ভ্রমণ কাহিনী কেদারনাথ যাত্রার পথে.
ভ্রমণ কাহিনী কেদারনাথ যাত্রার পথে.
2006 সালের মে মাস। এবারে গরমেই ভ্রমণ ।গন্তব্য স্থান- কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, হরিদ্বার, হৃষিকেশ। সঙ্গী হলেন কর্তামশাই এর দুই সহকর্মী। একই স্কুলের শিক্ষক ওঁরা, সপরিবারে সঙ্গী হলেন আমাদের। । হাওড়া স্টেশনে ওদের সাথে প্রথম পরিচয় হল আমার।
দুপুর 12.50 মিনিটে ছাড়ল উপাসনা এক্সপ্রেস। 12জনের দল আমাদের, হৈ হৈ করে শুরু হল যাত্রা, একটা কঠিন পথের উদ্দেশ্যে।
অনেকের ট্রেনে ভালো ঘুম হয় না। আমার আবার উল্টো। রাতটা সুন্দর ভাবে ঘুমিয়েই কেটে গেল। এই সকালবেলায় মনটা বেশ চা চা করছে। ভাবতে ভাবতেই চা ওয়ালা হাজির। এক কাপ গরম চা নিয়ে জুত করে বসলাম। ধিকি ধিকি শব্দ তুলে ছুটে চলেছে ট্রেন। একটার পর একটা স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে। আমরাও এগিয়ে চলেছি গন্তব্যের দিকে।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ দীর্ঘ ট্রেন যাত্রা শেষ হল আমাদের, পৌঁছলাম হরিদ্বার।
ভোলাগিরি ধর্মশালায় ঘর পেতে আমাদের অসুবিধা হল না। একদম গঙ্গার ধারে ধর্মশালাটা। আমরা ঘর পেয়েছি তিনতলায়। বিশাল ছাদের ওপর সারি সারি ঘর। ছাদে দাঁড়ালে একদম সামনেই গঙ্গা। আমাদের সবারই খুব পছন্দ হল জায়গা টা। রাতের দিকে হরকে পৈড়ির ঘাট থেকে একটু ঘুরে এলাম। গত দেড় দিনের ট্রেন জার্ণি তে সকলেই খুব ক্লান্ত ছিল। তাই ডিনার সেরে একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালটা শুরু হল গঙ্গায় স্নান দিয়ে। বিকেলে আবার গেলাম হরকে পৈড়ির ঘাটে ।উদ্দেশ্য, আরতি দেখা। ভারি সুন্দর গঙ্গা আরতি হয় এখানে সন্ধ্যা বেলায়। চমৎকার সে দৃশ্য।
হরকে পৈড়ির ঘাটে তখন প্রচুর মানুষের ভীড়। সে এক অপূর্ব জনসমাগম। কাতারে কাতারে লোক বসে রয়েছে ঘাটে মা গঙ্গার আরতি দেখার আশায়।
ঠিক সাতটা পনেরোর সময়ে শুরু হল আরতি। মাইকে বেজে উঠল গঙ্গা আরতির সেই বিখ্যাত গান - "জয় গঙ্গে মাতা, শ্রী জয় গঙ্গে মাতা।
যে নর তুমকো ধ্যাতা মন বাঞ্ছিত ফল পাতা।।"
একে একে অনেকগুলো দীপ জ্বলে উঠল। শুরু হল আরতি। গঙ্গাবক্ষে তখন ভেসে যাচ্ছে ফুল মালায় সজ্জিত পাতার নৌকায় অসংখ্য প্রজ্বলিত দীপ। পুণ্যলোভীরা আপন মনস্কামনা জানিয়ে এই দীপগুলি ভাসিয়ে দিয়েছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। মন ভরে গেল।
পরদিন - সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ হরিদ্বার থেকে আমাদের বাস ছাড়ল, গৌরীকুন্ডের উদ্দেশ্যে ।মনে প্রবল উৎসাহ নিয়ে শুরু করলাম যাত্রা। কিছুক্ষণ পর থেকেই শুরু হল পাহাড়ী চড়াই ।বেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে আমাদের
বাস। দেখতে দেখতে বেশ অনেকটা ওপরে উঠে এলাম।
হরিদ্বার থেকে যাত্রা শুরু করার সময়ে গঙ্গা ছিল আমাদের সাথে। কিছুক্ষণ পরে গঙ্গার পরিবর্তে পথের সাথী পেলাম মন্দাকিনী কে। এরপরই শুরু হল আসল খেল।পাহাড়ি রাস্তায় পাক দিতে দিতে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ওপরে উঠছে বাস। আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগল আমার সহযাত্রী রা। আমাদের 12জনের দলের মধ্যে একজনই মাত্র স্টেডি ছিলেন। ইনিই নানারকম রসিকতা করে দলের সবাই কে সজীব রাখার চেষ্টা করছিলেন। আবার আর একজন বমি করতে করতেই নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ আবৃত্তি করতে শুরু করলেন। এইসব কান্ড কারখানার ফলে হাজার কষ্টের মধ্যেও মুখের হাসিটি ঠিক ছিল।
বেলা একটা নাগাদ 'কুন্ড' নামে একটা জায়গায় ছোট্ট একটা হল্ট। বাস থেকে নেমে যেন শান্তি পেলাম। গাছ গাছালীর ছায়া ঘেরা শান্ত পাহাড়ি রাস্তা। ঝিরঝিরে ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শে শরীর, মন যেন জুড়িয়ে গেল। রাস্তার একপাশে অতল খাদের মধ্যে দিয়ে নৃত্যের ছন্দে বয়ে চলেছে স্বর্গের নদী মন্দাকিনী। আর এক পাশে রয়েছে সাজানো গোছানো একটা রেষ্টুরেন্ট। আশেপাশে রয়েছে আরও দুএকটা ছোট ছোট কোল্ড-ড্রিঙ্ক, চিপস এসবের দোকান। লাঞ্চ আমরা কেউই করলাম না অল্প কিছু খেয়ে আবার বাসে উঠে পড়লাম। এখন অনেকটা ফ্রেশ লাগছে। এখনও ঘন্টা তিনেকের রাস্তা আমাদের অতিক্রম করতে হবে।
এরপরে বাকি পথটুকু কারোরই তেমন কোনো অসুবিধা হয় নি। অবশেষে বিকেল পাঁচটা নাগাদ পৌঁছলাম গৌরীকুন্ড। এখানে ইচ্ছে ছিল 'ভারত সেবাশ্রম সংঘ' এ ওঠার। কিন্তু জায়গা না পেয়ে উঠলাম 'ধারীওয়াল গেস্টহাউস' এ ।
খানিক রেষ্ট নিয়ে আবার বেরোলাম গৌরীকুন্ড দেখতে। এটা আসলে একটা উষ্ণ প্রস্রবন। লোকের বিশ্বাস, এই কুন্ডের জলে স্নান করলে নাকি বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগ বা বাত ব্যাধি সেরে যায়।
গেস্টহাউস থেকে বেরিয়ে খানিকটা ওপরে উঠে কুন্ডের কাছে এলাম। পাথর দিয়ে বাঁধানো একটা বড় চৌবাচ্চার মতো, একধারে গরুর মুখের মতো একটা কল থেকে গরম জল পড়ছে। অনেকেই স্নান করছে এখানে। জল বেশি অপরিস্কার হয়ে গেলে নালী পথে বের করে দেবার ব্যাবস্থাও রয়েছে।
কুন্ড দেখে আরও খানিকটা ওপরে উঠে এলাম আমরা। এখানে একটা ঝর্ণা রয়েছে ।আসলে মন্দাকিনী নদীটাই এখানে বড় বড় বোল্ডার পার হয়ে ঝর্ণার আকারে নিচে পড়ছে।
আটটার মধ্যে ডিনার সেরে ঘরে ঢুকে পড়লাম। পরদিন আমাদের কঠিন যাত্রা। তার জন্য শরীরের সাথে মনকেও প্রস্তুত করা দরকার।
ক্রমশ —