ত্রিভুজের তিনটি শীর্ষবিন্দু
ত্রিভুজের তিনটি শীর্ষবিন্দু
Three Points of a Triangle ( ত্রিভুজের তিনটি শীর্ষবিন্দু ) :
‘পথের দাবী’র ‘ডাক্তার’ চরিত্রটি সাহিত্যের ইতিহাসে এক আশ্চর্য সমাপতন! ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হওয়া এই সাহিত্যটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন ‘ডাক্তার’, এমন এক সময়ে তিনি সর্বসমক্ষে আসছেন যখন বাস্তব জীবনে ভারতীয় মুক্তিকামী আন্দোলনের আকাশে ‘সুভাষচন্দ্র বোস’ নামক উজ্জ্বল নক্ষত্র তখনও উদিত হননি। কাজেই ‘এক মহামানবের ছায়ায় তৈরি উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র’- এই বক্তব্য কখনোই ধোপে টিকবে না। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা বাঞ্ছনীয়- একি শুধুই সমাপতন, আশু আগামীর বর্তমান কল্পরূপ, নাকি সত্যিই কোন বাস্তবিক চরিত্র তাঁর ছায়া ফেলেছে এই চরিত্রের রূপরেখা নির্মাণে?
‘ডাক্তার’ চরিত্রটির সার-সংক্ষেপ অবশ্য ফুটে ওঠে গল্পের দুটি ভিন্ন চরিত্র ‘অপূর্ব’ ও ‘দারোগাবাবু’-র আলাপচারীতায়। কিছু পরিচিত সাদৃশ্য, কিছু চেনা আদল ফুটে ওঠে তাদের আলাপচারীতার মধ্য দিয়ে। গড়পড়তা সাধারণ বাঙ্গালীদের মত চেহারা, এমনিতে বাইরে থেকে কিছু বোঝবার, বা আলাদা করে শনাক্ত করবার কিচ্ছুটি জো নেই, কিন্তু অসম্ভব গায়ের জোর! দুইহাতে বন্দুক-পিস্তল চালাতে সমর্থ, ছদ্মবেশ ধারণে পটু, গোটা ভারতের দশ-বারোটি ভাষায় অনর্গল কথাবার্তা বলতে সক্ষম, আর এই সব গুণগুলির সঙ্গে এসে মিশেছে এক ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা- জনতার ভিড়ে জনতার একজন হয়ে মিশে থাকতে পারার বিরল আশীর্বাদ! ‘গিরীশ মহাপাত্র’-এর গাঁজার কল্কে সাজানোর কারণ জেনে যখন উপহাস করে তাঁকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বের করে দেওয়া হয়, তখন কি কেউ ভাবতে পেরেছিলেন, হাতে চলে আসা ‘পরশপাথর’ ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে জনতার ভিড়ে?
সাহিত্য থাক, মানবকল্পনা স্বতঃস্ফূর্ত, হয়তো গল্পে গোরু হাইড্রোজেন খেয়ে গাছের মগডালে চড়ে বসতে পারে ভেবে এইসব ঘটনাপ্রবাহকে উপেক্ষা করা যেতেই পারে (Benefit of Doubt?), কিন্তু প্রশ্নটি অন্যত্র। যে যে গুণাবলী ‘ডাক্তার’ চরিত্রটিকে ভূষিত করল, তা কি বাস্তব জীবনে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে কোথাও ফুটে ওঠে নি? ’৪১ সালে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ার বাইরে পালিয়ে গেলেন ১১নম্বর জুতো পায়ে গলানো যে দীর্ঘদেহী মানুষটি, ধারণ করলেন বিভিন্ন নাম; কখনো মৌলানা জিয়াউদ্দিন তো কখনো অর্ল্যাণ্ডো মেজেট্টো- তিনিও কি একই ঐশ্বরিক প্রতিভার বরপুত্র ছিলেন না? কিন্তু, রহস্যটা তো এখানেই- এ তো আর ‘নস্ট্রাডামুস’-এর ভবিষ্যৎদর্শনের প্রসঙ্গ নয় যে লেখক ভবিষ্যৎ দেখে এসে অতীতে তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করছেন; সাহিত্যিক একজন প্রবল বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন সাধারণ মানুষ যিনি জগৎ দর্শন করেন সাদা-কালো চশমা দিয়ে। তাহলে কি করে ঘটল এতবড় সমাপতন, যা সাহিত্যের পাতায় সীমাবদ্ধ না থেকে উঠে এল বাস্তবের রোজনামচায়, সরাসরি যা আঘাত করল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ধ্বজায়?’
এইবারে ডাক্তার চরিত্রটিকে বরং আবরণ সরিয়ে দেখবার চেষ্টা করা যাক, কি দেখা যাচ্ছে? তাঁর চরিত্রের দুটি সত্তা। প্রথমটি সিংহের, দ্বিতীয়টি- একটি ক্ষুধার্ত হিংস্র চিতাবাঘের। সিংহের সত্তার ভাগে রাখা যাক- ‘প্রচণ্ড শারীরিক শক্তি, গায়ে অসাধারণ জোর, দুইহাতে বন্দুক-পিস্তল চালানোয় সমান দক্ষ, জীবনের সমস্ত প্রাণশক্তি এসে মিলিত হয়েছে একটিই কেন্দ্রবিন্দুতে- দুই চোখের মণিতে’। আর চিতাবাঘের ভাগে পড়ল- ‘ছদ্মবেশ ধারণে পটু, দশ-বারোটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে সক্ষম, মন্ত্রগুপ্তিতে বিশ্বাসী’। দুইটি সত্তার ওপরেই একটি সাধারণ বহিরাবরণ- আটপৌরে বাঙ্গালীদের মত সাধারণ, নিরীহ চেহারা। সাদৃশ্যটা কি ধরা যাচ্ছে?
এই বিষয়ে বরং দুটি পৃথক ঘটনা তুলে ধরা যাক, এতে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে-
প্রথম ঘটনা- উড়িষ্যার কাপ্তিপোদায় ভুডিগড়ের জঙ্গলের সামনে চষামাঠ। নিকটবর্তী গ্রামবাসীরা পুলিসদের জানিয়েছে পাঁচ ‘ডাকাত’দের এই অঞ্চলে অবস্থানের কথা; পুলিস এসে ঘিরে ফেলেছে জায়গাটি, যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে।
একটি টিলার ওপার থেকে গুলি চালাচ্ছেন দলের নেতা ও তাঁর চার অনুগামী। একটু আগেই একটা গুলি খেয়েছেন নেতা, ডান কাঁধের ঠিক নীচে। ঐ অবস্থাতেই গুলি চালাচ্ছিলেন তিনি, এমন সময় দ্বিতীয় আরেকটি গুলি এসে আঘাত করল তাঁকে, হাত থেকে ছিটকে গেল সি-৯৬ মাউজার পিস্তল; দেখা গেল, ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুল চুরমার। হাতে একটি কাপড় জড়িয়ে নিলেন তিনি, ক্ষতস্থানটিকে বাঁধলেন; তারপর বামহাতে পিস্তল তুলে নিয়ে অবলীলাক্রমে ফায়ারিং শুরু করে দিলেন আগুয়ান শত্রুসেনাদের উদ্দ্যশে! শুধু তাই নয়,এই অবস্থাতেও তিনি ধরাশায়ী করে ফেললেন বিপক্ষের বেশ কয়েকজনকে!
অবশ্যই এটি কোন ডাকাতদল নয়, ওটি ছিল ব্রিটিশ প্রোপাগাণ্ডা। এঁরা ছিলেন পাঁচ বিপ্লবী; আর নেতৃত্বে থাকা মানুষটির নাম? যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
দ্বিতীয় ঘটনা- ১৯১৫ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর। ‘সিনোকামারু’ নামক জাপানি জাহাজ তৈরি তার যাত্রা শুরু করবার জন্য। চূড়ান্ত ছাড়পত্র পাওয়ার পর সে পাড়ি জমাবে জাপানের উদ্দেশ্যে।
জাহাজের যাত্রী পি.এন.টেগোর-এর কেবিনে জুতো মশমশিয়ে এলেন রাসভারি পরিদর্শক, আপাদমস্তক সাহেব। সবকিছু খতিয়ে দেখে তবে ক্লিনচিট্ দেবেন তিনি। অভিজাতদের ঘরে তিনি নিজেই যাচ্ছেন, নিচুতলায় লক্ষ্য রাখছেন তার অধস্তন কর্মীরা।
-“আই অ্যাম সরি মিস্টার টেগোর”- খাঁটি বৃটিশ উচ্চারণে বলে উঠলেন সাহেব- “আপনাদের কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত। আমাদের কাছে খবর আছে রাসবিহারী বসু নামে একজন টেররিস্ট দেশ ছাড়বার মতলব করছেন। তাই আমরা একটু সার্চ করে দেখ-”
পুরোটা শেষ করতে পারলেন না সাহেব, তার আগেই কাঁপা গলায় বলে উঠলেন ঠাকুরসাহেব-
-“হোয়াট? আ ব্লাডি টেররিস্ট?? আমার ঘরটি খুঁজে দেখুন, সাহেব, পাট্টিকুল্লারলি আমার বাথরুমটা! খাটের তলাটা খুঁজে দেখতে যেন ভুলবেন না, প্লীজ!”
বেশ কয়েক সপ্তাহ পর খবর এল বৃটিশদের কাছে- রাসবিহারী বসু পি.এন.টেগোর ছদ্মনামে দেশের বাইরে পলাতক, ঐ সিনোকিমারু জাহাজেই!! পলাতক অবশ্য তত দিনে পৌছিয়ে গিয়েছেন জাপানে, নিরাপদ আশ্রয়ে।
তাহলে কি বলা যেতে পারে, সাহিত্যের ডাক্তার চরিত্রের বাঙ্গালী আটপৌরে চামড়ার নীচে আমরা খুঁজে পেলাম সেই সিংহ, ও তথাকথিত হিংস্র চিতাবাঘটিকে? উত্তর হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। সমাপতন তো আর বারংবার হয় না; তার চেয়ে আমরা বরং একটি ত্রিভুজের দুটি বিন্দুর দিকে মনোনিবেশ করি, যা গঠন করেছে তিন নম্বর বিন্দুটিকে। নেতাজী এখনও বহুচর্চিত বিষয়; অনেকেই অনেক কিছু জানেন তাঁর সম্পর্কে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বা আরও হতভাগ্য, ‘Unsung Hero’ রাসবিহারী সম্পর্কে আলোচনা সেরকম হয় কোথায়? তবে প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো- এটি কিন্তু কোন তুলনাভিত্তিক আলোচনা নয়; ত্রিভুজের তিনটি বিন্দুকে মেলানোর একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।
[ক্রমশঃ]