Dola Bhattacharyya

Tragedy

4  

Dola Bhattacharyya

Tragedy

একটা স্বপ্ন ভাঙ্গার গল্প

একটা স্বপ্ন ভাঙ্গার গল্প

5 mins
9



কলমে —দোলা ভট্টাচার্য্য 


স্বপ্ন পুরণের থেকে স্বপ্নভঙ্গ হয় বেশি। এ তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু যে স্বপ্ন পূরণ হতে গিয়েও ভেঙে যায়, তার দুঃখ বোধহয় সব থেকে বেশি। এরকমই একটা স্বপ্নভঙ্গের গল্প আজ বলি। 


    ছোট্ট একটা মুদিখানার দোকান। মালিকের নাম সুকুমার বিশ্বাস। স্ত্রী শকুন্তলা নিতান্তই আটপৌরে গৃহবধূ। একমাত্র সন্তান নির্ঝর, বাবা মায়ের আশা এবং ভরসা। খুব কষ্ট করেই ছেলেকে মনের মতো করে গড়ে তুলেছেন বিশ্বাস দম্পতি। 

ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রতি তীব্র আগ্রহ ছেলের। টিভিতে নাচ হচ্ছে দেখলে আর নড়তে চাইত না। খুব মন দিয়ে দেখত। তারপর একা একাই হাত পা ঘুরিয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে চেষ্টা করত। ক্রমে ক্রমে পায়ে এল তাল। ছন্দের দোলা লাগল দেহভঙ্গিমায়।ছেলের আগ্রহ দেখে স্থানীয় নাচের স্কুল “নৃত্যের অঙ্গন”এ ওকে ভর্তি করে দিলেন সুকুমার । আপত্তি করেছিলেন শকুন্তলা, “মেয়ে হলে আপত্তি করতাম না, কিন্তু ও যে ছেলে!“ কান দেন নি সুকুমার। ছেলে তো কি! পুরুষ নৃত্যশিল্পী তুমি দেখো নি? উদয়শংকরের নাম শোনোনি? প্রভু দেবা? শোনোনি নাম? “

চুপ করে যান শকুন্তলা। একবার শুধু মৃদুস্বরে বলে ওঠেন, “গরীবের ঘোড়ারোগ নয় কি? “জবাব দেন না সুকুমার। 

পড়াশোনার সঙ্গে চলল নাচের তালিম। দেখতে দেখতে কেটেও গেল একটা বছর। নাচের স্কুলে ইতিমধ্যেই সবার নজর কেড়েছে শিশু নির্ঝর। নৃত্যশিল্পী সুন্দর দাস দীর্ঘদিন ধরেই চালাচ্ছেন এই নাচের স্কুলটা। জহুরীর চোখ। রত্ন চিনতে ভুল করেন না। নিজের সবটুকু দিয়ে গড়ে তুলছিলেন নির্ঝর কে। 

    দিনের পরে কেটে যায় দিন। একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছে নির্ঝর। সমস্ত মনোযোগ ওর নাচে। তা বলে পড়াশোনায় অবহেলা করে না। স্কুল শেষ করে এবার কলেজের পালা। কিছুদিন থেকেই ওর ইচ্ছে, “নতুন বাংলা” টিভি চ্যানেলে প্রতি বছর “নৃত্যের তালে তালে” নামে যে রিয়্যালিটি শো হয়, তা’তে নাম দেবে। সুন্দর দাস শুনে বললেন, “নিশ্চয়ই দেবে। আমি ব্যাবস্থা করে দেব। “

      

 অডিশনের পালা চুকিয়ে এবার ফাইনাল সিলেকশন। তিনজন জাজ কে খুশি করে নির্বাচিত হল নির্ঝর। তারপর তো ইতিহাস। 

   দেখতে কেটে গেল কতগুলো সপ্তাহ। পাড়ার এবং আশেপাশের অঞ্চলের সবাই এই কয়েকটা মাস ধরে টিভিতে দেখেছে নির্ঝর কে। দেখেছে ওর নাচ। মুগ্ধ হয়েছে সকলে। গন্ধর্ব দেবতার মতো দক্ষ নৃত্য কুশলী এই ছেলেটিকে প্রাণভরে করেছে আশীর্বাদ। দেখতে দেখতে চলে এল গ্র্যান্ড ফিনালে । নিজের সবটুকু দিয়েও ফার্স্ট হওয়া গেল না। ব্যাড লাক। না না। ব্যাড লাক কোথায়! প্রথম না হোক। দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে নির্ঝর। প্রশংসার বন্যায় ভেসে যেতে ওর চোখ দুটো তখন সুকুমার কে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোথায় গেল বাবা! একটু আগেও তো অডিয়েন্সের গ্যালারিতে দেখা গেছে! দুচোখে রুমাল চেপে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তখন সুকুমার। এতোদিনের কৃচ্ছসাধন সার্থক হয়েছে আজ। এ যে আনন্দের কান্না । শকুন্তলার চোখেও জল ।তিনি চাননি ছেলে এই পথে যাক। তবু সহযোগিতা ছিল তাঁরও। আজ তিনিও খুশি ধরে রাখতে পারছেন না। 


    শুরু হল নতুন জীবন। চ্যানেলের চুক্তি অনুযায়ী প্রথম একটা ছোট সিরিয়ালের অফার পেল নির্ঝর। প্রথম কাজ। কয়েকটা মাস হাড়ভাঙা খাটনি গেল। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ওর কাজে খুব খুশি। তাই শেষ হতেই আর একটা অফার চলে এল। সুন্দর দাস নিতে বারণ করলেন। তাঁর লক্ষ্য ছেলেটিকে আরোও বড় জায়গায় পৌঁছে দেওয়া। সিরিয়াল করতে ঢুকে গেলে তো চলবে না। আরোও ঘষামাজা করতে হবে ওকে। সেইসঙ্গে পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে হবে। সেভাবেই চলছিল। মাঝেমধ্যেই শো থাকে। তবে খুব বেশি শো নেয় না নির্ঝর। গুরুজী বলেছেন, “আগে ভালো করে তৈরি হও। তারপর শো এর অভাব হবে না তোমার। 

    বিএ পাশ করল নির্ঝর। এরপর ক্রিয়েটিভ আর্টস নিয়ে পড়তে চায় ও। সেইসঙ্গে নাচের প্রশিক্ষণ। এখন আর সুকুমার কে টাকা দিতে হয় না। নিজের উচ্চশিক্ষার খরচ নিজেই বহন করে নির্ঝর। একমাত্র সন্তানের জন্য গর্ববোধ করেন সুকুমার ও শকুন্তলা। এমনই দিনে হঠাৎ এল খুশির খবর। প্রথম বিদেশ যাবার আমন্ত্রণ। দুবাইতে হবে সঙ্গীত ও নৃত্যের অনুষ্ঠান, বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের নিয়ে। নতুন বাংলা চ্যানেল থেকে ডাক দিয়েছে। দুবাই ডাকছে। যাবে নাকি! 

সুন্দর দাস খুব খুশি। বাবা মা একটু কিন্তু কিন্তু করছে ঠিকই। অবশেষে রাজি হয়ে গেলেন সুকুমার ও শকুন্তলা। ছেলের আনন্দেই যে ওঁদের আনন্দ। 

     পাসপোর্ট, ভিসা রেডি। উড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছে নির্ঝর। আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। এমন সময়েই অফারটা এসেছিল। সমতাপল্লি থেকে। দুবছর হল শুরু হয়েছে সমতাপল্লি উৎসব। এবারেও হবে। উৎসব কর্তৃপক্ষ ডেকে পাঠিয়েছে নির্ঝর কে। প্রথামাফিক চিঠি পাঠানো হয়েছে ওর নামে। সানন্দে রাজি হয়েছে নির্ঝর। সমতাপল্লী বেশি দূরে তো নয়। বাইকে গেলে বাড়ি থেকে মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছোনো যায়। খুশির উড়ান দেবার আগে একটা শো করা যেতেই পারে। এখানেও বড় বড় শিল্পীরা আসছেন। তাঁদের খুব কাছ থেকে দেখতে পাওয়া যাবে। এটাও তো একটা বড় পাওয়া। 


       “ এবার আমরা ডেকে নিচ্ছি নতুন বাংলা চ্যানেলের নৃত্যের তালে তালে রিয়্যালিটি শো তে দ্বিতীয় হওয়া শিল্পী নির্ঝর বিশ্বাস কে। টিভিতে আমরা যার নৃত্য প্রদর্শন দেখে মুগ্ধ হতাম, আজ তিনিই এসেছেন আমাদের মাঝে।” ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হাততালি। দর্শক আসনে আজ অনেক লোক। সুকুমার আর শকুন্তলাও রয়েছেন। শুরু হল অনুষ্ঠান। নির্ঝরকে সেদিন স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো দেবদূতের মতোই দেখাচ্ছিল। দর্শক মুগ্ধ। 

একটা সময়ে শেষ হল অনুষ্ঠান ।ক্লান্ত নির্ঝর দর্শকদের অভিবাদন জানিয়ে নেমে যাচ্ছে স্টেজ থেকে। ঠিক তখনই, সিঁড়ির কাছে পড়ে থাকা কিছু তারের গুচ্ছ জড়িয়ে গেল পায়ে ।তীব্র ঝাঁকুনি লাগল সারা শরীরে। আপ্রাণ চেষ্টা করে চিৎকার করে উঠলো নির্ঝর, “বন্ধ করোও মেন সুইইচ। “ শুরু হল হইচই। কোথায় ইলেকট্রিসিয়ান? কোথায়? কে বন্ধ করবে মেন সুইচ! তখনও প্রাণ আছে শিল্পীর শরীরে। বাঁচার জন্য আকুল চেষ্টায় শেষবারের মতো চিৎকার করে উঠলো, “আমাকে বাঁচিয়ে দাওও। “

পাগলের মতো ছোটাছুটি করছেন সুকুমার আর শকুন্তলা। কেউ ওদের এগোতেই দিচ্ছে না। “আমাদের যেতে দিন । ও আমাদের ছেলে। “

“না। এগোবেন না। বিপদ হয়ে যাবে। পরিস্থিতিটা বুঝতে চেষ্টা করুন। “

“মেন সুইচ টা অফ করুন দয়া করে “, কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে ওঠেন সুকুমার। তুমুল হইচই হট্টগোলের মধ্যে ডুবে যায় ওঁর গলা। 


তারপর কি হল!!! প্রত্যক্ষদর্শী জানেন, আমি নই। ছেলেটি মারা যায়। খবরটা কানে আসতে পাথর হয়ে গেলাম। এভাবে মৃত্যু! ওকে কি কোনোভাবে বাঁচানো যেত না! 

দুবাই যাওয়া আর হল না নির্ঝরের। কুড়ি বছরের জীবনটা তার এখানেই থেমে গেল।

নিজেদের দোষ অস্বীকার করে উৎসব কমিটি থেকে ঘোষণা করা হল — আচমকা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে উদীয়মান তরুণ শিল্পী নির্ঝর বিশ্বাসের মৃত্যু হয়েছে। হতবাক হয়ে গেলেন হতভাগ্য পিতামাতা। আপ্রাণ চেষ্টা করলেন প্রতিবাদ করতে—“আমার ছেলেটা অসুস্থ ছিল না।কোনো অসুখ ছিল না ওর ”। নাঃ। সেকথা কারোকে শুনতে দিতে চায় নি উৎসব কমিটি। তবু পৌঁছে গেছে সে সংবাদ কিছু মানুষের কানে। প্রতিবাদের সামিল হয়নি কেউ। হতে পারে নি। এখন যে ভয় পায় লোকে প্রতিবাদ করতে। তাই কোনো প্রতিবাদ হয়নি, ফেসবুকে কোনো পোস্ট পড়ে নি। তবে জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে মিছিল বেরিয়েছিল একটা, নির্ঝরের স্মরণে। কিছু Irresponsible মানুষের জন্য চিরতরে হারিয়ে গেছে নির্ঝর বিশ্বাস। এতবড় স্বপ্নভঙ্গের বিচার হয়নি কোনও। 


{গল্প টি সম্পূর্ণ কাল্পনিক}


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy