Aritra Das

Classics Fantasy Children

4.2  

Aritra Das

Classics Fantasy Children

বঙ্কিমবাবুর ভয়

বঙ্কিমবাবুর ভয়

42 mins
529



গ্রীষ্মের এক ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে ভুবনডিঙার বিখ্যাত ফাঁকা মাঠটি ধরে হন হন করে হেঁটে আসতে দেখা গেল এক মধ্যবয়ষ্ক ভদ্রলোককে। হাতে ধরা একটি ব্যাগ, মাথায় ছাতা, চোখে চশমা, মাথাভর্ত্তি কাঁচা-পাকা মেশানো চুল, বৃষস্কন্ধ। তার হাঁটবার ধরণে একটু বেশিই ব্যস্ত বলে মনে হল ওনাকে; এতটাই উদ্ভ্রান্তের মত হাঁটছিলেন তিনি যে সামনের মাটি থেকে বেরিয়ে আসা বড় পাথরের টুকরোটিকে যেন দেখতেই পেলেন না; একটা ঠোক্কর খেতে হল তাতে। পড়ে যেতে যেতে সামলে নিয়ে একবার পিছনে তাকিয়ে দেখে নিলেন পাথরটিকে, তারপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে সামনে এগিয়ে গেলেন তিনি। দৃশ্যতই একইসঙ্গে বিরক্ত ও কোন কারণে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল তাকে।

মাঠ পার করে একটি ছোট ডোবা পড়ে একপাশে; সেটিকে বাঁয়ে রেখে একটু এগিয়েই অনেকটা ছড়ানো জায়গা নিয়ে একটি ছোট, পুরনো আমলের কটেজবাড়ির মত দেখতে একটি বাড়ি চোখে পড়ল, পুরো জায়গাটিই অবশ্য ইঁটের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, তবে সংস্কারের অভাবে জায়গায় জায়গায় ভেঙে গিয়েছে সেটি। এই বাড়ির সামনের গেটে এসে গেট খুলে ভিতরে ঢুকতে গিয়ে নেমপ্লেটে চোখ পড়াতে একটু থমকে গেলেন ভদ্রলোক; দশক পেরোন পুরোন নেমপ্লেটটিতে বড় বড় করে লেখা-


শ্রী বঙ্কিম চন্দ্র রায়

শিক্ষক (ইতিহাস)

আনন্দ-নিকেতন ভবন, সন্ ১৯৪০


-“‘আনন্দ-নিকেতন’? এখন তো থাকবার মধ্যে শুধু ‘নিকেতন’টিই পড়ে আছে, ‘আনন্দ’ বোধ হয় পাকাপাকিভাবে বিদায় নিয়েছে আমাদের বাড়ি থেকে, বাবার সাথে সাথে-”

গেটটি বন্ধ করে পকেট থেকে চাবি বের করতে করতে মনে মনে গজগজ্ করে উঠলেন ভদ্রলোক। তারপর এগিয়ে গেলেন সদর দরজার তালা খোলবার জন্য; যদিও পথে একটু অপ্রত্যাশিত বাধা পেয়ে তাকে থমকে দাঁড়িয়ে যেতে হল কিছুক্ষণের জন্য- দ্বিতীয়বার।

-“বঙ্কিমবাবু!”

-“কে- ও, সমীরবাবু? কখন এলেন? আসুন, ভিতরে আসুন!”

সমীরবাবু- সমীররঞ্জন মিত্র হলেন বঙ্কিমবাবুর প্রতিবেশী। তার বসতবাড়িটি বঙ্কিমবাবুদের বাড়ি থেকে একটু এগিয়েই। আসলে একটু দিন-মান থাকলেই স্কুল থেকে ফেরবার পথে ভুবনডিঙার মাঠটি তার বাড়ি ফেরবার শর্টকাট রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করেন বঙ্কিমবাবু, সেক্ষেত্রে আগে পড়ে তাঁর বাড়িটি; নাহলে ঘুরে রাস্তা দিয়ে আসতে হলে পাড়ায় ঢোকবার মুখে দুটি-তিনটি বাড়ি অতিক্রম করে সমীরবাবুর বাড়ি টপকে তবে তার বাড়ি পড়ে। এমনিতে খুবই অমায়িক প্রকৃতির মানুষ এই সমীরবাবু, বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে নানা বিষয়ে মিল রয়েছে তার, সব থেকে বড় বিষয়টি হল- দুজনেই অকৃতদার; ফলে সখ্যতা জমে উঠতে বেশি সময় লাগে নি তাঁদের মধ্যে। সমীরবাবু এখানে মাসতিনেক হল এসেছেন, বঙ্কিমবাবুরা অবশ্য এখানকারই আদিবাসিন্দা। সমীরবাবুকে দেখতে পেয়ে এখন সদর দরজার তালা খুলে ভিতরে ঢুকলেন বঙ্কিমবাবু, অবশ্যই তার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে।

-“কি হয়েছে বলুন তো? আপনাকে এরকম বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেন?”- ভিতরে ঢুকে একটি চেয়ারের ওপর বসে জিজ্ঞাসা করলেন সমীরবাবু, খাটে বসা বঙ্কিমবাবুকে উদ্দেশ করে। ওনার গলায় আর শার্টের বুকের কাছে লেগে থাকা হালকা নীল রঙের পোঁচটা নজর এড়ায় নি সমীরবাবুর।

ভিতরে ঢুকে পুরো এক গ্লাস জল ঢক ঢক করে খেলেন আগে বঙ্কিমবাবু। খাটের পাশে রাখা ছোট টেবিলে গ্লাসটা ঠক্ করে নামিয়ে রাখলেন তিনি, তারপর বললেন-

-“পেশার প্রতি প্যাশনের পুরষ্কার!”

-“মানে?”

নতমস্তকে মাথাটি সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে অত্যন্ত অবসন্ন, অসহায়ের মত বসে ছিলেন বঙ্কিমবাবু; ঐভাবেই বসে থেকে তিনি ধীরে ধীরে যা বললেন তার মর্মার্থ এই-

ঘটনাটি ঘটেছে স্কুলে। আজকে শনিবার; এমনিতেই হাফ-ছুটি। বঙ্কিমবাবুর ক্লাস ছিল ছুটির আগে শেষ ক্লাস, ক্লাস এইটের ‘বি’ সেকশানে। পাল বংশের উথ্থান ও পতন নিয়ে যথারীতি বিভোর হয়ে পড়েছিলেন তিনি, মনের আনন্দে ক্লাস করাচ্ছিলেন সময়জ্ঞান ভুলে। খেয়ালও করেন নি কখন ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়ে গিয়েছে। তার ক্লাসের ছাত্ররা বেশ কিছুক্ষণ উসখুশ্ করছিল জায়গায় বসে; গুনগুন গলার সুর ক্রমশঃ ওপরে চড়তে শুরু করে দিল তাদের। কয়েকজন রীতিমতন উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল- ক্লাস শেষ হয়ে গিয়েছে, ছুটির ঘন্টা বেজে গিয়েছে, এখন তাদের বাড়ি যেতে দেওয়া হোক। কয়েকটা দরকারি তথ্য বলে দেওয়া বাকি ছিল; হাত দেখিয়ে ছাত্রদেরকে নিরস্ত করে সেটাই বারবার বলবার চেষ্টা করছিলেন বঙ্কিমবাবু- এমন সময় ছাত্রদের বেঞ্চির মাঝামাঝি দিক থেকে একটি জলভর্ত্তি বেলুন উড়ে এসে আঘাত করে তাকে! পুরো কালিমালিপ্ত হয়ে যান তিনি মুহুর্তের মধ্যে! রুমালে মুখটুখ মুছে যতক্ষণে ধাতস্থ হলেন তিনি ততক্ষণে ক্লাস ফাঁকা- কীর্তিমান ছাত্রের দল ধাঁ হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে অকুস্থল ছেড়ে!


তার বন্ধুবরটির দিকে সমবেদনার দৃষ্টিতে তাকালেন সমীরবাবু। এরকমই কিছু তিনি মনে মনে আঁচ করছিলেন, আর ঠিক সেটাই ঘটেছে। গত কয়েক মাস ধরে খুব কাছ থেকে দেখে আসছেন তিনি বঙ্কিমবাবুকে- আপাদমস্তক নিরীহ, নির্বিবাদী এই মানুষটি এখানে পরিচিত বিভিন্ন নামে- ‘ব্যাঁকা’, ‘বঙ্কু’, ‘ব্যাঁকাচাঁদ’- ভাববাচ্যে ডাকবার সুবিধায় যে যেমন নাম পেয়েছে একটা লাগিয়ে দিয়েছে। স্বভাব-পরোপকারী এই মানুষটির কাছ থেকে যে যেমন উপকার চেয়েছে দুহাত বাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে, পরিবর্তে জুটেছে বিভিন্ন শ্রেণীর লাঞ্জণা! প্রতিবাদ-বিমুখ এই মানুষটির স্বভাব অবশ্য তাতেও বদলায় নি, কিন্তু কতদিন চলবে এইভাবে?

-“হেডমাস্টারমশাইএর কাছে কমপ্লেন করেছেন? কি বললেন উনি?”


-“বলেছেন তো! চোখে-মুখে কালিঝুলি মেখে হেডমাস্টার নরহরিবাবুর ঘরে ঢুকতে চশমাটি খুলে গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলেন আমার অবস্থা; তারপর বললেন- ‘চোখ-মুখ আর শার্টের বুকের কাছটা ভালো করে জল দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে টিচার্সরুমে ফ্যানের নীচে বসে ভালো করে শুকিয়ে নিন। এ নিয়ে জলঘোলা করবার কোন মানে নেই! আর হ্যাঁ, কাল বিকালে কাশীনাথবাবুর বাড়িতে স্কুল পরিচালন সমিতির একটি মিটিং আছে, ওখানে ফাণ্ডিং পাওয়া যাবে বলে উনি আশ্বাস দিয়েছেন, মনে আছে তো? সময় বুঝে কিন্তু চলে আসবেন, মনে থাকে যেন! আপনি না গেলে উনি বলেই দিয়েছেন কিছু দেবেন না!’”

-“আপনি দেখেছিলেন, বেলুন কে ছুঁড়েছে? কাশীনাথবাবু কে? স্কুল পরিচালন সমিতির মিটিং স্কুলে না হয়ে ওনার বাড়িতে হচ্ছে…ব্যাপারটা বুঝলাম না। আপনি না গেলে স্কুলের ফাণ্ডিং উনি দেবেন না কেন?”


-“স্বনামধন্য শ্রী কাশীনাথ টুডু স্কুল পরিচালন সমিতির একজন কেষ্টবিষ্টু পদাধিকারী; শাসকদলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন লোক, স্কুলের বিভিন্ন খাতে খরচের প্রধান লগ্নিকারী ও টাকাপয়সার যোগানদার। ওর ভয়ে এই গ্রামে বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খায়! হেডস্যার এটিকে মিটিং বলে চালালেও ওটি আদতে কোন মিটিং নয়, ওনার তোষামুদির জন্য একটু মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা, জলসা। আর এই জলসাগুলিতে আমাকে ডাকা হয় একটিই সঙ্গত কারণে- প্রতিটি জলসায় একটি ‘খোরাক’ লাগে যার পিছনে লেগে দিব্যি ফূর্তিতে সময় কেটে যায়। ওনার জলসাগুলিতে আমিই হলাম সেই ‘খোরাক’। মঞ্চ আলো করে বসবেন শ্রী কাশীনাথ টুডু ও তাঁর স্যাঙাতরা, আর খোরাক হবেন ‘একমেবাদ্বিতীয়তম্’ এই ‘ব্যাঁকাচাঁদ’- এই হল প্রতিটি জলসার অভিন্ন কর্মসূচী! বুঝেছেন ব্যাপারটা?”

-“বুঝলাম!”- একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন সমীরবাবু- “আর বেলুন ছোঁড়ার ব্যাপারটা কে ঘটাল?”


-“ওঁনারই সুপুত্র শ্রীমান পল্টু! ছাত্রদের বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে-”

-“থাক! বাকিটা বুঝে গিয়েছি।”

এই কথা বলে অবসন্ন বন্ধুপ্রবরকে চাঙ্গা করে তোলবার উদ্দেশ্যে অন্য প্রসঙ্গে হাল্কা রসিকতার কিছু কথাবার্তা শুরু করলেন সমীরবাবু। যদিও আলাপচারীতা চলবার ফাঁকে খেয়াল করলেন, তখনও বেশ বিষন্ন ও অন্যমনষ্ক লাগছে বঙ্কিমবাবুকে- কোন একটি কারণে যেন উতলা হয়ে পড়েছেন তিনি। এরকমভাবেই দু-চারটে কথা চালানোর পর তিনি থেমে গেলে এতক্ষণে যেন হুঁশ ফিরে এল তার; সমীরবাবুর দিকে তাকিয়ে একটা অপ্রস্তুতের হাসি হাসলেন তিনি।

-“ক্ষমা করবেন সমীরবাবু, আসলে অন্য একটা বিষয় নিয়ে খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছি…আপনার কথাগুলি ঠিক খেয়াল-”

-“আবার কি হল? কাশীনাথবাবুর বাড়ির মিটিং নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে-”

সমীরবাবু বাকিটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন, কারণ বঙ্কিমবাবু এই অবধি শুনে হাত নেড়ে ইশারায় তাকে ‘না’ বলে দিয়েছেন। তারপর সমীরবাবু থেমে যেতেই তিনি বললেন-

-“তা নয়, গল্পটা অন্য জায়গায়। আচ্ছা, আপনি তো আমারই প্রতিবেশী; আমার বাড়ির চত্বরে আশেপাশে কোথাও কোন অস্বাভাবিক কিছু কি চোখে পড়েছে আপনার? এই ধরুন রাত-বিরেতে?”

এই অস্বাভাবিক, বেয়াড়া প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে গেলেন সমীরবাবু; কোন কথা না বলে দুদিকে সামান্য একটু মাথা নাড়িয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন-

-“কেন, কিছু হয়েছে নাকি?”

এর উত্তরে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন বঙ্কিমবাবু, তারপর বললেন-

-“ঘটনার সূত্রপাত পরশু দিন রাত্রে; বেশ গভীর রাতই হবে তখন, অকাতরে ঘুমোচ্ছি, হঠাৎ বেশ কিছু জোরালো আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল, মাথার ওপরের ছাদে যেন কিছু চলে ফিরে বেরাচ্ছে; যেন একদল বেশ মোটাসোটা লোক ছাদে উঠে ইতস্তত মার্চ পাস্ট করে যাচ্ছে- এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো! ভয়ে কাঠ হয়ে বিছানাতেই শুয়ে রইলাম, নড়ি নি এখান থেকে। আমাদের বাড়িটা ছোট একতলা বাড়ি হলে কি হবে, পুরনো আমলের বাড়ি তো, খুব শক্তপোক্ত আর মজবুত! এইটা বুঝতে পেরেছিলাম যে কোন লোকের সাধ্যি হবে না দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকে; যদি আমি নিজে থেকে না বেরোই তো! পায়ের আওয়াজের মালিকরা মনে হল ছাদে ঘুরে ঘুরে দেখছে- কোন দিক দিয়ে নামলে ওদের সুবিধা। তারপরেই যেন কোন কিছুর তাড়া খেয়ে সবকটা একসঙ্গে পালালো; তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম-”

-“ঘুমিয়ে পড়লেন? এই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার পর আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন? আশ্চর্য!”

-“কি করব বলুন? এখানে প্রায়ই বাঁদরের দল চলে আসে ঘুরতে ঘুরতে; সামনে একটু এগোলেই ঘন, গভীর বেলমুড়ির জঙ্গল, ওখান থেকে ছিটকে আসে বাঁদরের দল, খাবারদাবারের আশায়। আমি ভেবেছিলাম সেরকমই কিছু হবে হয়তো! আর তাছাড়া যা বললাম- রাত-বিরেতে আওয়াজের পিছনে ধাওয়া করতে গিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরোবার কোন সদিচ্ছা আমার নেই; একা থাকি, বুকে একটা ছুরি বসিয়ে দিলে দোতলার টঙের ঘরে উঠে যাওয়া ছাড়া আর কোন গতি থাকবে না আমার-”

-“‘বেলমুড়ির জঙ্গল’ বলাতে একটা কথা মনে এল আমার; আপনি বলুন, তারপরে বলছি।”

অনুমতি পেয়ে এরপর আবার বলতে শুরু করে দিলেন বঙ্কিমবাবু-

-“যাই হোক, বাকিটা বলি; গতকাল রাত্রে যা ঘটল তা আরও মারাত্মক! আমার ভিতরের হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে গিয়েছে এই ঘটনাটি!

গতকাল রাত্রে কিছুতেই ঘুম আসছিল না; গতকাল কিরকম গুমোট গরম গিয়েছে মনে আছে তো? খাটে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি- হঠাৎ আবার ছাতের ওপর সেই আওয়াজ! সেই এক শব্দ, তার আগের দিনের মতই! যেন ছাতের ওপর কুচকাওয়াজ করছে চার-পাঁচটি মোটা মোটা লোক! জেগেই ছিলাম, তাই বোধহয় আওয়াজটা যেন আরই স্পষ্ট। বেশ কিছুক্ষণ এরকম আওয়াজ চলবার পর আবার সেই ধুপুর-ধাপুর শব্দ, যেন ছুটে পালাচ্ছে সকলে মিলে!

আর শুয়ে থাকি নি এবারে, পালাবার শব্দটা শুনতে পেতেই খাট থেকে নেমে চলে গেলাম জানলার কাছে, তারপর উঁকি মেরে দেখি-”

এই অবধি বলে কিছুক্ষণের জন্য থামলেন বঙ্কিমবাবু; ভুঁরু কুঁচকে যেন খানিক্ষণের জন্য ভেবে নিলেন দৃশ্যটা। তারপর স্তিমিত মুখে অধোবদনে বললেন-

-“কলতলার ওপাশে ঐ গোয়ালঘরটা দেখছেন? ওটা এখন শূণ্য, কিন্তু ছোটবেলাতেও দেখেছি ওখানে গরু থাকত! যাই হোক, কাল রাত্রে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি ওখানে একটি লম্বা লোক দাঁড়িয়ে, ওর পাকা ছাদের ওপর-”

-“লোক! আপনি ঠিক দেখেছেন তো? মুখটা দেখেছেন?”

-“কি বলব সমীরবাবু…একদম স্পষ্ট, কোন ভুল নেই! আর মুখ দেখব কি করে? দিনের বেলাতেই এখান থেকে স্পষ্টভাবে মুখ চেনা যায় না, তায় রাত্রির অন্ধকারে! তবে লোকটি চাপা জামাকাপড় পরেছিল…চামড়ার জ্যাকেটের মত শক্তপোক্ত কিছু…প্যান্টটিও সেইরকমই চাপা, যেন গায়ের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। আর জুতোটা ছিল গোড়ালি ছাড়িয়ে হাঁটু অবধি প্রায়! অনেকটা গামবুটের মতন। লম্বায় প্রায় আপনার মতই হবে, দু-এক ইঞ্চি এদিক-ওদিক। মাথায় আবার একটা বাজখাঁই হেলমেট-”

-“হেলমেট? সেটা বুঝলেন কি করে?”

-“চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছিল যে!”

-“বেশ। তারপর?”

-“লোকটি মনে হল যেন কিছু খুঁজছে, এমনভাবে গোয়ালঘরের ছাদের ওপর থেকে চারধারে তাকাচ্ছিল সে। ঐভাবে দেখতে দেখতেই হঠাৎ যখন আমায় আবিষ্কার করল জানলা দিয়ে উঁকি মারতে, তখন যেন কতকটা অপ্রস্তুত হয়ে চলে গেল সে, একটা প্রকাণ্ড লাফ মেরে। আরও বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম কিছু দেখতে পাওয়ার আশায়, কিন্তু সে উপদ্রব আর ফেরৎ আসে নি। শেষে আমিও বিরক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।”

বঙ্কিমবাবুর বক্তব্য শেষ হওয়ার পর বেশ খানিকক্ষণ থম মেরে বসে থাকলেন সমীরবাবু। বিষয়টি সত্যিই চিন্তার। রাত্রিবেলায় একদল ডাকাত (তাই ধরে নিতে হবে, চোর তো চুরি করতে এসে এরকম শব্দ করবে না!) বন্ধু তথা প্রতিবেশীর ছাদ ভাঙবার মতলব আঁটছে- এ তো সত্যিই দুশ্চিন্তার বিষয়! খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকলেন তিনি, তারপর যেন মনস্থির করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন-

-“বেশ! সব শুনলাম এবং বুঝলাম! এবারে আপনি একটা কাজ করুন, আপনার রাত্রে যা যা প্রয়োজন সেগুলি চটপট একটা বাক্সে ভরে নিয়ে আসুন তো দেখি-”

-“কিন্তু কোথায়?”- অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন বঙ্কিমবাবু।

-“কোথায় আবার, আমার বাটীতে! আজ রাত্রে আপনি আমার বাড়িতে থাকবেন।”

এই ব্যাপারটাই ভাবিয়ে তুলেছিল বঙ্কিমবাবুকে, এই কারণেই তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন বন্ধুকে এই বিষয়ে কিছু বলবার ব্যাপারে। তাঁর মনে হয়েছিল তাঁর শোচনীয় দূরবস্থার কথা শুনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতে পারেন সমীরবাবু, আর ঠিক সেটাই হল! সমীরবাবুর প্রস্তাবে এখন হাঁ হাঁ করে উঠলেন বঙ্কিমবাবু-

-“সমীরবাবু শুনুন, চিন্তার কোন কারণ নেই; আমাদের এই পুরোন, শক্তপোক্ত দেওয়াল ভেঙে কোনমতেই কেউ বাইরে থেকে ভিতরে ঢুকতে পারবে না…আমি সুরক্ষিত এই ছাদের নীচে-”

-“এবারে আপনি শুনুন”- মাথা ঝাঁকিয়ে প্রবল আপত্তির স্বরে কথা বলে উঠলেন সমীরবাবু- “আপনার কোন কথাই আর শুনছি নে! আজ আপনাকে আমার বাড়িতে থাকতেই হবে; দরকার পড়লে কাল, পরশুও। চলুন!”

অনেক তর্ক-বিতর্কের পর অবশেষে হার মানলেন বঙ্কিমবাবু, বন্ধুর জেদের কাছে। তিনি বললেন-

-“বেশ। কাল থেকে আমি থাকব আপনার বাড়িতে গিয়ে কয়েকদিন, আপনি যখন এত করে বলছেন। তবে আজ নয় সমীরবাবু, আজ আমাকে একটু ছুটি দিতেই হবে-”

-“কেন? আজকে কি-”

-“সুপার্শ্ববাবুর কয়েকটি পরীক্ষার খাতা দেখে জমা দিতে হবে কালকের মধ্যে, নাহলে সমস্যা-”

-“দাঁড়ান দাঁড়ান; সুপার্শ্ববাবু, মানে সুপার্শ্ব মজুমদার? গণিতের শিক্ষক তো? আপনি আগে বলেছিলেন ওর কথা। তা আপনি তো ইতিহাসের শিক্ষক, ওনার অঙ্কের খাতা আপনি দেখবেন কি করে? ব্যাপারটি ঠিক-”

মৌণ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বঙ্কিমবাবু; তাঁর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ধীরে ধীরে ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন সমীরবাবু, তারপর বললেন-

-“আর কতদিন অন্যের বোঝা নিজের ঘাড়ে নামিয়ে আনবেন বলুন তো মশাই! ওনার সঙ্গে গতকাল দেখা হল মুণ্ডেশ্বরের মন্দিরের সামনে, বড়কালীতলার বাজারে; দিব্যি সস্ত্রীক ঘুরে বেরাচ্ছেন উনি, আপনার ঘাড়ে দায়িত্ব ফেলে সময় কাটাচ্ছেন পরিবারের সঙ্গে। আপনার ইতিহাসের খাতা উনি দেখে দেন?”

নীরব থেকে দুদিকে মাথা নাড়লেন বঙ্কিমবাবু, হতাশ হয়ে পাল্টা মাথা নাড়তে নাড়তে সমীরবাবু বললেন-

-“আপনার ভয়-রোগটি দেখছি তুঙ্গে মশাই! যাই হোক, আজকের দিনটি আপনাকে ছাড়লাম; কাল থেকে কিন্তু কোন অজুহাত আমি শুনব না। রাত্রে দরজার ভিতর থেকে তালা লাগিয়ে শোবেন, কেউ এসে ডাকলেও সাড়া দেবেন না। আসি তাহলে?”

মুখ ঘুরিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ কি মনে পড়াতে আবার বঙ্কিমবাবুর কাছে সরে এলেন সমীরবাবু, তারপর বললেন-

-“ঐ যাঃ, যে কারণে আসা…বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম! বেলমুড়ির জঙ্গলের খবরটা শুনেছেন?”

-“না…কি বলুন তো?”

-“ওখানকার জঙ্গলে অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটছে; তিনদিন আগে রাত্রিবেলায় নাকি ওখানে তারা খসে পড়ে, গভীর রাত্রে ঘটনাটি ঘটায় নাকি কেউ বুঝতেই পারে নি। জঙ্গলের আশেপাশে যাদের বাড়ি তারা নাকি শুধু একটা হালকা ভূমিকম্প মতন কিছু অনুভব করেছে- ব্যাস! সাথে একটা মৃদু গোঁ গোঁ আওয়াজ, আর কিছু নয়। তবে আসল ব্যাপারটা আজ সকালে ঘটেছে। একদল সাঁওতাল ঢুকেছিল জঙ্গলের একটু গভীরে, সেখানে তারা আবিষ্কার করে ছটি মানুষের মৃতদেহ!”

-“অ্যাঁঃ! বলেন কি? ডাকাত নাকি?”

-“মনে হয় না। আশেপাশে কোন অস্ত্র পাওয়া যায় নি। তাছাড়া…মৃতদেহগুলি ভারি অদ্ভুত ভাবে পাওয়া গিয়েছে। কারোর চোখ খোবলানো, কারোর মুখের একটা দিকের কিছুই নেই, দাঁতগুলি ভয়ংকর ভাবে বাইরে বেরিয়ে এসেছে, আর প্রত্যেকটি মৃতদেহই ভয়ংকর ভাবে ক্ষতবিক্ষত, যেন কেউ অপারেশান চালিয়েছে এদের ওপর-”

-“সে কি! পুলিস কিছু খুঁজে পেল না?”

-“নাঃ! জঙ্গলের ভিতরে খানা-তল্লাসি চালানোর ব্যাপারে ওরা খুব একটা আগ্রহী নন। এই ধরণের ‘সার্চ অ্যাণ্ড রেসকিউ’ অপারেশান চালাবার মতন যথেষ্ট লোকবল এখানকার পুলিসের নেই। তাছাড়া মৃতদেহগুলির কোন দাবীদার নেই, এরা নাকি স্থানীয় কোন লোক নয়! আপনি সারাদিন বাইরে ছিলেন, আপনি শোনেন নি কিছু?”

আর শোনা! স্কুলের গণ্ডীর মধ্যে ঢুকে গেলে বঙ্কিমবাবু পুরো গর্তের মধ্যে সিঁধিয়ে যান; নিজের ক্লাস আর পড়াশোনা ছাড়া অন্যের সঙ্গে যা কথাবার্তা হয় তা অত্যন্ত মামুলি, সাদামাটা। মনে করবার চেষ্টা করলেন- হ্যাঁ, আজ টিফিনের সময় টিচার্স রুমে সকলে গোল হয়ে বসে নিজেদের মধ্যে মৃদু গলায় কিছু একটা নিয়ে তর্কাতর্কি চালাচ্ছিলেন বটে, ‘ডাকাত’ কথাটাও যেন একবার-দুবার কানে এল, কিন্তু পরীক্ষার খাতা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তিনি আর ও নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামান নি। তাছাড়া…ওসব কেষ্টবিষ্টুদের মাঝে নাক না গলানোই ভাল। এনারা একটা চেয়ারে বসে বড় বড় বাঘ-সিংহ শিকার করেন; আর ফাঁকেতালে বঙ্কিমবাবুকে হেনস্থা করা পছন্দ করেন। দিবাকরবাবু- দিবাকর হাজরা, ফিজিক্যাল সায়েন্সের শিক্ষক- শ্রদ্ধেয় কাশীনাথ টুডুর কাছের লোক হওয়ার সুবাদে যা ইচ্ছে তাই করে বেরান। সেবারে কাশীনাথবাবুর জলসায় কাশীনাথবাবুর সামনে এক হাঁড়ি দই ফাঁকা করে দিয়েছিলেন বঙ্কিমবাবুর মাথায়- টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করতে পারেন নি তিনি লজ্জায়, অপমানে! আজকের টিচার্স-রুমের আলোচনাচক্রে স্বাভাবিক নিয়মেই তিনিই মধ্যমণি।

-“আর ‘তারা-খসা’ নিয়ে কি একটা বলছিলেন যেন”- জিজ্ঞাসা করে উঠলেন বঙ্কিমবাবু – “জঙ্গলে কিছু খুঁজে পেল কেউ?”

-“খেপেছেন? বেলমুড়ির জঙ্গল কি আর এইটুকুন জায়গা মশাই? আস্ত একটা কোলকাতা মহানগরী আরামসে ঢুকে যাবে ওর মধ্যে! আর জলে-জঙ্গলে-পাহাড়ে ঘুরে কোন মহাজাগতিক বস্তুর সন্ধান করার ইচ্ছে বা ‘ওয়ার্ক কালচার’ এখানে কোথায়? যাক, আপনি আজ রাত্রে পরীক্ষার খাতা যা দেখবার দেখে নিন, কাল থেকে আপনি আমার বাড়িতে থাকবেন।”

সমীরবাবুকে বাইরের গেট অবধি এগিয়ে দেওয়ার পর সেটিকে টেনে বন্ধ করবার আগে ভালো করে চারদিক আগে দেখে নিলেন বঙ্কিমবাবু। তারপর গেটটা বন্ধ করে এগিয়ে চললেন পরিত্যক্ত গোয়ালঘরটির দিকে।

মধ্য রাত্রির দিকে সমীরবাবু ঘুম থেকে উঠে একগ্লাস জল খেয়ে দাঁড়ালেন বিছানার মাথার কাছের জানালাটির সামনে; এখান থেকে বঙ্কিমবাবুর শোবার ঘরের জানালাটি দূর থেকে আবছা ভাবে দেখা যায়। অনেকটা ছড়ানো ফাঁকা জমির মাঝখানে অন্ধকারে একটা প্রেতবাড়ির মত আবছা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি। একটা আশংকা কাজ করছিল তার মনে, সব ঠিক আছে তো? এত দূর থেকে অবশ্য স্পষ্ট কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। খানিকক্ষণ চুপ করে আশেপাশের পরিস্থিতি একটু দেখে নিলেন তিনি, তারপর জানলার ধার থেকে সরে গেলেন।

অখণ্ড নীরবতার মধ্যে ডুবে রইল মুখোমুখি দুটি বাড়ি, একরাশ ঘন অন্ধকার বুকে মেখে নিয়ে।


----------------------------------------------------------------------------------------------------


বেশ খানিকটা অস্বস্তির মধ্যে যেন ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙ্গল বঙ্কিমবাবুর; প্রথমে চারদিক ঘোলাটে লাগছিল, মাথাটা বেশ ভালোই ধরেছে যেন, আর তার সাথে সর্বাঙ্গে প্রবল এক বেদনা! এসব সামলে ধীরে ধীরে চোখ মেললেন তিনি, তারপর দৃষ্টিশক্তি মোটামুটি ফেরৎ আসতেই ঘরের চতুর্দিকে চোখ বোলালেন তিনি। কিন্তু…এ কার ঘর? এ তো তার বাড়ি নয়!

ধড়মড় করে উঠে বসতে গিয়েই বিছানার মধ্যে আবার ছিটকে শুয়ে পড়লেন বঙ্কিমবাবু; বেশ জোর ব্যথা লেগেছে তার, শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। এই বেদনার অনুভূতিটিই সম্পূর্ণ সজাগ করে তুলল তাকে, নিজের দিকে পূর্ণ সজাগ দৃষ্টিতে এতক্ষণে তাকাতে পারলেন তিনি।

তার দুটি হাত, কোমর, এবং দুপায়ের গোছকে ঘিরে অদ্ভুত কিছু আলোকময় বৃত্ত দেখতে পেলেন তিনি। এই আলোকবৃত্তগুলির প্রত্যেকটির ওপরে একটি করে নলের মুখ, আগুনের শিখার মত কিছু একটা বেরিয়ে এসে সেগুলিই রচনা করছে এই আলোকবৃত্তগুলিকে। এই নলগুলি কিন্তু খোলা নয়, সেগুলির সবকটির অপর প্রান্তগুলি গিয়ে মিশেছে পেটের বেশ কিছুটা ওপরে হাওয়ায় ঝুলতে থাকা একটি গোলোকের মধ্যে; কিন্তু হাওয়ায় গোলোকটি ঝুলছে কেমন করে? কৌতুহলী হয়ে মুখ বাড়িয়ে গোলোকটিকে ভালো করে দেখতে গেলেন বঙ্কিমবাবু, কিন্তু পারলেন না, মাথায় টান পড়ে আটকে গেলেন। বুঝলেন, মাথাটাও অনুরূপভাবে বেঁধে রাখা আছে কোন ‘শক্তি-জাল’ দিয়ে। ‘শক্তি-জাল’ শব্দটি হুট করে এসে গেল তার মাথায়, কারণ শরীরের বিভিন্ন অংশে এই আলোকময় বৃত্তগুলি ছাড়া অন্য আর কিছুই চোখে পড়ল না যা তাকে বেঁধে রাখতে পারে বিছানার সঙ্গে। আর খুব শক্ত এই বাঁধন; একটু এপাশ-ওপাশ করলেই সাথে সাথে ব্যথা লাগছে বাঁধনের জায়গাগুলিতে।

বিছানায় শুয়ে শুয়েই এপাশ-ওপাশ তাকাতে লাগলেন বঙ্কিমবাবু, সাহায্যের আশায়, কিন্তু কিছু চোখে পড়ল না। প্রায়ান্ধকার এই মধ্য আয়তনের ঘরে মনে হল আশেপাশে আরও কয়েকটি বিছানা দেখতে পেলেন তিনি; স্তিমিত আলোয় মনে হল যেন দেহ রয়েছে সেই বিছানাগুলিতে! কিন্তু কারা এরা? আর তার থেকেও বড় প্রশ্ন- তিনি এখন কোথায়? আর এখানে পৌঁছলেনই বা কি করে? তিনি তো ঘুমোচ্ছিলেন নিজের বাড়িতে, তাহলে এখানে এলেন কেমন করে? এই কথাগুলিই স্তম্ভিত হয়ে ভাবছিলেন বঙ্কিমবাবু; আর ঠিক তখনই হঠাৎ-

হঠাৎ যেন সশব্দে একদিকে খুলে গেল ঘরের দরজা; একটি দ্বিপদ মূর্তি এগিয়ে এল তার দিকে। অন্ধকারে প্রথমটায় ভালো করে কিছু ঠাওর করতে পারেন নি তিনি, শেষে মূর্তিটি তার পাশে এসে দাঁড়াতে মুখ তুলে তাকালেন বঙ্কিমবাবু। সেটি মানুষদের মতই দেখতে বটে, কিন্তু এ কোন ধরণের মানুষ?

অস্বাভাবিক সাদা একটি সুন্দর মুখশ্রী, কিন্তু তাতে যেন মিশে একটি ক্রূর নিষ্ঠুরতা। সন্দিগ্ধ চোখ, সে চোখে পাতা প্রায় নেই বললেই চলে। নাক আকারে ছোট, কানের অবস্থাও তথৈবচ; এরকম লম্বা শরীরের অনুপাতে কানগুলি ছোট ছোট। কপালের ওপরে অগ্রমস্তিষ্কের অংশটি ফোলা ফোলা, যেন ওপরের দিকে ঠেলে উঠে আবার স্বাভাবিক খুলির আকার ধারণ করেছে। কোথায় যেন দেখেছেন এইরকম খুলির আকার- মনে করতে পারলেন না বঙ্কিমবাবু। হাতগুলি বলিষ্ঠ, ঋজু, কিন্তু অস্বাভাবিক দীর্ঘ। গায়ের চাপা জামার থেকে যেটুকু অনাবৃত অংশ দেখা যাচ্ছে তাতে অজস্র সরু সরু আঁশ ভর্তি। মূর্তিটি কাছে এসে দাঁড়ানোতে, আর আলোকপ্রভা সরাসরি তার গায়ে এসে পড়াতে আঁশের ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিলেন বঙ্কিমবাবু, নাহলে স্বাভাবিক আলোয় হয়তো বিষয়টি নজরে এড়িয়ে যেত তার।

মূর্তিটিও পাশে দাঁড়িয়ে একইভাবে দাঁড়িয়ে নিরীক্ষণ করছিল বঙ্কিমবাবুকে, এখন দেখা শেষ হতে ওপরে হাত বাড়িয়ে অন্ধকারের মধ্যে কোথা থেকে টেনে নামালেন একটি উদ্ভট যন্ত্র, তারপর সেটিকে নিয়ে খুটখুট শুরু করলেন তিনি; একদম বঙ্কিমবাবুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েই।

-“আমি কোথায় এখন? কে আপনি?”

একই প্রশ্ন দুতিনবার করাতেও ফল একই হল; নিরুত্তর থাকলেন আগন্তুক। তার নৈশব্দ অধৈর্য্য করে তুলল বঙ্কিমবাবুকে। ক্রমশঃ গলার সুর চড়তে লাগল তার। শেষে অধৈর্য্য হয়ে প্রবল আক্রোশে যখন চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি-

-“আমাকে এখানে আনা হয়েছে কেন? কে আপনারা?”

কোন কথা না বলে আগন্তুক পলকে ঘুরে গিয়েই তার মুখে ঢুকিয়ে দিলেন একটি নল; মাথার ওপরে যে যন্ত্রটিকে নিয়ে খুটখুট করছিলেন তিনি সেখান থেকেই বেরিয়ে এসছিল নলটি। আর সেটা শায়িত বঙ্কিমবাবুর মুখে পুরে দিতেই-

বঙ্কিমবাবুর মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল, মনে হল যেন তরল আগুন বইল কিছুক্ষণ তার দেহের আভ্যন্তরীণ কোষগুলি দিয়ে! অসহ্য বেদনা হল সর্বাঙ্গে, স্বাভাবিক নিঃশ্বাস প্রায় আটকে গেল, যোজন-বিস্তৃত সর্ষে ক্ষেত দেখা দিল তার চোখের সামনে। শেষে দম আটকে প্রাণ যখন প্রায় বেরিয়ে যাওয়ার যোগাড়, তখন ধীরে ধীরে সব আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। এরপর আস্তে আস্তে নলটিকে তার মুখ থেকে বের করে নিলেন আগন্তুক। বঙ্কিমবাবু তখনও মূহ্যমান; এই অবস্থায় নিজের চোখের পাতা খুলে রাখতে পারেন নি তিনি, চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই মনে হল যেন আগন্তুকের হাতের একটি আঙুল স্পর্শ করল তার কপালের মধ্যিখানটি। একটু শিউরে উঠলেন তিনি প্রথমটায়; তারপরই মনে হল কে যেন কথা বলে উঠল তার মাথার মধ্য থেকে, একটু জড়ানো, থমকানো বাংলায়-

-“বাধা-দেবেন-না। শুয়ে-থাকুন!”

-“কিন্তু কে আপনি? আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন?”- সর্বাঙ্গের ব্যথা অগ্রাহ্য করে কোনমতে কথা বলে উঠলেন বঙ্কিমবাবু; জড়ানো গলায়, অস্ফূটস্বরে, চোখ না খুলেই। উত্তর এল-

-“বাধা-না-দিলে-দ্রুত-মুক্তি…দিলে…দেরি!”

বঙ্কিমবাবু অনুভব করলেন, তার মাথার ওপর থেকে আঙুলটা সরে গেল। কোনমতে একটু চোখ মেলে তাকালেন ডানদিকে, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন আগন্তুকটি। তিনি সরে গিয়েছেন ততক্ষণে বঙ্কিমবাবুর পাশ থেকে। পাশের খাটের শায়িত দেহটির সামনে গিয়ে কিসব করলেন তা বোঝা যাচ্ছে না, তার কার্যকলাপ ঢাকা পড়ে গিয়েছে তার শরীরের আড়ালে। খানিকক্ষণ ঝুঁকে থেকে কিসব পরীক্ষা করে অবশেষে তিনি সরে গেলেন সেখান থেকে; খুব সম্ভবত ঘর থেকে বেরিয়েই গেলেন তিনি। আর তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই-

এতক্ষণ ঘরের অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল আরেকটি প্রাণী; অন্ধকারে আর হঠাৎ-উত্তেজনায় সেটা খেয়ালই করেন নি বঙ্কিমবাবু। এবারে একটি ভারি পায়ের আওয়াজে তার দৃষ্টি ঘুরে গেল সেদিকে; অন্ধকার থেকে স্তিমিত আলোর বৃত্তে প্রবেশ করল একটি দ্বিপদ প্রাণী। ‘লোক’ না বলে সেটিকে ‘প্রাণী’ বলাই বোধহয় সমীচীন হবে, কারণ আলো-আঁধারিতে দেখে বঙ্কিমবাবুর মনে হল যেন একটি বুনো শুয়োরের মুণ্ডু বসানো রয়েছে তার গলায়! বেশ লম্বা, দানবাকৃতির বিরাট আয়তনের শক্তিশালী এই প্রাণীটি দুপায়ে হেঁটে এল পাশের খাটে শায়িত দেহটির কাছে, তারপর চাদর জড়ানো দেহটিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল অক্লেশে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পরিষ্কার দেখতে পেলেন বঙ্কিমবাবু- চাদরের ভিতর থেকে বাইরে ঝুলতে থাকা একটি হাত! আর তারপরই, দ্বিতীয়বারের জন্য জ্ঞান হারালেন তিনি।


-------------------------------------------------------------------------------------------------------


-“‘বঙ্কিমবাবু’, ‘বঙ্কিমবাবু’…আপনি ঠিক আছেন তো?”

প্রথমটায় বঙ্কিমবাবু ভেবেছিলেন তিনি বোধহয় ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন; এখন পরিচিত নামে পরিচিত পরিবেশে নির্দ্বিদ্ধায় ঘুম থেকে উঠে বসবেন তিনি, মনে এই ভয়ংকর দেখা দুঃস্বপ্নের রেশ নিয়ে। হয়তো কপাল ভালো হলে খাটের পাশেই থাকবে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা সোনালি-রঙা চা- এই চায়ের চিন্তাতেই বিভোর হয়ে ধীরে ধীরে চোখ খুললেন তিনি। কিন্তু চোখ তুলে এক প্রকার হতাশই হয়ে গেলেন তিনি!

এখনও তিনি শায়িত সেই প্রায়ান্ধকার ঘরেই; আশেপাশে তাকে ঘিরে থাকা একপাল শায়িত দেহের দঙ্গলের মাঝেই। হতভাগ্য এই দেহগুলি যে মানুষেরই এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, তবে তিনি নিশ্চিত নন যে এরা জীবিত, নাকি মৃত! কয়েকটি দেহে অবশ্য একই রকম আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে, ধরে নেওয়া যায় এর অর্থ সেই দেহগুলি জীবিত।

‘আলোর রেখা’ বলতে তার মনে হল- তার শরীরে কোন আলোর বৃত্ত দেখা যাচ্ছে না তো! আর তার সর্বাঙ্গে যে চিনচিনে ব্যথাটি ছিল, এখন আর তা টের পাচ্ছেন না তিনি! হাত নাড়লেন, পা নাড়ালেন- না, কিছু বাধা পাচ্ছেন না তিনি। এইবার সাহস করে উঠে বসলেন তিনি। এই তো! দিব্যি ওঠা গেল তো! তিনি এখন বন্ধনমুক্ত, স্বাধীন! তার মানে-

বাঁ পায়ে ভর দিয়ে ওঠবার চেষ্টা করতেই একটি ভারি হাত এসে ন্যস্ত হল তার কাঁধে; চমকে উঠে বাঁদিকে দৃষ্টি ঘোরালেন তিনি, আর তা করতেই-

-“সমীরবাবু! আপনি?”

প্রায়ান্ধকার ঘরে শত্রুপুরীর ভিতরে বন্ধুকে চিনতে একটুও ভুল হয় নি বঙ্কিমবাবুর; তিনি যতটা না আনন্দিত হয়েছেন তার থেকে বিষ্মিত হয়েছেন বেশি। এই অজ্ঞাত জায়গাটির সন্ধান সমীরবাবু পেলেন কি করে? আর তাছাড়া- তার পরিধেয়। এ তো অবিকল সেই পোষাক, যা তিনি আগের দিন দেখেছিলেন রাত্রিবেলায়, গোয়ালঘরের ছাদে, অজ্ঞাতপরিচয় সেই ব্যক্তির দেহে! তাহলে কি সমীরবাবুই-?

-“আপনি কি সুস্থ? হাঁটতে পারবেন এখন? তাড়াতাড়ি, বেশি সময় নেই-”

-“এক মিনিট সমীরবাবু!” – চাপা গলায় আর্তনাদ করে উঠলেন বঙ্কিমবাবু – “এ সব কি হচ্ছে বলুন তো? আমি এখন কোথায়? আমি তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না-”

-“বোঝাবার জন্য বেশি সময় নেই বঙ্কিমবাবু- ওরা যে কোন সময় ফিরে আসতে পারে। ওরা আপনাকে অপহরণ করেছিল আপনার বাড়ি থেকে, গতকাল রাত্রে, আপনার জানালার শিকগুলিকে সম্পূর্ণ গলিয়ে ভিতরে ঢুকেছিল ওরা; ঐ পথ দিয়েই অজ্ঞান করে আপনাকে নিয়ে আসা হয় এখানে। আগেই সফল হত, প্রথম দুই দিন আমি বাধা দেওয়ায় ওরা পালিয়ে যায়-”

-“এ তো অন্যায়; সমীরবাবু, এই বাড়ি থেকে বেরনোর পর প্রথমেই যে পুলিস স্টেশন পড়বে সেখানে এদের বিরুদ্ধে আমি একটি রিপোর্ট- এক মিনিট! কি বললেন? ‘আপনি বাধা দেওয়ায়’- তার মানে আগের দিন রাত্রে আমি যে লোকটিকে গোয়ালঘরের ছাদে দেখতে পাই তা আপনিই ছিলেন? আজকের এই পোশাক পরে?”

প্রত্যুত্তরে দুবার ঘাড় নাড়লেন সমীরবাবু, তারপর বললেন-

-“আপনি এখনও ব্যাপারটা বোঝেন নি মনে হয়, তাই না? বঙ্কিমবাবু, এই প্রাণীগুলি কেউ ‘মানুষ’ না যাদের এখানে আপনি দেখছেন, ঐ শায়িত, চাদরে ঢাকা দেহগুলি বাদ দিয়ে। আর হ্যাঁ, এই মুহুর্তে আপনি কোন প্রকাণ্ড বাড়িতে নয়, বরং একটি ভিনগ্রহী মহাকাশযানের ভিতরে আছেন, পৃথিবীর পরিমণ্ডলের মধ্যেই, আপনার নিজের এলাকায়, মাটিতে!”

পুরো আধমিনিট স্থির চোখে বঙ্কিমবাবু তাকিয়ে রইলেন সমীরবাবুর হেলমেট পরা অনাবৃত মুখের দিকে; তারপর ধীরে ধীরে তিনি বললেন-

-“সমীরবাবু, আমি জানি না এরা কোন দেশের গুপ্ত সংগঠন, আপনি কোন রাষ্ট্রের গুপ্তচর এবং আমি এটাও বুঝে উঠে পারছি না আমি এর মধ্যে স্যাণ্ডউইচ হয়ে গেলাম কি করে; যাই হোক, আমাকে মুক্ত করবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এবারে বাকিদের মুক্ত করে আমি এখান থেকে বের হয়ে যেতে চাই শুধু, ব্যাস! কথা দিচ্ছি, আজীবন এই ঘটনাটি সম্পর্কে আমি নিশ্চুপ থাকব। আমাকে শুধু প্রাণে মারবেন না!”

হতাশ মুখে একবার নিজের দুটি হাত ঝাঁকিয়ে নিলেন সমীরবাবু; তারপর উত্তেজিত গলায় চাপা স্বরে তিনি বলতে লাগলেন-

-“আপনারাই গোটা মহাবিশ্বে একমাত্র মহাবুদ্ধিমান প্রাণী, তাই না? বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে কোথাও অন্য কোন প্রাণ থাকতে পারে না, একমাত্র পৃথিবী বাদে, ঠিক তো? বঙ্কিমবাবু, মানুষ চোখ থাকতেও দেখে না, কান থাকতেও শোনে না, নগ্ন সত্যকে জেনেও তারা আপন করে নিতে চায় না! এই মহাকাশযানের ভিতর চলে-ফিরে বেরানো প্রতিটি প্রাণী- প্রত্যেকে আমরা এসেছি ভিন্ন বিশ্ব থেকে, সৌরমণ্ডলের বাইরে, বহুদূর থেকে! এখানে কয়েকটি আজ্ঞাবাহী ভৃত্যস্থানীয় অতি-আদিম বুদ্ধির কিছু প্রাণী আছে যাদের পথে সংগ্রহ করা হয়েছিল মূলত রক্ষণাবেক্ষণ, সুরক্ষা ও আজ্ঞাপালনের উদ্দেশ্যে; আর আমরা দুজন- আমি এবং যে লোকটির সঙ্গে আপনার ভেট হয় কিছুক্ষণ আগে- আমাদের দেশ ধ্রুবতারার ওপারে, ‘ক্রেনিয়াস’ নামক একটি গ্রহে-”

এই নামটি শুনে যেন একটু চমকে উঠলেন বঙ্কিমবাবু; যেন এই নামটি তিনি আগেও শুনেছেন, বহুযুগ আগে, বেশ কয়েকবার, তার আরাধ্য দেবতার মুখে!

-“কি বললেন- ‘ক্রেনিয়াস’ গ্রহ? কিন্তু এই নামটি তো বাবার মুখ থেকে বেশ কয়েকবার শুনেছি বলে মনে পড়ছে-”

-“আপনার বাবা? কি শুনেছেন?”- অনুসন্ধিৎসু ভাবে প্রশ্ন করলেন সমীরবাবু। এই প্রথম তাকে যেন একটু আগ্রহী শোনাল। উৎসাহ পেয়ে কথা বলতে লাগলেন বঙ্কিমবাবু-

-“বাবা আমার কাছে প্রায়ই গল্প করতেন ছোটবেলায়- তিনি নাকি একবার ঘুরতে ঘুরতে জঙ্গলের মধ্যে ‘ক্রেনিয়াস’ গ্রহ থেকে আসা ‘আং’ নামক কারোর দেখা পেয়েছিলেন; তারপর ‘আং’ চলে যান এখান থেকে, তার মহাকাশযানে চেপে, আমাদের গ্রহের বাইরে-”

-“আর কিছু বলেন নি?”- অধৈর্য্য হয়ে প্রশ্ন করলেন সমীরবাবু।

-“আর তো কিছু…আসলে অনেকদিন আগে শোনা, আর তো কিছু সেরকম মনে… কেন বলুন তো?”

এর উত্তরে কিছু একটা বলবেন বলে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন সমীরবাবু; এমন সময়-

কথাবার্তায় কেউই বুঝতে পারেন নি ঘরের ভিতর যে একটি তৃতীয় প্রাণীর আগমন ঘটেছে; গুঁড়ি মেরে অনেকটা কাছিয়ে এসেছিল প্রাণীটি, তারপর সমীরবাবুর অসতর্কতার সুযোগে পিছন থেকে একটি চাপা স্বরে হুংকার দিয়ে লাফিয়ে পড়েছে সমীরবাবুর ওপর! ধাক্কার চোটে খাট টপকে ওপারের মেঝেতে ছিটকে পড়েছিলেন বঙ্কিমবাবু; কোনমতে সামলে উঠে দেখেন-

সমীরবাবুকে খাটে একেবারে ঠেসে ধরেছে প্রাণীটি! এ তো সেই দানব যে কিছুক্ষণ আগেই একটি মৃতদেহকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে! বিশাল বলশালী এই দানবটি এখন সমীরবাবুকে চেপে ধরেছে খাটের মধ্যে, তার উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার- দম আটকে সে মেরে ফেলতে চায় সমীরবাবুকে। অসহায়ের মত ইতিউতি তাকালেন বঙ্কিমবাবু, আর ঠিক তখনই তার চোখে পড়ল তার শরীরে আলোক-বৃত্ত সৃষ্টিকারী সেই সংবাহী নলটি। ধ্বস্তাধ্বস্তির চোটে অনেকটাই ঝুলে গিয়েছিল সেটি তার জায়গা থেকে, আর তার মুখ থেকে তখনও বেরিয়ে আসছিল অক্সি-অ্যাসিটিলিন গ্যাসের মত অনির্বাণ শিখা! কিছু না বুঝেই কোনমতে দ্রুতপদে এগিয়ে গিয়ে নলটিকে হাতে ধরে নেন বঙ্কিমবাবু, সিধে সেটিকে নামিয়ে আনেন আক্রমণকারী দানবটির মাথা উদ্দেশ্য করে। বিসদৃশ একটি আওয়াজের সাথে দানবটির বুনো শুয়োরের মত মাথা মাখনের মত ভেদ করে ভিতরে সবটুকু ঢুকে যায় নলটি! একটি আর্তনাদ করে একদিকে এলিয়ে পড়ে দানব; শেষ সংক্ষোভে বেশ কয়েকবার ছটফট করে তার দেহ, তারপর- আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ে তার শরীর। আর দানব মারা পড়তেই আস্তে আস্তে খাটে উঠে বসেন সমীরবাবু, ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে।

-“হুম…এটা মনে হয় দল থেকে ছিটকে এসেছিল!”- হাঁফাতে হাঁফাতে বলতে লাগলেন সমীরবাবু- “যাক, আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়ে দিলেন বঙ্কিমবাবু। কিন্তু আমার মনে হয় এখানে আমাদের আর থাকাটা আর উচিৎ নয়। চলে আসুন-”

-“কিন্তু বাকিরা?”- চাদরে ঢাকা শায়িত অন্য দেহগুলির দিকে হাত বাড়িয়ে ইশারা করলেন বঙ্কিমবাবু।

-“এদের বেশিরভাগই মৃত, বাকিদের অবস্থা সঙ্গীন, চলৎশক্তিরহিত! বঙ্কিমবাবু, আমার মনে হয় আপাতত ‘সামায়েল’কে থামানোটাই আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিৎ-”

-“‘সামায়েল’? এর কি ‘বাইবেল’ এর সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে নাকি?”

-“আপনাদের জিভ আর কান এখনও অতটা জটিল হয় নি দেখছি, যাক! আপনি যখন ঐ নামই শুনেছেন, তাহলে ঐটিই থাক। এখন আসুন আমার সাথে-”

-“চলুন।”

আর দ্বিরুক্তি না করে সমীরবাবুর পিছন পিছন পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বঙ্কিমবাবু।


===========================================================


-“আমরা কি উল্টো দিকে চলে এসেছি? বেরোনর রাস্তাটা কি ঐদিকে ছিল না?”

ফিসফিস করে বলে উঠলেন বঙ্কিমবাবু। তার প্রত্যুত্তরে দুদিকে জোরে মাথা নাড়লেন সমীরবাবু; তারপর একাগ্রমনে তাকিয়ে দেখে নিলেন ঘরটির আশপাশ, চার দিক।

বিশালায়তনের এই ঘরটি তখন যেন কুয়াশাচ্ছন্ন; এত ধোঁয়া এখানে কোথা থেকে এল তা খোদায় মালুম, ঘরটির মেঝে প্রায় অদৃশ্য! এত বড় ঘরটির আয়তন যে এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত প্রায় চোখে পড়ে না বললেই চলে। বিশাল দেওয়ালগুলিতে বিভিন্ন রকমের চিত্র আঁকা- সাদা রঙা দেওয়ালগুলি আরও প্রকটভাবে উজ্জ্বল কোন এক অদৃশ্য আলোক উৎসের প্রভাবে। প্রায়ান্ধকার ঘরটিতে এতটা উজ্জ্বল সাদা দেওয়ালগুলির উপস্থিতি তার বিভিন্ন চিত্র সমেত- বড় বেমানান সে উপস্থিতি!

সমীরবাবু এই ঘরটিতে ঢুকেই প্রথমে কানের কাছে হাত দিয়ে কি একটি বোতাম টিপলেন কে জানে, এতে তার চোখগুলি একটি কালো কাঁচের মত কিছু দিয়ে সম্পূর্ণ ঢেকে গেল। ঐ অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলেন তিনি। কিন্তু কি খুঁজছেন তিনি এই ভৌতিক পরিবেশে, আর্ধেকেরও বেশি অন্ধকারের মধ্যে?

গবেষণাগার থেকে (আসবার সময় সমীরবাবু বলেছেন যে ঘরটিতে তাকে ও অন্যান্য মানবদের চেতনাহীন করে রাখা হয়েছিল সেটি প্রকৃতপক্ষে গবেষণাগার) বেরিয়ে বিভিন্ন ছোট-বড় ঘর ও টানা হলঘর পেরিয়ে আসবার সময় হঠাৎ একটি বিকটদর্শন জন্তুর সঙ্গে দেখা হয় পথে। ভারি আজব এই জন্তুটি দ্বিপদ বটে, কিন্তু মানুষ বা বাঁদরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই প্রাণীগুলি দেখতে অনেকটা কুমীরদের মত! একটি পেল্লায় কুমীরকে পিছনের দুপায়ে খাড়া দাঁড় করিয়ে, তার ল্যাজ বাদ দিয়ে, চোখা বেরিয়ে আসা মুখবিবরকে মানুষের মুখের মত রূপ দিলে যে ব্যাপারটা দাঁড়ায়, এরাও অনেকটা দেখতে সেরকমই! বিকটদর্শন এই প্রাণীটি তাদের দুজনকে একসাথে দেখেই একটি বিকট চীৎকার করে পিছনদিকে দৌড়তে লাগল। সমীরবাবু একবার চেষ্টা করেছিলেন বটে তাকে ধরবার, কিন্তু কৃতকার্য হতে না পেরে হাত ধরে বঙ্কিমবাবুকে টেনে নিয়ে শেষমেশ ঢুকে পড়েন এই ঘরে। দরজা ভালো করে বন্ধ করবার পর যখন তিনি একজায়গায় উবু হয়ে বসে খতিয়ে দেখছিলেন ঘরের পরিস্থিতি, তখনই তাকে উক্ত প্রশ্নটি করেন বঙ্কিমবাবু। কোন কথা না বলে চোখ থেকে কালো কাঁচের আবরণ সরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি বলে ওঠেন-

-“তাপ-সংবেদী দর্শনে দেখছিলাম ঘরে কেউ কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা। স্বস্তির বিষয়, সামায়েল এই ঘরে নেই। তবে একটা কম স্বস্তির খবরও আছে বৈকি! এই ঘরে সরীসৃপরা লুকিয়ে থাকলে সেটা বোঝবার কোন উপায় নেই…ওদের শীতল রক্তের কারণে গা থেকে কোন তাপ নির্গত হয় না। এই অবস্থায় ওরা আক্রমণ করলেই চিত্তির! আমার অস্ত্র নিষ্ক্রিয়। আপনার বাড়িতে দুইদিনব্যাপী নৈশ-অভিযান চালানোর সময় দ্বিতীয়দিন ধ্বস্তাধ্বস্তিতে এই গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশটি হারিয়ে যায়!”

সমীরবাবুর বাঁ হাতে একটি দীর্ঘ, বেঢপ মণিবন্ধ বসানো ছিল সেটা আগেই খেয়াল করেছিলেন বঙ্কিমবাবু; এখন হাতটা বাড়িয়ে ধরতে তিনি খেয়াল করলেন- চোখের মত আকৃতিবিশিষ্ট একটি জায়গা জুড়ে নিটোল একটি গর্ত! অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি-

-“কি ছিল এতে?”

-“আমাদের ‘সংরক্ষক বৈদ্যুতিন কোষ’। আপনারা একে ব্যাটারিও বলতে পারেন। ওটি না থাকলে এই অস্ত্র কার্যকর থাকবে না। আপনার বাড়ির আশেপাশেই কোথাও পড়েছে…আপনি বরং ঘরটা একটু ঘুরে দেখুন, আমি ততক্ষণ একটু খুঁজে দেখি যদি কাজের কিছু পাওয়া যায়…”

তাই করছিলেন বঙ্কিমবাবু; বিরাট এই ঘরটির দেওয়ালে অঙ্কিত ছবিগুলি ও তার পাশে সজ্জিত লিপিগুলি দেখছিলেন তিনি। প্রথমে আলগোছে- শুধু দেখবার জন্যই দেখা। কিন্তু বেশ কয়েকটি ছবি ও লিপি দেখবার পর আস্তে আস্তে, একটু একটু করে কার্য-কারণ সম্পর্কটি যখন ধরতে পারলেন তিনি- শিহরিত হয়ে উঠল তার মন; চমকে উঠলেন তিনি! ইতিহাসের একজন ছাত্র তিনি, নিজেই ইতিহাস পড়ান, ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশ কিছু প্রাচীন লিপি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তার মধ্যে একটি ছিল প্রাচীন মেসোপটেমীয় কিউনিফর্ম লিপি। এখন তিনি যথেষ্ট বিষ্মিত হয়ে গেলেন এই ভেবে- পশ্চিমবঙ্গের এক নামগোত্রবিহীন ভূখণ্ডে, আধুনিক সভ্যতা ও নগরীর থেকে শত শত মাইল দূরে, পাণ্ডববর্জিত এই এলাকায় একটি অজানা, প্রকাণ্ড বাড়ির (সমীরবাবুর মতে মহাকাশযান!) একটি বিরাট ঘরের একদিকের উজ্জ্বল সাদা দেওয়ালে বিভিন্ন চিত্রের সঙ্গে এই বিদেশি প্রাচীন লিপি এখানে কি করছে? ভারতীয় প্রাগ-বৈদিক সংস্কৃত লিপির তো কোন চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না এখানে, বরং কিছু কিছু হরফ দেখা যাচ্ছে যা অনার্য সিন্ধু সভ্যতাগুলি থেকে প্রাপ্ত কিছু হরফের সঙ্গে মিল খায় বটে! কিউনিফর্ম লিপি- এর অর্থ মেসোপটেমিয়া, টাইগ্রীস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্ত্তী সুবিশাল ভূখণ্ড; তার সঙ্গে সংযোগ হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতার লিপি- সিন্ধু নদ তীরবর্ত্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল! এর মানে কি? উদগ্রীব হয়ে সামনের দিকে বকের মত মাথা বাড়িয়ে দিলেন বঙ্কিমবাবু, বিষয়টিকে বুঝবার আশায়, স্থান-কাল-পাত্র বেমালুম ভুলে গিয়ে!

-“কি ব্যাপার বলুন তো? এরকম কোলাব্যাঙের মত হামাগুড়ি দিচ্ছেন কেন?” – পিছন থেকে বিষ্মিত সমীরবাবুর প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরল অবশেষে বঙ্কিমবাবুর; সলজ্জ হেসে মেঝের থেকে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে এলেন তিনি। তারপর চাপা উত্তেজিত স্বরে বললেন-

-“সমীরবাবু…অবশেষে পেয়ে গিয়েছি…”

-“কি পেলেন আবার? আঃ, এখন রসিকতা করবার সময় নেই বঙ্কিমবাবু, সামায়েল-”

-“বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির মধ্যে সংযোগ! এই দেওয়ালে!!”

-“অ! তা কি পেলেন বলুন তো?”- নিষ্পৃহ গলায় জিজ্ঞেস করলেন সমীরবাবু। যেন মুখিয়েই ছিলেন প্রশ্নটির জন্য; এইবার একনাগাড়ে গড়গড় করে কথা বলা শুরু করলেন বঙ্কিমবাবু, একটুও না থেমে-

-“মেসোপটেমীয় সভ্যতা অনুযায়ী এক আদিমাতার সন্ধান মেলে, তাঁর নাম ‘নিন্তুর’। অসাধারণ বিদূষী এই রমণী তাঁর স্বল্পসংখ্যক সহযোগীদের সহায়তায় গড়ে তোলেন সেখানকার মানবজন, বিভিন্ন প্রাণী; পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেখানকার উদ্ভিদ, বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা। তখন অবশ্য মেসোপটেমিয়া এখনকার মত নিছক বালি-পাথরের দেশ ছিল না। সেখানে মনুষ্য সৃষ্টির পর তাদের আধুনিক করে তুলে, নগর-সভ্যতার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে তবে তিনি চলে যান সেখান থেকে; আবার ফিরে আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু মেসোপটেমিয়ায় ফেরৎ তিনি আসতে পারেন নি, কোন একটি অজ্ঞাত কারণে। কি সেই কারণ?

ঐ একই সময়ে, বা তার আগে-পিছে এই প্রক্রিয়াকরণটি চলে বিশ্বের বেশ কয়েকটি অংশে, বিভিন্ন জায়গায়। তার মধ্যে অন্যতম- ভারতবর্ষ। এখনকার তিন খণ্ডে খণ্ডিত দেশে অবশ্য নয়, তখনকার সংযুক্ত ভূমিতে। প্রচুর সূর্যালোকের জন্য স্বভাবতই তাঁরা গবেষণার জন্য বেছে নিয়েছিল এমন কোন একটি জায়গা, যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমান কম। তবে তাঁদের সৃষ্ট মানবদেরকে কিন্তু তারা বেঁধে রাখেন নি বালি-পাথরের জঙ্গলে, বিবর্তনের এবং সুশিক্ষার পর পর তাদের ছেড়ে দিয়েছেন তুলনামূলকভাবে উর্বর জায়গাগুলিতে। খেয়াল করলে দেখা যাবে নগরায়নগুলি ঘটেছে মূলত নদীর পার্শ্ববর্ত্তী অঞ্চলে, উন্নত অংশে, যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিক, মাটি উর্বর। আজকের যুগে হরপ্পা সভ্যতা যে শুষ্ক জায়গায় দাঁড়িয়ে, একসময় নাকি সেই জায়গাটিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিক ছিল, বন-জঙ্গলও ছিল প্রচুর। কালক্রমে ব্যাপক বন উচ্ছেদের ফলে জায়গাটি ক্রমে আজকের চেহারা নেয়। এনারাই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের শেখান গোষ্ঠিনির্ভর সমাজব্যবস্থা, কৃষি, স্থাপত্য, জলসেচ ব্যবস্থা! এদেরই প্রচেষ্টার সর্বশেষ দান- উন্নত নগরভিত্তিক সভ্যতা। শুধু একটি নির্দিষ্ট অংশে নয়, বরং বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত ছিল এদের কারবার।

এই ঘুরে ফিরে প্রাণসৃষ্টির সময় কোন এক অজ্ঞাত কারণে যুদ্ধ বাঁধে আদিমাতা ও তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে অপর কোন এক উন্নত গোষ্ঠীর। ভয়ংকর এই যুদ্ধ প্রাণ কেড়ে নেয় আদিমাতার, ফলে পরিচিত পরিবেশে সর্বপ্রথমে সৃষ্ট উন্নত মানবদের মধ্যে ফিরবার আগেই মারা যান তিনি-”

-“আপনি এত নিশ্চিতভাবে বিষয়টা বলছেন কি করে?”- জিজ্ঞাসা করলেন সমীরবাবু।

-“কিছুটা এই দেওয়ালের ছবি দেখে, বাকিটা পড়ার ওপর নির্ভর করে। সিন্ধু সভ্যতাতেও কিন্তু এক আদিমাতার উল্লেখ মেলে; যদিও বিস্তৃত কিছু জানা যায় নি তাঁর সম্পর্কে, একটি টেরাকোটার মূর্তিই একমাত্র প্রাপ্তি। এখন বুঝতে পারছি তাঁর এই অদ্ভুত পোষাক ও শিরস্ত্রাণের রহস্য! মিশরীয় কিংবদন্তী অনুযায়ী, স্বয়ম্ভু এতাম মিশরের প্রথম দেবতা যার মুখ থেকে বেরিয়ে আসেন আরও দুইজন - ভগবান সু ও তাঁর বোন, দেবী টেফনাৎ! এরাই মিশরের নয় মূখ্য দেবতার প্রধান। এইভাবেই তার মানে সৃষ্টি হয়েছিল প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির; হয়তো একই ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির দ্বারা, আর এই কারণেই হাজার হাজার মাইল ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও এই নগরীগুলির মধ্যে সংস্কৃতিগত, আচরণগত ও বিন্যাসগত সাদৃশ্যগুলি এভাবে আলাদা করে চোখে পড়ে! এই তিনটি আলাদা সভ্যতার মূলগত সাদৃশ্যগুলি যেন গ্রন্থিত হয়েছে একই জায়গায়- এদিককার এই দেওয়ালে! এখনও অবশ্য ওদিকের দেওয়ালটা দেখা বাকি-”

-“পরে কোন একসময় ঘুরতে ঘুরতে এসে দেখে যাবেন না হয়, এখন কিছু ‘কুমীর-খেদানো’র কাজ করে নেওয়া যাক? ওদিকে গোটা মহাকাশযান আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গিয়েছে, সে খবর রাখেন কিছু? এই নিন, ধরুন!”

একটি ইয়া বড় তলোয়ার ঝুলছিল সমীরবাবুর হাতে, এখন সেটি সঁপে দিলেন তিনি বঙ্কিমবাবুর কাছে। বঙ্কিমবাবু গোবেচারা হলে কি হবে, রীতিমতন কসরৎ করা একজন শক্তিশালী পুরুষ; কিন্তু দুহাতে যখন তিনি বাগিয়ে তুলতে গেলেন তলোয়ারটিকে, বিরাট কষ্ট হল তার! তলোয়ারটিকে ধরে অবাক হয়ে তিনি তাকালেন সমীরবাবুর দিকে।

-“যেকোন মুহুর্ত্তে সদলবলে গার্ডরা চলে আসতে পারে এখানে; আমার অস্ত্রটি তো ঘোড়ার ডিম খেয়ে উল্টে পড়ে রয়েছে, এখন আপনাদের পার্থিবদের সেকেলে অস্ত্র ছাড়া অপর কোন গতি নেই। আমি অবশ্য ভাগ্যবান, তুলনামূলকভাবে আধুনিকতম একটি অস্ত্র পেয়েছি।”

সমীরবাবুর হাতে একটি অস্ত্র ছিল; একটি রাইফেল। এই ধরণের রাইফেলের সঙ্গে পরিচিত বঙ্কিমবাবু, সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন যুদ্ধের রণাঙ্গণে মার্কিন সেনাদের হাতে দেখেছেন তিনি এই অস্ত্রগুলি, অবশ্যই খবরের পাতাগুলিতে। কিন্তু কতদিন পড়ে ছিল এই অস্ত্রগুলি তা তিনি জানেন না, এখন বিপদের সময় এগুলি চলবে তো?

-“ঐদিকে একটি উঁচু, লম্বামতন টেবিল রয়েছে; আমরা ওতে কভার নিতে পারি। চলে আসুন বঙ্কিমবাবু-”


=============================================================


-“এই অনবদ্য ‘পিরিয়ড পিস’গুলি এখানে কোথা থেকে এল বলুন তো?”- কোলে রাখা তলোয়ারটি দেখতে দেখতে চাপা স্বরে জিজ্ঞাসা করে উঠলেন বঙ্কিমবাবু; ঐ তলোয়ারের হাতলে খোদাই করা তলোয়ারের মালিকের নাম ও তার নীচে থাকা সালটি খতিয়ে দেখতে দেখতে। কোন এক বৃটিশ হাইল্যাণ্ডার রবার্ট ড্যাভেনপোর্টের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে এই তলোয়ার, ১৮১৭ সালে! নাকি, এই নাম তলোয়ার প্রস্তুতকারকের? সেটা অবশ্য জানবার উপায় নেই।

-“এটা এই মহাকাশযানের একটি সংগ্রহশালা; বিভিন্ন সময়ে মানুষদের এখানে নিয়ে আসবার সময় তাদের মালিকানাধীন বস্তুগুলিকে এনে সাজিয়ে রাখা হয় এখানে। ঐ কারণেই-”

-“বিভিন্ন সময়ে বলতে? ঠিক বুঝলাম না! আপনারা কতদিন ধরে আসছেন আমাদের কাছে?”

এই প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন সমীরবাবু, যেন দুম করে একটি বেফাঁস কথা বলে ফেলেছেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন-

-“প্রথম যুগে পাঁচ হাজার বছরের ব্যবধানে, তারপর হাজার…এভাবে কমতে কমতে তিরিশ বছর; এখন প্রতি দশকে দু-তিনবার করে এখানে আসি আমরা। আপনাদের ‘উন্নতি’ দেখতে, আমাদের ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে।”

খানিকক্ষণ বিষ্ময়ে সমীরবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখলেন বঙ্কিমবাবু, তারপর চুপ করে গেলেন, আর কিছু বললেন না কিছুক্ষণ; বোধহয় ব্যাপারটা বসে হজম করলেন। এরপর মুখ তুলে বললেন-

-“আচ্ছা এই সামায়েল-এর ব্যাপারটা কি? উনি কি কোনরকম…ইয়ে, মানে, বিদ্রোহী?”

-“বেশি কথা বলবার সময় নেই, ওরা খবর পেয়ে এখুনি আসল বলে- শুনুন বঙ্কিমবাবু; যদি আপনার তলোয়ারের সামনে কোনভাবে সামায়েলকে পেয়ে যান, এক মুহুর্তও ইতস্তত করবেন না ওকে গিঁথে ফেলতে। নাহলে ও আপনাকে মেরে ফেলতে কোনরকম দ্বিধা করবে না জানবেন। সামায়েলকে ফেলতে পারলে বাকিরা আপনাকেই অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে মেনে নেবে। আমার কাছে আপনাদের অস্ত্রের মাত্র ছয়টা ম্যাগাজিন আছে, তারপর কিন্তু আপনার তলোয়ারই ভরসা… ঐ যে, ওরা আসছে; তৈরি হন।”

সংগ্রহশালার দরজাটা হঠাৎ দুহাট হয়ে খুলে গেল; সাথে সাথে ভিতরে প্রবেশ করতে লাগল মহাকাশযানের রক্ষীরা। ভয়ংকর চেহারার সেই ‘অমানুষ’, কুমীরের মত দেহাবয়ব বিশিষ্ট প্রহরীরা ভিতরে প্রবেশ করতেই টেবিলের একধার থেকে নাগাড়ে গুলিবর্ষণ শুরু করলেন সমীরবাবু। অব্যর্থ সন্ধানে গুলিগুলি ছুটে যেতে লাগল শিকারকে লক্ষ্য করে; এক একটি আওয়াজের সাথে সাথে মাটিতে পড়ে যেতে লাগল নিরস্ত্র সেই প্রহরীর দল; বোঝা গেল, দাঁত-নখই তাদের প্রধান ভরসা, অস্ত্রের ব্যবহার এদের জানা নেই। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলতে লাগল। কয়েকজন ছুটে আসতে গিয়েছিল বটে কাছিয়ে আসবার লক্ষ্যে, কিন্তু অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ মাঝরাস্তাতেই থামিয়ে দিল তাদের যুদ্বপ্রচেষ্টা। এইভাবে কিছুক্ষণ একনাগাড়ে গুলিবর্ষণের পর ধোঁয়া বেরোন রাইফেলটিকে নিয়ে টেবিলের পিছনে বঙ্কিমবাবুর পাশে ধপ করে বসে পড়লেন সমীরবাবু। বেশ খানিকক্ষণ একটু হাঁফিয়ে নিলেন তিনি।

-“আমার অস্ত্রের গুলি প্রায় শেষ। এবার এখানে আর বসে থাকা যাবে না বঙ্কিমবাবু! যা থাকে থাকুক কপালে, এখানে বসে থাকলে আমাদের গল্প এমনিতেই শেষ!”

-“এত ভালো গুলি চালানো শিখলেন কোথায়? আপনার ছোঁড়া প্রায় প্রতিটি গুলিই নিশানায় লেগেছে!”- প্রশংসার গলায় বললেন বঙ্কিমবাবু।

-“আমাদের সবরকম অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেওয়া থাকে; মানে, যার ঘাড়ে যে গ্রহের দায়িত্ব বর্তায় আর কি। তাছাড়া, আপনাদের কাছে আমি এই প্রথম আসছি না। এখন…চলুন!”

হাসতে হাসতে উত্তর দিয়ে জায়গা ছেড়ে উঠতে গেলেন সমীরবাবু, কিন্তু ‘এখন চলুন’ ব্যাপারটা বোধহয় এত সহজে ঘটল না। টেবিলের ওপর সমীরবাবুর মাথাটা সম্পূর্ণ ভেসে উঠতেই একটি বলিষ্ঠ হাত এসে টিপে ধরল তার গলা! ঐ অবস্থাতেও অসহায় সমীরবাবু নিজের হাতে ধরা রাইফেলের মুখ তার আততায়ীর শরীরের দিকে ঘুরিয়ে ধরতেই অপর বলিষ্ঠ হাতের একটি তীব্র ঝটকায় রাইফেলটি তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল একপাশে। তারপর দুইহাতের তীব্র পেষণে শূণ্যে ঝুলতে লাগলেন সমীরবাবু, পেরেকের গোড়ায় আটকানো কাচপোকার মত ঝুলতে ঝুলতে। ঐ অবস্থায় ক্ষীণস্বরে ঘৃণা ভরে একটিই কথা বেরলো তার মুখ দিয়ে-

-“সামায়েল!!!”

গোটা ব্যাপারটায় হতবুদ্ধির মত দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন পাশেই তলোয়ার হাতে বসা বঙ্কিমবাবু; এখন শূণ্যে ঝুলন্ত সমীরবাবুর মুখ থেকে নামটি শোনা মাত্র তিনি ফিরে তাকালেন ‘সামায়েল’ নামধারী ব্যক্তিটির দিকে। তার পোশাক সমীরবাবুর মতই, কিন্তু মাথার শিরস্ত্রাণ থেকে আরম্ভ করে পায়ের জুতো অবধি পুরোটা আপাদমস্তক কালো রঙের। আপাতত প্রবল ঘৃণাভরে মুখে একরাশ জিঘাংসা নিয়ে তিনি তাকিয়ে তার হাতের মধ্যে ঝুলতে থাকা অসহায় শত্রুর দিকে।

খুব দ্রুত পরিস্থিতি বিচার করে নিলেন বঙ্কিমবাবু। এই মহাকাশযানে তার একমাত্র বন্ধু সমীরবাবু বর্তমানে বিপন্ন, শত্রুর হাতে কাচপোকার মত ঝুলন্ত, প্রতিটি সেকেণ্ডে ক্রমশঃ আরও নেতিয়ে পড়ছেন তিনি, আর বঙ্কিমবাবুর হাতে ধরা একটি তলোয়ার! এই পরিস্থিতিতে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া স্বাভাবিক, তাই করলেন বঙ্কিমবাবু; কোনমতে তলোয়ারটি সজোরে একপাক ঘুরিয়ে প্রহার করলেন শত্রুর উদ্দেশ্যে, কিন্তু-

কিন্তু ক্ষণিকের উত্তেজনায় তিনি ভুলে গিয়েছিলেন- তিনি বর্তমানে রয়েছেন ভিনগ্রহীদের যানে; প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে যারা পার্থিবদের থেকে বহুমাত্রায় এগিয়ে। বঙ্কিমবাবুর প্রহার করা তলোয়ার সামায়েলের বর্মে কোন আঁচড়ও কাটল না, একটু শুধু সামনের দিকে টলে গেলেন উনি ধাক্কার প্রাবল্যে; হাত থেকে সমীরবাবুকে ছেড়ে দিয়ে এবারে বাঁহাত দিয়ে বঙ্কিমবাবুকে তুলেই একদিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন সামায়েল! অনেকটা পথ যেন প্রায় উড়ে এসে পড়লেন বঙ্কিমবাবু, উল্টোদিকের দেওয়ালে মাথাটা জোর ঠুকে গেল তার। ঐ অবস্থায় কোনমতে কিছুক্ষণ মাথা চেপে বসে রইলেন তিনি; তারপর সম্বিৎ ফিরতেই দেওয়ালের দিকে চোখ গেল বঙ্কিমবাবুর। ধাতস্থ হতেই দেওয়াল-চিত্রটি তার মনোযোগ আকর্ষণ করল গভীরভাবে- এটা কি?

দেওয়ালের ঠিক যেখানটায় তার মাথা ঠুকে গিয়েছিল, সেখানেই আঁকা একটি বিখ্যাত ‘চোখ’-এর ছবি। এটি একটি মিশরীয় হিয়েরোগ্লিফিক চিত্র, এর নাম ‘হোরাসের চক্ষু’। সুস্বাস্থ্য ও সুরক্ষার প্রতীকি চিহ্ন এই চোখটির ছবি বঙ্কিমবাবু আগেও দেখেছেন, কিন্তু এখন এই ছবিটি দেখতে দেখতে যেন হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেল তার! দ্রুত নিজের পরণের পায়জামার নীচের হাফপ্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাতড়াতে লাগলেন তিনি… কিছু একটা এসে ঠেকল তার হাতে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে জিনিষটিকে বের করে আনলেন তিনি, মেলে ধরলেন সেটিকে দেওয়াল-চিত্রের সামনে…হ্যাঁ, তার অনুমান সঠিক; দুটি এক জিনিষই বটে!

বঙ্কিমবাবুর ডানহাতের তর্জ্জনি ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে ধরা ‘আই অফ্ হোরাস’-এর একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ; কাঁচের মত চকচকে, তেজোদ্দীপ্ত, প্রদীপ্তময়! হালকা একটি আলোর প্রভা যেন বিকিরণ হচ্ছে তার দেহ থেকে! এই জিনিষটিকেই তিনি কুড়িয়ে পেয়েছিলেন তার বাড়ির শোওয়ার ঘরের জানালার নীচে; কৌতুহলবশতঃ জিনিষটিকে তিনি রেখে দেন হাফপ্যান্টের পকেটে, ভেবেছিলেন পরে দেখবেন, কিন্তু আর দেখা হয়ে ওঠেনি, তার আগেই অপহরণ হয়ে যান তিনি নিজের ঘর থেকে।

বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছেন বঙ্কিমবাবু, এটা কি এবং কার; কিন্তু প্রশ্নটি হল এটি তার মালিকের হাতে তিনি পৌঁছিয়ে দেবেন কি করে?

দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে সামনের দিকে তাকালেন বঙ্কিমবাবু, ডানহাতে ‘হোরাসের চক্ষু’-টিকে ধরে সামনের দিকে তুলে। সেখানে তখন করুণ এক দৃশ্য! মেঝেতে পড়ে সমীরবাবু, তার মুখটা বঙ্কিমবাবুর দিকে ঘোরানো। আর বঙ্কিমবাবুর দিকে পিঠ রেখে সমীরবাবুর বুকের ওপর চেপে বসে দুহাতে তার গলা টিপে ধরেছেন সামায়েল! এই অবস্থাতেও সমীরবাবুর মরণাপন্ন মুখে তার হারানো ধন হঠাৎ দেখতে পেয়ে যেন একটা প্রভা খেলে গেল- কষ্টক্লিষ্ট মুখে তিনি ঠায় চেয়ে রইলেন বঙ্কিমবাবুর দিকে। আর দেরি করলেন না বঙ্কিমবাবু, মেঝের ওপর দিয়ে ঘষটিয়ে হাতের জিনিষটি তিনি ছুঁড়ে দিলেন সমীরবাবুর দিকে; এক মুহুর্ত পরেই সেটি অব্যর্থ লক্ষ্যে গিয়ে ঠেকল সমীরবাবুর বাঁহাতে। সেটিকে তুলে কোনমতে সামায়েলের চোখ এড়িয়ে বাঁ হাতের মণিবন্ধে সঠিক জায়গায় ‘চোখ’-টিকে লাগিয়ে নিতে সমর্থ হলেন সমীরবাবু; আর তার পরেই-

একটি অদ্ভুত আওয়াজের সঙ্গে দেখা গেল, সামায়েলের দেহটি শূণ্যপথে উড়ে আসছে সিধা বঙ্কিমবাবুর দিকে। হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন বঙ্কিমবাবু, পাশে হাতড়ে তলোয়ারটা খুঁজে পেয়ে এখন কোনমতে বাড়িয়ে ধরলেন সামনের দিকে; সামায়েলের দেহটা উড়ে এসে সিধে তলোয়ার ফুঁড়ে ঢুকে অনেকটা পিছিয়ে এসে আঘাত করল বঙ্কিমবাবুকে, তারপর স্থির হয়ে পড়ে রইল ওখানেই, পিছনের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকা বঙ্কিমবাবুর ওপর। বঙ্কিমবাবুর তলোয়ারটি পিছন থেকে আমূল বিদ্ধ করেছে তাকে বুকের ওপর দিয়ে। এদিকে এতক্ষণের উত্তেজনা, তায় বিরাট চেহারার এই ভিনগ্রহীর শরীরের পুরোটা ওজন- আর স্থির থাকতে পারলেন না বঙ্কিমবাবুও। সামায়েলের দেহটি নড়াচড়া বন্ধ করতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলেন তিনিও!


==============================================================


-“বঙ্কিমবাবু…বঙ্কিমবাবু! আপনি সুস্থ আছেন তো?”

বেশ খানিক মৃদু ধাক্কাধাক্কি ও গলার আওয়াজে আস্তে আস্তে চেতনা ফিরে এল বঙ্কিমবাবুর। চোখ খুলেই দেখলেন, একপাশে মৃত সামায়েল। তার বুকের কাছের বর্মটি ভেঙে সম্পূর্ণ চুরমার; বর্মের নীচের যে দেহটি দেখা যাচ্ছে তাতে বিরাট একটি গর্ত, হালকা তামাটে লাল ও কালচে বর্ণের রক্ত এখন জমাট বেঁধে রয়েছে সেখানে। তার শিরস্ত্রাণটি এখন খোলা। মৃত্যুকঠিন একটি মুখ, মৃত্যুর পরেও ভয়ংকর এক পাশবিকতা লেগে সেই মুখে।

-“আপনি ঠিক আছেন তো?”- সামনেই দাঁড়িয়ে সমীরবাবু; তারও মাথায় কোন শিরস্ত্রাণ নেই এখন, আর বর্মের বুকের কাছটি ক্ষতবিক্ষত। ভালো করে তার দিকে তাকিয়ে দেখলেন বঙ্কিমবাবু- হ্যাঁ, এতক্ষণে তাকে দেখতে ভিনগ্রহীদের মতই লাগছে বটে, মুখের আদল আর দৈহিক বৈশিষ্ট্যগুলি বাদে আর কোন মিলই নেই মানুষদের সঙ্গে! এখন সমীরবাবুই তাকে সাহায্য করলেন উঠে বসতে।

-“আপনার চেহারা আর আঙুলগুলি আপনি আমার কাছ থেকে লুকোতেন কি করে? তিন মাসেও আমি ধরতে পারি নি!”- একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে প্রশ্ন করলেন বঙ্কিমবাবু। বিষয়টা যথেষ্ট ভাববার মতই বিষয় বটে। নিজের হাতের দিকে একবার তাকালেন সমীরবাবু, তারপর উত্তরে বললেন-

-“‘হিপনোটাইজার’, যা আমার আসল চেহারা আর হাতের চারটি আঙুলকে লুকিয়ে রাখত আপনাদের দৃশ্যমান বর্ণালী থেকে । ওটা এখন বিস্ফোরণে নষ্ট হয়ে গিয়েছে, এত কাছ থেকে সামায়েলকে গুলি করবার ফলে সৃষ্ট অভিঘাতে…”

-“এই সামায়েলের ব্যাপারটা কি বলুন তো? একে মারবার জন্য আপনারা এত মুখিয়ে ছিলেন কেন?”

এই কথায় কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে যান সমীরবাবু; তারপর, অনেকটা জবানবন্দীর ঢঙে তিনি বলতে শুরু করেন-

-“বলছি বঙ্কিমবাবু, আপনি স্থির হয়ে বসুন। অনেকটাই ছড়ান এর প্রেক্ষাপট; অনেককিছুই হয়তো বলা যাবে না, তবে সংক্ষেপে যতটা সম্ভব আমি বলতে চেষ্টা করব। আপনি ধৈর্য্য ধরে শুনুন।

আগেই বলেছি- ধ্রূবতারার ওপারের দেশ ‘ক্রেনিয়াস’ আমাদের গ্রহ। তবে আমরা সেখানে কিন্তু একা বুদ্ধিমান প্রাণী নই, আমাদের সৃষ্টিকর্তারা আমাদের সঙ্গেই থাকেন। এরা আপনাদেরও সৃষ্টিকর্তা, অর্থাৎ এক হিসেবে দেখতে গেলে আমরা-আপনারা জাতভাই! যদিও আমাদের জন্ম ও বিকাশ আপনাদের আগে; বিবর্তনের ধারায় আপনাদের আগেই আমাদের আগমন, প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এই কারণেই আমরা আপনাদের থেকে এগিয়ে।

আমাদের বিকাশের সাথে সাথে আমাদের ঘাড়ে অল্প অল্প দায়িত্ব এসে পড়ে; আস্তে আস্তে তার মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বেশ কয়েকটি গ্রহ যেখানে সৃষ্টিকর্তারা প্রাণের বিকাশ ঘটান, সেগুলির মধ্যে কয়েকটির মনিটরিং এর দায়িত্ব আমাদের ওপর ন্যস্ত হয়। আস্তে আস্তে সেগুলির দায়িত্ব পুরোটাই আমাদের কাঁধে এসে পড়ে। এরকমই একটি গ্রহ হল পৃথিবী। দুধসাদা একটি ছায়াপথের পরিধির দিকে বিস্তৃত এই সৌরমণ্ডলের তৃতীয় গ্রহটির রক্ষনাবেক্ষণের মূল দায়িত্ব আমাদের ওপর এসে বর্তায়। আর এখান থেকেই শুরু হয় গল্পের সূত্রপাত।

সামায়েল ও আমার পিতা ছিলেন এই মনিটরিং দলের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারীক। ওরাই দেখাশোনা করতেন এই ইউনিটটির। একইসঙ্গে। যদিও আমার পিতা কোনদিন বুঝতেই পারেন নি, কিভাবে আস্তে আস্তে বিদ্রোহী হয়ে উঠছেন সামায়েল। সৃষ্টিকর্তার বিধান আর মানতে চাইছিলেন না তিনি; কিন্তু বিদ্রোহ করতে গেলে যে লোকবল দরকার তা ছিল না তার।

এরই মাঝে হঠাৎ একদিন এক আবিষ্কার হয়; আমার পিতা এমন একটি মিনিয়েচারাইজড যন্ত্র আবিষ্কার করে বসেন যা একটি ক্ষুদ্র নুড়ির মত ধারকের মধ্যে ধারণ করতে পারবে বেশ কয়েকটি সৌরমণ্ডলের মধ্যে অবস্থিত সব ধরণের জৈব প্রাণের প্রধান একক- ডি.এন.এ.এর গঠন ও প্রাণ সৃষ্টির একক অ্যামিনো অ্যাসিড। এর ফলে ব্রহ্মাণ্ডের একটি বিপুল অংশের বিলুপ্তপ্রায় সকল প্রাণীগুলিকে নবনির্মান করা সম্ভব হবে- অন্তত এমনই চিন্তাভাবনা ছিল আমার পিতার; কিন্তু-”

-“ক্লোনিং?”

-“ক্লোনিং-এ সৃষ্ট প্রাণীদের বিবর্তন হয় না, বঙ্কিমবাবু; কিন্তু বাবার আবিষ্কৃত এই ধারক থেকে সৃষ্ট প্রাণীগুলির শরীরে বিবর্তন আবার সেখান থেকেই শুরু হবে, ঠিক যেখানে তা শেষ হয়েছিল! এই কারণেই এই আবিষ্কার ছিল অভিনব; স্বয়ং আমাদের সৃষ্টিকর্তারা স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এই আবিষ্কারটিকে; বাহবা জানিয়েছিলেন আমার পিতাকে। অত্যন্ত খুশি ছিলেন বাবা, ডেকে ডেকে দেখান সকলকে তাঁর এই নব আবিষ্কারটি। আর এখানেই কাল হয়ে দাঁড়ান সামায়েল!

ভয়াবহ এক চক্রান্ত করেন তিনি, সৃষ্টিকর্তাদের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে। এই আবিষ্কারটির মধ্যে নিদর্শন হিসেবে রাখা ছিল আমাদের মূল মহাকাশ কেন্দ্রের সবকজন সদস্যের ডি.এন.এ.; সামায়েল ছক কষেন- প্রথমে তিনি সকলকে মেরে ফেলবেন, তারপর এই যন্ত্রটি চুরি করে পুনরুজ্জীবিত করবেন নির্বাচিত কয়েকজনকে। তারপর তাদের ব্রেনওয়াশ করে নিজের দলে ভেড়াতে কতক্ষণ? সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।

কেউই বুঝতে পারেন নি সামায়েলের পরিকল্পনা, বাবা বাদে। তিনিও সবটুকু বুঝতে পেরেছিলেন তা নয়; কিন্তু কিছু একটা সন্দেহ করেছিলেন তাঁর সামায়েলের হাব-ভাবে। পৃথিবী পর্যবেক্ষণে আসবার নাম করে একদিন তিনি চলে আসেন এখানে; সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তার আবিষ্কার, লুকিয়ে। সামায়েলের লোক বাবার ওপর নজর রাখা শুরু করেছিল।

তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এখানকার কোন মানবের হাতে তিনি সোপর্দ করবেন নিজের সম্পত্তি। এইভাবেই সঠিক পাত্র খুঁজতে খুঁজতে একদিন তিনি চলে আসেন এখানে, আপনাদের গ্রামে। দেখা পান একজন নিঃস্বার্থ ব্যক্তির, যার হাতে নিজের আবিষ্কার গচ্ছিত রেখে তিনি ফেরৎ চলে যান মহাকাশ কেন্দ্রে…”

একটু একটু গরম লাগতে শুরু করেছে বঙ্কিমবাবুর; বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে তার কপালে। শুকনো ঠোঁটটিকে একবার জিভ দিয়ে চেটে ধরা গলায় তিনি প্রশ্ন করলেন-

-“কে সেই ব্যক্তি?”

-“আপনার পিতা, শ্রী বঙ্কুবিহারী রায়!”

পুরো আধ মিনিট হাঁ করে বঙ্কিমবাবু তাকিয়ে রইলেন সমীরবাবুর দিকে। তারপর অতিকষ্টে ধীরে ধীরে বললেন-

-“আপনি বলতে চান…‘ক্রেনিয়াস’ গ্রহের ‘আং’…তিনি আপনার বাবা…তিনি আমার বাবাকে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার সোপর্দ করে পৃথিবীর বুক থেকে চলে যান…বাবা সেই মূল্যবান খোঁজটিকে নিয়ে সারাজীবন কাটান অথচ কেউ কিছু ঘূণাক্ষরেও জানতে…রসিকতার একটি সীমা আছে সমীরবাবু!!”

শেষ কথাটি যথেষ্ট জোরে বলেন বঙ্কিমবাবু; বোঝা যায় এই হঠাৎ-প্রসঙ্গ উথ্থাপনে যথেষ্ট বিরক্ত তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে অধৈর্য্যের মত মাথা নাড়েন সমীরবাবু, তারপর বলেন-

-“আপনি বোকার মত তর্ক করছেন, বঙ্কিমবাবু; খেয়াল করে দেখুন, আপনার বাবার মধ্যে স্বভাবগত কোন পরিবর্তন দেখেছিলেন কি আপনি?”

-“এইটুকুনি মনে আছে যে বাবা আমার মতই অত্যন্ত ঠাণ্ডা ও গোবেচারা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ একদিন রাতারাতি তাঁর মধ্যে এক বিরাট পরিবর্তন আসে; নিজ চরিত্রের স্বাভাবিক প্রতিবাদ-বিমুখতাকে কাটিয়ে উঠে তিনি আমাদের গ্রামের প্রতিবাদের মুখ হয়ে ওঠেন-”

-“এই যন্ত্রটির বিশেষত্বই হচ্ছে ধারক-কোষের সঙ্গে একটি সম্পর্ক সাধন করে শারীরবৃত্তীয় উৎসেচকগুলির ক্ষরণের মাত্রা রকমফের করা। এর ফলে ‘ভয়’ জিনিষটি আস্তে আস্তে চলে যায়, বঙ্কিমবাবু! আপনার বাবার ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল; অন্যায়ের প্রতিবাদী কন্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তিনি-”

-“তাঁর নিজের জীবনের বিনিময়ে!”- ক্ষুব্ধ গলায় বলে উঠলেন বঙ্কিমবাবু। খানিকক্ষণ সহানুভূতির দৃষ্টিতে চুপ করে তার দিকে তাকালেন সমীরবাবু, তারপর বললেন-

-“আমাদের কাজ আপনাদের পর্যবেক্ষণ করা, বঙ্কিমবাবু, কিন্তু আপনাদের নীতি নির্ধারণ করবার অনুমতি আমাদের নেই, দেওয়া হয় নি। যদি থাকত-”

বাকি বক্তব্যের নির্যাসটুকু নীরব থেকে বুঝিয়ে দিলেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা কাটিয়ে তারপর আবার বলা শুরু করলেন সমীরবাবু-

-“মহাকাশ-কেন্দ্রে ফেরৎ আসবার স্তম্ভিত হয়ে যান বাবা; দুই-একজন হাতে গোণা লোক বাদ দিয়ে আস্ত মহাকাশ-কেন্দ্রের সমস্ত কর্ম্মীরা তখন মৃত! এই সামায়েল মেরে রেখেছেন এদের; তার নারকীয় পরিকল্পনাকে বাস্তবরূপ দেওয়ার জন্যে। কিন্তু বাবার কাছ থেকে সেই যন্ত্র উদ্ধার যখন হল না, তখন তাঁকে প্রাণে না মেরে বন্দী বানান উনি। সৃষ্টিকর্তাদের সামনে এই ধোঁকার টাঁটি অবশ্য বেশিদিন চলে নি; মহাকাশ-কেন্দ্রটি হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে বুঝতে পেরে সাহায্য পাঠান ওঁনারা; কিন্তু চতুর সামায়েল এই আশু অভিযান বুঝতে পেরে বাবাকে নিয়ে পালিয়ে আসেন পৃথিবীতে। বাবাকে অত্যাচার করে উনি জানতে পারেন যে যন্ত্রটি উনি দান করেছিলেন পৃথিবীরই কোন অধিবাসীর কাছে, কিন্তু কে সেটা হয়তো বাবা বলেছেন অনেকদিন পর। সামায়েল প্রায় কুড়ি বছর পৃথিবীতে কাটান, পার্থিবদের সময়ের হিসেবে-”

-“তার মানে ‘তারা-খসা’ ব্যাপারটা…ওটা আপনি নন?”

-“আমি তিনমাস আগে এখানে এসে জাল পাতি, আপনারই প্রতিবেশী সেজে। আপনার গ্রামের অবস্থান-এর চুলচেরা হিসেব বাবা ফেরৎ যাওয়ার সময়তেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সৃষ্টিকর্তাদের কাছে, ফলে সঠিক জায়গা খুঁজে পেতে সামায়েলের কুড়ি বছর লাগলেও আমার বেশি সময় লাগে নি! তবে গোড়ার দিকে আমি জানতাম না আপনিই সেই উদ্দিষ্ট ব্যক্তি, পরে জানতে পারি। প্রথম দুই দিন আপনাকে নিরাপত্তা আমিই দিই, সামায়েলের পোষা কুমীরের হাত থেকে। নাহলে আপনার মজবুত বাড়ির নিরাপত্তা ভেদ করে আপনাকে হরণ করা ওদের পক্ষে অসম্ভব ছিল না!”

একটু চুপ করে থেকে বিষয়টি হজম করলেন বঙ্কিমবাবু, তারপর বললেন-

-“আচ্ছা, কি দেখে আপনি বুঝতে পারেন যে আমিই নির্দিষ্ট ব্যক্তি?”

একথায় সমীরবাবু চুপ করে তাকান বঙ্কিমবাবুর হাতের আংটির দিকে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে বঙ্কিমবাবুও নিজের আঙুলের অনামিকার আংটির দিকে তাকান; একটি হালকা নীলাভ দ্যূতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে সেই আংটি থেকে। একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক থেকে; আগেই বোঝা উচিৎ ছিল তার! এই আংটিটি বাবা তাকে নিজের হাতে পরিয়ে দেন, নিজের মৃত্যুর ঠিক আগের দিন-

-“কিন্তু একটা কথা-”- হঠাৎ একটি কথা মনে পড়ে যাওয়ায় প্রায় শীৎকার করে ওঠেন বঙ্কিমবাবু- “আপনি বলেছিলেন এই যন্ত্রটি পরে নিলে ‘ভয়’ জিনিষটি চলে যায়; কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তাহলে তা গেল না কেন? একে তো আমি পরে রয়েছি আজ প্রায় দশ বছরের বেশি সময় হতে চলল-”

-“এই ‘কেন’র কোন সঠিক উত্তর নেই, বঙ্কিমবাবু! উন্নত মস্তিষ্কের জটিলতার থেকে বেশি জটিল কোন যন্ত্র হতে পারে না। হয়তো আপনি প্রকৃতিগতভাবে অধিক ভীরু, অথবা আপনার বাবার মৃত্যু আপনার সাহসি সত্ত্বাকে নিস্তেজ করে রেখেছে। অথবা, আপোষ করাকেই আপনি বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন! মোদ্দা কথা, যে কোন কারণেই হোক এই যন্ত্র আপনার ক্ষেত্রে কোন ছাপ ফেলতে পারে নি।”

-“আর একটি কথা, সামায়েল বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ তুলে এনে কিসের পরীক্ষা করছিলেন?”

একথায় মুখ নামিয়ে একটু ভেবে নিলেন সমীরবাবু, তারপর বললেন-

-“বিষয়টি তদন্ত-সাপেক্ষ, চোখে কিছু না দেখলে বোঝা যাবে না; তবে আমার ধারণা উনি ওঁনার একটি সেনাদল গঠন করবার লক্ষ্যে নিজের এই নারকীয় পরীক্ষা সাধন করছিলেন; প্রাথমিক চোখে দেখে তো তাই মনে হয় তবে, মূল যন্ত্রটি হাতে না আসা অবধি উনি কোন বড় ধ্বংসের দিকে এগোতে চান নি। আমার আসতে দেরি হলে হয়তো উনি গোটা পৃথিবীর মানুষদের মেরে ফেলবার কোন উপায় খুঁজে নিতেন।”

-“আর এরা?”- এতক্ষণে সমীরবাবুর পিছনের দৃশ্য নজরে এসেছে বঙ্কিমবাবুর; সেখানে তখন হাতজোড় করে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে মহাকাশযানের রক্ষী ও আজ্ঞাবাহী প্রাণীগুলি; সেই বিকটদর্শন সরীসৃপের মত দ্বিপদবিশিষ্ট অদ্ভুত জন্তুর দল! একটু আগেই তাদের মারবার জন্য মুখিয়ে এসেছিল এরা; এখন তাদের শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাকই হয়ে গেলেন বঙ্কিমবাবু!

-“এরা আপনার নতুন প্রজা! সামায়েলের প্রত্যক্ষ মৃত্যু যেহেতু আপনার হাতে ঘটেছে, তাই এরা এখন আপনার কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছে! কি বঙ্কিমবাবু, রাজা হবেন নাকি?”

-“না, ধন্যবাদ!”- সমীরবাবুর বাড়ানো হাতের ওপর ভর করে আস্তে আস্তে উঠতে উঠতে বললেন বঙ্কিমবাবু- “আমার মনে হয়, এখন আমি বেশ কয়েকদিনের ছুটি নিতে চলেছি। একটা কাজ অবশ্য বাকি আছে! আমাকে আমার বাড়ি অবধি পৌঁছিয়ে দেবেন নাকি, সমীরবাবু?”

-“অবশ্যই। তার আগে, আপনার কাছে আমার একটি নিবেদন আছে-”

-“বলুন!”

-“এই মহাকাশ-যানেই বাবা আছেন, বন্দী অবস্থায়। তাঁকে মুক্ত করে এখানে আনতে বলেছি। আপনি একটু থেকে বাবার সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলে যাবেন কি?”


==============================================================


আঞ্চলিক পঞ্চায়েত সমিতির চেয়ারম্যান শ্রী কাশীনাথ টুডুর বাড়ির জলসা তখন প্রায় মধ্যগগনে; সভাঘর আলো করে একটি উঁচু তাকিয়ার ওপর বসে তিনি। খুব একটি শিক্ষিত নন তিনি; নামটুকু সই করতে পারাই তার একমাত্র শিক্ষা। দরকারও নেই শিক্ষার, অনেক কষ্ট করে তার বাবা কাস্ট-সার্টিফিকেটখানি করিয়ে নিয়েছিলেন; তারই আলোয় আলোকিত প্রথম জীবন, পরে ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মাটি তো ছিলই! ‘ওস্তাদের মার শেষ রাত্রে’-র চলমান নিদর্শন এই মাতব্বরটি দল পাল্টে পাল্টে আজ এই জায়গায়, তবে কি না-! নিন্দুকেরা অবশ্য বলেন তিনি প্রথম সারির ক্রিমিনাল, তবে এসব তুচ্ছ কথায় কোনদিনই বেশি কান দেন নি কাশীনাথবাবু।

-“ব্যাঁকাচাঁদ এখনও এল না কেন রে হেডম্যাস্টর?”- চোখ লাল করে পায়ের কাছে বসা স্নাতকোত্তর হেডস্যার নরহরিবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি। চোখ লালের কারণটি অবশ্য রাগ নয়, তার হাতে ধরা বিলিতি মদে পরিপূর্ণ পানপাত্রটি।

-“জানি না স্যার…কিছু তো আর বলে নি আমাকে…গতকাল তো বলল ‘আসব’; জানি না এত দেরি করছে কেন!”

-“হুমম্! আসুক ব্যাটা! আগের দিন তো দই মাথায় ঢেলেছিলাম, আজ একেবারে পচা ঘোল মাখাব! কি হে দিবাকর, ঘোল রেডি তো?”

-“তৈরি করে দরজার কাছে রেখে দিয়েছি স্যার; ও এলেই একেবারে-”- সাথে সাথে উত্তর ভেসে এল দিবাকরবাবুর কাছ থেকে; এই ধরণের স্থূল রসিকতার ব্যাপারে দিবাকরবাবুর উৎসাহ বরাবরই বেশি।

আলোচনার মোড় খুব শীঘ্রই অন্যদিকে ঘুরে গেল; বিষয় হিসেবে স্বাভাবিক নিয়মেই উঠে এল আজকের তাজা খবর- বেলমুড়ির জঙ্গলে ‘তারাখসা’ সংবাদ; ব্যাপারটা যদিও তিনদিনের পুরনো, তাও। কেউ এটিকে বলল গুজব, কেউ বলল উল্কাপিণ্ড; শিক্ষাবিদ মাতালদের দলের একাংশ জড়ানো গলায় বলে উঠল এটি বেঁটেদের রোগ ছড়ানোর কোন নতুন দাওয়াই- টিপ করে ইয়া বড় পাথর ছুঁড়ে মেরেছে আমাদের দিকে; কেউ বা বলল প্লেনের বা স্যাটেলাইটের ভাঙা টুকরো আছড়ে পরেছে পৃথিবীর বুকে! নানা বিষয় নিয়ে উঁচু গলায় সভা যখন সরগরম এমন সময়-

-“ওসব কিস্যু নয়; ওটি নিখাদ একটি বহির্বশ্বের প্রাণীর মহাকাশযান!”

বক্তাকে দেখা গেল খুব শান্ত গলায় কথাটি বলতে বলতে খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে, নিজস্ব মোবাইলখানি হাতে নিয়ে, একদম ফিটফাট বেশে।

-“আপনি এসেছেন তাহলে বঙ্কিমবাবু?”- জিজ্ঞাসা করলেন হেডস্যার নরহরিবাবু; তার আশা ছিল হয়তো বঙ্কিমবাবু আসবেন না। আসলে, তার স্কুলের একজন স্টাফকে প্রতিনিয়ত জনসমক্ষে হেনস্থা করা হোক- এই দৃশ্য বারংবার মন থেকে দেখা তার পছন্দ নয়, কিন্তু তার মানবিকতার সামনে বারংবার ‘দায়িত্ব’ শব্দটি চীনের প্রাচীরের মত এসে দাঁড়ায়। আর থাকতে পারলেন না তিনি; প্রশ্নটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এল বটে, কিন্তু উত্তর শোনবার অপেক্ষায় না থেকে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলেন তিনি। এর পরের দৃশ্যটি দেখবার কোন বাসনাই নেই তার।

যদিও চমকের অনেক কিছুই বাকি ছিল।

-“ব্যাঁকাচাঁদ নাকি! তা আসতে এত দেরি কেন? এর জন্য একটা শাস্তি তো তোকে পেতেই হবে! দিবাকর!!”

দিবাকরবাবু পচা ঘোলের হাঁড়ি নিয়ে তৈরিই ছিলেন; এবারে কর্তার হুকুম পেতেই সেটি নিয়ে বঙ্কিমবাবুর মাথায় ঢালতে যেতেই-

প্রথমেই গালে এক বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় পড়ল; তারপর পচা ঘোলের হাঁড়িটা বসে পড়া দিবাকরবাবুর মাথায় সম্পূর্ণ উপুড় করে দিয়ে বাঁ হাত দিয়ে তার জামার কলার ধরে এক হ্যাঁচকা টানে তাকে দাঁড় করিয়ে দিলেন বঙ্কিমবাবু। তারপর একইরকম শান্ত গলায় বললেন-

-“আপনার সাবজেক্ট ফিজিক্যাল সায়েন্সের পঞ্চাশটি পরীক্ষার খাতা এখনও আমার কাছে পড়ে রয়েছে। ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে আমি ছাত্রদের নাম্বার দিতে ভুল করতেই পারি, একই ক্লাসের পঞ্চাশজন ছাত্র ফিজিক্যাল সায়েন্সে ফেল করতেই পারে; কিন্তু তাদের গার্জেনরা, আর স্কুল শিক্ষা পর্ষদ ‘আপনার’ এই ভুলটিকে ক্ষমা করবেন তো, দিবাকরবাবু?”

থাপ্পড় আর পচা ঘোল- যুগপৎ খেয়ে তখনও বনবন করে মাথা ঘুরছিল দিবাকরবাবুর; কথা শেষে বঙ্কিমবাবু তার জামার কলার ছেড়ে দিতেই এখন ধপ করে তিনি বসে পড়লেন মাটিতে, কোন কথা না বাড়িয়ে।

-“আপনি কি থ্রে-থ্রেট দিচ্ছেন নাকি মশাই?”- অবাক চোখে বঙ্কিমবাবুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটি করলেন কাশীনাথবাবু। তার মদের নেশা ছুটে গিয়েছে, বিষ্ময়ে!

-“একেবারে ‘আপনি’! যাক, তাও ভালো। শুনুন, বিগত দশমিনিট বাবদ আমি আপনার এই ‘স্কুল পরিচালন সমিতির মিটিং’ লাইভ করেছি ফেসবুকে, অনেকেই দেখেছেন আপনার মিটিং-এর বিষয়বস্তু। উপরন্তু, স্কুল পরিচালন সমিতির কয়েকজনকে লিঙ্ক পাঠিয়েও দেওয়া হয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ, এইবারে আমি কিন্তু থ্রেট দিলাম কাশীনাথবাবু!”

এতক্ষণ হাঁ হয়ে বঙ্কিমবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছিলেন কাশীনাথবাবু। এবার তার বক্তব্য শেষ হতেই গর্জ্জে উঠলেন তিনি-

-“বটে! এত বড় সাহস তোর? আমার বুকে বসে আমারই দাড়ি ওপড়ানো? তোর এই কীর্তির ফল ভালো হবে না; কালকে সকালেই তোর ব্যবস্থা করছি দাঁড়া! ঐ স্কুল থেকে গলাধাক্কা দিয়ে যদি না তোকে বের করি-”

কথাবার্তার মাঝখানে একটি ফোন এল কাশীনাথবাবুর দামী মোবাইলে। প্রথমে কিছুক্ষণ কথাবার্তা শুনলেন তিনি, মোবাইলটিকে কানে চেপে। তারপর কথা শেষ হতে ফোনটি নামিয়ে সব ফেলে-টেলে তিনি ঢুকে গেলেন ঘরের ভিতর; কাউকে কিছু না বলেই। এবারে সকলে ঘুরে তাকালেন বঙ্কিমবাবুর দিকে, প্রশ্নমাখা চোখে।


-“আপনাদের সকলকে শুভরাত্রি। দিবাকরবাবু, শোওয়ার আগে ভালো করে চান করে নেবেন। হেমন্তকাল; ঠাণ্ডা লাগিয়ে বসবেন না যেন!”

বাইরে বেরিয়ে এসে নিজের ডানহাতের অনামিকার দিকে একবার তাকালেন বঙ্কিমবাবু; আঙুলটা এখন ফাঁকা, কিছু নেই সেখানে। আঙটিটা তার মূল্যবান পাথরসমেত এখন ‘আং’-এর কাছে। যে আবিষ্কার তার জন্মলগ্ন থেকেই অমঙ্গল ডেকে আনে, তা রেখে দেওয়াটা আর যুক্তিযুক্ত মনে করছেন না তিনি। আং নিয়ে নিয়েছেন ওটা। আর এর পরিবর্তে দিয়েছেন এক অমূল্য উপলব্ধি- মনুষ্যত্ব! বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছিল এই বহির্বিশ্বের প্রাণীটির, পার্থিবও নন তিনি; কিন্তু মানবিকতার সারাংশটি যেভাবে অল্প সময়ের ব্যবধানে তুলে ধরলেন বঙ্কিমবাবুর সামনে, তা অভিনব! এক অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছিল তার, ‘আং’-এর মধ্যে নিজের ‘মৃত’ বাবাকে খুঁজে পেয়ে। যাওয়ার সময় তার মাথায় হাত দিয়ে ঠিক যেন বাবার মতই আশীর্বাদ করে গেলেন তিনি!

চলতে চলতে মাথার ওপর খোলা, অন্ধকার আকাশের দিকে তাকালেন বঙ্কিমবাবু। ঐ তো কালপুরুষ, তার কোমরবন্ধনী সমেত! আর ঐ যে, সপ্তর্ষি মণ্ডল! কি যেন নাম ঐ সাতজন ঋষির? অত্রি, অঙ্গি, পুলহ, পুলস্ত্য, ক্রেতু, বশিষ্ঠ, মরিচি- তাই তো? যাই হোক, আজকে রাত্রের আকাশ যেন অগুন্তি তারকাখচিত। কত তারা তাদের নিজেদের ছায়াপথে, সেই তারাদের ঘিরে কতশত গ্রহ! কিছু গ্রহ নিশ্চই আছে, যা কিনা পৃথিবীর মতই! আচ্ছা, সেই গ্রহে কি ‘মানুষ’ আছে? তাদেরও নিয়মকানুন কি পৃথিবীর সমাজব্যবস্থার মতই? না হলেই ভাল!


অন্ধকারের মধ্যে দ্রুত এগিয়ে চললেন বঙ্কিমবাবু, বাড়ির পথে। দূরের আকাশে কোথায় যেন আবার একটি তারা খসল…



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics