-
-"এই গ্রহটির সামগ্রিক বিষয় সম্বন্ধে নিরবিচ্ছিন্ন খবর পাঠাচ্ছে আমাদের ড্রোনগুলি, ডেটা এখনও সম্পূর্ণ নয়। তা সম্পূর্ণ হলে না হয়-"
-"আপনি কি অনুমান করছেন? আপনার সন্দেহটা একটু খোলসা করুন তো!"- সোজা-সাপটা এবং আচমকা প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিলেন কমাণ্ডার সুলিভান; ঘটনাচক্রের পরম্পরায় মরীয়া হয়ে উঠেছেন তিনি বোঝা গেল তার প্রশ্নের ধরণ দেখে। খানিকক্ষণ স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললেন ক্যাপ্টেন থট-
-"আমার ধারণা…আমার অনুমান আমরা নিজেদের ঘর ছেড়ে বেরোতে পারি নি!"
ভুঁরু কুঁচকে কিছুক্ষণ ক্যাপ্টেন থটের দিকে তাকিয়ে রইলেন কমাণ্ডার সুলিভান, তারপর কোন কথা না বলে হাত নেড়ে চলে যেতে বললেন তাকে। ছোট্ট একটি অভিবাদন সেরে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন ক্যাপ্টেন থট।
====================================================================
পরের দিন সকালে দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য!
ডাঃ লী ও ডাঃ থিয়োডর প্রস্তাবিত এই 'মানব'গোষ্ঠীকে আবার ফেরৎ আসতে দেখা গেল 'এতাম'-এর সামনে। তবে এবারে আর কয়েকটি যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত একটি বিক্ষিপ্ত, ছোট দল নয়; বর্ণাঢ্য সমাবেশ করে আস্ত একটি গ্রাম বা জনপদই বুঝি বা উঠে এল 'এতাম'-এর পায়ের নীচে!
এই গ্রহ থেকে নিষ্ক্রমণের একমাত্র উপায় নিজেদের যানটিকে কিভাবে সারিয়ে তোলা যায় তা নিয়ে যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় ছিলেন কমাণ্ডার সুলিভান; সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেন নি তিনি। এই গ্রহটি আকারে এবং আয়তনে যতই 'পৃথিবীর যমজ বোন' হোক না কেন, ক্যাপ্টেন থটের শেষ কথাগুলি নিরবিচ্ছিন্ন আশংকার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে তাকে; আশংকার থেকেই শেষমেষ তিনি সিদ্ধান্ত নেন- দ্রুত ছাড়তে হবে এই গ্রহ। এই কারণেই আর দেরি না করে তিনি সকালবেলাতেই একটি অধিবেশন ডাকেন, যেখানে 'এতাম'কে কিভাবে দ্রুত সারিয়ে তোলা যায় তা নিয়ে একটি জোরদার আলোচনা হয় সকলের মধ্যে। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন নি একমাত্র গিলবার্ট; যানের আশেপাশের দৃশ্যে তীক্ষ্ন নজরদারিতে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। তার নজরেই সর্বপ্রথম আসে যানকে ঘিরে ঐ স্থানীয় অধিবাসীদের কাছিয়ে আসা ব্যাপারটি, এবং তৎক্ষণাৎ তিনি সতর্ক করেন গোটা অভিযাত্রী দলটিকে। তার ডাক শুনে এগিয়ে আসেন কমাণ্ডার সুলিভান, দূরদর্শনের পর্দায় চোখ রেখে দেখেন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য!
'এতাম'-এর ঠিক বাইরে তখন অগণিত নর-নারীদের ভিড়! 'নর-নারী' শব্দবন্ধটি এই কারণেই ব্যবহার করা হল, যেহেতু তাদের অঙ্গ-সংস্থানগতভাবে পরিষ্কার বিভেদ করা যাচ্ছিল, এতটাই স্পষ্ট সেই প্রভেদ। এছাড়া তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, তাদের সাজ, বাহার- সবকিছুই যেন বৈচিত্র্যময়! আট থেকে আশি- বিভিন্ন বয়সের লোকজনের জমায়েত ছিল সেই ভিড়ে। শিশু-বৃদ্ধ-বালক-কিশোর-তরুণ-যুবক-মহিলা-পুরুষ – কে ছিল না সেখানে? প্রত্যেকেই বাহারি পোশাক পরে একটা উৎসবের ভঙ্গীতে কাতারে কাতারে এসেছেন, আর সকলের সামনে চিত্র-বিচিত্র পোশাক পরা এক পুরুষ দুহাত তুলে আবৃত্তির ঢঙে যেন একটানা কিছু বলে চলেছেন।
পর্দার মধ্য দিয়ে 'এতাম'কে ঘিরে একটা নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যে যতটুকুনি দেখা যাচ্ছে, তা মন দিয়ে দেখলেন কমাণ্ডার সুলিভান। এরপর চোখ সরিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাকি সকলের দিকে তাকালেন তিনি; প্রত্যেকেই উৎসুক মুখে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে।
-"ওয়েল, কমাণ্ডার?"
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ক্যাপ্টেন থটকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আত্মস্থ হলেন কমাণ্ডার সুলিভান; তারপর বললেন-
-"গতকালের মতই আজও আমরা দুজন সামনে যাব বটে, তবে সরাসরি ওদের সামনে নয়; কি পরিকল্পনা করে এরা এসেছে আমি জানি না, সতর্ক থাকাই ভালো। একটা কাজ করুন- আমাদের খেয়া-যানগুলির নির্গমনের যে প্ল্যাটফর্মটি ওপরে আছে, তা সক্রিয় করুন, ওখান থেকেই না হয় ওদের 'দর্শন' দেওয়া- এরা যে ছাই কোন ভাষায় কথা বলে-"
-"মনে হয় আমি তা জানি কমাণ্ডার! আপনি এগিয়ে যান, আজকে আমিও শুনব ওদের ভাষা, আর বোঝবার চেষ্টা করব! করুণাময় ঈশ্বর আমাদের সহায় হন-"
ক্যাপ্টেন থটের দিকে তাকাতে তাকাতে মিস স্টিফেনিকে নিয়ে ওপরের 'ল্যাণ্ডিং বে'-র দিকে এগিয়ে গেলেন কমাণ্ডার সুলিভান। পণ্ডিতরা মাঝে-মধ্যে এত দূর্বোধ্য হয়ে ওঠেন…
মহাকাশ যান 'এতাম'এর প্রান্তদেশ থেকে বেরিয়ে আসা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন দুজনই, কাতারে কাতারে লোক জড়ো হয়েছে নীচে! যেখানে যেখানে দাঁড়ানোর জায়গা সেখানে লোক দাঁড়িয়ে আছে তো বটেই, এমনকি অজস্র ছোট-বড় পাথরের ওপর গাদাগাদি করে বসেও আছে অনেকে! প্রত্যেকেই যে তাদের দর্শনের জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিল তা বেশ বোঝা গেল, কারণ কমাণ্ডার সুলিভান ও মিস স্টিফেনি প্ল্যাটফর্মটিতে দাঁড়াতেই তাদের দেখতে পেয়ে যে পরিমাণ প্রবল জয়োচ্ছাস ও উল্লাস দেখা গেল দর্শকদের মধ্যে, তা এককথায় অভাবনীয়! দর্শকদের এই হর্ষধ্বণি চলল বেশ কিছুক্ষণ ধরে; তারপর সামনে বিচিত্র পোশাক পরা ও মাথায় পাখির পালক লাগানো লোকটি নিজের হাতের দণ্ড উঁচিয়ে ধরতেই হঠাৎ থেমে গেল সকলে; সূচীভেদ্য নীরবতা নেমে এল চারদিকে।
-"মনে হয় এই গোষ্ঠীর মানুষগুলির একটি নিজস্ব সমাজব্যবস্থা আছে; তার মানে সামনে দাঁড়ানো ঐ লোকটি নিশ্চই পুরোহিত কমাণ্ডার, যে সকলকে নিয়ন্ত্রণ করে-"
ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন মিস স্টিফেনি। এ কথায় মৃদু ঘাড় নাড়লেন কমাণ্ডার সুলিভান; তিনি তখন ঐ প্রাণীগুলির কর্মকাণ্ড দেখবার বিষয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন।
মিস স্টিফেনি বর্ণিত পুরোহিতটি তখন দুহাত আকাশের দিকে তুলে একটানা কিসব যেন বলে যাচ্ছিলেন তাদের লক্ষ্য করে; উঁচু গলায় বলা সেইসব কথাগুলির একবর্ণ না বুঝলেও মাঝে-মধ্যেই ভেসে আসা কথামালার মধ্যে 'সু' আর 'টেফনাৎ' শব্দগুলি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলেন দুজনেই। দুজনেরই মনে হল- তাদের সম্বন্ধে কোন প্রশস্তি মুখস্ত করে আসা হয়েছিল, এখন তাই পাঠ করে শোনাচ্ছেন পুরুতমশাই। কিন্তু ভাষা না বোঝায় এর অর্থও বুঝে উঠতে পারছিলেন না কেউ।
বেশ কিছুক্ষণ পর মন্ত্রপাঠ পর্ব শেষ করে এবার হাঁটু গেড়ে নতজানু হয়ে বসলেন পুরোহিত; তার দেখাদেখি বাকি সকলেও নতজানু হয়ে বসলেন। নীরবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে উঠে দাঁড়িয়ে পিছনদিকে ঘুরে একটি ইশারা করলেন তিনি; কিছুক্ষণ পর দুজন করে মোট চারজন লোক দুটি কাঠের মূর্তি এনে নামিয়ে রাখল তার সামনে; তারপর অভিবাদন জানিয়ে এরা পিছনে সরে যেতে আবার বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেই মূর্তিগুলির উদ্দেশ্যে চলল শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। শেষে গোটা প্রক্রিয়াটি শেষ হয়ে যাওয়ার পর মিলিত ভাবে অভিবাদন জানিয়ে আস্তে আস্তে সমবেত দর্শকদের দলটি সরে গেল অকুস্থল থেকে; পিছনে তাদের পস্থিতির সাক্ষ্য হিসেবে পড়ে রইল দুটি কাঠের তৈরি মূর্তি।
-"কি হল বলুন তো ব্যাপারটা, কমাণ্ডার সু?"- সব মিটে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলেন মিস স্টিফেনি- "এরা কি আমাদের কিছু উপহার-টুপহার দিয়ে গেল নাকি?"
কিছু বলবার উদ্দেশ্যে মুখ খুলেছিলেন কমাণ্ডার, এমন সময়ে কড়কড়্ শব্দ করে উঠল তার কানে থাকা ক্ষুদে বেতার-যন্ত্রটি; সেখান থেকে ভেসে এল ক্যাপ্টেন থটের গলা-
-"পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে কমাণ্ডার সুলিভান; আপনি মিস স্টিফেনিকে নিয়ে দয়া করে ফিরে আসুন, তারপর বলছি। আর…মূর্তিগুলিকে একবার ভিতরে আনানোর ব্যবস্থা করতে হবে।"
মিস স্টিফেনিকে নিয়ে যানের ভিতর তৎক্ষণাৎ ঢুকে এলেন কমাণ্ডার সুলিভান; যাক, ক্যাপ্টেন থট যখন বলছেন তার অর্থ…বিষয়টি অন্তত পরিষ্কার তো হবে! এই হেঁয়ালির জট না কাটা অবধি তার মনে শান্তি নেই।
-"কোনখান থেকে শুরু করব তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কমাণ্ডার…আচ্ছা, প্রথমে আমাদের নতুন এই গ্রহটি সম্পর্কে কিছু বলা যাক বরং-"
বিরাট অধিবেশন কক্ষে তখন এসে জড়ো হয়েছিলেন সকলেই; 'এতাম' আন্তর্নক্ষত্র যানের এগারোজন অভিযাত্রীই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে নয়, একজায়গায় বসে তারা মন দিয়ে তখন শুনছেন ক্যাপ্টেন থটের বক্তব্য। যন্ত্রবিদ ডেনহ্যামের ড্রোনগুলি তাদের কাজ শেষ করে ফেরত এসেছে; সমস্ত গ্রহটির ভৌগোলিক গঠন ও ভূপ্রাকৃতিক অবস্থানগুলি সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট রিপোর্ট চলে এসেছে যানে; সকলেই ওয়াকিবহাল গ্রহটির ভৌগোলিক সীমানা সম্পর্কে। আর এখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে হাজার প্রশ্ন, যার উত্তর সকলের কাছেই অজানা। স্বভাবতই যখন ক্যাপ্টেন থট এই রহস্যভেদে ব্রতী হয়েছেন তখন সকলেই আগ্রহী হয়ে এগিয়ে এসেছেন ব্যাপারটা কি তা জানবার জন্য।
কমাণ্ডার সুলিভানের নির্দেশে দুজন বাইরে বেরিয়ে মূর্তিগুলি নিয়ে আসেন যানের ভিতরে; সেগুলির ত্রিমাত্রিক স্ক্যান করে ডেটা মূল পরিগণকে তোলার কাজটি শেষ। অভিযাত্রীদের সামনের বিরাট পর্দায় তখন ভেসে উঠছে পাশাপাশি দুটি গ্রহের মানচিত্র; প্রথমটি সদ্যআবিষ্কৃত, নতুন এই গ্রহটির ভৌগোলিক সীমানা, অপরটি তাদের ছেড়ে আসা বহু প্রাচীন গ্রহ- ধূসর পৃথিবী। নতুন গ্রহটির সবুজের আধিক্যের পাশে যা বড়ই ফ্যাকাশে, বেমানান, ম্রিয়মান।
-"আমাদের এই নতুন গ্রহটির ভৌগোলিক মানচিত্র অনুযায়ী- এর জলভাগ ও স্থলভাগ প্রায় সমানুপাতি, আধাআধি। এই গ্রহটিতে বর্তমানে তুষারযুগ প্রায় শেষের পথে। যে বিস্তীর্ণ জল ও স্থলভাগ হিমবাহে ঢাকা ছিল তা অল্প অল্প করে গলতে আরম্ভ করেছে। এছাড়া এখানে সবুজের প্রাচুর্য্য ও জীবনবৈচিত্র্য অত্যন্ত বেশি। বায়ুমণ্ডলে উপপস্থিত কণা, তাদের পরিমান প্রায় পৃথিবীর মতই, বলা ভালো পৃথিবীতে আমাদের সময়কাল থেকে প্রায় দশ-এগারো হাজার বছর আগে মহাপ্লাবনের আগে যে প্রস্তাবিত ডেটা-ম্যাপ আমরা তৈরি করেছিলাম, প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ- আমি পাশাপাশি রেখে দুটিকে মিলিয়ে দেখেছি। এখনও অবধি ড্রোনগুলি থেকে পাওয়া তথ্য এইটুকুনিই, বিশদ বিবরণ সংগ্রহের প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত। ও হ্যাঁ, ভালো কথা- এই গ্রহের প্রস্তাবিত তিনটি নক্ষত্রের মধ্যে একটি নক্ষত্রেরই হদিস পাওয়া গিয়েছে মাত্র; অপর দুটি নক্ষত্রের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, অপর নক্ষত্রদুটিকে খুঁজলেও এই সৌরমণ্ডলে তা খুঁজে পাওয়া যাবে না; কেন, তা আমি একটু পরে বিশদে আলোচনা করছি।
এইবারে আসা যাক এই গ্রহে যে যে জীবনের নিদর্শনগুলি আমরা দেখেছি সেই বিষয়ে। আগেই একটি কথা বলে নিই- যতক্ষণ না আমরা আমাদের স্বল্প উচ্চতার খেয়াযানগুলিকে কাজে লাগিয়ে এই পুরো গ্রহটির সকলপ্রকার জৈবভরগুলিকে নিজের চোখে দেখতে না পাচ্ছি, ততক্ষণ অবধি এই বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসা অসম্ভব। অন্যান্য জটিল কোষগুলিকে বিশ্লেষণের চেষ্টা না করে আমরা বরং মাথা ঘামাই যে উন্নততম প্রাণটির দেখা আমরা পেয়েছি গতকাল ও আজকে, তা নিয়ে। ডাঃ থিয়োডর ও ডাঃ লীর মত অনুযায়ী, এই উন্নত দ্বিপদ প্রাণীগুলি আমাদের বহুযুগ আগেকার বিলুপ্ত পূর্বপুরুষ; আর আজকে একধাপ এগিয়ে আমি বলতে চাই- আমরা যে শুধু এখানে আমাদের পূর্বপুরুষদের দেখা পেয়েছি তাই নয়- আমরা এখানে একটি নতুন ধারণার সৃষ্টি করতে চলেছি, বা বলা ভাল- করে ফেলেছি ইতিমধ্যেই!!"
একটি মৃদু গুঞ্জণের সৃষ্টি হল গোটা ঘরটি জুড়ে। সকলেই অবাক হয়ে গিয়েছেন কথাটি শুনে। 'নতুন ধারণা' বলতে কি বোঝাতে চাইছেন ক্যাপ্টেন থট?
-"সামনের পর্দায় আমাদের পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে অনুগ্রহ করে তাকান। দেখুন, ওখানে আমি একটি গোল চিহ্ন দাগিয়ে রেখেছি। জায়গাটি-"
-"মিশর প্রদেশ। আমরা জানি। আমাদের গ্রহের কোন দেশের অবস্থান জানবার জন্য আমাদে ম্যাপের দিকে তাকাবার কোন কারণ নেই-"
-"আপনার বা আপনাদের পাণ্ডিত্যকে ছোট করে দেখবার প্রয়াস এটি নয়, ডাঃ চাওলা। যাই হোক, মানচিত্রের ওপরের দিকে কোণা ঘেঁষে যে সংখ্যাগুলি দেখতে পাচ্ছেন তা মিশরের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ, পৃথিবীর সাপেক্ষে। এবারে তার পাশেই এই নতুন বিশ্বকে দেখুন। মানচিত্রে তার অবস্থান দেখুন, এবং অবশ্যই ভালো করে পর্যবেক্ষণ করুন এই স্থানটির অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ- নতুন গ্রহটির সাপেক্ষে। কি দেখতে পাচ্ছেন?"
বিশাল পর্দার দিকে তাকিয়ে ততক্ষণে থ' হয়ে গিয়েছেন সকলে! এ কি করে সম্ভব? নতুন গ্রহে তাদের অবস্থান আর পৃথিবীতে মিশরের অবস্থান প্রায় একই অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশে; সামান্য কিছু ভগ্নাংশের এদিক-ওদিক তারতম্য বাদে! ব্যাপারটা এতক্ষণে বুঝে নড়েচড়ে বসলেন সকলে।
-"বিষয়টি এতক্ষণে পরিষ্কার হল তবে, নয় কি? কিন্তু বিষ্ময়ের এখনও অনেক কিছু রয়েছে; এই গ্রহের সামগ্রিক ভর ও পৃথিবীর সামগ্রিক ভর একই-"
-"পরিসংখ্যানগত কচকচানিকে কি একটু সংক্ষিপ্ত করা যায় না, ক্যাপ্টেন? আমরা কোথায় এসে পড়েছি তবে?"
একথায় মুচকি হাসলেন ক্যাপ্টেন থট; তারপর বললেন-
-"নিশ্চই বলব কমাণ্ডার; তার আগে একটি ছোট গল্প বলে নিই?
মিশর দেশ এক অদ্ভুত রহস্যঘেরা দেশ। এই ২৯৬৭খৃীষ্টাব্দেও, মানে আমাদের সময়-সারণি অনুযায়ী আর কি, এখনও বেশ কিছু অজানা রহস্য রয়েছে এর বালির নীচে লুকিয়ে। যাই হোক, আমাদের ঐতিহাসিকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে মোটামুটিভাবে যা জানতে পেরেছেন একট দীর্ঘ সময় ধরে, তাই বরং ব্যক্ত করি।
মনে করা হয়- বহুকাল আগে প্রাগৈতিহাসিক কোন এক সময়ে এ দেশে একটি বিরাট, প্রাকৃতিকভাবে কাটা একটি মিষ্ট জলের হ্রদ ছিল; এই হ্রদকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল বাস্তুতন্ত্র। ধীরে ধীরে এই হ্রদকে ঘিরে মানুষের বসবাস শুরু হয়, এই অঞ্চলটিতে সৃষ্টি হয় জনপদ। শহর-নগর-গ্রাম – সবকিছু মিলিয়ে একটি এলাহী ব্যাপার। নামহীন এই অঞ্চলটি একটি নাম পায়- 'ফেইয়ূম'; আর যে হ্রদকে ঘিরে এই অঞ্চলের প্রাণচঞ্চলতা, তার নাম ছিল 'মোয়েরিস', বা 'মিরিস'। মিশরীয় পুরাণ অনুযায়ী এই হ্রদের ধারেই সর্বপ্রথম নেমে আসেন ভগবান; সর্বশক্তিমান প্রভু নেমে আসেন পুরোহিতদের আহ্বাণে মিরিস হ্রদের ধারে একটি পাহাড়ের কোলে, রুক্ষ ভূমির ওপর…"
একটু উশখুশ করে নিলেন কমাণ্ডার সুলিভান, তার হঠাৎ জ্বর জ্বর লাগছে। তিনি কি বুঝতে পেরেছেন ক্যাপ্টেন থটের অকথিত বক্তব্য?
-"…পুরাণ অনুায়ী প্রথম যে দেবতা আসেন মিশরে, তার নাম 'এতাম'। প্রচণ্ড বজ্রনির্ঘোষ ও দূর্ভেদ্য ধোঁয়ার চাদরে ঢেকে নেমে আসেন তিনি মিরিসের প্রান্তসীমায়, আর এখানে এসেই তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসেন দুইজন দেবতা- একজন নারী, অপরজন পুরুষ। আপনারা জানেন তাঁদের নাম? দেবতা সু ও দেবী টেফনাৎ!"
ক্যাপ্টেন থটের ওপর থেকে প্রতিটি চোখ ঘুরে গেল কমাণ্ডার সুলিভান ও মিস স্টিফেনির দিকে। প্রতিটি চোখেই ছিল প্রশ্ন; প্রতিটি মুখে আঁকা ছিল বিষ্ময়ের অভিব্যক্তি। আর থাকতে পারলেন না কমাণ্ডার সুলিভান, মৃদু অথচ তীব্র গলায় তিনি বলে উঠলেন-
-"কি উল্টোপাল্টা বকছেন বলুন তো? আপনার মাথা ঠিক আছে? আমি কমাণ্ডার এথান সুলিভান, জন্ম কোথায় তা জানি না, প্রাগের একটি অনাথ আশ্রমে আমার বেড়ে ওঠা- কাকতালীয় ভাবে একটি-দুটি ঘটনা মিলে যেতেই এভাবে কোন সিদ্ধান্তে আসা-"
-"কোনটা কাকতালীয়, কমাণ্ডার? জানলা দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখুন- বিরাট একটি হ্রদ! পিছনে আস্ত একটি পাহাড়। আমরা এগারোজন অভিযাত্রীর মধ্যে বাইরে গেলেন আপনারা দুইজন, আর বাইরের এই আদিম জনগোষ্ঠীর চোখে পড়ে গেলেন! স্থানীয় ভাষ্যে আপনাদের নাম বিকৃত হয়ে নতুন নামকরণ হল; সেই একই নাম যা আদি দেবতাদের দেওয়া হয়েছিল। আর আজ যে মূর্তিদুটি আপনাদের উপহার দেওয়া হল- ওটি কোন 'উপঢৌকন' নয়, কমাণ্ডার, ওটি আপনাদের স্থূল, জাগতিক প্রতীক! ওরা আপনাদের ধর্মের মোড়কে বেঁধে ফেলেছেন!"
মূর্তিদুটি তখনও ঘরের মাঝখানে টাঙানো বিরাট পর্দার একধারে রাখা ছিল; সাধারণ কয়েকটি কাঠকে কেটে নিতান্তই অপটু হস্তে খোদাই করা হয়েছে মূর্তিগুলিকে। এবারে পরিগণকের ওপর প্রায় ঝুঁকে পড়ে দ্রুতহাতে কিছু কাজ করে পর্দার দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন থট; দেখা গেল পাশাপাশি দুটি মূর্তির বেশ কয়েকটি ছবি ফুটে উঠতে। সেদিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন তিনি-
-"লাক্সৌরের মাটির নীচে গত শতাব্দীতে হঠাৎ-পাওয়া একটি মন্দির থেকে আবিষ্কার হওয়া সু ও টেফনাতের শেষ ভাষ্কর্য মূর্তি; অবিকৃত অবস্থায়। দেখুন তো এই কাঠের আদিম মূর্তিগুলির সঙ্গে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কি না?"
দুটি নিদর্শনের বাহ্যিক প্রকৃতিগুলি এক, এ বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। দুটি ক্ষেত্রেই দেখা গেল- পুরুষ দেবতাটি হাঁটু গেড়ে বসা এবং তাঁর কাঁধে একটি বিরাট ঠেকনা; দুইহাত দিয়ে ঘাড়ে বসানো এই ঠেকনাটির সাহায্যে তিনি যেন কোন কিছুর ভার ধরে রেখেছেন। অপরদিকে মহিলা দেবতাটির মুখটি সিংহীর, মাথায় একটি গোল চাকতি বসানো; হাতে আবার যেন একটি দণ্ড ধরে রেখে একটি পাশ হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে গর্বিত ময়ূরীর ভঙ্গিমায়। কাঠের মূর্তিগুলিতে মুখের অভিব্যক্তিগুলি নেই; কাজটিও মনে হয় অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়েছে; কিন্তু উভয়ক্ষেত্রেই বাহ্যিক লক্ষণগুলি একেবারে স্পষ্ট সাদৃশ্যযুক্ত!
-"যে কথাগুলি আপনাদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছিল আজকে, তার মর্মার্থ জানেন আপনি?"-জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন থট; এর উত্তরে কমাণ্ডার সুলিভান মাথা নেড়ে না বলতেই এবার খানিকক্ষণ আগে রেকর্ড হওয়া আদিম মানুষের 'স্তোত্র' আবার চালিয়ে দিলেন তিনি। যন্ত্রের মধ্য থেকে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের সাথে সাথে পর্দায় ফুটে উঠল তার আক্ষরিক অনুবাদ-
-"হে সূর্যের দেবতা রা-এর দূত সর্বশক্তিমান 'এতাম', তোমার সঞ্জাত দুই দেবতা সু ও টেফনাৎ-এর দর্শনে আমরা বিমোহিত। আকাশের দেবতা সু ও বৃষ্টির দেবী টেফনাৎ-এর আশীর্বাদ বৃষ্টির মতই ঝরে পড়ুক আমাদের মাথায়…হোম-যজ্ঞ-জপ-তপ হল স্বর্গলাভের একমাত্র পথ…সুদূর ভূমি থেকে একটুকরো মেঘ এবার বায়ুতাড়িত হয়ে বৃষ্টি হয়ে নিশ্চই ঝরে পড়বে আমাদের এই অভিশপ্ত ভূমির বুকে…"
-"উনবিংশ শতক থেকে আজকের দিন অবধি বিশ্বের বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতাগুলির ভাষার ওপর ভিত্তি করে যা যা গবেষণা হয়েছে, তাদের আমরা সংকলন করেছি এক জায়গায়; সেই সফটওয়্যারের ওপর ভিত্তি করে এই অনুবাদ, সবচেয়ে আধুনিকতম ও নিখুঁত। এর থেকে বেশি নিখঁত অনুবাদ আর পাওয়া সম্ভব নয়, কমাণ্ডার; লুপ্ত এই ভাষাটির অনুবাদে কিছু ত্রুটি থাকলেও মোটের ওপর এটিই বিষয়বস্তু ছিল পুরোহিতের বর্ক্তৃতার।"
দুহাতে মাথার রগ টিপে ধরে মাথা নীচু করে বসেছিলেন কমাণ্ডার সুলিভান নীরবে; একই অবস্থা ছিল মিস স্টিফেনিরও; প্রস্তরমূর্তির মত নীরব ও স্থবির হয়ে বসেছিলেন দুজনেই, কেউ কোন কথা বলতে পারছিলেন না। অস্বস্তিকর নীরবতা কাটিয়ে প্রথম কথা বলে উঠলেন গিলবার্ট-
-"আপনাদের মাঝখানে কথা বলে ওঠবার জন্য দুঃখিত, কিন্তু আপনি কি বলতে চান যে আমরা এখনও পৃথিবীতেই রয়েছি?"
খানিকক্ষণ সোজা তাকিয়ে রইলেন ক্যাপ্টেন থট, বয়সে নবীনতর, ছটফটে এই অভিযাত্রীটির দিকে; বোধহয় কিছুক্ষণ ভেবে নিলেন এই প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর দেবেন কি দেবেন না। অবশেষে জড়তা কাটিয়ে দ্বিধাহীন গলায় তিনি বললেন-
-"হ্যাঁ।"
এই অপ্রত্যাশিত উত্তরে মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছিল গিলবার্টের, বিষ্ময়ে চোখ প্রায় ঠিকরে বেরিয়ে এসেছিল অক্ষিকোটর থেকে; কোনমতে আমতা-আমতা করে দ্বিধাজড়ানো গলায় তিনি বললেন-
-"কিন্তু তাই বা কি করে সম্ভব…মানে…ঐ ছবিটি দেখুন, ঐ তো আমাদের পৃথিবী যার সঙ্গে আমরা আজন্মকাল পরিচিত! ধূসর, মরুভূমির বালিতে ঢাকা আর্ধেকের বেশি জনপদ, ইতিউতি কয়েকটি জংলাগাছের জঙ্গল উঁকি মারছে মাত্র- পৃথিবীতে এত ভূমি, এত সবুজই বা কোথায়? নতুন বিশ্বের মানচিত্রে আপনার প্রস্তাবিত মিশরপ্রদেশের আয়তন দেখুন- কি বিশাল, কি সবুজ! এ মিশর তো আমাদের পৃথিবীর মিশর কোনদিক দিয়েই হতে পারে না; সে তো সম্পূর্ণ বালিতে ঢাকা ঘুপচি, একচিলতে, ছোট একটি প্রদেশ- ক্যাপ্টেন থট! আপনার গণনায় নিশ্চই কিছু গণ্ডগোল হচ্ছে!"
একথার উত্তরে ক্যাপ্টেন থটের হাতের ছোঁয়ায় পরিগণকের কি-বোর্ডটি সক্রিয় হয়ে উঠল; এতে পর্দায় থাকা পূর্বতন ছবিগুলির নীচে পৃথিবীর পরপর কয়েকটি ভিন্ন বর্ণের মানচিত্র ভেসে উঠল। সেদিকে একবার তাকিয়ে বলতে লাগলেন তিনি-
-"এই হল পৃথিবীর বিভিন্ন সময়কার ছবি; আমাদের সময় থেকে ধরে খৃীষ্টের জন্মের চার হাজার বছর আগে পর্যন্ত; সঙ্গত কারণেই তার আগের কোন প্রামাণ্য ছবি নেই, কারণ তার আগের কোন বিশ্বাসযোগ্য, পঞ্জীভূত বিবরণ পাওয়া যায় নি যা থেকে পৃথিবীর কোন মানচিত্র পাওয়া যেতে পারে। এই মানচিত্রগুলির নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন সময় ধরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রামাণ্য পুঁথিগুলি ঘেঁটে। এদের মধ্যে সবচাইতে শেষে যে ছবি, বা মানচিত্রটি আপনার চোখে পড়ছে তা হল আমাদের সময়কার; আর সবচাইতে প্রথমে যেটি চোখে পড়ছে তা খৃীষ্টের জন্মের চারহাজার বছর আগের পৃথিবী। কোন প্রভেদ দেখতে পাচ্ছেন?"
প্রভেদ তো স্পষ্ট! একদম প্রথমেই যে পৃথিবীর যে ছবিটি দেখা যাচ্ছে তাতে ফুটে উঠছে অপার সৌন্দর্য্য- সবুজ ও নীল মেশানো একটি গ্রহ; অনুপম, শাশ্বত ও সুন্দর। এতে স্থলভাগের পরিমানও অনেকটা বেশি। আর শেষে আধুনিক পৃথিবীর যে ছবিটি দেখা যাচ্ছে তা এককথায় ভয়াবহ! হলুদ-খয়েরি-ধূসর মসীকৃষ্ণ কালোবর্ণের একটি গোলোক, যেখানে সবুজের কোন স্থান নেই। ভূমি বিক্ষিপ্ত ও ছাড়া-ছাড়া, কালো জলে ঢাকা অধিকাংশ জায়গা। প্রথম ছবিটি যদি পৃথিবীর শৈশব হয় তবে শেষ ছবিতে এসে পৃথিবী তার যৌবন হারিয়ে ফেলেছে- জরা ও বার্ধক্যের ছাপ তার সর্বাঙ্গে! কেউ কোন কথা বলতে পারলেন না, শুধু ছবিগুলির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া। এই অবস্থায় গমগম্ করে উঠল ক্যাপ্টেন থটের গলা-
-"আমাদের পৃথিবী, আমাদের বর্তমান! দূষণের মাত্রা, ক্ষতিকর আলোক বিকিরণের প্রভাব এত বেড়েছে যে বর্তমানে কাঁচের ঘরের ভিতর ঘোমটা টেনে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমাদের। পৃথিবী থেকে সবুজ ক্রমাগত ধ্বংস করে সুন্দর গ্রহটাকে আজ আমরা বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছি। বাস্তুতন্ত্র বলে আমাদের গ্রহে আর কিছু নেই; বেঁচে থাকবার জন্য পরীক্ষাগারে নির্মিত কিছু কৃত্রিম পুষ্টিদায়ক ক্যাপসুলের ওপর নির্ভর করতে হয় আমাদের! ভূমিভাগের বেশিরভাগ অঞ্চল ক্রমাগত বন্যায় জলের নীচে; বায়ুমণ্ডলের সুস্পষ্ট বিভাজন এই সহস্রাব্দের দ্বিতীয় শতক থেকে অদৃশ্য, উষ্ণতা মাত্রাতিরিক্ত। জানেন, এর জন্য দায়ী কারা? আমরা, মানুষরা!"
মাথা নীচু করে ক্যাপ্টেন থটের তিরষকার হজম করলেন সকলে। বিরোধীতার কোন প্রশ্নই নেই, তিনি যা বলেছেন তা ধ্রূব সত্য। আর এ তো বাস্তব; পৃথিবীর চরম অসহিষ্ণু জলবায়ুর জন্যই তো নতুন বিশ্বের খোঁজে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসবার এই তাগিদ, একে অস্বীকার করবার জায়গা কোথায়?
সে তো না হয় হল, কিন্তু নিজেদের গ্রহ, নিজেদের বর্তমান ছেড়ে বেরিয়ে তারা এলেন কোথায়? এই প্রশ্নটাই বেরিয়ে এল মিস স্টিফেনির মুখ দিয়ে-
-"তাহলে আপনি বলতে চান- আমরা স্পেসস্টেশন থেকে বেরিয়ে, এতটা ঝুঁকি মাথায় নিয়ে, কৃষ্ণগহ্বরের প্রবল ক্ষুধাকে পরাস্ত করে মহাকাশে এতটা পথ অতিক্রম করে আবার এসে পৌঁছেছি আমাদের নিজ গ্রহেরই একটি অজানা অতীতে, অজানা সময়ে- শুধুমাত্র 'ভগবান' সেজে থাকবার আকুল বাসনায়, তাই তো?"
-"এটিই সেই প্রশ্ন যার সঠিক উত্তর দিতে হলে 'কল্পনা বিনে গতি নাই', মিস স্টিফেনি! আমরা যে আমাদের অতীতে ফেরৎ এসেছি এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু কিভাবে তা আমরা জানি না। কৃষ্ণগহ্বর যে অতীতে কালযাত্রার একটি প্রধান মাধ্যম হতে পারে এ বিষয়ে বহুযুগ ধরে অবশ্য আমাদের বিজ্ঞানীরা অসংখ্যবার এর আগে সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছিলেন; কিন্তু সেই দাবীর কোন বাস্তবিক ভিত্তি ছিল না, কারণ কৃষ্ণগহ্বরকে পোর্টহোলের মতন যে ব্যবহার করা যেতে পারে সময়-পরিবহনের একটি মাধ্যম হিসেবে, সেটাই কেউ করে দেখাবার চেষ্টা করেন নি আজ অবধি। আমরাই প্রথম 'গিনিপিগ' যারা অজ্ঞানে এই পরীক্ষাটি করলাম, এবং জীবিত রইলাম! আমার ধারণা, কৃষ্ণগহ্বরের দুটি প্রান্ত দুটি পৃথক মাত্রাকে ছুঁয়ে রেখেছে যার ফলে আলোকসমান গতিবেগে অতীতে কালযাত্রা সম্ভব; আর আমাদের বেলাতেও ঠিক তাই হয়েছে। এর থেকে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে-"
-"তাহলে আমরা…আমরা ফেরৎ যাব কি করে? মহাকাশে গিয়ে কৃষ্ণগহ্বর খুঁজে তাতে ঢুকে না পড়তে পারলে তো- বাবা রে! মহাকাশ অবধি পৌঁছবই বা কি করে? 'এতাম'কে সারিয়ে না তুলতে পারলে তো…"
হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন ডাঃ থিয়োডর; বোঝা গেল ঘটনার আবর্তে হিতাহিত ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। ঠিক এইসময়তেই দীর্ঘকালীন নীরবতা ভেঙে শান্তগলায় বলে উঠলেন কমাণ্ডার সুলিভান-
-"আপনি কোন চিন্তা করবেন না, ডাঃ থিয়োডর! মনে হয় আমি জানি কিভাবে 'এতাম'কে সারাতে হবে। দেবতা যদি সাজতেই হয়, তবে আমরা তা ভালো করেই সাজব!"
স্থির চোখগুলি একরাশ আশা নিয়ে তাকিয়ে রইল কমাণ্ডার সুলিভানের দিকে। তাঁর অন্তর্ভেদী, তীক্ষ্ন দৃষ্টি তখন সোজা তাকিয়ে সামনের দিকে, সু ও টেফনাতের কাঠের মূর্তিগুলির দিকে…
===================== প্রথম খণ্ড সমাপ্ত=====================