কুহু ও একটি তারার গল্প
কুহু ও একটি তারার গল্প
আমি কুহু, তোমরা আমায় চেনো না। চিনবেই বা কি করে? আমি তো এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাই না। আমি তোমাদের মতো স্কুলেও পড়ি না। আজ তেরো বছর ধরে আমি এই ঘরটাতেই শুয়ে থাকি। আমার ঘরটা গোলাপী রঙের, আর জানালার পর্দা গুলোয় কি সুন্দর সব কার্টুন আঁকা। ঘরের ছাদে বাবাই কি সুন্দর সব চাঁদ আর তারার স্টিকার লাগিয়ে দিয়েছিল, ওগুলো অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। আমি তো রাতের আকাশ দেখতে পাই না এই ঘর থেকে। তাই বাবাই এটা করেছিল।
'করেছিল'.... বাবাই না খুব ভাল ছিল। আমায় হুইল চেয়ারে বসিয়ে বাগানে ঘুরাতো। কোলে করে একদিন ছাদে নিয়ে গেছিল। কত গল্প বলত। গান শোনাতো। মজার মজার কার্টুন দেখাতো। বাবাই আর নেই। মাম্মা বলে বাবাই নাকি আকাশের তারা হয়ে গেছে।
শেষ যে দিন বাবাই আমার ঘরে এসেছিল, আমার দিনটা এখনো মনে আছে। সেদিন ছিল আমার এগারো বছরের জন্মদিন। আমি ব্ল্যাকফরেষ্ট কেক ভালোবাসি, বাবাই ওটাই এনেছিল আমার জন্য। মাম্মা বাবাই আর আমি মিলে কেক কেটেছিলাম। ধুর , আমি কাটবো কি করে!! আমি তো একা কিছুই পারি না। আমি চোখ দিয়ে দেখি আর কান দিয়ে শুনি। হাত পা ও নাড়তে পারি না তোমাদের মত। সব কিছু মাম্মা আর বিন্নি দিদি করে দেয়। আমার নাম করে বাবাই আর মাম্মা কেকটা কেটেছিল। বাবাই কত বেলুন দিয়ে ঘরটা সাজিয়েছিল। আমার জন্য বাবাই একটা বড় আ্যকুইরিয়াম কিনে এনেছিল। তাতে রঙিন মাছ আর পাথরকুচি দিয়ে সাজিয়ে ঐ টেবিলে রেখেছিল। বিকেলে কেক কাটার পর বাবাইয়ের একটা ফোন এসেছিল। ঐ ফোনটা আসার সাথে সাথে আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। এমন আমার হঠাৎ হঠাৎ হয়। কিছুই ভাল লাগে না। সব ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছা করে। চিৎকার করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কিছুই করতে পারি না আমি। অসহায় হয়ে শুয়ে শুয়ে শুধু দেখি।
ফোনটা পেয়েই বাবাই বেরিয়ে গেছিল। আর ফেরেনি। মাম্মা খুব কেঁদেছিল। অনেক লোক এসেছিল বাড়িতে। মৈনাক কাকুও এসেছিল। মাম্মাকে কত কি বোঝাচ্ছিল। আমার আবার সেই অস্বস্তি টা হচ্ছিল। ওটা মৈনাক কাকু এলেই হয়। সেদিন বেড়ে গেছিল। কিন্তু আমি তো কাউকে বোঝাতে পারি না কিছু।
এরপর মাম্মা আর বিন্নি দিদি খুব চুপচাপ হয়ে গেছিল। লোকজনের আসা-যাওয়া কমে গেছিল। কিন্তু মৈনাক কাকুর আসাটা বেড়ে গেছিল। আমি তো দোতলায় থাকি। আমার ঘরের পাশেই বারান্দা, নিচেই বাগান। আমি বাগানে মৈনাক কাকুর গাড়ির আওয়াজ পাই আর অস্বস্তিটা শুরু হয়। কাকু মাম্মার সাথে নিচেই গল্প করে। যাওয়ার আগে একবার আমায় দেখতে আসে। কখনো বড় চকলেট বার বা পেষ্ট্রি নিয়ে আসে। আমি তো শক্ত কিছু খেতেই পারি না। চকলেটটাকেও ওভেনে গরম করে নরম হলে আমায় খাওয়ানো হয়। একবার কাকু সন্দেশ এনেছিল । আমার গলায় আটকে সে কি কান্ড!
বাবাই আগে আমায় মাঝেমধ্যে গাড়িতে করে পার্কে নিয়ে যেত। ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যেত। গত দেড় বছর আমি এই ঘরের বাইরে যাইনি। কে নিয়ে যাবে? আমি তো বড় হচ্ছি। শরীরটা বড় হচ্ছে। এখন মাম্মা আর আমায় কোলে নিতে পারে না। কাকু মাম্মাকে বলেছিল আমায় হুইলচেয়ারে বসতে সাহায্য করবে । ঘুরতে নিয়ে যাবে। মাম্মা রাজি হয়নি। মাম্মা আর বিন্নি দিদি মিলেই হুইল চেয়ারে করে বাথরুমে নিয়ে স্নান করায় মাঝে মাঝে। তবে রোজ নয়। ওদেরো খুব কষ্ট হয়। আজকাল বারান্দাতেও নেয় না কেউ। আগে আমি গাছ দেখতাম, পাখি দেখতাম। কাঠবেড়ালী দেখতাম। এখন শুয়েই থাকি।
রঙিন মাছগুলো দেখি। আর কার্টুন দেখি। তবে বাবাই চলে যাওয়ার পর আমি দেখেছি আমার ঘরের ছাদে একটা তারা বেড়ে গেছে। সবচেয়ে উজ্জ্বল আর বড় তারাটা আগে ছিল না। ঐ তারাটা দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। ঐ তারাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি আজকাল কত কি অনুভব করি। তারাটাকে আমি আমার মনের কথা বলি। আমার মন খারাপ, আমার দুঃখ সব ঐ তারাটা জানে।
আজকাল মৈনাক কাকু প্রায় রোজ আসছে। মাম্মাকে কত কি বোঝাচ্ছে। আমি হঠাৎ করে খেয়াল করেছি আমি আজকাল অনেক কিছু শুনতে পাই। মাম্মা আর কাকু নিচের ঘরে বসে কথা বলে অথচ আমি উপরে শুয়ে শুয়ে সব শুনতে পাই। কাকু মাম্মাকে খুব ভুল কথা বোঝায়। বলে কাকু নাকি আমার দায়িত্ব নেবে। আমায় সারাজীবন দেখবে। কাকু মাম্মাকে বিয়ে করতে চায়।
আমি মাম্মাকে কাঁদতে দেখেছি। মাম্মা আসলে আমার জন্য ভয় পায়। বাবাই চলে যাওয়ার পর থেকেই মাম্মা কাঁদে। একা থাকলেই কাঁদে। আমি জানি মাম্মা বাবাইকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু মৈনাক কাকু মাম্মাকে ভয় দেখায়। আমার
কথা বলে ভয় পাওয়ায়। আমি চিৎকার করে বলতে চাই - "মাম্মা, ভয় পেয়ো না। বাবাই আমাদের কাছেই আছে। ঐ লোকটা বাজে।"
কিন্তু বলতেই পারি না। আজকাল মৈনাক কাকু আসলেই অস্বস্তিটা বেড়ে যায়। সেদিন মাম্মা নিচে রান্নাঘরে ছিল। কাকু একাই আমার ঘরে এসেছিল। খুব বাজে ভাবে আমায় আদর করছিল। আমার গায়ে এমন ভাবে হাত দিচ্ছিল যে সারা শরীর ঘিন ঘিন করছিল। রাগ হচ্ছিল খুব। চিৎকার করতে পারছিলাম না। হঠাৎ দেখি দিনের আলোতেও ছাদের বড় তারাটা জ্বলজ্বল করছে। মনে হচ্ছে একটা আগুনের গোলা। হঠাৎ আমার মধ্যে কি যে হলো আমি নিজেই জানি না। খুব জোড়ে কাকুকে ঠেলে দিলাম। জীবনে প্রথমবার হাত নাড়তে পেরেছিলাম। এতো শক্তি আমার শরীরে কাকুও বোঝে নি। গিয়ে পড়েছিল আ্যকুইরিয়ামের উপর। বিকট শব্দে আ্যকুইরিয়াম টা ভেঙ্গে সব জল আর মাছ ছিটকে পড়েছিল। সেই আওয়াজে মাম্মা ছুটে এসেছিল। যে নোংরা হাতে কাকু আমায় ছুঁয়েছিল ভাঙ্গা কাচের টুকরো ঢুকে গেছিল সেই হাতে, ঝরঝর করে রক্ত পড়ছিল। অবাক মাম্মাকে কাকু বলেছিল হোচট খেয়ে আ্যকুইরিয়ামের উপর পড়ে যাওয়ার গল্প। আমি ধাক্কা দিয়েছি বললে কেউ বিশ্বাস করবে না যে। আমি তো জড়ভরত। আ্যকুইরিয়াম ভেঙ্গে আমার শখের মাছগুলো মরে গেলেও আমার খুব আনন্দ হয়েছিল সেদিন। এর পর মৈনাককাকু আমার ঘরে এলেও আমার কাছে আসতো না। দূর থেকেই কথা বলত। ওর না বলা কথা গুলোও আমি শুনতে পেতাম। ওর আসল লোভ বাবাইএর এত বড় বাড়ি আর সম্পত্তির দিকে। কিন্তু মাম্মাকে বোঝাতেই পারতাম না। মাম্মাকে ঐ নোংরা লোকটা সারাক্ষণ উল্টোপাল্টা বোঝাতো। আমি তারাটার দিকে তাকিয়ে শক্তি চাইতাম। কথা বলার শক্তি। একবার মাম্মাকে যদি সব বলতে পারতাম! তারাটা উজ্জ্বল হয়ে ফুটে থাকত ছাদে।
সেদিন মাম্মা আমায় অনেক আদর করেছিল। ভেজা চোখে আমায় বলেছিল -"তোর জন্যই মৈনাকের কথায় রাজি হচ্ছি রে। তোর মাথার উপর একটা অভিভাবক দরকার। কাল যদি আমার কিছু হয়ে যায় তোকে কে দেখবে বল ? ও তোর দায়িত্ব নেবে বলেছে। শুধু তাই...."
আমি চিৎকার করে বলতে চাইছিলাম - "লোকটা মিথ্যা কথা বলছে। ওকে বিশ্বাস করো না। আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না।" কিন্তু একটা শব্দও বের হচ্ছিল না মুখ দিয়ে। হাত পা নাড়াবার ব্যার্থ চেষ্টায় রাগে মাথার শিড়া ছিড়ে যাবে মনে হচ্ছিল। তারাটা সেদিন ও জ্বলজ্বল করছিল। আমি বারবার বলছিলাম আমায় একটু ক্ষমতা দিতে। হয় কথা বলার নয়তো নড়াচড়ার। কিন্তু সেদিন কোনো মির্যাকল হয়নি। আমার চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়েছিল শুধু। সারারাত মাম্মা আর আমি জেগেছিলাম সেদিন। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বোধহয়। একটা ছেড়া ছেড়া স্বপ্ন দেখেছিলাম। বাবাই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে , হঠাৎ একটা বেপরোয়া ট্রাক এসে বাবাইয়ের গাড়িটা পিষে দিল। ট্রাক ড্রাইভারটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়িকে ইশারা করল কাজ শেষ। ঐ দূরের গাড়ির লোকটাকে আমি চিনি।
পরদিন একটা নতুন সকাল, মাম্মা গেছিল মন্দিরে পূজা দিতে। মৈনাককাকুর সাথে সেদিন মাম্মার রেজিষ্ট্রি হবে। কাকু আমার ঘরে এসে নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়েছিল। ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে মৃদু গলায় আমায় বলছিল - "এবার তোর গল্প শেষ করবো। সেদিনের শোধ তুলবোই। আজ আমি জিতে গেছি...."
আমি ছাদের দিকে তাকিয়ে তারাটা দেখছিলাম, ঐতো! রঙ বদলাচ্ছে!! সাদা থেকে হলুদ...কমলা থেকে আরো গাঢ়ো...ঐ নোংরা লোকটার বকবক শুনতে ভালো লাগছিল না আর। তারাটার থেকে একটু ঘরের মাঝখানে ফ্যানের দিকে চোখ গেল। বনবন করে ঘুরছে বড় সিলিং ফ্যানটা। হঠাৎ কি যেন হল!! আমার শরীরের সব অস্বস্তি একটা শক্তির রূপ পাচ্ছে বুঝতে পারছি। ফ্যানটা... তারাটা... লোকটা ঘরের ঠিক মাঝে, মাথার উপর ফ্যানটা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে টুং করে মৃদু আওয়াজটা পেয়েছিলাম। সাথে সাথে অত ভারি চলন্ত সিলিং ফ্যানটা খুলে পড়ল লোকটার মাথায়। রক্ত, ঘিলু আর চিৎকার .....সারা ঘরের দেওয়ালে ছোপছোপ রক্ত আর হলদেটে ঘিলু.... আর কিছুই মনে নেই।
পরদিন পেপারে ছোট করে বেরিয়েছিল দুর্ঘটনার খবরটা, যেমন বাবাইএর খবরটাও বেরিয়েছিল একদিন। আমার ঘরে মাম্মা নতুন ফ্যান লাগিয়ে দিয়েছে। ঘরটাও নতুন করে রঙ করেছে। বাবাইয়ের লাগানো স্টিকার গুলো আর নেই। কিন্তু বড় তারাটা রয়েছে আমার মাথার উপর। আমাদের কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবে না জানি। কারণ বাবাই তারা হয়েও আমাদের সাথেই রয়েছে।