চোখের আলোয় (পর্ব - 13)
চোখের আলোয় (পর্ব - 13)
দোলা ভট্টাচার্য্য
সকালে চায়ের পট নিয়ে ব্রেকফাস্টের টেবিলে অপেক্ষা করছিল আঁখি। তরুবালা সেই ভোরবেলাতেই গেছেন মন্দিরে পুজো দিতে। অরুময় আসতে কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিল আঁখি। চায়ে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করলেন অরুময়, "পিসীমা কোথায়?"
"মন্দিরে গেছেন পুজো দিতে"।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবার কথা বললেন অরুময়, "কালকের ঘটনায় আমি জানি তুমি খুব আঘাত পেয়েছো।"
চমকে উঠে মুখ তুলে তাকাল আঁখি। চোখ দুটোতে জলের আভাস সকালের আলোয় চিকচিক করে উঠল ওর ।
"আসলে এ কাজ আমি করতেই চাইনি"।
" আমাকে জানালেন না কেন?" আঁখি বিস্মিত।
" কোনো উপায় ছিল না আমার। বিশ্বাস করো।"
"না। উপায় তো ছিলই। আসলে আপনি পিসীমার ওপর রিভেঞ্জ নিতে চেয়েছিলেন।"
কথাটা একরকম ঠিকই বলেছে আঁখি। তাই সহসা কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পরে বললেন," তোমায় আমি ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছি আঁখি। আবার নতুন করে জীবন শুরু কর তুমি।"
" তাতে আমার লাভ "! অরুময় চুপ ।এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই ওঁর।
বুকের মধ্যে উথলে ওঠা ঢেউটাকে সামলে নিয়ে আঁখি বলল, "আপনি আমাকে যেদিন বলবেন সেদিনই এখান থেকে চলে যাব আমি। আপাতত আমরা কি একে অপরের ভাল বন্ধুও হতে পারি না! পিসীমার জন্য এটুকু না হয় আমরা করলাম।" যে পিসীমার জন্যে ওর নিজের জীবনটা নষ্ট হতে বসেছে, সেই পিসীমার জন্যেও ওর প্রাণ কেঁদে উঠছে। তাই এই আপোস করার চেষ্টা। আঁখি যে এরকমই। চিন্তিত মুখে অরুময় বললেন," রূপা কে যে আমি কোনোদিনই ভুলতে পারব না।"
" না ই বা ভুললেন। "
" আমার ঘরে তোমাকে কবে ওয়েলকাম জানাতে পারব, তাও বলতে পারছি না।"
জলে ভেজা ভোরের শিউলির মতো মুখটায় অনাবিল হাসি ফুটে উঠল আঁখির,
"আমি অপেক্ষা করব।"
"বেশ। তবে তাই হোক" । বিষণ্ণ মুখে কথাগুলো বলে উঠে গেলেন অরুময়।
আঘাত টা সহ্য করতে পারলেন না তরুবালা। বিয়েটা ঘটিয়ে দিয়ে দিনের পর দিন ধরে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছেন উনি। ভালবেসে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল যারা, ছলে বলে কৌশলে তাদের আলাদা করে দিয়েছেন। তিনটে জীবন নষ্ট হতে বসেছে ওনার জেদের জন্যে। একদিন ভোর রাতে প্রায় নিঃশব্দেই চলে গেলেন তিনি। সংসারের চাবি এল আঁখির হাতে। পিসীমার আদরের রাই কমলিনী কেও পরম যত্নে বুকে তুলে নিল। সেইসঙ্গে অনভ্যস্ত হাতে সংসারটাকেও গুছিয়ে তুলতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু বড় বেশি নিঃসঙ্গতা পেয়ে বসল ওকে। অরুময় ওর সঙ্গে নিছকই একটা কেজো সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন। তবে অভদ্রতা করেন না কখনও। হায় রে কপাল! শুধু কি এর জন্যেই ওর জন্ম! কেবলমাত্র পরিবেশ আর পরিস্থিতি ওকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিল না।
ভাগ্যের চাকা হঠাৎই একদিন ঘুরে গেল। সিতারা কে নিয়ে রোজ বিকেলে বাড়ির কাছে একটা পার্কে বেড়াতে যায় আঁখি। হ্যাঁ। রাই কমলিনীর নতুন নাম সিতারা। আঁখিই রেখেছে। সেদিন বিকেলে পার্ক থেকে ফেরার সময় হঠাৎ একটা বিদেশি গাড়ি, ওদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেল। চমকে উঠল আঁখি। গাড়ির দরজা খুলে যে নেমে এল, তাকে দেখে আনন্দে, বিস্ময়ে ও যেন বোবা হয়ে গেল। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। মনে হচ্ছিল, যেন কত যুগ পার হয়ে এল ওরা দুজনে। পথ চলতি দু একটা কৌতুহলী মুখ দাঁড়িয়ে পড়ছে ওদের দেখে, দুজনের কারোরই খেয়াল নেই। কেউ একজন বলে উঠল, "মেঘা রায় না!" কথাটা কানে যেতেই সচকিত হয়ে উঠল দুজনেই । মেঘা এখন বেশ ব্যস্ত গায
়িকা। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটা গানের আ্যলবামও বেরিয়েছে ওর। হাসতে হাসতে আঁখি বলে, "কতদিন বাদে আমাদের দেখা হল বল তো!" মেঘার দুচোখে খুশি উপচে পড়ছে। জিজ্ঞেস করল, "তুই এদিকেই থাকিস?"
"হ্যাঁ ।ওই তো, সামনেই আমাদের বাড়ি ।চল না একটু ঘুরে আসবি।" বলেই একটু যেন থমকে গেল আঁখি। কুন্ঠার সঙ্গে আবার বলল, "অবশ্য তোর যদি সময় থাকে।" দমকা হাওয়ার মতো উচ্ছল হাসির একটা ঝাপটায় ওর মনের মেঘটাকে সরিয়ে দিয়ে মেঘা বলে উঠল, "নেই-ই তো। সময় একদমই নেই। তবু তুই যখন ডেকেছিস, আমি অবশ্যই যাব। চল। দেখে আসি, কেমন সংসার করছিস তুই।"
মেঘাকে পেয়ে আজ মনের অর্গল খুলে গেছে আঁখির। এতদিনের দুঃখ যন্ত্রণার সমস্ত কথাই আজ উজার করে দিল মেঘার কাছে । মেঘা নির্বাক। এতদিন ধরে এত কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা! অথচ ও কিছু জানতেই পারেনি।
আঁখির ঘরটায় বসে কথা বলছিল ওরা দুজনে। খানিক পরে উঠে গিয়ে মেঘার জন্যে চা আর কিছু স্ন্যাক্স নিয়ে এল আঁখি। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মেঘা বলল,
"সেদিনের পর থেকে আমিও তোর সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি। তোর বাড়িতে ফোন করে তোর কথা জানতে চাইলেই কেউ একজন ফোনটা নামিয়ে রাখত। শেষ পর্যন্ত একদিন চলেই গেলাম তোদের বাড়ি। তোর মাসিমণি একরকম অপমান করেই তাড়িয়ে দিলেন। তারপর আমি বেনারস চলে যাই, ওস্তাদ রুস্তমজীর কাছে তালিম নিতে। এম এ টাও ওখানেই কমপ্লিট করলাম। কয়েকদিন হল ফিরেছি এখানে। তোর কথা একদিনের জন্যও ভুলতে পারি নি।" সোফার এককোণে বসে মুখ নীচু করে হাতের নখ খুঁটছিল আঁখি। মেঘার কথা থামতে বলল," আমি যতবার তোকে ফোন করেছি, তোর ফোনটা সুইচড অফ বলছিল। তোর বাবা, মা দুজনকেই ফোনে ধরতে চেষ্টা করেছি। পাইনি।"
" Destiny. বুঝলি! এটাকে মানতেই হবে। আমার ফোনটা চুরি হয়ে গিয়েছিল।অন্য একটা ফোন কিনেছিলাম। বাপি আর মা এখন এখানে নেই। বাপির অফিসের আর একটা শাখা রয়েছে নিউইয়র্ক এ । বাপির কোম্পানি বাপিকে ওখানেই পাঠিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঘা। কিছুক্ষণ পরে আবার বলে,
"তুই এক কাজ কর আঁখি। গানটাকে আবার শুরু কর। তোর প্রতিভা আছে। অনেক ওপরে উঠতে পারবি।"
মুখ তুলে তাকাল আঁখি, "আর আমার সংসার! এতটুকু বাচ্চা মেয়ে, তার কি হবে!" খানিকটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠল মেঘা, "সংসার! এটাকে সংসার বলিস তুই!"
হাসল আঁখি, "তাহলে কি বলা যায়!"
"আমি জানি না। এবার তো একটু সিরিয়াস হবার চেষ্টা কর। "
" তুই কিন্তু শুধু শুধুই রাগ করছিস"।
"না রে। শুধু শুধু নয়। তুই একটু ভেবে দ্যাখ, একটা বয়স্ক মানুষ ভুল করতেই পারেন। কিন্তু অরুময় বাবু একজন অধ্যাপক হয়ে এটা কি করে করলেন!"
"ওর কিছু করার ছিল না। তুই বুঝতে পারছিস না কেন? "
" করার তো ছিলোই অনেক কিছু। যাক, এ নিয়ে আর তর্ক করতে চাইছি না। তবে আমি যা বললাম, ভেবে দেখিস একটু। প্রয়োজনে আমি তোকে সাহায্য করব। অরুময় বাবুর সাথে কথা বলে দেখিস। আজ তাহলে উঠি। "
গাড়িতে ওঠার আগে আঁখির হাত ধরে মেঘা আবার বলল," প্লিজ আঁখি, আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি তোর সংসারটা ভেঙে দিতে বলছি না। মনে আছে তোর, ছোট বেলায় তোকে দুঃখ পেতে দেখলে আমারও চোখে জল এসে যেত? " মেঘার নরম সুডৌল হাতের ওপরে আলতো করে চাপ দিল আঁখি।
একরাশ ধুলো উড়িয়ে মেঘার গাড়িটা যেন উড়ে চলে গেল আঁখির সামনে দিয়ে।
ক্রমশ :—