Apurba Kr Chakrabarty

Horror Tragedy Crime

4.0  

Apurba Kr Chakrabarty

Horror Tragedy Crime

কুমারী মা (২য় পর্ব )

কুমারী মা (২য় পর্ব )

10 mins
201


রায়পাড়ার দূর্গা মন্ডবটা পাঁচ বছর আগেই তৈরী হয়েছিল। এগ্রামে যতগুলো দূর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়, সবই পারিবারিক, তাই রায় পাড়ার সম্পন্ন সচ্ছল চাষী দূর্গাদাস রায়ের উদ্যোগে এই দূর্গামন্ডব তৈরী হয়েছিল। তারই জায়গা ও সিংহ ভাগ তার আর্থিক মদতছিল। এখনকার দিনে আর নতুন করে পারিবারিক দূর্গাপূজা সূচনা তেমন কেউ প্রায় করে না।সেই আভিজাত্যের অহংকার এখন অচল বরং বারোয়ারী পূজা চালু করে পরিচালক কমিটিতে কর্মকর্তা ও পৃষ্ঠপোষক হলে এলাকায় প্রভাব বাড়ে। জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায়।

দূর্গাদাস তখন নতুন বামপন্থী ভাবনায় টগবগে ঘোড়া।আদর্শগত না ক্ষমতার মোহ সেটা ভিন্ন প্রশ্ন তবে রাজ্যে নামী দামী সব গন্যমান্য বামনেতাদের তার বাড়ীতে যাতায়াত। বনেদী সচ্ছল কৃষক পরিবারের মানুষ, অনেক জমি, আর পড়াশোনা গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন না করতে পারলেও, কলকাতায় তিন বছর থেকে একটা বাম রাজনীতি সংস্পর্শে এসেছিল ,তৎকালীন কিছু শীর্ষ নেতার পরিচিত ছিল।

গ্রামে তথাকথিত পিছিয়ে পড়া অশিক্ষিত গরীব ক্ষেত মজুর, দুলে বাগ্দি মুচি মানুষদের বড় সংখ্যক এ গ্রামে বাস। তাদেরকেই মুল লক্ষ্য। বড় বড় সব রাজ্যের বাম নেতা।একনামে রাজ্যে সে সময়ে সবাই চিনত। গ্রামে আসে,দুর্গাদাসের বাড়িতে মিনিং হয়।গরীব অশিক্ষিত ক্ষেত মজুর বাগ্দী দুলে পরিবারে তাদের জীর্ণ ভাঙ্গা কুঁড়েতে রাজ্যের গন্যমান্য গরীব দরদী নেতারা আলো করে যায়। একসাথে তাদের সঙ্গেই মাটির মেঝেতে বসে মোটা চালের ভাত, গুগলীর ঝাল,আর চুনোপুটি মাছের টক দিয়ে অন্ন খেতো।

গরীব অশিক্ষিত ক্ষেত মজুর ঘরের শীর্ন রুগ্ন শিশু ও বাচ্চাদের কোলে তুলে কত আদর করত!আবার কোন বাচ্চার নাকের সর্দি বের হলে পরম যত্নে কলকাতার বাবু নেতারা নিজের হাত দিয়ে বা তাদের পরিচ্ছন্ন  রুমালে তা মুছিয়ে দিতো।যেন অনেকটাই "আমি তোমাদেরই লোক " আবেগঘন দরদী বার্তা।মোট কথা গরীব সরল মূর্খ মানুষের মধ্যে নিজেদের গরীব দরদী একটা ভাবমূর্তি তৈরী ও গ্রহনযোগ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের দলের স্থায়ী ভোট ব্যাংক তৈরী করার একটা সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা।

দূর্গাদাস বামপন্থী হলেও ধার্মিক না ভন্ড ধার্মিক সেটা বড় প্রশ্ন নয় ,তবে পাড়ার সাধারণ মানুষের কাছেও শারদীয়া দূর্গার প্রতিমা এনে পূজার আয়োজন করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা তার বাসনা। সেই সঙ্গেই গ্রামের যতসব বনেদী অহংকারী পারিবারিক দূর্গা পূজো হয়, ঐ সব বাড়িতে হীনমনত্যা নিয়ে তার স্ত্রী কন্যাদের যাতে যেতে না হয়,তার সুষ্ঠ সম্মানজনক ব্যবস্থা করা তার লক্ষ্য। বারোয়ারী হলেও তার আর্থিক মদত বেশী থাকত। নিজের বাড়ির পূজার মতই একটা গর্ব দাপট নিয়ে পূজো কদিন আনন্দ করত, তার বাড়ির মানুষ জন। এটাই তার উদ্দেশ্য।

হয়েছিলও তাই,রায় পাড়ার বারোয়ারী পুজোর নতুন সংযোজন কুমারী পূজা। গ্রামে কোন পারিবারিক পূজা এই প্রথা ছিল না। দুর্গাদাসের বড় মেয়ের বয়স তখন এগার বছরের, কুমারী করা হল, মায়ের লালপেড়ে গরদের শাড়ি ফুলের মালা চন্দনে টিপ দিয়ে মুখমন্ডল কপাল সাজিয়ে অষ্টমীর তিথিতে দূর্গা মঞ্চে তোলা হয়েছিল। মিতালী কুমারী বেশে মা দূর্গার এক জীবন্ত সত্তায় পূজা পাবে, কিন্তু ওর ধারনা তাকে বলি দেওয়া হবে।মা বাবা গোপন করছে, ভয়ে নার্ভাস হয়ে সমানে কাঁদছিল। কেউ তার মনে এই ভয় জেনে বা না জেনে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।

বামুন ঠাকুর অনেক বুঝিয়ে তার কান্না থামালেও মুখ চোখে আতঙ্ক ভাবছিল। সেসময় এত মিডিয়া ছিল না।কূমারী পুজো বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের বহুদিনের প্রথা হলেও এত প্রচার ছিল না। এ গ্রামে এই কুমারী পূজা কেউ আগে জানত না।পুজোর পর মিতালী যখন বেঁচে বাড়ি এল,খুব আনন্দ, হাসি মুখে আবার পরের বছর কুমারী হবে মাকে আবদার করে।তবে পর বছর সে ঋতুময়ী হয়েছিল , পুজোর কিছু দিন আগেই। এবার তার মেঝ বোনের পালা।

মিতালী কুমারী হয়ে মা দূর্গার এক ভিন্ন রূপী নারী শক্তির পূজা ও সম্মান তাকে ভীষণ খুশী করেছিল। দেবী দূর্গার বড় ভক্ত হয়ে ওঠে , আবার আত্মগর্বিত ছিল,অবোধ কিশোরী মনে আবেগবশত দেবীর অংশ ভাবত ।পাড়ার সব মেয়ে বৌ দূর্গা মন্ডবে সারা বছর খড়বাঁশের কাঠামোকে দেবী কল্পনা করে নিত্য সন্ধ্যায় ধূপ ধুনো প্রদীপ জ্বালিয়ে ভুমিষ্ঠ হয়ে প্রনাম করত ।মিতালী শুদ্ধ কাপড় পরে সেই এগার বারো বছর থেকেই দূর্গার মন্ডবে ধূপ ধুনো প্রদীপ জ্বালিয়ে নিষ্ঠা ভরে নিত্য সন্ধ্যায় প্রনাম করে যেত।

বছরের পাঁচ ছদিন মাত্র মহা ধূমধামে দেবী দূর্গার পুজো ।বাদ বাকী সময়,দূর্গামন্ডবের সামনে প্রশস্ত বারেন্দায় গ্রামের পান্নালাল মাস্টার ছোট ছেলে ও মেয়েদের নিত্য সকালে টিউশন পড়াত। সন্ধ্যার পর পাড়ার উঠতি যুবক ছেলেরা ক্যারাম খেলত।বড়োরা, তাস দাবা খেলত। দশটার পর সব ফাঁকা হয়ে যেত। দূর্গাদাসের বাড়ির প্রায় সংলগ্ন, এই দূর্গামন্ডব, তার বাড়ির এতরাতে যাতে হৈহুল্লোরে অসুবিধা না হয় তাই এই সতর্কতা ও সমীহ।

দুর্গাদাসের তিন দিদির অনেক আগেই বিয়ে হয়েছিল। ছোট বোনের চেয়েও সে তিন বছরের বড়। বোনের বয়স যখন আঠারো ,দুর্গাদাসের বাবা মেয়ের বিয়ে দিল,একটু দুর গ্রামে বেশ ধনী পরিবারে অনেক জমি সম্পত্তি ছিল।আর তার আট মাস পর দূর্গাদাসের বোন মালতীর স্বামী বর্ষার চাষের সময় ক্ষেত আলে এক বিষধর কেউটের কাল দংশনে মারা গেল। মালতীর তখন ছসাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা দশা ,এত কম কিশোরী বয়সেই বিধবা হয়ে, মালতী তার বাবার বাড়ির ফিরে এসেছিল।বিধবা মলতী কমাস পর এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। দুর্গাদাসের বাবা এর কিছুদিন পরেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। দুর্গাদাসের মাথায় সমস্ত এবার সংসারের সব দায় এসে পড়ল।

কলকাতা ছেড়ে গ্রামে ফিরল। সে রাজনীতি করবে দেশে বিপ্লব আনবে ! না বিধবা মা,বিধবা বোন,বাপ হারা ভাগনাকে দেখভাল করবে! আবার তার পৈতৃক সম্পত্তির জমির রক্ষা চাষআবাদ তো করতেই হবে !এটাই তো তাদের মুল আয়ের উৎস।

দূর্গাদাস গ্রামের এলেও এমন যুবা রসাল ধনী গ্রামের এক কর্মীকে কলকাতার বাম নেতারা ছাড়েনি।আবার দুর্গাদাসেরও তখন মগোজ ধোলাই হয়েছিল,সঙ্গে তার রাজনৈতিক উচ্চ আকাঙ্খা স্বপ্ন।তাই গ্রামের নিষ্ঠাবান কর্মী হিসাবে বাম আন্দোলনের সে অন্যতম কর্ণধার ভাবত। একদিন তাদের এই দল সমস্ত ভারত দখল করবে স্বপ্ন দেখত। চীনে তখন সত্য মিথ্যা যাইহোক সবে সর্বহারাদের রাষ্ট্র । তখন সদ্য এক বছর দেশ স্বাধীন হয়েছিল। এ আজাদী ঝুটা হ্যায়! বাম তথা কমিউনিস্টদের বীজমন্ত্র, পাকিস্তানের উগ্র সমর্থন।

বিধবা মা,বিধবা বোন আর ভাগনা নিয়ে তার রীতিমত সংসার।দূর্গাদাস ভাগনা বিলাসকে নিজের সন্তানের মতই ভাবে। বোনের শ্বশুরের গ্রামের তার মৃত স্বামীর জমিজমা বিধবা স্ত্রী সন্তানের অধিকার ছিল।শ্বশুরের মৃত্যুর পরে দুই দেওর তখন বিবাহিত। জমি সম্পত্তির ভাগ যদি হাত ছাড়া হয়। সেই ভয়েই দুর্গাদাসের বোন মালতী শ্বশুর বাড়ি ফিরে যায়। বিলাস তখন মাত্র সাত বছরের। 

দুর্গাদাসের তখনও বিয়ে হয়নি।এতদিন পর তার যেন দ্বায়িত্ববোধ কমল। মা আর অপেক্ষা করেনি, ছেলের বিয়ে দিল। বিধবা বোনের দাদা ও বাপ মরা ভাগনার মামা হিসাবে তার দ্বায়িত্ববোধ তখনও ছিল। বোনের শ্বশুর বাড়িতে চাষআবাদ জন্য বছর দুবার পনের দিন করে থাকত।দুর্গাদাসের মানসিকতা ছিল দ্বিচারিতায় ভরা।

বামপন্থী কিন্ত সংস্কারাছন্ন।পর পর চার কন্যা সন্তান, তাকে আরও ভাগনাকে কাছে টেনেছিল। বাল্যকাল থেকেই কোলে পিঠে করে ভাগনাকে মানুষ করেছিল, বোনের একমাত্র স্বপ্ন,বাপ মরা ভাগনা কে নিজের মেয়েদের চেয়েও যেন বেশী ভালবাসত। রগচটা সবজান্তা,বামপন্থী দুর্গাদাস ছিল তীব্র পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার, কন্যা সন্তানদের প্রতি কেমন দুরত্ব দায়হীন।স্ত্রীর কথা শোনা বা তার সাথে পরামর্শ তার দায় ছিল না।মেয়েদের কী আদর সোহাগ করত কে জানে,কড়া শাষনে রাখত।

ছয়ের দশকের শেষ তখন দূর্গাদাস একজন বড় বাম নেতা। এগার ফ্রন্ট, চৌদ্দ ফ্রন্ট কত সব গালভরা সরকারের বামেরা ছিল অংশীদার। সে অনেক মস্তানী বজ্জাতি করেছিল। আর একাত্তরের পর কংগ্রেসের আমলে মস্তান বাহিনীর হাতে মার খাওয়ার ভয়ে তাই দূর্গাদাস অনেকদিন গ্রাম থেকে আত্মগোপন করেছিল, কুখ্যাত বর্ধমান সাঁই বাড়ির হত্যাকাণ্ডের তার নামও যে জড়িয়েছিল! একটা ভয় তো থাকবেই। তার সুবিধা হল

গ্রামের সে সময়ের ত্রাস,যে বিশটা কংগ্রেস যুবা মস্তান ছিল, তাদের লিডার দুর্গাদাসের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠ এক জ্ঞাতি, তাকে ধরাধরি করে ,অনেক টাকার রফা করে দূর্গাদাস গ্রামে ফিরল।

কংগ্রেসের সেই জমানায় মস্তানেরা কেউ বিদ্যুত দপ্তরে,

কেউ হাসপাতাল, কেউ ভূমি দপ্তরে, কেউ বা স্কুলের শিক্ষক ,ক্লাকের কাজ পেলো।কেউ এম আর ডিলার হল। তারা সংসারী হয়ে মস্তানি কমাল।আর ছাগলের তিন নম্বর সন্তানের মত অজমূর্খ কজন তখনও গ্রামের মস্তান। লোকের পুকুরে রাতে মাছ চুরি,অন্যের বাড়ির গাছে বাতাবি লেবু থেকে নারকেল ডাব,চুরি করলেও অভিযোগ করা যেত না।

পথেঘাটে মারধর করে তারা বীরত্ব ফলাত,বামপন্থীদের কেন পুরোন কংগ্রেসী বুড়োগুলোও হেনস্থার শিকার হতো। কিশোরী ও সদ্য যুবতী গ্রামের মেয়েদেরই কেউ কেউ মন্তান ভীতি প্রদর্শন,যৌন উৎপীড়ন নানা ভাবে মানসিক শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে নিজেদের বীরত্ব ফলাত।স্কুল তাদের লক্ষ্য, বাচ্চা ছেলে মেয়েদের নিয়ে মিছিল করবে। ভাদ্রমাসের গরম। গ্রামের রাস্তা তখন কাদার পায়েস,এঁটেল মাটির কাদা যেন চিটে গুড়ের মত টান।

এমন ভাবে কচিকাচা স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে মিছিলে হাঁটানো সেই বাম আন্দোলনের অস্ত্র, এগার ফ্রন্ট,চৌদ্দ ফ্রন্টের আমলে দূর্গাদাসরা ভাবত বাচ্চাদের মিছিলে হাঁটিয়ে,"ছিনিয়ে নিয়ে বিলিয়ে দাও","দুনিয়ার মজদুর এক হও," " টাটা বিড়লার কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও" "ইনকিলাব জিন্দাবাদ "এমন সব শত শত রক্ত গরম করা হিংসা ঘৃনা দ্বেষমুলক স্লোগান দিয়ে মিছিলে হাঁটালেই বালক বালিকা সুবোধ ছাত্র ছাত্রীদের বাম আন্দোলনের সামিল করা যাবে, স্বপ্ন দেখতো। আর মাঝে মধ্যেই হরতাল ডেকে শ্রমিক সংগঠন ও কর্মীদের বিনা শ্রমে একদিন বেতনের ব্যবস্থা, আর চাকুরী দাতা মালিকই প্রধান শোষক ও তাদের যত বঞ্চনার কারন, ওরাই দেশ তথা সমাজের শ্রেনীশত্রু বুঝিয়ে, তাদের কারখানা অচল করা ,কারখানা বন্ধ করে অন্য রাজ্যে পালাতে বাধ্য করা ,শিল্প শ্রমিকদের ক্ষমতা উপলব্ধ করিয়ে তাদের জয়ী দেখানো,সঙ্গে ক্ষুব্ধ দিশাহীন বেকারত্ব দারিদ্র্য ভরা সমাজ তৈরির মাধ্যমে দলে টানা ও শিল্প মহল এলাকায় ভোট ব্যাংক তৈরীর তাদের সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল।

এ গ্রামের বিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রী পীড়নে ক্ষমতা প্রদর্শন সেই নীতি কংগ্রেসের মস্তানেরা গ্রহন করে। কজন গ্রামের স্কুলের গোঁড়া বামপন্থী মাষ্টার বাচ্চা ছাত্রীদের নিয়ে কংগ্রেসের এই মিছিলের তারা বিরোধ করেছিল।অবোধ নিরীহ কম বয়সের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে মিছিল কিন্তু হয়েছিল গায়ের জোর ক্ষমতার দর্পে। মিছিলের পর, এবার মস্তান বাহিনীর মুল টার্গেট ঐ সব বেয়ারা চীনের দালাল বামপন্থী শিক্ষক গুলোকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। এক গ্রামেরই গোঁড়া বামপন্থী মাষ্টারকে মিছিল শেষে ঐ দিনই মস্তানরা বিকালেই তার বাড়ি থেকে ডেকে এনে খুব মেরেছিল। যারা এক সময়ের তারই স্কুলের সব ছাত্র। রোগাপাতলা মদনা মাষ্টারকে ভীষণ হেনস্থা করে, তুলে তুলে বার বার তাকে আছাড় মেরেছিল। কোমরে ব্যাথা আর লজ্জার কারনে গ্রাম ছেড়ে শহরের নার্সিংহোমে পরদিন ভর্তি হয়েছিল।

পরদিন স্কুলের অন্য গোঁড়া বামপন্থী তিন চার জন শিক্ষক, যারা বর্ধমান থেকে যাতায়াত করত তাদের রামধোলাই হবে ,এই সিদ্ধান্ত জানতে পেরে,আর স্কুলে মস্তানদের এক এক করে আসতে দেখে, ঐ চার জন শিক্ষক শিক্ষিকা স্কুল ছেড়েই ভরদুপুরে ,ভাদোরের গরমে মাঠে মাঠে ধান ক্ষেতের আল দিয়ে প্রাণপণ ছুটতে লাগল। স্কুলের উত্তরে বাস রাস্তা, উল্টোদিকে দক্ষিণে বিস্তীর্ণ ধানের ক্ষেত। ভাদ্রমাসে তীব্র রোদ ধানের সবুজের ক্ষেত,আলে ঘন ঘাস জঙ্গল পরিপূর্ণ। বাসস্ট্যান্ডে ঐ সব বেয়ারা শিক্ষক এলেই ধরে প্রহার চলবে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছিল।চারজনের মধ্যে একজন আবার শিক্ষিকা ছসাত মাসের গর্ভবতী,এতবড় পেট। ঐ অবস্থায় সরু আল দিয়ে ধানের গাছ টপকে ছুটছে। ঘাস জঙ্গল ভরা আলে সাপও থাকে।পা গর্তে পড়ছিল, এমন বিপদ সঙ্কুল পথে ছোটা তার অভ্যাস নেই।শহুরে মানুষ ।

পিছনে মস্তানদের চিৎকার ও দৌড়ানো দেখে সেই শিক্ষিকা দু একবার মাঠের ধান জমিতে পড়ল,আবার উঠে ছুট।মস্তানরা ধরে প্রহার করতে পারত,তবে উঠতি যুবক এটাকে মজা হিসাবেই দেখছিল। অনেকক্ষন পর গ্রামের স্কুলের ঐ চারজন গোঁড়া কমিউনিস্ট শিক্ষক শিক্ষিকাদের এভাবে কুকুর ছোটানো করে তারা ক্ষ্যান্ত হয়। সঙ্গে চিৎকার করে অশ্লীল অশ্রাব্য গালাগাল ও হুমকি দিচ্ছিল ,স্কুল এলেই লাশ পড়বে।

বাম জামানা এলে তবে তারা স্কুল আসতে পেরেছিল। দীর্ঘ কবছর তাদের বেতন ঘরে বসে থাকার শর্তেও বকেয়া বেতন ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়।ওরা সব নাকী রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। বাম সরকার তাদের প্রতি বড় উদারতা দেখিয়েছিল। মদন বাবু এ গ্রামেরই মানুষ,তাই মারধর খেয়ে মস্তানদের ক্ষমা পেয়ে স্কুলে অবশ্য যাবার ছাড় পেয়েছিল,একমাস পরেই।

ভিতরে ভিতরে বামপন্থী দূর্গাদাস কিন্তু গ্রামে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াল।টাকার নাকি ভুত নাচে,মস্তান তো কোন ছাড়। এই সত্যটা দূর্গাদাস রায়ের তখন জানা হয়ে গিয়েছিল।গ্রামের স্কুলে সেক্রেটারীকে টাকা খাইয়ে ভাগনা বিএ বাংলা অনার্স,মাষ্টারী ঢুকাল।তখন চব্বিশ বছরের তাজা যুবা আবার মামার বাড়ি আদরে থাকত।শনিবার মায়ের কাছে যেত, আর সোমবার ফিরত।

মামাতুতো তার চার বোন, বড় দশমশ্রেণির ছাত্রী পনের বছরের মিতালীর তখন ভরাযৌবন আকর্ষণী স্বাস্থ্যবতী ভারী সুন্দরী, মেঝ অষ্টম শ্রেণীতে, সেজ যষ্ঠ আর ছোট চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। পিসতুতো দাদা বিলাস তখন গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। তার কাছে ওরা পড়াশোনার করত। বিলাস কিন্তু বোনদের ছাড়া বাইরের কোন ছাত্র ছাত্রীদের প্রাইভেট টিউশন পড়াত না।

দশম শ্রেণির ছাত্রী বড়বোনের উপর বিলাসের একটা দুর্বলতা ছিল , আবার শিক্ষক হিসাবে তার একটা দ্বায়িত্ববোধও ছিল। একাদশ শ্রেণিতে তখন ফাইনাল পরীক্ষা হত। মিতালী তখন দশম শ্রেণীর আর্টসের ছাত্রী। বাংলা ছাড়াও ইতিহাস দর্শন ইংরাজি আর রাষ্ট্র বিজ্ঞান সব বিষয়ে পড়াতে পড়াতে রাত হত। মিতালী তাই একা একাই যুবক আপন পিসতুতো দাদার কাছে পড়ত।পিসতুতো দাদা ও মামাতুতো বোন দিনের পর দিন এই ভাবেই নির্জন পরিবেশে পড়াশোনার ফাঁকে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছিল।

দুর্গাদাসের তখন দেশের কথা ভাবে,কত বড় দ্বায়িত্ব তার!খুব গোপন সব মিটিং হয়, দেশ উদ্ধার করতেই হবে। চীন ভিয়েতনাম আর কিউবা!তখন ওদের স্বপ্ন। নিকায়াগুয়ে ভেনিজুয়েলার সব কথাই তাদের মুখস্থ।বিশ্ব পরিস্থিতি,জাতীয় পরিস্থিতি, আর রাজ্য পরিস্থিতি আর এই সব দুর্দশা নিয়ে তাদের চোখে ঘুম নেই।তাদের চলন বলন কথাবার্তা এমন পন্ডিত্যভাব আর চরম আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠত, তারাই সবজান্তা জ্ঞানী! বাকী সব নির্বোধ পথভ্রষ্ট বিপথগামী,মূর্খ। হোক না শিক্ষিত!পাক না সরকারি বড় বড় সব পদ,ডাক্তার বা অধ্যাপক, পাক না সামাজিক সম্মান, তাদের দলে না এলেই ওরা সব শ্রেণী শত্রু।

পাশের বাংলাদেশের খবর রাখে না।কেন এত উদ্বাস্তুর ঢেউ ভারত আর এরাজ্যে আসতে বাধ্য হচ্ছে! এসব আলোচনা তাদের চেতনা বিরোধী।ওসব সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা। নিজের চল্লিশ পঞ্চাশ বিঘা জমি।ভাগনার অনেক সম্পত্তি তবু ভাগনাকে স্কুলের শিক্ষক চাকরীতে ঢোকাল।এসব মোটেও সুবিধাবাদী নীতি নয় সর্বহারার সংগ্রাম! যদিও তখন শিক্ষকদের বেতন কম, তেমন লোভনীয় চাকরী নয়, আর নিয়োগ মামা কাকা শ্বশুর বা পাটির সুপারিশ ধরে বেশীরভাগ হত। টাকাও মোটা রকম বেশীরভাগ ক্ষেত্রে লাগত। সরকারী খোদ চাকরীও এম এল এ,মন্ত্রীর কোঠায় বেশী ভাগ হতো।

বামপন্থী দুর্গাদাসের নীতি ছিল ধান্ধাবাজী আর নিজ স্বার্থ,স্বজন পোষন।মা তখন মারা গেছেন। স্ত্রী আর চার কন্যা ,আবার প্রানের ভাগনা কর্মস্থল এ গ্রামে তাই মামার গৃহে অস্থায়ীভাবে থাকত। বিশ্ব পরিস্থিতির এত বড় চিন্তক বাড়ির পরিস্থিতি জানা তার দরকার ছিল না।স্ত্রী বাড়ির কাজ কর্ম আর ধর্ম কর্ম নিয়েই ব্যস্ত। সবাইকে আপন মনে বিশ্বাস করা তার স্বভাব ছিল।

দুর্গাদাসের সাধের বারোয়ারি দূর্গা পূজা গ্রামে প্রথম। নিজের জায়গায় সিংহভাগ আর্থিক মদতে দূর্গামন্ডব তৈরী করলেও তেমন পূজার সময়ও অংশ নিত না। আর্থিক সাহায্য করত। তার স্ত্রী কন্যাদের সক্রিয় অংশ গ্রহণ থাকত। দুর্গাদাসের দেবী দূর্গার প্রতি আস্থা বা আস্থিকতা ছিলনা ,নিজের পাড়ায় তার প্রতিপত্তি আর রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির কৌশল কীনা বোঝা যেত না।

পান্নালালে মাস্টারের এক ছাত্রী, কবিতা খুব সকাল সকাল তার টিউশন আসার ঝোঁক।পড়াশোনার খুব আগ্রহ। দূর্গা মন্ডবের সামনে প্রশস্ত বারান্দায় সকল ছাত্র ছাত্রী টিউশন পড়তে নিজের নিজের পাটের বস্তা বা শতরঞ্জি দূর্গামঞ্চের বারেন্দায় পেতে পড়াশোনা করত। গম্ভীর পান্নালাল মাস্টার সদা লাঠি হাতে,কড়া ধাতের মাষ্টার।এদিন সকালে দূর্গা মায়ের বাঁশখড়ের কাঠামোর পিছনে খুব সকালেই কবিতার চোখে এক মৃত শরীর ঝুলতে দেখা মাত্রই সে ভয়ে চিৎকার আর কান্না কাটি করছিল ,পাড়ার মানুষজন সবাই হাজির হয়েছিল।

সবাই বিষ্ময় আর দুঃখে হতবাক,দূর্গাদাসের বড়কন্যার দেহ ঝুলছে, তার পা মাটিতে ঠেকে। দূর্গাদাসের কোন হদিশ ছিল না। মিতালীর মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল, মাঝে মাঝেই মুর্ছা যাচ্ছিল। মিতালীর তিন ছোট বোন দিদির এই মৃত্যুতে যত না দুঃখ, ভয়ে বলির পাঁঠার মত মুখে চোখে আতঙ্ক, থর থর করে কাঁপছিল।

পুলিশ এল,মৃতদেহ দেখে তাদের অনুমান মিতালীকে খুন করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।কবিতা এই মৃতদেহ সবার প্রথমে দেখেছিল, হোক না সে নবছরের বালিকা পুলিশ তাকে জেরা করে করে জেরবার করেছিল।


 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror