Aritra Das

Classics

5.0  

Aritra Das

Classics

লেগ্যাসি অফ রাম-খণ্ডচিত্র২

লেগ্যাসি অফ রাম-খণ্ডচিত্র২

5 mins
542


-“আমরা এখন কি দেখছি. ভাষ্কর?”- নিজের প্রধান অঙ্গরক্ষক ও সদা-সহচর ভাষ্করের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন মহারাজ শান্তনু।


কাঁচের প্রকাণ্ড জানালার ঠিক অপর পারটিতেই সাক্ষাৎকার-কক্ষে একটি মেজের ধারে বসবার আসনে একাকী বসে উদ্ধার হওয়া রাজপুত্র স্বয়ং; একশত ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র ভাগ্যবান, যাকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বাকিদের উদ্ধার করা যায় নি। তাঁরা সকলেই মৃত। অনাহার ও রোগভোগে পর্যায়ক্রমে মৃত্যু হয়েছে বাকি সকলের। প্রশ্নটা এখানেই, এতগুলি ভাইদের মধ্যে একমাত্র এই ভাইটি বেঁচে আছেন কি করে? তাও আবার প্রায় অক্ষত অবস্থায়? চোখের সামনে ভাইদের মৃত্যু দেখে এমনিতে একটু মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হওয়া ছাড়া অপরাপর কোন উল্লেখযোগ্য শারীরিক বৈকল্য কিছু ধরা পড়ছে না। কি করে সম্ভব হল এই অসম্ভব?


উদ্ধার হওয়া এই ব্যক্তিটি বয়সে নবীন; হয়তো সদ্য তরুণ। অবিন্যস্ত চুল, চোখ-মুখ তীক্ষ্ণ,একমুখ দাড়ি, বসবার ভঙ্গীটি দীর্ঘ ও ঋজু। বসবার আসনে বসে মেজের ওপর দুটি হাত রেখে ঠায়, প্রায় নিষ্পলক হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছেন তিনি; সেই দৃষ্টিতে কোন রাগ নেই, অভিমান নেই, ক্ষোভ-হিংসা-ঘৃণা – কোন মানবিক অনুভূতিই নেই। তাকে হঠাৎ দেখলে মনে হবে কোন একটি যন্ত্রপুতুল বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে কেউ, ঘরের মাঝখানে – যার মধ্যে কোন মানবিক অনুভূতিই কাজ করে না।


-“অনেককিছু, মহারাজ! নিশ্চিত না হওয়া অবধি অহেতুক আপনাকে বিব্রত করতে চাই নি। প্রথমতঃ, এর ভাইদের সকলেই মৃত; কেউ আর বেঁচে নেই। দ্বিতীয়তঃ, বন্দী অত্যন্ত কম কথার লোক। বেশি কথা বলে নি, কিন্তু মোটামুটিভাবে যা জানা গিয়েছে ইনি হচ্ছেন এর ভাইদের মধ্যে সর্কনিষ্ঠ ব্যক্তি; পাঞ্চালদের সঙ্গে যুদ্ধের পর এদের সকলকেই এখানে বন্দী করে আনা হয়েছিল প্রায় বছরখানেক আগে, শেষকটা দিন এরা এখানেই বন্দীজীবন কাটিয়েছিলেন একসঙ্গে। হিমালয় পর্বতমালার অপরপারে বালুকাময় এক দেশ; সেখানকার রাজপুত্র ছিলেন এরা…”


-“গান্ধারপ্রদেশ?”


প্রশ্নটা করেই ফেললেন মহারাজ শান্তনু। তিনি অবাকও কম হননি। মহাসৈন্ধব নদের অপরপ্রান্তে যে বিশাল পাঞ্চাল সাম্রাজ্য তৈরী হয়েছিল তা যুগের সাথে সাথে বহুধা ধারায় বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন অংশে; কুরুবংশের মত অতটা না হলেও তাদের সাম্রাজ্যের আয়তনও নেহাত কম ছিল না। এই পাঞ্চালদেরই একটি শাখা ‘গান্ধার’নাম নিয়ে শিকড় বসায় হিমালয় পর্বতমালার অপরপ্রান্তে। বালি-পাথরের দেশ; কম জনসংখ্যার এই ভূখণ্ডকে আক্রমণ করবার পিছনে কোন কারণই খুঁজে পেলেন না মহারাজ শান্তনু। প্রশ্নটা করেও বসলেন তিনি ভাষ্করকে, যদি আক্রমণের উপলক্ষ হিসেবে কোন সূত্র বেরিয়ে আসে।


-“এরকম একটি রুক্ষ, অনুর্বর ভূমিকে আক্রমণ করবার পিছনে আপাতদৃষ্টিতে কোন কারণ তো নেই ভাষ্কর! কিন্তু, তাও আক্রমণ হল এবং এতবড় একটি হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন হল। কেন?”


-“এর উত্তর প্রয়াত মহারাজের সঙ্গে চিতায় লীন হয়ে গিয়েছে, মহারাজ। ‘কারন’ হয়তো সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন; অথবা- প্রয়াত মহারাজ হয়তো কোন মিথ্যা জনশ্রুতির পিছনে দৌড়েছিলেন। এরকমটি ঘটা-টা অসম্ভব নয়।”


নিশ্চুপ হয়ে গেলেন মহারাজ শান্তনু। বাস্তবিকই, এরকম ঘটা অসম্ভব কিছু নয়। যদিও তাঁর পিতা খুবই বাস্তববাদী লোক ছিলেন, তার পক্ষে কি সম্ভব একটি কষ্টকল্পিত লোককাহিনীর পিছনে দৌড়ে এরকম পর্যায়ের হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করা? কথা ঘুরিয়ে ফেললেন তিনি-


-“বন্দী সম্পর্কে আর কি জানা গিয়েছে?”


-“আরও দুটি চিত্তাকর্ষক তথ্য পাওয়া গিয়েছে বন্দী প্রসঙ্গে, মহারাজ! তার মধ্যে প্রথমটিই বলি আগে? তিলমাত্র খাদ্যগ্রহণের পরেও বন্দীর শারীরিক অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নি কেন তার একটি যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে-”


-“তাড়াতাড়ি ব্যক্ত কর।”- অধৈর্য্য হয়ে বলে উঠলেন মহারাজ শান্তনু।


-“সীমিত খাদ্য সরবরাহের নির্দেশ যেদিন থেকে দেওয়া হয় সেদিন থেকে সকল ভ্রাতারা একত্রে মিলিত হয়ে একটি মর্মন্তুদ সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন, এই তিলমাত্র খাদ্য গ্রহণে শেষ অবধি প্রাণে কেউ বাঁচবেন না; দুদিন আগে বা পরে সকলকেই মৃত্যুবরণ করতে হবে, অচিরেই। তাই সন্মিলিতভাবে তাঁরা এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেন। যে খাদ্য একশজনকে দেওয়া হচ্ছিল, তা একশজনের হিসেবে তিলমাত্র হলেও একজনের পক্ষে প্রয়োজনের থেকেও বেশি। তাই, নিরানব্বইজন ভ্রাতা খাদ্য পরিহার করে প্রাণত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু একজন- অনুপাতটি মাথায় রাখুন মহারাজ- মাত্র একজন ব্যক্তি সেই খাদ্যগ্রহণ করেন, ও জীবিত থাকেন…”


-“এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য?”- চোয়াল শক্ত হয়ে এল মহারাজ শান্তনুর; কিছু একটি ব্যাপার কি অনুমান করেছেন তিনি?


-“বন্দী উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই বলেন নি পরিষ্কার করে। এ বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করেন নি। তবে তিনি বয়সে যেহেতু সর্বাপেক্ষা নবীন, এবং সর্বসন্মতিক্রমে তিনিই যখন নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাই এক্ষেত্রে ধরেই নেওয়া যেতে পারে অনুজের বয়সের প্রতি অগ্রজরা সকলেই সহানুভূতিশীল ছিলেন-”


এই পর্যন্ত বলে চুপ করে গেলেন ভাষ্কর; তিনি আজন্ম মহারাজ শান্তনুর পার্শ্বচর, তিনি জানেন কখন চুপ করে যেতে হয়।


-“চোখের সামনে যা দেখা যাচ্ছে তা নাও হতে পারে। আর কি তথ্য জানা গেল বন্দী প্রসঙ্গে?”


এই প্রসঙ্গে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন ভাষ্কর; মহারাজের কথার সূত্র ধরে তিনি বললেন-


-“এই তথ্যটা জানাবার জন্য আমি খুবই উদগ্র ছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না আপনাকে এই তথ্য জানাব কি করে! আপনি যখন জানতেই চাইলেন মহারাজ-”


-“তাড়াতাড়ি!”


-“আমরা বন্দীর ওপর অনেকগুলি শারীরিক পরীক্ষা চালাই, তার দ্রুত আরোগ্যের সন্ধানেই। বাকি পরীক্ষার ফল সন্তোষজনক,কিন্তু একটিই পরীক্ষার ফল বিস্ময়কারক! মহারাজ, এই ব্যক্তিটি প্রাকৃতিক উপায়ে ভূমিষ্ঠ হওয়া এক সন্তান, যার শরীরে পিতা-মাতার সকল প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন গুণগুলি বর্তমান।”


-“অ্যাঁ! বল কি হে?”- শীৎকার করে উঠলেন মহারাজ শান্তনু। তাঁর এরকম অদ্ভুত আচরণের পিছনে অবশ্য কারণও ছিল।


প্রযুক্তির ওপর অতি-নির্ভরশীলতা গন্ধর্বদের ঠেলে দিয়েছিল প্রকৃতি থেকে অনেক দূরে। এতটাই যে আগেকার যুগের স্বাভাবিক সন্তানধারণের ও ভূমিষ্ঠকরণের দিকেও তাদের আর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। স্বাভাবিক উপায়ে সন্তানকে পৃথিবীতে আনবার প্রক্রিয়া আইনতঃ বাতিল হয় দুইশ বছর আগে; গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে সন্তানজন্মের প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানায় সকলে। এতে জীবন সংশয়ের কোন প্রশ্নই নেই, অহেতুক রক্তপাত নেই, কমসময়ে অধিক সন্তানলাভ সম্ভব – এগুলিই মূল কারণ ছিল কলসজাত সন্তানধারণ তত্ত্বের দ্রুত সমর্থনলাভের পিছনে। এক হিসেবে দেখতে গেলে, গন্ধর্ব সভ্যতার গত দুইশ বছরে একমাত্র স্বাভাবিক উপায়ে জন্মলাভ করা শিশু,যার জন্ম স্বাভাবিক উপায়ে মাতৃগর্ভে, সে এখন বসে আছে কাঁচের জানালার ওপারে; খুব বেশি হলে পনের হাতের ব্যবধানে। বিস্মিত মহারাজ শান্তনু খানিক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন সেদিকে।


-“স্বাভাবিক উপায়ে জন্মলাভ করা শিশু অধিক বুদ্ধিমান, তেজোদ্দীপ্ত ও বলশালী হয়, তাই নয় কি, ভাষ্কর?”


-“বিজ্ঞজনেরা তাই বলেন বটে, মহারাজ!”


-“এই ব্যক্তিই একমাত্র বেঁচে থাকবেন, এই সিদ্ধান্ত মেনে বাকি নিরানব্বই জন ভ্রাতা আত্মবলিদান করেছেন,তাই তো?”


সন্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে কথা বলতে গিয়ে আত্মসংবরণ করলেন ভাষ্কর। মহারাজ শান্তনুর দৃষ্টি তখন সটাং বন্দীর দিকে নিবদ্ধ। চুপ করে তাকিয়ে আছেন তিনি, যেন কিছু একটা ভাবছেন, অন্যমনস্কের মত। কথা বলে তাঁর চিন্তাসূত্রকে নষ্ট করতে চাইলেন না তিনি।


বেশ কিছুক্ষণ একাগ্রতার সাথে মনে মনে কি যেন চিন্তা করে নিলেন মহারাজ শান্তনু; তারপরই যেন আচমকাই ফেরৎ চলে এলেন তিনি বাস্তব জগৎে। ভাষ্করের দিকে তাকিয়ে বললেন-


-“বন্দীর সঙ্গে কথা বলতে হবে; চল, ওর সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ করে ওকে যেতে দিই। ‘সংঘর্ষবিরতি চুক্তিপত্রটি’সঙ্গে নিয়ে নাও ভাষ্কর- আর হ্যাঁ, ওর বোধ হয় একটি বোন আছে, না?”


বেশ কিছুক্ষণ পর মহারাজ শান্তনু ও সদাসহচর ভাষ্করকে একজন প্রহরীসমেত দেখা গেল সাক্ষাৎকার-কক্ষে, বন্দীর সঙ্গে আলাপরত অবস্থায়।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics