Aritra Das

Abstract

3  

Aritra Das

Abstract

দ্য লেগ্যাসি অফ্ রাম-খণ্ডচিত্র

দ্য লেগ্যাসি অফ্ রাম-খণ্ডচিত্র

6 mins
828


[খণ্ডচিত্র-১: একটি ঘৃণার জন্ম]


(গন্ধর্ব সভ্যতার কোন একটি সময়ে)


চারিদিকের চারটি নাতিউচ্চ পাহাড়ের ঘেরাটোপে আটকে পড়া মাঝখানের এই সমতল ক্ষেত্রটির চারিদিকে তখন মৃত্যুর উষরতা। মাথার ওপর তখন চক্রাকারে পাক খাচ্ছে শকুনের দল; ধূসর মালভূমির এই পার্বত্যময় অংশটিতে মূলতঃ এদেরই রাজত্ব। এছাড়াও অন্যান্য প্রজাতির মাংসভূক পাখিরাও আছে এই দলে। এরা অবশ্য কেউই চুপচাপ ছিল না এতক্ষণ ধরে, প্রত্যেকেই এরা ব্যস্ত ছিল এতক্ষণ মৃতদেহ থেকে মাংস খুবলে খেতে! কিন্তু আচমকাই দোপেয়েদের আরও একটা দল এসে পড়ায় ব্যস্ত হয়ে মুখের খাবার ফেলে পালাতে হয় এদের;মুখ দিয়ে কর্কশ স্বরে তীব্র আপত্তি জানাতে জানাতে। উঠে পড়ে তারা সাধের প্রান্তরটিকে ছেড়ে, খোলা আকাশের নিরাপদ দূরত্বে।


সবথেকে কাছের নাতিদীর্ঘ পাহাড়ের মাথাটি কিন্তু অন্যান্য পাহাড়ের মত সূঁচোল নয়, বরং হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন কেউ পাহাড়ের মাথাটি কেটে একটা সমতল ক্ষেত্রের মুখ দিতে চেয়েছে। এই অংশেই দেখা গেল এক রাজপুরুষ ও তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন অঙ্গরক্ষককে। তাদের সকলেরই দৃষ্টি ছিল সামনের সমতল ক্ষেত্রটির দিকে, হয়তো সেখানে কিছু খুঁজছিলেন তাঁরা; কিন্তু, কি?


সেখানে অবশ্য দেখবার মত আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। মাথার ওপর সূর্যও তখন ঘন মেঘের আশ্রয়ে- চারিদিকের পড়ন্ত, মরা আলোয় যা চোখে পড়ে তা কেবলই একটা একটানা মৃতদেহের সারি! পচা-গলা, সদ্যমৃত – সব ধরণের মৃতদেহ সেই সারিতে। কোথাও একলা একটি মৃতদেহ, কোথাও তিন-চারজন একসাথে মরে একটা স্তুপ রচনা করে শুয়ে রয়েছে – বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, বিভিন্ন অবস্থানে অন্তিম শয়ানে শায়িত সকলেই। মড়া রৌদ্রের বিষন্ন আলোয় ভয়ংকর এক পরিবেশ! পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীচের দৃশ্যপট – মৃত্যুই একমাত্র সদাসত্য বাস্তব! খুব সম্ভবতঃ, কেউই আর বেঁচে নেই নীচের দূর্ভাগাদের দলে।


-“আদেশ করুন, মহারাজ!”-মহারাজের কাছে এগিয়ে এল এক প্রহরী।


-“এখানে একটি সন্ধানী আলো বসাও। ভালো করে বোধগম্য হচ্ছে না কিছু। সন্ধানী আলো ফেলে দেখ কাউকে জীবিত দেখা গেল কি না! মৃতদেহগুলি জায়গায় জায়গায় এরকম স্তুপাকৃতি হল কিভাবে? কে করেছে এই ঘৃণ্য কাজ?”


কিছুকাল চুপ করে থাকল প্রহরী; তারপর বলল-


-“এরা নিজেরাই, মহারাজ! প্রচণ্ড ক্ষুধায় শেষপর্যন্ত যুঝতে না পেরে যখন এরা বুঝল মৃত্যু আসন্ন, তখন শেষবিদায় নেওয়ার জন্য এরা একে অপরের সান্নিধ্যে আসবার চেষ্টা করেছিল। কয়েকজন সমর্থ হলেও, বেশিরভাগই অবশ্য অসমর্থ, অকৃতকার্য হন! তাঁরা পথমধ্যেই শ্রান্তিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। মৃতদেহগুলি জায়গায় জায়গায় গাদাগাদি হয়ে থাকবার এটিই সবচেয়ে বড় কারণ।”


অনুতপ্ত চোখে সামনের দৃশ্যপটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন রাজপুরুষটি, তিনি মহারাজ শান্তনু। সত্যিই বড় করুণ দৃশ্য, ভাবলেই চোখে জল এসে যায়; দেখলে পরে তো কথাই নেই! ভাবা যায়? ক্ষুধায় কাতর কঙ্কালসার কয়েকটি দেহ বুকে হামাগুড়ি দিয়ে পরস্পরের সান্নিধ্যে আসতে চেয়েছিল; এইটুকুনই তো মোটে অন্তর একে অপরের থেকে, সেটাও অতিক্রম করা গেল না! ক্ষুধা কি নির্মম, ভয়ংকর,জান্তব সত্য!ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে শেষ মুহুর্ত অবধি এরা সৌজন্যতার সীমা অতিক্রম করেন নি; মহামাংস ভক্ষণ করে নিজেকে নামিয়ে আনেন নি পশুদের স্তরে!


একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মহারাজ শান্তনুর বুক থেকে – এড়ানো যেত; এই অকারণ মৃত্যুমিছিল এড়ানো যেত! কিন্তু গন্ধর্ব প্রজাতির ক্রমবর্ধমান লোভ ও লালসাই ডেকে এনেছে এই মহামারীকে, নিজের ঘরে! যখন এই ঘটনা ঘটছে, তখন তাকে প্রতিহত করবার সামর্থ্য তাঁর ছিল না; আর যখন সামর্থ্য এল তখন মৃত্যু তার প্রভাব বিস্তার করে চলে গেল তাঁকে আকন্ঠ পাপবোধে নিমজ্জিত করে। ওপরে, মেঘের আড়ালে থাকা সূর্যের দিকে একবার তাকালেন মহারাজ শান্তনু – “যদি একজনকেও বাঁচানো যেত!”- মনে মনে স্বগতোক্তি করে উঠলেন তিনি।


কিংবদন্তী ‘ইক্ষকু’বংশের একটি শাখা ‘চন্দ্রবংশ’। এই বংশ পরবর্তীকালে তার সর্বাধিক সফল রাজপুরুষের নামে পরিচিত হয় ‘কুরুবংশ’নামে।এই বংশেরই নবীনতম এবং বর্তমান রাজা মহারাজ শান্তনু। পিতা দর্পের মৃত্যুর পর রাজবংশ তথা সিংহাসনের পরবর্ত্তী প্রজন্ম। বংশের নাম পরিবর্তন হয় বটে, কিন্তু একটি মৌলিক বিষয় অক্ষুণ্ণই থাকে – তা হল পশ্চিমে বৈতরণী নদীর ওপারে থাকা পাঞ্চালদের সঙ্গে মতবিরোধ; কালের সদা-প্রবাহমানতার নিরিখে যার ধরণের আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে।


সবথেকে আগে যে জিনিষটির পরিবর্তন ঘটে তা হল, গন্ধর্বদের জীবনদর্শন ও মূল্যবোধ। অতীতের পারষ্পরিক বিবাদ যা মূলতঃ কলহ বা ছোটখাটো কিছু হাতাহাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, বর্তমানে তাই এসে ঠেকেছে মরণপণ যুদ্ধে। অতীতের শান্তিপ্রিয় গন্ধর্ব প্রজাতি আজ রক্তলোলুপ,আগ্রাসী ও লোভী জাতিতে পরিণত!অবশ্য,জীবনযাত্রার সামগ্রিক মান এখন উন্নত; নিন্দুকেরা অবশ্য বলে প্রযুক্তির ওপর এই অকারণ, সর্বাঙ্গীন ভরসা গন্ধর্বদের জীবনযাত্রাকে জটিল করে তুলেছে মাত্র – যদিও সিংহভাগ গন্ধর্ব এই তত্ত্ব মানতে গররাজি। মোটের ওপর, সমস্ত তর্ক-বিতর্কের উর্দ্ধে উঠে বলা যায়, একদিকে বিজ্ঞান যত অঙ্গীভূত হয়েছে গন্ধর্বদের শিরায়-উপশিরায়, অপরদিকে সামাজিক মূল্যায়ণগুলির মান কমেছে বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কে। গন্ধর্বরা আজ আর কোন আঞ্চলিক, উপজাতিভিত্তিক গোষ্ঠী নয়, তারা এখন পাড়ি জমাতে সক্ষম মহাবিশ্বের অন্যত্রও, সীমিত স্তরে, দেবতাদের আশীর্বাদে। -‘আমরা যদি দেবতাদের মতই সবকিছু করতে সক্ষম, তবে দেবতাদের প্রয়োজন আর কিসে’- এই হল চুম্বকসারে বর্তমান গন্ধর্ব নীতি। এই মানসিকতারই প্রতিফলন গন্ধর্বদের অন্তরে।


এই আগ্রাসী মানসিকতারই চরম প্রতিফলন ঘটেছিল মহারাজ দর্পের আমলে। পাঞ্চালদের সঙ্গে প্রাচীনতম এই বিরোধ তিনি নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিলেন এককথায় – পাশবিকতার হাত ধরে। পাঞ্চালরা বর্তমানে একটু দূর্বল অবস্থানে ছিলেন; মহারাজ সৃঞ্জয়ের মৃত্যুর পর তাদের বংশে আর কোন সুদক্ষ রাজা জন্মগ্রহণ করেন নি যিনি বংশকে চালনা করবেন বিচক্ষণতার সঙ্গে। সুযোগ বুঝে মহারাজ দর্প অবশ্য যে কীর্তিটা করলেন তা এককথায় ন্যক্কারজনক – সামান্য এক ছুতোয় একটি পাঞ্চালবংশ আক্রমণ করে অধিকার করে বসলেন তিনি। তবে, তাঁর এর পরের কীর্তিটি আরও জঘন্য, নারকীয়!


প্রথমে সদ্য অধিকৃত পাঞ্চাল রাজ্যটির একশ জন ভাইকে বন্দী করা হয়েছিল এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। কিন্তু, তাঁর ক্রুর ও নিষ্ঠুর বুদ্ধির ছাপ তিনি রাখলেন এই সিদ্ধান্তে। কোন সাধারণ কারাগারে এই একশজন ভাইকে না রেখে তাদেরকে এনে রাখা হয়েছিল চারিদিক নাতিউচ্চ পাহাড়ে ঘেরা মধ্যিখানের সমতল এই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। চারটি পাহাড়ের মাথাতেই প্রহরার ব্যবস্থা করেন তিনি, যাতে কেউ পালাতে না পারে এই জায়গাটি থেকে। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে আস্তে আস্তে মৃত্যু এসে গ্রাস করে নেবে সকল বিরোধী রাজপুত্রদের – এই ছিল তাঁর মনোগত অভিপ্রায়।


কিন্তু অদ্ভুত কড়া জীবন এই রাজপুত্রদের! ঝড়-জল মাথায় নিয়েও দিব্যি বেঁচে রইলেন এঁরা! এ তো সরাসরি রাজদ্রোহীতা! দর্পের মত একজন প্রবল পরাক্রান্ত রাজার সিদ্ধান্তের মুখের ওপর এ যেন প্রবল চপেটাঘাত! সিদ্ধান্ত নিলেন মহারাজ দর্প। এবারে অন্য ঔষধ। প্রহরীদের ডেকে আদেশ দিলেন তিনি – এখন থেকে একজন বন্দীর সমপরিমান খাদ্য বণ্টন করা হবে একশজন ভাইয়ের মধ্যে! এইভাবে দিনের পর দিন তিলমাত্র খাদ্যগ্রহণ করে দেখি কতক্ষণ বেঁচে থাকে ব্যাটারা!


সৌভাগ্যের বিষয়, তাঁর এই গবেষণার কোন প্রত্যক্ষ ফললাভের আগেই ৺গঙ্গাপ্রাপ্তি হয় মহারাজ দর্পের। মারা যান তিনি, তাঁর জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হন শান্তনু; আমাদের পূর্ব পরিচিত এই রাজপুরুষটি।


পিতার এ হেন মতবাদকে কোনদিনই অবশ্য সমর্থন করেন নি মহারাজ শান্তনু; তিনি বরাবর হিংসার পরিপন্থী। যদিও পিতার কোনপ্রকার সিদ্ধান্তকেই তিনি কোনদিন আটকানোর চেষ্টাও করেন নি; দুএকবার ক্ষীণ প্রতিবাদ করা ছাড়া। তিনি জানতেন, প্রতিবাদ এক্ষেত্রে নিস্ফল। মহারাজ দর্পের মাথাটি ছিল পাথরের মত শক্ত ও অনমনীয়; একবার তিনি যা ভাবতেন তা তিনি করতেনই। পিতা অবশ্য সব ব্যাপারই নিজের এই পুত্রটির কাছে খোলসা করতেন না; উক্ত পাঞ্চাল প্রদেশ আক্রমণ সংক্রান্ত বিষয়টি যেমন তিনি সম্পূর্ণ চেপে গিয়েছিলেন শান্তনুর কাছে।


এই কারণেই, সমগ্র বিষয়টি জানতে পেরেই দৌড়ে এসেছেন শান্তনু; অনির্বার্য দূর্দৈব ঠেকাতে, এই অকারণ মৃত্যুমিছিল বন্ধ করতে। কিন্তু, বোধ হয় দেরি হয়ে গেল আসতে।


-“মহারাজ! শীঘ্র ওদিকে দেখুন! মনে হয়…ওটা কি? হাত?”


-“কোথায়?”


সন্ধানী আলোর তীব্র ছটা ঘুরে গেল অদূরে বিক্ষিপ্ত কিছু মৃতদেহের স্তুপের দিকে। মৃতদেহগুলি ওখানে গাদাগাদি করে একটা স্তুপের চেহারা নিয়ে রয়েছে; তার ওপর সন্ধানী আলো এসে পড়তেই দেখা গেল – ভিতর থেকে বাইরের দিকে উঁচিয়ে রয়েছে একটি হাত, একটিই মাত্র ডান হাত! আকাশের দিকে তোলা, দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ! যদিও ঐ একটিমাত্র হাত ছাড়া শরীরের বাকি অন্য অংশ আর দেখা যাচ্ছে না; দেহের বাকিটা চাপা পড়ে আছে মৃতদেহের স্তুপে।


-“সেবক! কিছু প্রহরী নিয়ে ওকে বহন করে শিবিরে নিয়ে যাও; খাদ্য ও পানীয় দিয়ে সুস্থ করে তোল ওকে। মনে রেখ, ও কিন্তু একজন রাজপু- ও কি?”


অনেকক্ষণ ধরেই মেঘ করেছিল আকাশে, এবার তার থেকে একটি বজ্রপাত ঘটল পূর্বদিকের পাহাড়ের মাথায়। বিকট শব্দ ও আলোর ঝলকানি খানিক্ষণের জন্য স্থবির করে তুলল প্রত্যেককে।


-“ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল বলে; যাও, আর বেশি দেরি কোর না। ওকে নিয়ে এস। একদল প্রহরী নিয়ে ভাষ্কর, তুমি চলে যাও পূর্বদিকের পাহাড়ে। দেখ, কেউ হতাহত হল কি না! আর সকলকে খবর পাঠিয়ে দাও পাহাড়ের মাথা থেকে নেমে আসতে, এখানে আর কোন প্রহরার দরকার নেই। সকলকেই বল নীচে নেমে আসতে। যাও!”


সকলেই দৌড়ে গেল যার যার অভীষ্ট কর্মে, মহারাজ শান্তনুর আদেশ মাথায় নিয়ে।





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract