কিছু সংসারের গল্প কথা
কিছু সংসারের গল্প কথা
তপতী চিৎকার করে বলে উঠলো, "আমি আর পারছি না ৷ এভাবে চলতে পারে না ৷ শোনো লোলিত, তুমি তোমার বাবা মাকে নিয়ে ভালো থাকো আমাকে ছেড়ে দাও ৷ রোজকার এত অপমান আমি আর নিতে পারছি না ৷ সারাদিন অফিস করে, রান্না করে ,তোমার অসুস্থ বাবা মা এর সেবা করে আমার ও তো ক্লান্তি লাগে, নাকি? সামান্য পান থেকে চুন খসলেই তোমার মা এর বাক্যবাণ শুরু ,কেন বলতে পারো ?"
লোলিত বলে উঠে, "কি হলো আবার ?মা কি বলেছে ?কি যে তোমার হয় না মাঝেমাঝে, এত অবুঝ এর মতো আচরণ করো না এক এক সময় , কিছু বুঝেই উঠতে পারি না ৷ মা তো এমনিতেই অসুস্থ , ডায়বেটিসের জন্য আজকাল চোখের সমস্যাটাও বেড়েছে, বাবাও ভুগছে সেই কবে থেকে, ওনাদের বয়স হয়েছে কখন কি বলেছে তাই নিয়ে তুমি শুধু শুধু রাগ করছো ৷"
তপতী বলে উঠলো, "ওনাদের অসুখ নিয়ে তো কিছু বলিনি আমি, আমার সাধ্য মতো সেবা করি তারপরেও একটা ভালো ব্যবহার আশা করা কি খুব অন্যায়, ওনাদের জন্য তো আজ অবধি বিয়ের পর থেকে না সিনেমা না কোথায় ও ঘুরতে যাওয়া, সে বার পুরী গিয়েও তো তোমার বাবার ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি চলে আসতে হলো, অর্ধেক জায়গাই ঠিকমতো ঘোরা হলো না ৷"
চিৎকারের আওয়াজ পেয়ে লোলিত এর বাবা এসে বললেন , "কি রে বাবু কি হয়েছে ? বউমা কি হলো , বাবু অফিস থেকে ফিরেছে ওকে চা দিলে না ? তোমাদের মা আবার আওয়াজ পেয়ে চিন্তা করছিল ৷"
তপতী বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে আবার , "আচ্ছা বাবা আমিও তো অফিস থেকে ফিরেছি আপনার মনে হয় না আমিও আপনার ছেলের মতো ক্লান্ত আমারও যত্ন লাগে ৷"
লোলিত সঙ্গে সঙ্গে বলে, "আহ্ তপতী কি হচ্ছে, বাবা তুমি ঘরে যাও ৷"
পরের দিন সকালবেলা, তপতী স্নান করে সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছে অফিস বেরোবার আগে ৷ শাশুড়ির ঘরে গিয়ে প্রতিদিন এর মতো কি কি ওষুধ খাবেন তিনি সব বার করে দিলো, আর বললো, "মা আমি থাকতে থাকতে স্নানটা করে নিলেই তো পারতেন ৷"
উনি বলেন ,"না ,আমি পরে করবো", তারপর উনি ছেলেকে ডাকলেন, "শোন বাবু হাঁটুর ব্যথাটা ভীষণ বেড়েছে ৷ সময় করে একদিন আমায় ডাক্তারখানায় নিয়ে যাস ৷"
তপতী বলে উঠে, "আমাকেই তো বললে পারতেন এর আগে প্রত্যেকবার তো আমিই নিয়ে গেছি ওর আর কবে সময় হয়েছে ৷"
তপতীর শাশুড়ি তখন বললো , "তোমাকে বললে তো আবার তোমার মনে হবে আমরা তোমাকে বেশী খাটাছি , তোমার যত্ন করি না ৷"
তপতী বললো, "মা এভাবে বলবেন না অফিস থেকে ফিরলে সব মানুষই ক্লান্ত থাকে সে কথাই কাল বাবাকে বলেছি ৷"
তপতীর শাশুড়ি বলে উঠে, "আমার যদি ক্ষমতা থাকতো সবটা করবার তাহলে তোমাদের দিয়ে কি আর "....বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ৷
অফিসে বসে তপতী কাজে ব্যস্ত ৷ হঠাৎ ফোন এলো, ঝুমা ফোন করেছে ৷ তপতীর বান্ধবী ৷ ওদিক দিয়ে বলছে , "আমি আর পারলাম না, টুকলুকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম ৷ ওর সঙ্গে থাকা যায় না, ওকে মানুষ বলেই মনে করি না আমি ৷"
তপতী বললো, "কি হয়েছে? কোথায় এসেছিস এখন ?"
ঝুমা জানায়, "সে পর্নার বাড়ি এসেছে ৷"
তপতী বলে সে অফিস ফেরত দেখা করবে ওদের সাথে ৷
ঝুমা, পর্না আর তপতী ওরা তিন বান্ধবী ,কলেজ এ পড়ার সময় থেকে ৷ ঝুমা তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলে নিজের পছন্দের পাত্রের সঙ্গে ৷ ওর বাড়ি থেকে এই বিয়েতে মত ছিল না ৷ আর ঝুমার বর এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বিয়ের পর থেকে নানা রকম খোঁটা দেওয়া , বাজে ব্যবহার করেই চলে ৷ ঝুমার বাপের বাড়িতে তার দাদা বৌদিরা চাইত না ঝুমা আসুক ওই বাড়িতে৷ ঝুমার কোথায়ও যাওয়ার জায়গা ছিল না ৷ তাই দিনের পর দিন সব মেনে নিতে হয়েছে তাকে ৷ ঝুমার এক ছেলে এক মেয়ে , মেয়ে একটুবড় আর ছেলেটা ছোটো ৷ এদিকে পর্না এখনও বিয়ে করেনি , তবে চেষ্টা চলছে, পর্না চাকরি করে ৷
বিকেল বেলা তপতী পর্নার বাড়ি যায় ওখানে গিয়ে জানতে পারে পর্নার মা ঝুমা আর টুকলুকে তাদের বাড়ি রাখতে রাজি নয়, এদিকে ঝুমা বলে ,সে আর থাকতে পারছে না, রীতিমত তার গায়ে হাত তুলছে তার বর ৷ পর্না জানায় একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সে ঝুমা এবং টুকলুকে নিয়ে আপাতত থাকবে ৷ তপতীও বলে সে যতটা সম্ভব সাহায্য করবে ৷ পর্নার বাড়িতে তুমুল অশান্তি হয় তবু পর্না কয়েক দিন পর বাড়ি ভাড়া নিয়ে ঝুমা আর টুকলুর সাথে থাকতে শুরু করে ৷
এদিকে তপতীর কাছে লোলিত সব শুনে বলে, "এভাবে পর্না ঝুমার জন্য কতদিন বাড়ি ছেড়ে থাকবে ৷ আর তোমরাই বা ওদের সব দায়দায়িত্ব কিভাবে চালাবে ৷"
তপতী বলে, "এছাড়া আর তো কোনো উপায় ভেবে পাচ্ছি না ৷"
টুকলু নতুন স্কুলে ভর্তি হলো ,ক্লাস ওয়ান ৷ তপতী বই খাতা, স্কুলের যাবতীয় খরচ দিলো ৷ এখন অফিস ফেরার পথে রোজ টুকলুকে স্কুল এর হোমওর্য়াক করিয়ে বাড়ি ফেরে তাই রোজই রাত হয় বাড়ি ফিরতে ৷ এই নিয়ে তপতী লোলিত এর মধ্যে রোজ একপ্রস্থ কথা কাটাকাটি হয়ে যায় কিন্তু তারপরে ও রাতের গভীরে লোলিত তপতীর সব মান অভিমান ভালোবাসার স্রোত এ ভাসতে থাকে আর পরের দিন আবার সেই এক রুটিনবাঁধা জীবন চলতে থাকে ৷
একদিন ঝুমার বর আসে ৷ পর্নার মার কাছ থেকে ভাড়া বাড়ির ঠিকানা নিয়ে ওদের কাছে যায় ৷ ঝুমার সাথে তুমুল ঝগড়া শুরু হয়, ঝুমা বলে, "কেন এসেছো তুমি ? আমাকে কি কোনো দিন শান্তি দেবে না তুমি ? আর আমি তো ছেলের জন্য মরতেও পারবো না নইলে কবেই .... আজ বুঝি বাবা দাদার অমতে জীবন এ কত বড়ো ভুল করেছিলাম ৷"
ঝুমার বর বলে, "প্লিস ফিরে চলো, তুমি কি মেয়ের কথাটা ভুলে গেলে , তোমার জন্য কেঁদে কেঁদে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে আর টুকলুর কি আমাকে দরকার নেই ? এভাবে এইটুকু একটা ভাড়া বাড়িতে তোমাদের কষ্ট হচ্ছে , প্লিস্ ফিরে চলো ৷"
ঝুমা বলে উঠে , "আমার কষ্ট নিয়ে তোমার ভাবনা হয় তাহলে ৷ আমার গায়ে হাত তোলার সময় মনে হয়নি ৷ আর টুকলুর সাথে আমি টুকিকেও আনতে চেয়েছিলাম ও নিজেই আসতে চায়নি ৷ আর টুকিকে তো দিনের পর দিন তোমার মা-ই আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে ৷"
এই সব ঝগড়ার আওয়াজ এ বাড়িওয়ালা ছুটে এসে বলে উঠে ,"এসব আমার বাড়িতে চলবে না, পাড়ার মধ্যে এ সব কি ", বাড়িওয়ালা আরও কিছু কথা বলে ঝুমাকে অপমান করলো আর ঝুমার বরও বাড়িওয়ালার সঙ্গে কিছুটা বচসায় জড়িয়ে পড়লো ৷
পর্না অফিস থেকে ফেরার পর আরো ঝামেলা বাড়লো ৷ ঝুমার বর বলে উঠলো ,"দেখুন পর্না আপনি আপনার বন্ধুকে একটু বোঝান, তাছাড়া এ ভাবে আপনি আপনার বাড়ি ছেড়ে এতদিন ,সেটাও তো ঠিক নয় , আর টুকলুরও কি তার বাবাকে দরকার নেই ?"
যা কিছু ঘটলো পরের দিন তপতী সবটা জানলো ৷ কিন্তু কি করা উচিত তা সত্যি বুঝতে পারলো না ৷ এদিকে টুকলুর সাথে তপতীর খুব ভাব হলো ,তপতী ছাড়া সে পড়তেই বসতে চায় না, ক্লাস টেস্টের খাতা বেরোলো টুকলু সবগুলোতেই ভালো নম্বর পেলো ৷ তপতীর মুখে যেন এখন শুধুই টুকলুর কথা ৷ বাড়িতেও লোলিত এর সঙ্গে কথা বলতে বলতে টুকলুর কথাটা আজকাল প্রতিদিন ৷
এইভাবে বেশ কিছুদিন চললো ৷ সেদিন তপতীর শাশুড়ি বললো, "বউমা কাল যে বিয়ের নিমন্ত্রণটা আছে ওটার জন্য গিফ্ট কিনেছো তো, তোমরা যাচ্ছো তো , পালবাবু ওনার পুরনো বন্ধু ৷ তার মেয়ের বিয়ে ,বাবু তোরা যাবি তো ?"
লোলিত আর তপতী দুজনেই জানালো ,তারা যাবে ৷
পরের দিন তপতী জমকালো সাজ সাজলো বিয়েবাড়ির জন্য ,একটা কমলা গোল্ডেন রঙের শাড়ি ,কানে ভারী দুল , গলায় নেকলেস ৷ তপতীর সাজ দেখে লোলিত বললো, "কতদিন পর তোমাকে সাজতে দেখলাম ,তোমাকে খুব ফ্রেস লাগছে ৷"
বিয়েবাড়িটা খুব আনন্দ করে দুজনে কাটালো ৷ রাত্রি এগারোটা নাগাদ ফিরলো ওরা ৷ বাড়ি ফিরে যখন তপতী তার ফোনটা চেক্ করলো তখন দেখলো পর্নার চারটে মিস কল আর তারপর দেখলো ঝুমার ম্যাসেজ ,লেখা আছে, "চললাম রে শ্বশুর বাড়িতে , এতদিন তোরা অনেক করলি আমার আর টুকলুর জন্য , আর পর্নাটাও সত্যি ,আমার জন্য নিজের বাড়ি ছেড়ে এতগুলো দিন, আমি অরেকবার ওকে সুযোগ দিতে চাই ৷ টুকলুর কথা ভেবে ওকে ক্ষমা করে দিলাম রে , আর টুকিটা বড় হচ্ছে আমাকে তো ওর দরকার বল ,দেখি আর একবার নতুন করে চেষ্টা করে, যদি ভাগ্যটা বদল করতে পারি ৷ তোরা ভালো থাকিস্ ৷ আর হ্যাঁ টুকলুটা আসার আগে তোর কথা বলছিল রে .... ৷"
তপতী পর্নাকে কল ব্যক করে জানতে পারলো, ঝুমার বর আর তার শাশুড়ি এসে ক্ষমা চেয়ে ওদের নিয়ে গেছে আজ ৷ সব শুনে তপতী অনেকক্ষণ বসে ছিল , তপতীকে বসে থাকতে দেখে লোলিত জানতে চাইলো ,তপতী সবটা বললো আরও বললো, "এই কদিন টুকলু টার সঙ্গে এতটা সময় কাটিয়েছি যে ওকে খুব মিস করবো ৷ আমার বিকেলগুলো জুড়ে ছিল ৷ খুব মন খারাপ লাগছে ৷"
লোলিত বললো, "যাক ওদের সমস্যাটা মিটলো তাহলে এতদিনে ৷"
তপতীর শাশুড়ী এলেন , লোলিত বললো, "মা তুমি এত রাতে উঠে এলে কেন ?"
উনি তপতীর পাশে বসে তপতী কে বললো ,"বউমা, এত মন খারাপ করো না , রোজই তোমার বান্ধবীর ব্যাপারটা শুনতে পাই ,তুমি তার ছেলের জন্য এত করেছো তাই বাচ্চাটাকে মনে পড়াটা স্বাভাবিক ৷ তবে অনেকগুলো দিনই তো হয়ে গেল তোমরা এবার নিজের কথাটাও ভাবো, আমাদেরও তো বয়েস হচ্ছে, আমাদেরও দেখতে ইচ্ছে করে কেউ ছোটো ছোটো পায়ে ছুটে বেড়াক বাড়িতে, আর আমায় ঠাম্মি বলে জড়িয়ে ধরুক , আরো বললেন সবার কথা এত ভাবো সারাদিন এবার একটু নিজের কথাও ভাবো ৷ আমি সত্যি এবার তোমায় কিন্তু শাসন করবো ৷"
তপতীর সঙ্গে তার শাশুড়ির যেন এক অদ্ভুত মিল হলো সেদিন ৷
ধীরে ধীরে এক খোলা দক্ষিণ হাওয়া ছুঁয়ে গেল তপতী আর লোলিতকে আর ওরাও নতুন এক দিনের স্বপ্ন বুনতে শুরু করলো ৷