চোখের আলোয় (পর্ব 13 —14)
চোখের আলোয় (পর্ব 13 —14)
পর্ব - 13
সকালে চায়ের পট নিয়ে ব্রেকফাস্টের টেবিলে অপেক্ষা করছিল আঁখি। তরুবালা সেই ভোরবেলাতেই গেছেন মন্দিরে পুজো দিতে। অরুময় আসতে কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিল আঁখি। চায়ে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করলেন অরুময়, "পিসীমা কোথায়?"
"মন্দিরে গেছেন পুজো দিতে"।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবার কথা বললেন অরুময়, "কালকের ঘটনায় আমি জানি তুমি খুব আঘাত পেয়েছো।"
চমকে উঠে মুখ তুলে তাকাল আঁখি। চোখ দুটোতে জলের আভাস সকালের আলোয় চিকচিক করে উঠল ওর ।
"আসলে এ কাজ আমি করতেই চাইনি"।
" আমাকে জানালেন না কেন?" আঁখি বিস্মিত।
" কোনো উপায় ছিল না আমার। বিশ্বাস করো।"
"না। উপায় তো ছিলই। আসলে আপনি পিসীমার ওপর রিভেঞ্জ নিতে চেয়েছিলেন।"
কথাটা একরকম ঠিকই বলেছে আঁখি। তাই সহসা কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পরে বললেন," তোমায় আমি ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছি আঁখি। আবার নতুন করে জীবন শুরু কর তুমি।"
" তাতে আমার লাভ "! অরুময় চুপ ।এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই ওঁর।
বুকের মধ্যে উথলে ওঠা ঢেউটাকে সামলে নিয়ে আঁখি বলল, "আপনি আমাকে যেদিন বলবেন সেদিনই এখান থেকে চলে যাব আমি। আপাতত আমরা কি একে অপরের ভাল বন্ধুও হতে পারি না! পিসীমার জন্য এটুকু না হয় আমরা করলাম।" যে পিসীমার জন্যে ওর নিজের জীবনটা নষ্ট হতে বসেছে, সেই পিসীমার জন্যেও ওর প্রাণ কেঁদে উঠছে। তাই এই আপোস করার চেষ্টা। আঁখি যে এরকমই। চিন্তিত মুখে অরুময় বললেন," রূপা কে যে আমি কোনোদিনই ভুলতে পারব না।"
" না ই বা ভুললেন। "
" আমার ঘরে তোমাকে কবে ওয়েলকাম জানাতে পারব, তাও বলতে পারছি না।"
জলে ভেজা ভোরের শিউলির মতো মুখটায় অনাবিল হাসি ফুটে উঠল আঁখির,
"আমি অপেক্ষা করব।"
"বেশ। তবে তাই হোক" । বিষণ্ণ মুখে কথাগুলো বলে উঠে গেলেন অরুময়।
আঘাত টা সহ্য করতে পারলেন না তরুবালা। বিয়েটা ঘটিয়ে দিয়ে দিনের পর দিন ধরে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছেন উনি। ভালবেসে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল যারা, ছলে বলে কৌশলে তাদের আলাদা করে দিয়েছেন। তিনটে জীবন নষ্ট হতে বসেছে ওনার জেদের জন্যে। একদিন ভোর রাতে প্রায় নিঃশব্দেই চলে গেলেন তিনি। সংসারের চাবি এল আঁখির হাতে। পিসীমার আদরের রাই কমলিনী কেও পরম যত্নে বুকে তুলে নিল। সেইসঙ্গে অনভ্যস্ত হাতে সংসারটাকেও গুছিয়ে তুলতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু বড় বেশি নিঃসঙ্গতা পেয়ে বসল ওকে। অরুময় ওর সঙ্গে নিছকই একটা কেজো সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন। তবে অভদ্রতা করেন না কখনও। হায় রে কপাল! শুধু কি এর জন্যেই ওর জন্ম! কেবলমাত্র পরিবেশ আর পরিস্থিতি ওকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিল না।
ভাগ্যের চাকা হঠাৎই একদিন ঘুরে গেল। সিতারা কে নিয়ে রোজ বিকেলে বাড়ির কাছে একটা পার্কে বেড়াতে যায় আঁখি। হ্যাঁ। রাই কমলিনীর নতুন নাম সিতারা। আঁখিই রেখেছে। সেদিন বিকেলে পার্ক থেকে ফেরার সময় হঠাৎ একটা বিদেশি গাড়ি, ওদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেল। চমকে উঠল আঁখি। গাড়ির দরজা খুলে যে নেমে এল, তাকে দেখে আনন্দে, বিস্ময়ে ও যেন বোবা হয়ে গেল। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। মনে হচ্ছিল, যেন কত যুগ পার হয়ে এল ওরা দুজনে। পথ চলতি দু একটা কৌতুহলী মুখ দাঁড়িয়ে পড়ছে ওদের দেখে, দুজনের কারোরই খেয়াল নেই। কেউ একজন বলে উঠল, "মেঘা রায় না!" কথাটা কানে যেতেই সচকিত হয়ে উঠল দুজনেই । মেঘা এখন বেশ ব্যস্ত গায়িকা। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটা গানের আ্যলবামও বেরিয়েছে ওর। হাসতে হাসতে আঁখি বলে, "কতদিন বাদে আমাদের দেখা হল বল তো!" মেঘার দুচোখে খুশি উপচে পড়ছে। জিজ্ঞেস করল, "তুই এদিকেই থাকিস?"
"হ্যাঁ ।ওই তো, সামনেই আমাদের বাড়ি ।চল না একটু ঘুরে আসবি।" বলেই একটু যেন থমকে গেল আঁখি। কুন্ঠার সঙ্গে আবার বলল, "অবশ্য তোর যদি সময় থাকে।" দমকা হাওয়ার মতো উচ্ছল হাসির একটা ঝাপটায় ওর মনের মেঘটাকে সরিয়ে দিয়ে মেঘা বলে উঠল, "নেই-ই তো। সময় একদমই নেই। তবু তুই যখন ডেকেছিস, আমি অবশ্যই যাব। চল। দেখে আসি, কেমন সংসার করছিস তুই।"
মেঘাকে পেয়ে আজ মনের অর্গল খুলে গেছে আঁখির। এতদিনের দুঃখ যন্ত্রণার সমস্ত কথাই আজ উজার করে দিল মেঘার কাছে । মেঘা নির্বাক। এতদিন ধরে এত কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা! অথচ ও কিছু জানতেই পারেনি।
আঁখির ঘরটায় বসে কথা বলছিল ওরা দুজনে। খানিক পরে উঠে গিয়ে মেঘার জন্যে চা আর কিছু স্ন্যাক্স নিয়ে এল আঁখি। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মেঘা বলল,
"সেদিনের পর থেকে আমিও তোর সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি। তোর বাড়িতে ফোন করে তোর কথা জানতে চাইলেই কেউ একজন ফোনটা নামিয়ে রাখত। শেষ পর্যন্ত একদিন চলেই গেলাম তোদের বাড়ি। তোর মাসিমণি একরকম অপমান করেই তাড়িয়ে দিলেন। তারপর আমি বেনারস চলে যাই, ওস্তাদ রুস্তমজীর কাছে তালিম নিতে। এম এ টাও ওখানেই কমপ্লিট করলাম। কয়েকদিন হল ফিরেছি এখানে। তোর কথা একদিনের জন্যও ভুলতে পারি নি।" সোফার এককোণে বসে মুখ নীচু করে হাতের নখ খুঁটছিল আঁখি। মেঘার কথা থামতে বলল," আমি যতবার তোকে ফোন করেছি, তোর ফোনটা সুইচড অফ বলছিল। তোর বাবা, মা দুজনকেই ফোনে ধরতে চেষ্টা করেছি। পাইনি।"
" Destiny. বুঝলি! এটাকে মানতেই হবে। আমার ফোনটা চুরি হয়ে গিয়েছিল।অন্য একটা ফোন কিনেছিলাম। বাপি আর মা এখন এখানে নেই। বাপির অফিসের আর একটা শাখা রয়েছে নিউইয়র্ক এ । বাপির কোম্পানি বাপিকে ওখানেই পাঠিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঘা। কিছুক্ষণ পরে আবার বলে,
"তুই এক কাজ কর আঁখি। গানটাকে আবার শুরু কর। তোর প্রতিভা আছে। অনেক ওপরে উঠতে পারবি।"
মুখ তুলে তাকাল আঁখি, "আর আমার সংসার! এতটুকু বাচ্চা মেয়ে, তার কি হবে!" খানিকটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠল মেঘা, "সংসার! এটাকে সংসার বলিস তুই!"
হাসল আঁখি, "তাহলে কি বলা যায়!"
"আমি জানি না। এবার তো একটু সিরিয়াস হবার চেষ্টা কর। "
" তুই কিন্তু শুধু শুধুই রাগ করছিস"।
"না রে। শুধু শুধু নয়। তুই একটু ভেবে দ্যাখ, একটা বয়স্ক মানুষ ভুল করতেই পারেন। কিন্তু অরুময় বাবু একজন অধ্যাপক হয়ে এটা কি করে করলেন!"
"ওর কিছু করার ছিল না। তুই বুঝতে পারছিস না কেন? "
" করার তো ছিলোই অনেক কিছু। যাক, এ নিয়ে আর তর্ক করতে চাইছি না। তবে আমি যা বললাম, ভেবে দেখিস একটু। প্রয়োজনে আমি তোকে সাহায্য করব। অরুময় বাবুর সাথে কথা বলে দেখিস। আজ তাহলে উঠি। "
গাড়িতে ওঠার আগে আঁখির হাত ধরে মেঘা আবার বলল," প্লিজ আঁখি, আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি তোর সংসারটা ভেঙে দিতে বলছি না। মনে আছে তোর, ছোট বেলায় তোকে দুঃখ পেতে দেখলে আমারও চোখে জল এসে যেত? " মেঘার নরম সুডৌল হাতের ওপরে আলতো করে চাপ দিল আঁখি।
একরাশ ধুলো উড়িয়ে মেঘার গাড়িটা যেন উড়ে চলে গেল আঁখির সামনে দিয়ে।
ক্রমশ :—
পর্ব - 14
রোজ রাতে নটার মধ্যে সিতারাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় আঁখি। দশটা নাগাদ খেতে আসেন অরুময়। খাবারটা বেড়ে দিয়ে ওখানেই থাকে আঁখি, কি লাগে না লাগে দেখার জন্য। অরুময়ের খাওয়া হলে নিজে খেতে বসে। বিয়ের পর থেকে ওরা কোনোদিনই একসাথে খেতে বসেনি। অরুময়ও বলেননি কোনোদিন। আজ অরুময় কে খেতে দিয়ে নিজের ইচ্ছের কথা জানাল আঁখি। মেঘার কথাও বলল। সব শুনে অরুময় বললেন, "বেশ তো। এত সুন্দর একটা গুণ যখন রয়েছে তোমার, তাকে নষ্ট করে লাভ কি! আমিও ভাবছিলাম, কথাটা বলব তোমাকে। তুমি বরং তোমার গুরুজীর সঙ্গে যোগাযোগ করো।"
"কিন্তু একা হাতে সংসার সামলে এসব করা, আমার তো অসুবিধা হবে।"
"ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না আঁখি । সারাদিনের জন্যে একটা লোক রেখে দেব। সে তোমাকে সাহায্য করবে। আর তুমি বাড়িতে না থাকলে, সে সব কাজই করবে। শুধু সিতারাকে নিয়েই যা একটু সমস্যা হবে। "
আঁখি বলল, "সে আমি ম্যানেজ করে নেব। তবে আর একটা সমস্যা রয়েছে। আমি যদি আবার গান শুরু করি, তাহলে অনেকটা সময় ধরে আমাকে রেওয়াজ করতে হবে। তার জন্যে একটা নিরিবিলি ঘরের দরকার। আমার নিজের বাড়ি দুটো তো রয়েছেই । কিন্তু এখান থেকে দূরত্ব তো কম নয়। সেটা একটা সমস্যা। আর ভাবছি নিজের জন্যে একটা গাড়ি কিনে নেব। এরপর থেকে তো বিভিন্ন জায়গায় যেতে হবে আমাকে। "
অরুময় বললেন," ঘরের সমস্যা হবে না। তুমি চাইলে আমার রিডিং রুমটা ইউজ করতে পার। আমি না হয় আমার বেডরুমেই পড়াশোনার কাজটা করব। আর আমিই তোমায় একটা গাড়ি কিনে দিচ্ছি। এটা আমার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। "
" না। প্লিজ না।" কথাটা যেন চাবুক মারল অরুময় কে। চমকে উঠে ওর দিকে তাকালেন অরুময়। অদ্ভুত এক কাঠিন্য ঘিরে রয়েছে ওর মুখমন্ডল জুড়ে।
" স্যরি। আমি ভুল কিছু বলে ফেলেছিলাম। তোমার কোনোও কিছুতেই আমি আপত্তি করব না", কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন অরুময়। বুকের মধ্যে এতক্ষণ যেন একটা দামাল ঝড় দাপাদাপি করছিল ।এতক্ষণে সেটা শান্ত হল। নিশ্চিন্ত হল আঁখি।
মেঘা! মেঘা! মেঘা! একরাশ দমকা হাওয়ার মত এসে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলল ওকে, ওর সেই চির আকাঙ্খিত স্বপ্নের জগতে। আবার নতুন করে শুরু হল তালিম নেওয়া, স্বপ্ন পূরনের চেষ্টা। ভিত ওর তৈরিই ছিল। তাই বেশি অপেক্ষা করতে হল না। টি. ভি-তে একটা প্রাইভেট চ্যানেলে একটা গানের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করল আঁখি। বাঘা বাঘা জাজ দের সামনে রীতিমত কঠিন পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে ফাইনালে উঠল। ফাইনালে ওর সহ প্রতিযোগী আরও পাঁচজন রয়েছে। কেউ কারো থেকে কম যায় না। রীতিমত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই ।অবশেষে চ্যাম্পিয়ন হল আঁখি বসু। যে কোম্পানি এই অনুষ্ঠানটা স্পনসর করেছিল, তারা ওকে দিয়ে তিন বছরের চুক্তি পত্রে সাক্ষর করাল। ওর প্রথম গানের সিডি বেরোবে এখান থেকেই। খুলে গেল স্বপ্নের জগতের প্রথম দরজা। শুরু হয়ে গেল এগিয়ে চলা। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি ওকে।
প্রথম রেকর্ডিং এর দিন মেঘাই ছিল ওর পাশে। খুব তাড়াতাড়ি মেঘার হাত ধরে অনেক টা ওপরে উঠে এল আঁখি। বাজারে এখন উঠতি শিল্পী হিসেবে ওদের দুজনের খুব নাম।
কদিন পরে আবার মেঘা এল আঁখির কাছে। এসেই আগে সিতারার সাথে খুনসুটি শুরু করে দিল। দুজনে মিলে তুমুল হৈচৈ লাগিয়েছে। আঁখি ঘরে ঢুকতেই, সিতারা নালিশ করল, "দ্যাখো না মা, মেঘা আন্টি আমাকে সীতা, সীতু কি সব পচা নামে ডাকছে। আমার নাম তো সিতারা। ওসব বিচ্ছিরি, পচা নাম আমার হবে কেন?"
আঁখির চোখে মুখে খুশির ঝিলিক, বলল, "তাইতো"!
"তাহলে তুমি মেঘা আন্টিকে বকে দাও"।
মেঘার জন্যে ডিশে করে কিছু খাবার নিয়ে এসেছিল আঁখি। ডিশটা মেঘার দিকে এগিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল," আচ্ছা, দেব "।
পরম আগ্রহে ডিশটা টেনে নিয়ে খেতে শুরু করে দিল মেঘা," খুব ক্ষিদে পেয়েছিল জানিস তো। আজ আমার রেকর্ডিং ছিল। সেই কখন খেয়ে বেরিয়েছি।" আঁখি অবাক হয়ে দেখছিল ওর ছোটবেলার প্রিয় বান্ধবী, বর্তমানের নামকরা সঙ্গীত শিল্পী মেঘাকে।
"কি দরকারি কথা বলবি বলছিলি "?
" হ্যাঁ ।আমাদের ঝগড়া টা আগে মেটাই ।তোর মেয়েকে তুই কি বলে ডাকিস রে"?
" রাই। পিসীমা ওকে আদর করে রাই কমলিনী বলতেন। আমি নামটাকে আরও সর্ট করে নিয়েছি। রাই —আমার রাই মা"। সিতারাকে কাছে টেনে নিয়ে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল আঁখি ।
"বাঃ ।এটা তো সুন্দর নাম। আমিও তাহলে রাই বলেই ডাকব "।
বেশ গম্ভীর মুখ করে সিতারা বলল," না। ওই নামটা শুধু মায়ের জন্যে।"
মেঘা এবার ব্যাগ থেকে একটা বড়সড় চকোলেট বার করে বলল," তাহলে তো এটা যার জন্যে এনেছিলাম, তাকে আর দেব না। আমিই খেয়ে নেব এটা।"
আঁখিকে ছেড়ে এবার মেঘার পাশে এসে বসল সিতারা। মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে পা দোলাতে দোলাতে বলল, "ঠিক আছে, ঠিক আছে, ওটা আমাকে দিলে তবে কনসিডার করতে পারি"। আড়চোখে ওকে দেখতে দেখতে চকোলেট টা বাড়িয়ে ধরল মেঘা। ওটা হাতে নিয়ে গম্ভীর মুখে মোড়কটা খুলতে খুলতে সিতারা বলল, "ঠিক আছে, এবার থেকে তুমিও আমায় রাই বলেই ডেকো।" চকোলেট খেতে খেতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সিতারা। ওরা দুজনে হেসে গড়িয়ে পড়ল।
একটু ধাতস্থ হয়ে আঁখি বলল, "এবার কি বলবি তোর জরুরি কথাটা"?
"হ্যাঁ ।শোন। যা বলতে এসেছিলাম। একটা ডুয়েট গানের প্রোগ্রাম নিবি"?
" ডুয়েট! কার সাথে! "
" মল্লার দার সাথে "।
"মল্লার দা! মানে সেই ফেমাস মল্লার চ্যাটার্জি"? তার সাথে আমার ডুয়েট! কি যে বলিস!"
" ভেবে দ্যাখ আঁখি। সুযোগটা হাতছাড়া করবি?"
এতে ভাবার কি আছে! কোথায় আমি, আর কোথায় মল্লার চ্যাটার্জি। উনিই রাজি হবেন না "।
" যদি বলি, উনি রাজি আছেন "।
চমকে উঠল আঁখি।" কিন্তু কোথায়, কি প্রোগ্রাম কিছুই তো জানি না"।
" শোন, মিলনী সংঘের নাম শুনেছিস তো। প্রতিবারই ওরা পুজোর আগে একটা অনুষ্ঠান করে। বড় বড় শিল্পী কে নিয়ে আসে ওরা। এবারেও ওদের অনুষ্ঠান হবে, রবীন্দ্রসদনে। ওদের উদ্যোক্তারা মল্লার দার কাছে এসেছিল। আমিও তখন সেখানেই ছিলাম। মল্লার দা কথা দিলেন, ওদের প্রোগ্রামে গাইবেন উনি। তারপর ওরা আমাকে বলল, "ম্যাডাম, আমরা আপনার কাছেও গিয়েছিলাম। আপনি ছিলেন না। তাহলে এখানেই কথাটা সেরে ফেলি"।
বললাম, "হ্যাঁ, বলুন"।
ওরা বলল, ওরা তোকে আর আমাকে দিয়ে ডুয়েট প্রোগ্রাম করাতে চায়। কিন্তু আমি তো পারব না। ওইদিন আমার অন্য জায়গায় প্রোগ্রাম আছে। তখন ওদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে আমি মল্লার দার সাথে কথা বললাম। উনি রাজি হলেন। বাইরে এসে ওদের বলতে, ওরাও খুব খুশি হল। কাল পরশুর মধ্যেই ওদের লোক আসবে তোর কাছে। এবার তুই কি করবি ভেবে দ্যাখ। "
রাজি হয়ে গেল আঁখি। তবে মনে একটা ভয় রয়েই গেল। অত বড় মাপের শিল্পী। তার সাথে ডুয়েট! কল্পনাতেই আনতে পারে নি ও। অবশ্য মেঘার সাথে মল্লার দার দীর্ঘদিনের পরিচয়। খুব ভাল বন্ধু ওরা।
অনুষ্ঠানের দিন সকালে ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল আঁখি। আজ তেসরা অক্টোবর। ঠিক তিন বছর আগে এই দিনেই এই রবীন্দ্রসদনেই ওর প্রোগ্রাম ছিল। ওর জীবনের প্রথম প্রোগ্রাম। আর ওই দিনই ওর জীবনের মোড় টা বিশ্রী ভাবে অন্য রাস্তায় ঘুরে গিয়েছিল। আজকের সাথে সেই দিনটার একটাই তফাৎ, সেদিন ছিল বিজয়া দশমী। আর আজ এই তেসরা অক্টোবরে পুজোর এখনও শুরুই হয়নি। আর দুদিন বাদেই দেবীর বোধন। একটা হিমস্রোত যেন ওর সমস্ত স্বত্তাকে আচ্ছন্ন করে দিল। ক্রমশ :—
( এই উপন্যাসের সমস্ত পর্ব রয়েছে চোখের আলোয় পর্ব —1 এ)