ধারাবাহিক চোখের আলোয় পর্ব 9
ধারাবাহিক চোখের আলোয় পর্ব 9
ঠাকুরমার দালানের কাছে সরু গলির সামনে অরুময় বসুর গাড়িটা দাঁড়াল। গতকাল রাতের সমস্ত ঘটনাই আঁখি বলেছে। শুনে বিস্মিত হয়েছেন অরুময় ও শান্তনু। গাড়ি থেকে নেমে আঁখি ডাকল ওনাদের, আসুন আপনারা, আলাপ করিয়ে দিই আমার বাড়ির সবার সাথে। বাড়িতে ওর জন্যে একটা নাটক অপেক্ষা করছে, সেটা বুঝতেই পেরেছিল আঁখি। তাই ডেকে নিল দুজনকে। কোর্টে কেস উঠলে সাক্ষ্য দেবার জন্যে তো লোক প্রয়োজন। যদিও এনারা সাক্ষ্য দিতে রাজি হবেন কিনা জানে না ও।
হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ অরুময়ের নজর পড়ে, রাস্তার ধারে ঝোপের মধ্যে কি যেন একটা পড়ে রয়েছে। "মিস্ সেন"। অরুময়ের ডাকে সাড়া দিতে ফিরে তাকাল আঁখি, "কিছু বলছেন স্যার"!
"ওইটা বোধহয় আপনার তানপুরাটা, ঝোপের মধ্যে পড়ে রয়েছে"।
"হ্যাঁ ।তাইতো।" অরুময় নিজেই গিয়ে তুলে আনলেন তানপুরাটা। তারগুলো ছিঁড়ে গিয়েছে , ভেঙেও গেছে কোনো কোনো জায়গায়। প্রিয় তানপুরাটার এই অবস্থা দেখে চোখে জল চলে এল আঁখির। কাল রাতে এই যন্ত্রটাই প্রাণ বাঁচিয়েছে ওর। শান্তনু বললেন," একটু সারিয়ে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে ওটা"। মৃদু হেসে সায় দিল আঁখি। তানপুরাটাকে কোলে নিয়ে এগিয়ে চলল আবার শান্তনু ও অরুময়ের সঙ্গে।
সদর পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল ওরা। আওয়াজ পেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন মীনা। সামনের রাস্তা পেরিয়ে দালানে উঠতে উঠতে ডাকল আঁখি, "আসুন, এই আমাদের বাড়ি"।"দাঁড়াও!" চমকে মুখ তুলে তাকাল আঁখি। "কোথায় যাচ্ছো! আর আসছই বা কোথা থেকে"!
"মাসিমণি, কাল রাতে আমার একটা আ্যক্সিডেন্ট হয়েছিল। এঁদের গাড়িতেই ধাক্কা খেয়ে…."। কথাটা শেষ করতে দিলেন না মীনা। চিৎকার করে উঠলেন তার বদলে, "চুপ কর মিথ্যেবাদী মেয়ে। এ বাড়িতে তোর আর জায়গা হবে না। যা। যেখানে রাত কাটিয়েছিস, সেখানেই যা। মুক্তি দে আমাকে এবার "। অরুময় আর শান্তনু বুঝতেই পারেন নি, এইরকম একটা ঘটনা দেখতে হবে চোখের সামনে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ওঁরা। বাড়িটার চারদিকে তাকিয়ে দেখছিলেন অরুময়। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল ওনার। কিছু যেন মনে পড়ছে।
" এসব কি বলছো মাসিমণি! " অস্ফুটে বলে উঠলো আঁখি।
"হ্যাঁ ।ঠিকই বলছি। এতোদিন ধরে কি লীলা চলছিল, ভেবেছিস তার কিছুই আমরা জানি না, তাই না! কাল রাত থেকে ও বাড়ির পরেশও উধাও। সুতরাং কোথায় ছিলি আমার আর জানতে বাকি নেই। রণের কাছ থেকে তোর আর পরেশের সব কথাই শুনেছি আমি। "
" ভুল শুনেছো মাসিমণি। একদম মিথ্যে কথা শুনেছো।"
" সবার কথাই মিথ্যে, আর তুই শুধু সত্যবাদী, তাই না!" শ্লেষ ঝরে পড়ছে মীনার গলা থেকে।
" হ্যাঁ মাসিমণি, তাই।"
" এতবড় কথা! যা! বেরিয়ে যা বাড়ি থেকে। তোর মতো নোংরা মেয়ের মুখ দেখতে চাই না। আমারও দুটো মেয়ে রয়েছে। তাদের তো বিয়ে থা দিতে হবে।"কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন মীনা। ঝকঝকে কালো দুটো চোখের তারায় দপ করে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল আঁখির। ঈষৎ কঠিন গলায় বলে উঠল," তাই যদি মনে হয়, তোমরা চলে যাও এখান থেকে। এই বাড়িটা আমার। এখান থেকে আমাকে তাড়িয়ে দেবার কোনো অধিকার তোমার নেই।"
রণ এতক্ষণ ঘরেই ছিল। এবার এসে দাঁড়াল মায়ের পাশে। হাসতে হাসতে বলল, "কি বললি তুই! তোর বাড়ি! স্ট্রেঞ্জ! তুই তো নিজেই বাড়ি টা মায়ের নামে লিখে দিয়েছিস। এখন আবার নিজের বলে ক্লেম করছিস!"
" রণ'দা, কালকের মারটা ভুলে গেছিস দেখছি।"
ভয়ংকর একটা হাসি ফুটে উঠল রণের মুখে, অরুময় আর শান্তনুকে দেখিয়ে বলল, "কাল এই লোক দুটোর গাড়িতে উঠে তুই যখন পালাতে গেলি, তখন তোকে বাধা দিতে গিয়ে তোর হাতে মার খেলাম আমি। কি করে ভুলি বল!" রণের এই কথায় এতটুকু অবাক হল না আঁখি। ওরা এরকম বলতেই পারে। তাই বলে উঠল, "কি! কি বললি! আর একবার বল ।আরে, তোরা নিজেরাই বুঝতে পারছিস না, কি বলবি! তাই, একবার বলছিস, পরেশের সঙ্গে পালিয়েছি, আর একবার বলছিস, এনাদের গাড়িতে উঠে পালিয়েছি। কোন টা! বল।"সহসা জবাব দিতে পারে না রণ। রণকে চুপ করে থাকতে দেখে মীনা বললেন, "তুই কি করেছিস, সেটা শুধু তুইই জানিস ! আমরা শুধু জানি, কাল রাতে বাড়ি ফিরিস নি। ওই দ্যাখ, তোর সর্বাঙ্গে ফুর্তির চিহ্ন লেগে রয়েছে।" এই বাড়িটা থেকে এবার সত্যিই চলে যেতে হবে বুঝতে পেরে চোখে জল এসে গেল আঁখির । অরুময় আর শান্তনু এরকম বিশ্রী একটা ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে খুবই অস্বস্তি বোধ
করছিলেন। মেয়েটাকে সত্যিই ওরা তাড়িয়ে দিচ্ছে দেখে এগিয়ে এলেন শান্তনু,
"মিস্ সেন, এইভাবে এইসব সমস্যার সমাধান হয় না। আপনি আসুন আমাদের সঙ্গে।" আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল আঁখি। শরীরটা যেন ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে ওর। অশ্রুরুদ্ধ স্বরে বলে উঠল, "বেশ। চলে যাচ্ছি আমি। তার আগে একবার আমার ঘরে যেতে দাও। আমার অনেক দরকারী জিনিস রয়েছে। সেগুলো নিয়েই চলে আসব "।
দরজা আগলে দাঁড়ালেন মীনা,"একদম না, কিচ্ছু তুমি নিতে পারবে না এখান থেকে।"
চলে যাবার আগে শেষ বারের মতো পেছন ফিরে তাকাল আঁখি। ওপরের ঘরের জানলায় মেসোমশাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। আঁখি তাকাল একবার। আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুললেন প্রভাস। প্রভাস কাঁদছেন, বুঝতে পারল আঁখি। দূর থেকেই প্রভাস কে নমস্কার জানাল ও। এই মানুষটা ছিল বলে! এতদিন বেঁচে আছে আঁখি। না হলে মাসিমণি হয়তো সম্পত্তির লোভে খুনই করে ফেলত ওকে ।
রাস্তায় এসে আঁখি বলল, "প্লীজ, কিছু মনে করবেন না। এরকম একটা ঘটনা দেখতে হল আপনাদের, আমারই জন্যে। স্যরি। আপনারা এবার আসুন তাহলে।"
"আপনি কি করবেন এখন!" অরুময়, শান্তনু দুজনেই উদ্বেগ প্রকাশ করলেন।
"দেখি, কি করা যায়!"
"এভাবে আপনাকে ছেড়ে দিতে আমরা পারি না। যদি কোথাও যাবার থাকে বলুন, আমরা পৌঁছে দেব আপনাকে "।
" আমার দাদুর বাড়ি আছে। সেখানেই যাব আমি। এখান থেকে এক কিলোমিটার রাস্তা।"
শুভরঞ্জনের বাড়ি 'সেন ভিলা'র গেটে এসে দাঁড়াল অরুময়ের গাড়ি। এই বাড়িও অরুময়ের চেনা। আঁখি বলল, এই বাড়িটাও আমার। দাদু আমার নামে উইল করে দিয়ে গেছে। এটা ওরা জানে না। জানলে এটাও হাত করতে চেষ্টা করত। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল আঁখি। "আসুন, প্লীজ"। অরুময় আর শান্তনু ঢুকলেন।
অবাক হয়ে দেখেছিলেন ওঁরা। পুরোনো দিনের বিশাল দোতলা বাড়ি। একটা ছোটোখাটো প্রাসাদের মতোই প্রায়। ওপরে নিচে অনেকগুলো ঘর, বারান্দা। ছাদের কার্ণিশে বাড়ির সামনের দিকটায় একটা পরী বসানো। বাগানেও রয়েছে বেশ কয়েকটা শ্বেত পাথরের পরী। পরীর মাথায় ফোয়ারা। এখন অবশ্য খারাপ হয়ে গিয়েছে। সুন্দর টলটলে জল ভর্তি বিশাল পুকুর। বাড়িটা দেখে দুজনেই মুগ্ধ। শান্তনু জিজ্ঞেস করলেন, "আর কে থাকে বাড়িতে?"
"ঠাম্মি ।দাদু মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। ঠাম্মির বয়স হয়েছে, বাট্ স্টেডি আছে।"
"কোথায় আপনার ঠাম্মি"?
"ঠাম্মি এখন অমরকন্টকে। বেড়াতে গিয়েছে । খুব বেড়ানোর সখ ঠাম্মির" ।
"এই বাড়িতে আপনি একা থাকবেন নাকী!"
"কি করব বলুন ।থাকতে তো হবেই।"
শান্তনু বলেন," এই এতবড় বাড়িতে একলা থাকা একটু রিস্কি হয়ে যাবে আপনার পক্ষে। কিরে অরুময়! বল কিছু!" অনেকক্ষণ ধরে কি যেন ভাবছিলেন অরুময় এবার বললেন," আচ্ছা! জ্ঞানদারঞ্জন সেন… "
" আমার বাবা।" অরুময় কে প্রশ্ন টা কমপ্লিট করতে না দিয়েই উত্তরটা দিল আঁখি।" অরুময় বলেন, ও, আপনি মাষ্টার মশাইএর মেয়ে। আমি তো ওনার স্টুডেন্ট। ক্লাস ফাইভ থেকে একেবারে টুয়েলভ পর্যন্ত অঙ্ক করেছি ওনার কাছে। এই দুটো বাড়িতেই আমি দীর্ঘদিন ধরে যাতায়াত করেছি। প্রথমে তো এখানেই পড়াতেন মাষ্টার মশাই । পরে নিজেই বাড়ি করলেন । তারপর থেকে নিজের বাড়িতেই পড়াতেন। ভীষণ ভালো মানুষ ছিলেন মাষ্টার মশাই। আর কি আশ্চর্য দ্যাখ শান্তনু, ওনার অবর্তমানে ওনার একমাত্র মেয়ের কি অবস্থা। মিস্ সেন, আপনার ঠাম্মি না ফেরা অবধি, আপনি আমার বাড়িতে আমার পিসিমার কাছে থাকবেন, চলুন। এখানে এভাবে একা থাকার দরকার নেই।"
আঁখিকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রশ্ন করেন শান্তনু," কি ভাবছেন মিস্ সেন! যাবেন তো আমাদের সাথে?"অনেকগুলো ভাবনার ভীড় জমেছে আঁখির মনে। সেই ভীড় সরিয়ে উত্তর দিল," অনেকগুলো কাজ এখন করতে হবে আমাকে। আগে থানায় গিয়ে একটা অভিযোগ দায়ের করা দরকার। তারপর উকিলের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। আর সবার আগে একটা মোবাইল দরকার। আমার মোবাইল টা কাল ভেঙে গিয়েছে । আমাকে ফোন করে যদি না পায় ঠাম্মি, তাহলে অস্থির হয়ে উঠবে।"
শান্তনু বললেন, সব কাজ হবে। আপনি চলুন আমাদের সাথে। আমরা আছি তো। সবরকম সাহায্য করব আমরা। আঁখি অবাক। এতখানি ভরসা কে দেয়! হঠাৎ করেই চোখ দুটো জলে ভরে উঠল ওর।
ক্রমশ :—