Dola Bhattacharyya

Fantasy Inspirational

4  

Dola Bhattacharyya

Fantasy Inspirational

কোথায় আলো

কোথায় আলো

12 mins
440


আমি যে বড়ো রূপসী, আমার কোনো শত্রুতেও বলবে না সে কথা। তবু আমার মা নাম দিয়েছিল রূপাঞ্জনা, ছোট্ট করে রূপ । ছাত্রী হিসেবে আমি বেশ মেধাবী। ভালো গানও জানি। নিন্দুকেরা বলে, আমার নাকি অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। আসলে প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী আমি আর সেটাকেই ওরা অহংকার ভেবে ভুল করে।

পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পরীক্ষা দিতে শুরু করলাম। লেগেও গেল একটাতে। ডাক পড়ল ইন্টারভিউ তে। পেয়ে গেলাম চাকরি টা। বাড়িতে কেবল বাবা আর আমি। খুব ছোটবেলাতেই মাকে হারিয়েছি । তাই শৈশব, কৈশোর একা একাই কেটে গিয়েছে। বন্ধু ছিল না কোনো। পড়াশোনা আর অবসরে গান। এটাই ছিল আমার জগৎ। 

সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন বাবা।চাকরিটা পাওয়ায় বেশ খুশিই হলেন।

    আমাদের সামনের বাড়িতে কিছুদিন হল নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। নিচের তলার দুটি ঘর নিয়ে একাই থাকে। কিছুদিন ধরে দেখছিলাম, ছেলেটি প্রায়ই আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। বিরক্ত হতাম। একদিন ওই বাড়ির মাসিমা আমাকে ডেকে বললেন, ছেলেটি নাকি আমাদের বাড়ির সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছিল। বিরক্তি চরমে উঠল।

একদিন ও সরাসরি চলে এল আমাদের বাড়িতে। নিজের পরিচয় দিয়ে বাবাকে বলল, - আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। বাবা স্তম্ভিত, আমি নির্বাক। নিজের সমস্ত কথাই আমাদের সেদিন জানিয়েছিল অমিতাভ। রায়পুরে ওর আসল বাড়ি। সেখানে ওর বাবা মা থাকেন। এখানে একটা বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করে ও। চলে যাবার আগে আমাকে বলেছিল, - আপনার যদি মত না থাকে তাহলে সরাসরি জানাবেন। আর ডিস্টার্ব করব না আপনাকে।

                  …………………

 আমার বর কেমন হবে, এমন কোনো চিন্তা মনের অগোচরে ছিল কি আমার! কোনো স্বপ্ন দেখেছিলাম কি ! কই! না তো! কিন্তু পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির অমিতাভ যখন আমার সামনে এসে দাঁড়াল, আমার মনোজগতে ছায়া পড়ল ওর । ডার্ক, টল আ্যন্ড হ্যান্ডসাম। মনের ভেতর থেকে কেউ বলে উঠল, এই তো! এই তো আসল মানুষ। এর জন্যেই ছিল অপেক্ষা। জনম জনম ধরে একেই তো চেয়ে এসেছি আমি। বিয়েটা হয়ে গেল আমাদের। 

বিয়ের পর আলাদা ফ্ল্যাট নিতে চেয়েছিল অমিতাভ। কিন্তু আমি চাইলাম না। বাবার অবর্তমানে এই বাড়িটা তো আমার। এই বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইলাম না আমি। এখানেই গড়ে তুললাম আমার নতুন সংসার। 

নতুন বিবাহিত জীবন আমাদের। কেমন যেন খাপছাড়া। অমিতাভর তরফ থেকে তো কোনো ত্রুটি নেই। আদরে উষ্ণতায় ভরিয়ে রাখতে চায় ও আমাকে। কিন্তু আমি যে সাড়া দিতে পারি না ওর ডাকে। নিস্তব্ধ দুপুরের নীরবতা ঘিরে থাকে আমাকে। সমগ্র স্বত্ত্বা জুড়ে শীতল কাঠিন্য। ঘরের দুয়ারে এসে করাঘাত হেনে ফিরে যায় অমিতাভ! বার বার। হে ভগবান! এ কেমন খামতি আমার। আমি ভালোবাসি ওকে। কিন্তু কেন তা বোঝাতে পারি না! এ কী শাস্তি! 


একটা সময়ে এই বাড়িটা বেশ জমজমাট ছিল। দাদু, ঠাকুমা, বাবা, মা আর আমি। উচ্ছলতায় ভরা ছিল জীবন আমাদের । আমার তখন পাঁচ বছর বয়স। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মা-কে আর খুঁজে পেলাম না। তারপর কতদিন কেটে গেল, মা আর ফিরে এল না। মা দুগ্গার মতোই দশ হাতে সবাই কে আগলে রেখেছিল মা। সেই মায়ের অভাবে বাড়িটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেল। মা চলে যাবার পর থেকে বাবাকে আর হাসতে দেখিনি কখনো। 

তবু বাড়িটায় প্রাণ ছিল। মা না থাকলেও, ঠাকুমা আর দাদু আগলে রেখেছিল আমায়। তবে ভাঙন ধরেছিল দুজনেরই শরীর ও মনে। মা চলে যাবার দুবছরের মাথায় আচমকা হার্ট আ্যটাকে চলে গেলেন দাদু। দাদুর পরে ঠাকমাও আর বেশিদিন বাঁচেননি। মায়ের মৃত্যুটা ওঁরা মেনে নিতে পারেন নি। তারপর থেকেই এই বাড়ির দুটি ঘরে আমরা দুজন। কবে যেন হাসতে ভুলে গিয়েছিলাম আমিও। না ছিল আদর, না কোনো আবদার। বাবা কিন্তু আমার সবকিছুই খেয়াল রাখতেন। নিস্পৃহ থেকেও গড়ে তুলেছিলেন আমার জীবনটা। 

 এভাবেই কেটে গিয়েছে শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলো ।শীতল কাঠিন্য ছিল আমার স্বভাবের বৈশিষ্ট্য

             —-----------------------------

প্রায় দশ বছরের বিবাহিত জীবন আমাদের। একমাত্র সন্তান সৌম্যজিৎ, দার্জিলিংএ হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। এতদিনে আমি একটু স্বাভাবিক হয়েছি বৈকি। তবু সেই শীতলতার মুখোশ পুরোপুরি খুলে পড়ে নি। 

সেদিন অফিস ফেরত একটা শপিংমলে ঢুকলাম। সামনেই অমিতাভর জন্মদিন। একটা শার্ট কিনব ওর জন্য। হ্যাঙারে ঝোলানো শার্টগুলো দেখছি। আশপাশে লোকজনও বেশি নেই। হঠাৎ নজর পড়ল শাড়ির কাউন্টারের দিকে। এ কি! অমিতাভ! সাথে ওটা কে! ফুটফুটে সুন্দরী , আনম্যারেড, বয়স ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম খানিক। লক্ষ্য করতে লাগলাম ওদের। একটা সিল্কের শাড়ি পছন্দ করল মেয়েটা। দামে বোধহয় পোষাল না। তাই চলে গেল ওরা। কাউন্টারে গিয়ে আমিই কিনে নিলাম শাড়িটা। বাড়ি ফিরে অমিতাভকে দেখালাম। - দ্যাখো তো, এই শাড়িটা কেমন মানাবে আমাকে?

চুপ করে রইলো ও। আমিও আর কিছুই না বলে সরে গেলাম ওর সামনে থেকে। এরপরে আর একদিন দেখলাম ওদের। ব্যাঙ্কের সামনে এ টি এম কাউন্টার থেকে বেরোল ওরা। একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমার সামনে দিয়েই বেরিয়ে গেল। বুঝলাম আমাকে ওরা দেখতে পায়নি। পর মুহূর্তেই আর একটা ট্যাক্সি নিয়ে ধাওয়া করলাম ওদের পিছনে। ওদের অনুসরণ করে একটা বিলাস বহুল ফ্ল্যাটের সামনে এসে পৌঁছলাম। ভেতরে ঢুকে গেল ওরা দুজন। আর এগোতে পারলাম না আমি। রুচি তে বাঁধল। 


  আমার স্বভাবের শীতল কাঠিন্য প্রথম থেকেই দূরত্ব তৈরি করেছিল আমাদের মধ্যে। ছেলেটার জন্মের পর সেই দূরত্ব কেটেছিল কিছুটা। আজ আবার আমরা দূরতম দুই মেরুর বাসিন্দা। কারণ! সেই মেয়েটা। প্রায় ছমাস আগে শপিংমলে ওদের দেখেছিলাম আমি। মেয়েটার পরিচয় অমিতাভ আমাকে দেয়নি। তবু জেনেছি, ওর নাম তানিয়া। জেনেছি আরও কিছু বিস্ময়কর তথ্য। মেয়েটার নাকি প্রচুর টাকার প্রয়োজন। আর সেই প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্ব নিয়েছে অমিতাভ। কেন! কে ওই মেয়ে! এতদিন জানতে চাই নি, কিন্তু আজ চাইব। আজ জবাব ওকে দিতেই হবে। অনেক রাতে ক্লান্ত শরীরটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল অমিতাভ। সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, "মেয়েটা কে?" জবাব দিল না ও। 

"কি হল! আমি কিছু জানতে চাইছি তো"! 

ক্ষুব্ধ স্বরে অমিতাভ বলে, "কোনোদিন আমার কোনো কিছুতে আগ্রহী ছিলে না তুমি। তাহলে আজ কেন?

কোনোদিন জানতে চাই নি বলে আজও জানতে চাইব না! এ কেমন যুক্তি?" 

"বেশ ।বলো কি জানতে চাও!"

"কে ও?" 

"আমার বন্ধুর স্ত্রী । আর কিছু!" 

"হ্যাঁ ।সব থেকে বড় প্রশ্নটাই তো বাকি রয়েছে। এই কয়েক মাসে তোমার আ্যকাউন্ট থেকে বেশ কয়েক লাখ টাকা তোলা হয়েছে। আমি জানি, টাকাগুলো ওই মেয়েটিকে দিয়েছো। কেন? এত টাকার দরকার হচ্ছে কেন ওর? তোমাকেই বা দিতে হচ্ছে কেন এত টাকা?"

" বন্ধুর প্রয়োজনে টাকা দিয়েছি । এর বেশি কৈফিয়ৎ আমি দিতে পারব না। "

তিক্ত স্বরে বললাম," প্রয়োজন! মাই ফুট। অন্য কিছুই কি পাচ্ছো না তানিয়ার কাছ থেকে। আরে! সারা পৃথিবীটাই তো এখন গিভ আ্যন্ড টেক্ পলিসিতে চলে।" 

অমিতাভ নির্বাক। ওর নীরবতা আরো অস্থির করে তুলল আমাকে। রাগে ফেটে পড়লাম," কি হল! জবাব দাও।" ততোধিক শান্ত স্বরে ও বলল, "ঈর্ষা আর সন্দেহ তোমার ভেতরের পাশবিক সত্ত্বাটাকে প্রকট করে তুলেছে। আজ বুঝতে পারছি, তোমাকে বিয়ে করে কতটা ভুল করেছি আমি।"

রাগের চোটে চিৎকার করে উঠলাম, - "বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।" চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ও। একঝলক দেখল আমাকে। সে দৃষ্টিতে কি ছিল আমি জানি না। দরজার দিকে এগিয়ে গেল ও। অধৈর্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম 

" কোথায় যাচ্ছো "! উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেল ও। চিৎকার করে বললাম - 

" যেখানে যাচ্ছ যাও। ঠিকানাটা জানিয়ে দিও। ডিভোর্স এর চিঠি পাঠিয়ে দেব।" 

                   ………………….

    বাইরে ঝড়ের তান্ডব চলছে। কালবৈশাখীর সময় এখন। ঝড় উঠেছে আমার মনের ঘরেও। এইমাত্র তানিয়ার ফ্ল্যাট থেকে ফিরলাম আমি। দরজার তালা টা খুলতেই একরাশ অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে একটা সোফার ওপর বসে পড়লাম। আলো জ্বলতে ইচ্ছে করছে না। আমার সমস্ত অন্তঃকরণ আজ ধিক্কার দিচ্ছে আমাকেই।

"কোথায় আলো কোথায় ওরে আলো

বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো

রয়েছে দীপ না আছে শিখা

এই কি ভালে ছিল রে লিখা

ইহার চেয়ে মরণ বুঝি ভালো"।  

আজ তানিয়া নিজেই ফোন করে ডেকেছিল আমাকে। প্রথমে ভেবেছিলাম, যাব না। তারপর মনে হল, ও যখন সাহস করে ডাকল আমাকে, তখন যেতে তো হবেই। মুখোমুখি একবার দাঁড়াতে হবে মেয়েটার। ওর রূপের দেমাক, না আমার বিদ্যার জোর, কোনটা বেশি শক্তিশালী একবার দেখে আসি। 

কি ভীষণ ভুল করেছি আমি। ভাবতে পারিনি, অমিতাভর বোন তানিয়া। অমিতাভর কলেজ ফ্রেন্ড প্রীতমের সাথে বিয়ে হয়েছে ওর। নর্থ বেঙ্গলে থাকত ওরা। ব্রেন ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রীতমকে নিয়ে চিকিৎসা করাতে কলকাতায় এসেছিল তানিয়া। অমিতাভ ওদের পাশে না থাকলে কোথায় যেত ওরা!

সেদিন শপিংমলে ওরা দেখেছিল আমাকে। অমিতাভ ভেবেছিল, আমিই যাব ওদের কাছে। তানিয়া তাই শাড়িটা কিনছিল প্রথম সাক্ষাতে আমাকে উপহার দেবার জন্য। কিন্তু আমি ওদের সন্দেহ করছি বুঝতে পেরে বিস্মিত হয়েছিল অমিতাভ। আমি ওকে অবিশ্বাস করতে পারি, সেটা ভাবতেই পারেনি ও।

"বেদনা দূতী গাহিছে ওরে গান

তোমার লাগি জাগেন ভগবান

নিশীথে ঘন অন্ধকারে

ডাকেন তোরে প্রেমাভিসারে

দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান"

 নর্থ বেঙ্গল থেকে কলকাতার কলেজে পড়তে এসেছিল প্রীতম। খুব সুন্দর গান গাইত। একটা রিয়েলিটি শো এ প্রীতমের গান শুনে মুগ্ধ হয় তানিয়া। অমিতাভর মাধ্যমে যোগাযোগ হয় ওদের। সেকেন্ড রানার আপ হয়ে রিয়েলিটি শো থেকে বেরোবার পর গানের জগতে পাকাপাকি ভাবে প্রবেশাধিকার পায় প্রীতম। ধীরে ধীরে উঠতে থাকে ওপরের দিকে। এই সময়ে বিবাহ সুত্রে আবদ্ধ হয় ওরা। 

নেপালী জামাই কে মেনে নেন নি তানিয়া আর অমিতাভর বাবা, মা । 

তবু থেমে থাকে নি ওদের জীবন। ধীরে ধীরে ওপরে উঠেছে প্রীতম। কলকাতার বুকে নিজস্ব ফ্ল্যাট হয়েছে। তারপর গাড়ি। যদিও ওরা বেশিরভাগ সময়ই নর্থ বেঙ্গলে থাকত। হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ে প্রীতম। ধরা পড়ে কাল রোগ। সুখের সংসার ভেঙে পড়ার উপক্রম। চিকিৎসার জন্য কলকাতায় চলে আসে ওরা, অমিতাভর আশ্রয়ে। ততদিনে নিজেদের পুঁজি প্রায় শেষ। এসবই 

তানিয়া বলেছে আমাকে। অমিতাভ নাকি সব কথা আমাকে বারবার বলতে চেয়েছে। কিন্তু আমি শুনতে চাই নি। সত্যিই তো! অমিতাভ অনেকবার আমাকে বলেছে, ওর একটা অতীত আছে। সেটা আমার সাথে শেয়ার করতে চায়। আমি শুনতে চাই নি। অতীত মানেই আমার কাছে খুব কষ্টের। সেই কষ্টের মুখোমুখি আর হতে চাই না আমি। তাই যতবার ও বলতে চেয়েছে, শুনতে চাই নি আমি। ভাবতে পারি নি তো, সেই কষ্ট হঠাৎ আমাকে এমন করে ছুঁয়ে দেবে। আর আজ, সন্দেহের বশে, ওকে কত দূরে ঠেলে দিয়েছি আমি । সরে গিয়েছে অমিতাভ। চলে গেছে আমাকে ছেড়ে।

"বিজলী শুধু ক্ষণিক আভা হানে

নিবিড়তর তিমির চোখে আনে

জানিনা কোথা অনেক দূরে

বাজিল গান গভীর সুরে

সকল প্রাণ টানিছে পথ পানে।"

অমিতাভ আজ চলে যাচ্ছে এখান থেকে। কোম্পানি ওকে মুম্বাইতে শিফট করার নির্দেশ দিয়েছে। আমাকে বলেনি ও। তীব্র অভিমানে ওর কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলাম আমি। সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে চেষ্টা করেনি ও। কেন? আমার অভিমান ভাঙানোর চেষ্টাই করে নি। সেটা কি ওর কর্তব্য ছিল না! চলে যেতে বললাম বলে কিছু না বলেই চলে গেল! হয়তো ওরও অভিমান হয়েছিল। ওর সেই অভিমান আজ আমাকেই ভাঙতে হবে। রাত দশটায় ওর গাড়ি। তার আগেই আমাকে পৌঁছতে হবে হাওড়া স্টেশনে।

        "কোথায় আলো কোথায় ওরে আলো

            বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো

               ডাকিছে মেঘ হাঁকিছে হাওয়া

                সময় গেলে হবে না যাওয়া

                নিবিড় নিশা নিকষঘন কালো

              পরাণ দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালো। "

তাই করব আমি। যাব ওর কাছে। ফিরিয়ে আনব ওকে। এ ঝড় বৃষ্টি তুচ্ছ করে এখুনি যেতে হবে আমাকে। অনেকটা দূরত্ব অতিক্রম করে আমাকে পৌঁছতেই হবে ওর কাছে।

          —----------------------------

 নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে গেলাম হাওড়া স্টেশনে। ট্রেন ছাড়তে একটু দেরি আছে। কোচ নাম্বার তানিয়া বলেই দিয়েছিল। S/9কোচ। বেশ খানিকটা দূরে। পাগলের মতো ছুটলাম। এই তো S/6.দৌড় দৌড় দৌড়। S/7, S/8 পেরোলাম। এই তো S/9কোচ। এতবড় কম্পার্টমেন্টের কোথায় আছে অমিতাভ। আর তো বেশি সময় নেই। তবে কি দেখা হবে না! কম্পার্টমেন্টের প্রথম দরজার সামনেই দাঁড়িয়েছিল অমিতাভ ।আমাকে দেখেই নেমে দাঁড়াল, "রূপ!" 

আমার এতদিনের অহংকারী আবরণ টা কে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ওর হাতদুটো জড়িয়ে ধরলাম, "ভীষণ ভুল করেছি।" 

আমার দুচোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে জল অবিরল ধারায়। অশ্রু নদীর বাঁধ ভেঙেছে আজ। কিন্তু এ কী দেখছি আমি। অমিতাভ হাসছে। সেই প্রশান্ত নির্মল হাসি। 

"দূর পাগলী! এত জল জমেছিল তোর বুকের ভেতরে!" 

রুদ্ধ স্বরে বললাম," হ্যাঁ। উৎসের মুখটা অভিমানের মস্ত একটা পাথরে চাপা পড়েছিল। আজ সেই পাথরটা হঠাৎ করেই সরে গেল।" 

"কে সরাল সেই অভিমানের পাথর?" 

উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর বললাম, "ফিরে চলো আমার সাথে। প্রীতমের অবস্থা খুব খারাপ। তুমি না থাকলে তানিয়া দিশাহারা হয়ে পড়বে।"

" জানি রূপ ।কিন্তু কি করব! চাকরি বজায় রাখতে গেলে আমাকে যেতেই হবে। "

" আর তানিয়া!"

" কেন! তুমি আছো তো। "

"আমি! নিশ্চয়ই। তোমার দেওয়া দায়িত্ব আজ মাথায় তুলে নিল তোমার রূপ । আগলে রাখব ওদের "। 


প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দূরপাল্লায় পাড়ি দিয়েছে ট্রেন মিনিট দশেক আগে। পার্কিং লটে এসে গাড়িটা বার করলাম। এখন কোথায় যাব! ওই ফাঁকা বাড়িতে! ওকে ছাড়া ওই বাড়িতে ফিরতেই ইচ্ছা করছে না। যদিও ওটা আমার নিজের বাড়ি। নাঃ। এখন ওটা আমাদের দুজনের বাড়ি। কি ভেবে ফোন করলাম তানিয়া কে, "আজ রাতটা তোমার কাছে থাকতে দেবে আমায়?" 

"এটা কি জিজ্ঞেস করতে হয় বৌদি ভাই। তুমি এসো। তুমি এলে আমারও ভালো লাগবে"। 

আজ অনেকক্ষণ ধরে ঝড়, বৃষ্টির তান্ডব চলেছে। বৃষ্টি টা এখন ধরেছে। জলকণাবাহী বাতাসের আনাগোনায় তাপমাত্রা নিম্নমুখী। বিদ্যুতের শলা মাঝে মাঝেই চিরে দিয়ে যাচ্ছে আকাশটাকে। গাড়িটা উড়িয়ে নিয়ে চলেছি তানিয়ার ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। 

সে রাত টা না ঘুমিয়েই কেটে গেল দুজনের। ভোরবেলায় হাসপাতাল থেকে ফোন এল। প্রীতমের অবস্থা খুব খারাপ। ছুটে গেলাম দুজনে। ডাক্তার বললেন," এখনই অপারেশন না করলে পেশেন্ট কে বাঁচানো যাবে না।" 

জিজ্ঞেস করলাম, "অপারেশন হলে বাঁচবে তো"! 

"বাঁচবেই এমন কোনো কথা নেই। যত সময় যাচ্ছে, অবস্থা ততো খারাপ হচ্ছে। অপারেশন টেবিলেই এক্সপায়ার করতে পারে। তবে কপাল ভালো থাকলে আরো কিছুদিন পৃথিবীটা ভোগ করতে পারবে"। 

"তার মানে চান্স ফিফটি /ফিফটি।" 

"ধরে নিন তাই।" 

" অথচ এইরকম পেশেন্ট কে আপনারা ফেলে রেখেছেন, পুরো টাকা জমা না করলে অপারেশন হবে না। বেশ। ভালো কথা। আমি এখনই পুরো টাকা জমা করে দিচ্ছি। তাহলে শুরু করুন অপারেশন।"ক্ষোভ প্রকাশ না করে আর পারলাম না। এতদিন ধরে কম খরচ তো হয়নি , এরা তো সব মিটিয়েই দিয়েছে। এখনই পাঁচ লক্ষ টাকা না জমা দিলে অপারেশন হবে না। অথচ এই অপারেশনের ওপর পেশেন্টের মরা বাঁচা নির্ভর করছে। 

     অবশেষে যুদ্ধে জয় লাভ করলাম। আমাদের তিনজনের ভালোবাসা আর প্রার্থনার জোরে আরও কিছুদিন পৃথিবীতে থেকে যাবার মেয়াদ বাড়ল প্রীতমের । ওরা এখন ফ্ল্যাট ছেড়ে আমার বাড়িতেই এসে রয়েছে। প্রীতমের ফ্ল্যাটে গানের স্কুল খুলেছে তানিয়া। 

চিকিৎসার জন্য প্রীতমকে মুম্বই নিয়ে আসতে বলছে অমিতাভ। এইসব রোগের চিকিৎসা ওখানে খুব ভালো হয়। বেশ কিছুদিনের ছুটি জমা ছিল। বেরিয়ে পড়লাম ওদের দুটি কে নিয়ে। মুম্বই যাবার আগে আরো একটা কাজ বাকি রয়েছে। অমিতাভর মা, বাবার সাথে অনেকদিন দেখা হয়নি। একবার রায়পুরে যেতে হবে। তানিয়া শুনেই বেঁকে বসল, "এ তুমি কি বলছ বৌদি ভাই। ও বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছি আমি। কেমন করে আবার গিয়ে দাঁড়াব সেখানে!" 

"তোরা যাবি কেন! আমি যাব। অনেকদিন দেখিনি ওঁদের। আমার নিজের তো বাবা, মা কেউ নেই। ওঁদের কাছ থেকেই বাবা মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা পেয়েছি।" 


রায়পুরে একটা হোটেলে ওদের দুজনকে রেখে আমি গেলাম শ্বশুরবাড়ি। আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন ওঁরা।" হ্যাঁ বৌমা । এতদিন পর মনে পড়ল আমাদের!"

আরে, সব সময়েই তোমাদের কথা মনে পড়ে। কেন! ফোন করি না তোমাদের!" 

"হ্যাঁ ।তা করিস। কিন্তু আসতে তো পারিস না।" 

"আসলে জানো তো, কত ব্যস্ত থাকি। "

" হ্যাঁ ।তা আর জানি না। কত বড় চাকরি করিস তুই "। 

আসলে এই মানুষগুলো এমনই। বড় সহজ সরল। এঁদের কাছে আমার অহংকারের মুখোশ প্রথম দিনেই খসে গিয়েছিল। নিজের মেয়ের সঙ্গে এমন ভুল এঁরা করলেন কি করে কে জানে? 

" বাবা, জানো, দুটো ছেলেমেয়ে কে নিয়ে মুম্বই যাচ্ছি আমি। ওরা স্বামী স্ত্রী। ছেলেটা ক্যান্সার পেশেন্ট। অপারেশন হয়েছে। রায়পুরে একটা হোটেলে রেখেছি ওদের। কাল রাতের ট্রেনে আবার রওনা দেব।" 

"ওমা তাই! আহা গো। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সুস্থ হয়ে ফিরুক ছেলেটি"। করুণা ঝরে পড়ছে মমতাময়ী মায়ের দুটি চোখ থেকে ।বললাম," হ্যাঁ মা। প্রার্থনা করো। বড় দুঃখী ছেলেমেয়ে দুটো। ওদের কেউ নেই। ভালোবেসে ভিন্ন জাতের ছেলেকে বিয়ে করার অপরাধে মেয়েটার বাবা মা ওকে তাড়িয়ে দেয় বাড়ি থেকে। কিন্তু ছেলে টা খুব ভালো জানো ।ওর পরিবার কিন্তু মেয়েটাকে আশ্রয় দেয়। সুখেই ছিল ওরা। কিন্তু নিয়তির পরিহাস দেখো। আসলে জীবনে চলার পথে বাবা মায়ের আশীর্বাদের খুব প্রয়োজন আছে। সেটাই যে পেল না ওরা। আমি আর তোমাদের ছেলে বুক দিয়ে আগলে রেখেছি ওদের। ভালো করিনি বলো? "

শাশুড়ি মায়ের চোখে জল। কাঁদছেন উনি আঁচলে মুখ ঢেকে। শ্বশুরমশাইও কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়েছেন। বললেন," আমাদের নিয়ে যাবে ওদের কাছে! একবার দেখা করে আসি। মনটা কেমন যেন করছে। অনেক দিন আগে… "

" অনেক দিন আগে কি বাবা! "

" না না কিছু নয় "। 

" আমি জানি বাবা আপনি কি বলতে চাইছেন। এখন আর লুকিয়ে রাখার সময় নেই। হ্যাঁ। ওরা আপনারই মেয়ে আর জামাই। এই জাত পাতের বিচার এসব কি বাবা! এত শিক্ষিত মানুষ আপনি। আপনাকে তো এসব মানায় না।"

" বৌমা, বৌমা তুমি জানো না। ওরা ভালো হয় না। "

" কে বলেছে। আপনি দেখেছেন ছেলেটিকে! বা ওর পরিবার কে! আপনি জানেন কত সুন্দর গান গায় ও!" আমার মোবাইলে প্রীতমের গাওয়া একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে দিলাম। 


সন্ধ্যা বেলায় শ্বশুরমশাই ও শাশুড়ি মাকে নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। দীর্ঘদিন পরে মিলন হল বাবা মায়ের সাথে তাদের আদরের মেয়ের। সেই স্বর্গীয় দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে রইলাম আমি। এ আমার চরম সৌভাগ্য। 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy