Dola Bhattacharyya

Inspirational Others

3  

Dola Bhattacharyya

Inspirational Others

ধারাবাহিক চোখের আলোয় পর্ব 8

ধারাবাহিক চোখের আলোয় পর্ব 8

5 mins
29



দারুণ জোরে ব্রেক কষে থেমে গেল গাড়ি টা। চালক শান্তনু রায় আগেই লক্ষ্য করেছিলেন, একটি মেয়ে প্রাণভয়ে ছুটতে ছুটতে আসছে, আর পেছনে দুটি ছেলে ওকে তাড়া করেছে। গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়েছিলেন শান্তনু। তার পরেই আঁখি গাড়ির ওপর এসে পড়ে। 

শান্তনু রায় ও অরুময় বসু, অভিন্নহৃদয় বন্ধু। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স দুজনের। দুজনেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। থাকেন সুভাষ গ্রামের দিকে। দুই বন্ধু গিয়েছিলেন রবীন্দ্রসদনে, মল্লার চ্যাটার্জির গান শুনতে। শান্তনু রায় ভীষণ গান পাগল মানুষ। নিজের সঙ্গে বন্ধুকেও টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। গান শুনে দুজনেই মুগ্ধ। মল্লার চ্যাটার্জির আগে ধীমান গোস্বামীর দুই নবাগতা ছাত্রী গান পরিবেশন করল। দুটি মেয়েই অসাধারণ পারফর্ম করেছে। এসবই আলোচনা করছিলেন ওঁরা। হঠাৎ বিপত্তি। গাড়ির দরজা খুলে তাড়াতাড়ি নেমে এলেন দুজনে। যে ছেলেদুটি ওকে তাড়া করে আসছিল, তাদের আর দেখা গেল না। অচৈতন্য মেয়েটাকে দেখে অবাক হয়ে দেখছিলেন শান্তনু। বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে কি! দ্যাখ তো।" অরুময় বিরক্তি সহকারে বলেন, "চেনা হবে কি করে! দ্যাখ, কোনো কলগার্ল হবে হয়তো। না হলে এতো রাতে কুত্তারা তাড়া করবে কেন!" শান্তনুও বিরক্ত। "তোর যত আজেবাজে কথা। আমার তো মনে হচ্ছে, মেয়েটা ভদ্র ঘরের মেয়ে। কোনো বিপদে পড়েছে "।

প্রতিবাদ করে উঠলেন অরুময়," কলগার্ল যে নয়, বুঝলি কি করে!" 

"না। কলগার্ল নয়। আমার কথা মিলিয়ে নিস। আমার তো মনে হচ্ছে আঁখি সেনের কথা। ঠিক ওই রকমই দেখতে মেয়েটাকে।" 

"ওঃ গড! কার সাথে কার তুলনা! সংগীত শিল্পীই যদি হয়, এত রাতে তাহলে একলা কেন! আর ছেলেগুলো ওকে তাড়াই বা করল কেন"! 

"জানি না ।তবে এগুলো এখন না ভাবলেও চলবে। আগে ওর চিকিৎসার প্রয়োজন। আগে তো সেটার ব্যবস্থা করি ", শান্তনু বললেন। 

আঁখিকে ওঁরা কাছাকাছি একটা নার্সিংহোমে ভর্তি করে দিলেন। রিসেপশনিস্ট মেয়েটা একটু ঝামেলা করছিল,"এটা তো পুলিশ কেস। আগে পুলিশ আসুক "। 

অরুময় কঠিন স্বরে বললেন," মেয়েটার এখনও জ্ঞান ফেরেনি। আপনারা ট্রিটমেন্ট শুরু করুন। আমরাই থানায় ফোন করছি।"সঙ্গে সঙ্গেই সোনারপুর থানায় ফোন করলেন অরুময়। অফিসার দিব্যেন্দু ব্যানার্জি অরুময়ের ছেলেবেলার বন্ধু। অরুময়ের কাছ থেকে ঘটনাটা শুনে, নিজেই রিসেপশনিস্টের সঙ্গে কথা বললেন। এরপর দুজন ওয়ার্ডবয় এসে স্ট্রেচারে করে আঁখিকে ভেতরে নিয়ে গেল। 

   পরদিন সকালে, আঁখি তখন অনেকটাই সুস্থ। ও একাই চুপচাপ ওর বেডে বসেছিল। নানা ধরণের চিন্তা ভিড় করে আসছে মনের মধ্যে। মাসিমণি হয়তো আর বাড়িতে ঢুকতেই দেবে না। ওই বাড়ির পর্ব শেষ সম্ভবত। তবে একটা ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে সযত্নে গোপন করে রেখেছিল ও । সেটা ওর দাদু অর্থাৎ শুভরঞ্জনের সঙ্গে যোগাযোগ। একমাত্র ছেলের মৃত্যুর পর ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছিলেন শুভরঞ্জন। চেয়েছিলেন নাতনীটাকে আঁকড়ে ধরতে। নাতনীর খোঁজ করতে গিয়েছিলেন উনি জ্ঞানদারঞ্জনের বাড়ি। বিশ্রী ভাবে অপমান করে ওনাকে তাড়িয়ে দেন মীনা। আঁখি সেদিন জানতেও পারেনি। শুভরঞ্জন বুঝতে পেরেছিলেন, মীনার উদ্দেশ্য ভালো নয়। অপেক্ষায় ছিলেন শুভরঞ্জন। দুটো বছর কেটে যাবার পর আঁখি কলেজে ভর্তি হল। কলেজেই একবার আঁখির সাথে দেখা করতে এলেন শুভরঞ্জন। সেদিন ক্লাস শেষ হতে কলেজের দারোয়ান একটা চিরকুট এনে দিয়েছিল আঁখির হাতে। চিরকুটে লেখা ছিল, 'তুমি যদি জ্ঞানদারঞ্জনের মেয়ে আঁখি সেন হও, তাহলে একবার বাইরে এসে দেখা করো আমার সঙ্গে। আমি শুভরঞ্জন সেন, তোমার দাদু।" চিরকুট টা মেঘাকে দেখিয়েছিল আঁখি। প্রশ্ন করেছিল মেঘা ," কি করবি এখন "? 

" দেখা করব। আমার সাহায্যের প্রয়োজন। এই লোকটাই এখন একমাত্র আমাকে আগলে রাখতে পারবে। যদিও আমার বাবা হয়তো ওনার জন্যেই মারা গেছেন। আমার মা কেও অপমান করেছেন উনি। তবুও উনি আমার বাবার বাবা। ওনাকে ফেরাতে পারব না আমি।" মেঘা আর আঁখি দুজনেই এসে দাঁড়িয়েছিল শুভ রঞ্জনের সামনে। দাদু নাতনীর ভাব হতে বেশি সময় লাগেনি। মা বাবাকে হারানোর কতদিন পরে আঁখি নিজের দাদু, ঠাম্মির আদরের স্বাদ পেয়েছিল। মারা যাবার আগে শুভরঞ্জন নিজের বাড়িটা উইল করে দিয়েছিলেন আঁখির নামে।বিভিন্ন জায়গায় কিছু ফাঁকা জমি ছিল ওনার। সেই জমি বিক্রি করে তার টাকার একটা ভাগ নিজের স্ত্রীর নামে ব্যাঙ্কে রেখেছিলেন তিনি।নমিনি ছিল আঁখি। আর একটা ভাগ আঁখির নামে ব্যাঙ্কে ফিক্সড করে রেখেছিলেন । সেই টাকার সুদেই আঁখির নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা এবং শখ দুটোই মিটত। তার ওপরে ছিল স্কলারশিপের টাকা। একবার সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন মীনা, "এসব দামী দামী জামা কাপড়, শখের জিনিস কোথা থেকে আসছে তোর?" 

আঁখি জবাব দিয়েছিল, "আমি তো একটা মেধাবী ছাত্রী নাকী! সরকার আমাকে একটা স্কলারশিপ দেয়। সেটা কি ভুলে গেছ?" চুপ করে গিয়েছিলেন মীনা। 

     শুভরঞ্জন এক সময়ে আঁখিকে বলেছিলেন, "কেন ওখানে এত কষ্ট করে পড়ে আছিস মা। চলে আয় না আমাদের কাছে "। 

" না দাদু। আমি ওদের ছাড়ব না। শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় আছি। উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে ওদের। আমার মৃত্যু পথযাত্রী বাবাকে ওরা প্রতারণা করেছে। তার দাম তো দিতেই হবে ওদের।" 

এখন আর দাদু বেঁচে নেই। ঠাম্মি আছে। তবে ও বাড়ি এখন তালা দেওয়া। ঠাম্মি এখন বাড়িতে নেই। বেড়াতে গেছে। খুব বেড়ানোর সখ ঠাম্মির ।এখন অমরকন্টকে আছে ঠাম্মি। ওই বাড়ির ডুপলিকেট চাবি একটা আঁখির কাছেই থাকে সবসময়। একটা মোবাইল ফোন ওকে কিনে দিয়েছিলেন দাদু, যোগাযোগের সুবিধার জন্যে। সেই ফোনটা কাল ভেঙে গেছে। আগে একটা মোবাইল ফোন কিনতে হবে। না হলে ঠাম্মি ফোন করতে পারবে না। খুব চিন্তা করবে তখন। এসব কথাই ভাবছিল আঁখি। ডাক্তার চৌধুরী ঢুকলেন কেবিনে , সাথে রয়েছেন সিস্টার। ওকে দেখে বললেন, "এই তো। তুমি একদম ঠিক হয়ে গিয়েছো। হাতে, পায়ে একটু চোট আর কপালে দুটো স্টিচ্ পড়েছে। ও দুদিনে ঠিক হয়ে যাবে। তোমার বাড়ির লোকেরা এলে এখনই ছেড়ে দেব তোমায়। সিস্টার বললেন," কিন্তু স্যার, উনি বাড়ির যে ফোন নাম্বার দিয়েছেন, সেখানে ফোন করা হয়েছিল, তারা বলেছেন, ওই বাড়িতে আঁখি সেন বলে কেউ থাকে না। আঁখি বলে," জানতাম, এটাই হবে "। ওর মৃদু স্বরে বলা কথাগুলো কেউই বুঝতে পারেনি। তাই সিস্টার জিজ্ঞেস করেন," কি বলছেন "? আঁখি বলে "না। কিছু না। কে ফোন ধরেছিল।" 

"রণজয় মল্লিক নামের কেউ। ফোনটা ধরে বেশ বিরক্ত হয়েই বলল,'দেখুন এটা মল্লিকবাড়ি। এখানে সেন আসবে কোথা থেকে। ওই নামে কেউ থাকে না এখানে। আর ডিস্টার্ব করবেন না আমাদের"। মাথা নিচু করে বসে আছে আঁখি। চিন্তিত মুখে ডাক্তার চৌধুরী বললেন, স্ট্রেঞ্জ! একে যারা এখানে নিয়ে এসেছিলেন, তারাই বা কোথায়"! আঁখি বলে চিন্তা করবেন না ডাক্তারবাবু। আমি আ্যডাল্ট। আমাকে ছেড়ে দিন। আমি পেমেন্ট করতে পারব। আমার কাছে এটি এম কার্ড আছে।" ডাক্তার চৌধুরী ভাবছিলেন কি করবেন। সেই মুহূর্তেই অরুময় আর শান্তনু ঢুকলেন। আজ নার্সিংহোমে এসেই আঁখির আসল পরিচয় পেলেন ওঁরা। শান্তনু হাসতে হাসতে বললেন," কি বলেছিলাম অরুময়! তখন বিশ্বাস করিসনি। একদম ঠিক চিনেছিলাম আমি "। 

  সকাল দশটা নাগাদ নার্সিংহোম থেকে আঁখিকে নিয়ে বেরোলেন দুই বন্ধু। নার্সিংহোমের পেমেন্ট ওনাদের করতে দেয়নি আঁখি, নিজেই করেছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ওর দৃঢ় চরিত্রের পরিচয় পেলেন অরুময় ও শান্তনু। তবে একটু বিস্মিত হয়েছেন ওঁরা। এতগুলো টাকা চট করে দিয়ে দিতে পারল! কত ধনী পরিবারের মেয়ে ও! 

                           ক্রমশ :—


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational