ধারাবাহিক চোখের আলোয় পর্ব-11
ধারাবাহিক চোখের আলোয় পর্ব-11
দোলা ভট্টাচার্য্য
সেদিন রাতে অরুময় কে খেতে দিয়ে পিসীমা বললেন, "বাড়ি টা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, বুঝলি অরু। মেয়েটার জন্যে বড় মন কেমন করে"। কিছু না বলে একটু হাসলেন অরুময়। কতদিন রাতে খেতে বসে আঁখির সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন অরুময়। আলোচনা অনেক সময়ে তর্কের দিকে গড়াত। তখন পিসীমাই এসে সামাল দিতেন। একদম ঘরের মেয়ে হয়ে উঠেছিল আঁখি। দিন কুড়ি মাত্র এখানে ছিল মেয়েটা। তার মধ্যেই সবাইকে কেমন মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছিল। বড্ড বই পাগল ছিল মেয়েটা। এক দৃষ্টিতে অরুময়ের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন তরুবালা। মনের মধ্যে কোনো অস্পষ্ট কল্পনা দানা বেঁধে উঠতে চাইছে, কিন্তু প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে না। অরুময়ের চোখে চোখ পড়তেই নিজেকে সামলে নিলেন তরুবালা। অরুময় বিস্মিত,
"কিছু বলবে পিসীমা"?
"হ্যাঁ রে অরু! মেয়েটাকে কি এবাড়িতে নিয়ে আসা যায় না?" বেশ দ্বিধার সঙ্গেই প্রশ্নটা করলেন তরুবালা।
"কেন পিসীমা! সে তো তার নিজের বাড়িতে ফিরে গেছে। আর, তাকে যতটা সাহায্য করা দরকার, করেছি তো আমি"।
"ব্যাস। এখানেই কর্তব্য শেষ! ওইটুকু একটা মেয়ে, একলা একলা কি করে কাটাবে ভেবে দেখেছিস একবার! এর পরেও তো যেকোনো বিপদ ঘটতে পারে ওর। "
হতাশ গলায় অরুময় বললেন, "তাহলে আমাকে আর কি করতে বলছো তুমি!"
" ওকে তুই বাঁচা অরু। "
ঈষৎ বিরক্তির সাথে বললেন অরুময়, " কিভাবে?"
" বিয়ে করে। তুই কি ভেবেছিস এভাবেই সারা জীবন কাটিয়ে দিবি?"
" তা হয় না পিসীমা"। আর্তনাদ করে উঠলেন অরুময়, " রূপাকে আমি আজও ভুলতে পারি নি। ওর জায়গায় কারোকে বসাতে পারবো না আমি। "
" ভুলবি কেন! এভাবে নিজেকে শেষ করে দিলে, সে খুব খুশি হবে বুঝি! তার মেয়েটাকে দেখতে হবে না! আমি জানি, আমার রাই কমলিনী তোর মনটাকে টানতে পারে নি। কিন্তু ওর প্রতি দায়িত্ব তো তুই অস্বীকার করতে পারিস না। আমি মারা গেলে ওর কি হবে ভেবে দেখেছিস একবার?"
গুম মেরে বসে রইলেন অরুময়। একদম মোক্ষম জায়গায় ঘা দিয়েছেন পিসীমা। "কি হল! বল কিছু! "
" এ হয় না পিসীমা। মাত্র তেইশ বছর বয়স ওর। আমার সাথে বয়সের তফাৎ ওর অনেকটা।" পিসীমা কে বোঝাতে চেষ্টা করলেন অরুময়।
কিন্তু তরুবালার মাথায় সেদিন কি যেন ভর করেছিল। জেদের বশে বলে বসলেন, "ওটা কোনো ব্যাপার নয় অরু। আমার রাই কমলিনীর জন্যে এটা তোকে করতেই হবে, এই আমি বলে দিলাম। "
উঠে পড়লেন অরুময় ।রোজ এসময় একটু পড়াশোনা করেন। কিন্তু আজ আর কিছু ভালো লাগছিল না। পিসীমার কথাগুলো ঠিক ফেলে দেবার মতো নয়। সত্যিই তো, রাই এর ভবিষ্যৎ কি! ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে অন্ধকারেই চুপ করে বসে রইলেন অরুময়।
প্রায় প্রতিদিনের মতোই আজও সেন ভিলায় এসেছেন শান্তনু। সাজানো ড্রইং রূমে বসে আঁখির গান শুনছেন। পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইছে আঁখি। সপ্তা খানেক আগেই এটা নিয়ে এসেছে ও । আঁখি কে যত দেখছেন, ততোই অবাক হচ্ছেন শান্তনু। কি অদম্য জেদ মেয়েটার। নিজের জিনিস ঠিক আদায় করেই ছাড়ল। ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে, এভাবে লড়াই করে জিতে আসতে পারত না হয় তো। মনে মনে মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছেন শান্তনু। প্রথমটায় মনে হয়েছিল, বয়েসটা হয়তো বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সেটা অবশ্য হয়নি। আঁখি সাড়া দিয়েছে ওঁর ডাকে। শান্তনু জানেন, আঁখ
ি ওনাকেই ভালবাসে। ভাবনার অবকাশে ঘরে ঢুকলেন স্বর্ণলতা। সদ্য শেষ হয়েছে আঁখির গান। স্বর্ণলতার হাতে দুটো প্লেট দেখে আঁখি এগিয়ে এল, "কি এনেছো ঠাম্মি! ওমা! ফিসফ্রাই! দারুউণ।" "গরম গরম ভেজে আনলাম তোদের জন্যে। নে। খেয়ে নে।"
গরম ফিসফ্রাই তে একটা কামড় দিয়েই স্বর্ণলতা কে জড়িয়ে ধরল আঁখি, "দারুণ হয়েছে ঠাম্মি। তোমার জন্যে আছে তো?"
অল্প একটুখানি ভেটকি মাছ ছিল। সেটুকু দিয়েই ওদের জন্যে কটা ভেজেছিলেন স্বর্ণলতা। তাই বললেন, "না রে দিদিভাই। এখন এসব খেতে পারব না।"
উঠে এল আঁখি। ও বুঝতেই পেরেছে, জিনিসটা কম ছিল। স্বর্ণলতার মুখের সামনে প্লেট টা ধরে বলল, আমার থেকে একটুখানি খাও তুমি। কিছু হবে না তোমার। প্লীজ ঠাম্মি।" বাধা হয়ে ওর থেকে একটু ভেঙে নিলেন স্বর্ণলতা।
ওরা আবার হাসি গল্পে মেতে উঠেছে। কলিংবেল টা বাজতে উঠে গেল আঁখি। দরজা খুলতেই, বিরাট একটা চমক। "একী! আপনি!"
" শুধু আমি নই রে মেয়ে। আর একজনও আছে।"ঠাকুমার পেছনে লুকিয়ে ছিল রাই। এবার বেরিয়ে এল ।" ওমা! রাই!" হাসতে হাসতে ছোট্ট মেয়েটাকে কোলে তুলে নিল আঁখি। বলল, "আসুন পিসীমা, ওপরে আসুন।"
আঁখির পেছন পেছন সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এলেন তরুবালা। এই বিশাল বাড়িটা দেখে অবাক হয়ে গেছেন উনি। ড্রইং রুমে এনে ওনাকে বসাল আঁখি।
শান্তনু কে এখানে দেখবেন, আশা করেননি তরুবালা। অবাক হয়ে বললেন, "একি! তুই এখানে!" হাসতে হাসতে বললেন শান্তনু," অবাক লাগছে তো!"
" তা তো লাগছেই।" তরুবালার পাশে চুপ করে বসেছিল রাই। হঠাৎ উঠে গিয়ে আঁখির পাশে বসল। ওকে আদর করে কাছে টেনে নিল আঁখি, "কি রাই! খবর কি তোমার! আবার কতদিন পরে দেখা হল আমাদের!" এতক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে আঁখির দিকে তাকিয়েছিল মেয়েটা। হঠাৎ বলে উঠল, "জানো তো, ঠামু বলেছে , তুমি আমার মা হবে। সত্যিই আমার মা হবে তুমি! বলো না।"
ঘরে যেন বাজ পড়ল। সকলেই অপ্রস্তুত। শুধু তরুবালাই হাসতে হাসতে বললেন," ওই দ্যাখ, বলে দিলি তো। তাহলে বলেই ফেলি। ও দিদি, শুনুন। আপনার নাতনী কে আমার ভাইপোর বৌ করে নিয়ে যেতে এসেছি। আর একটুও দেরী করতে চাই না আমি। সামনেই যে দিন টা আছে, সেই দিনেই চারটে হাত এক করে দেবো।" স্বর্ণলতার অনুমতি চাইলেন না উনি। তার বদলে নিজের সিদ্ধান্ত দিলেন জানিয়ে। স্বর্ণলতা একবার বলতে চেষ্টা করলেন," আমার নাতনী রাজি কিনা, সেটা জানতে হবে তো।"স্বর্ণলতার কথা উড়িয়ে দিলেন তরুবালা।
" আমার অরু যখন একবার রাজি হয়েছে, তার মানে অরুর ওকে পছন্দ হয়েছে। এ তো ওর সৌভাগ্য। আমার অরু কি ফেলনা নাকি! আর এই ছেলে, তুই কিন্তু এখানে অমন হুটহাট করে আর আসবি না। আমি উঠব এবার। চল রে শান্তনু। তুইও চল আমার সঙ্গে।"
বজ্রাহতের মতো বসেছিল আঁখি। সবাই কে বিদায় দিয়ে ঘরে এলেন স্বর্ণলতা।" কি রে দিদিভাই! কি ভাবছিস!"
" এ বিয়ে সুখের হবে না ঠাম্মি। মাসিমণির অভিশাপ ফলে গেল ঠাম্মি। যাকে ভালোবাসি, তার সাথে ঘর বাঁধতে পেলাম না, "বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল আঁখি।
" ভাবিস না দিদিভাই। আমি অরুময়ের সাথে দেখা করে সব বলব। চেষ্টা তো আমাকে করতেই হবে।"
ক্রমশ :—