শুধু অপেক্ষা
শুধু অপেক্ষা
অলিন্দ নদীর পাড়ে বসে, চোখ বন্ধ করলো আর দেখতে পেলো পুরোনো দিনের সেই স্মৃতি, ......... চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেদিনের কথা।।
সেদিন অপেক্ষার শেষ হল, অবশেষে অলিন্দ তাকিয়ে দেখলো সে আসছে।।
সাদা রঙের চুড়িদার আর হাতে একগুচ্ছ গোলাপ সে আসছে ।। অলিন্দ মনে মনে বললো, "ঠিক যেন উচ্ছল প্রাণবন্ত ঝরনার মতো সে আসছে আমার দিকে।। "
অলিন্দ এর দিকে সে তাকালো আর গোলাপের গুচ্ছ টা সামনে ধরলো,
অলিন্দ বলল, "হঠাৎ এখন গোলাপ দিচ্ছও? সঙ্গে সঙ্গে সে রাগ দেখালো তারপর নাম ধরে বললো, অলিন্দ... তুমি না সত্যি কিছুই জানো না!!!"
তারপর ঘাসের দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাগ করে বসে পড়লো।।
অলিন্দ এর সেই "সে" হলো --তরী।।
তরী প্রানচ্ছল,আবেগ চঞ্চল মেয়ে।। অলিন্দ এর সঙ্গে দুবছর ধরে সম্পর্ক, এই বছর তরী অলিন্দ এর সঙ্গে তিন নম্বর ভ্যালেনটাইন্স ডে পালন করবে।। তাই ভীষন ভাবে উৎসাহী।। অলিন্দ শহরে চাকরি করতে এসে তরীর সঙ্গে আলাপ।। অলিন্দ এর গ্রামের বাড়ি তার মা আছে, মধ্যবিও পরিবার।। এদিকে তরী র বাবা মা ভীষন কড়া ধরনের, মেয়ে কে খুব শাসনে মানুষ করছে, এখন চায় তার বিয়ে দিতে তাদের পছন্দের পাত্র এর সঙ্গে।।কিন্তু এ ব্যাপারে তরী এখন ও কিছু ই জানে না।। সে শুধু ই অলিন্দ কে নিয়ে দিন রাত ভাবে।।
তরী র সব ব্যাপারে আগ্রহ একটু বেশি আর এই ভ্যালেন্টাইস ডে পালন করার জন্য ভীষন তার আগ্রহ।। যদি ও অলিন্দ তেমন একটা গুরুত্ব দেয়না।। তার মতামত হলো-- "ভালোবাসার আলাদা দিন কি প্রয়োজন।।"
তবু ও এই দু বছরে তরীর সব পাগলামি অলিন্দ এর জানা হয়ে গেছে।। আর অলিন্দ এর এখন বেশ ভালোই লাগে।। তরী কি নতুন চমক দেবে সেই ব্যপারে অলিন্দ বেশি উৎসাহী এখন।। তাই তরী র জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে থাকতে অলিন্দ এর ভীষন ভালো লাগে।। এই নিয়ে কতবার দুজনের খুনসুটি ও হয়েছে।।
তবে অলিন্দ ভুলে গেছে যে এই বছর ভ্যালেন্টাইস ডে টা চলে ই এসেছে প্রায়।।
পার্কে র বিকেল সেদিন...
অলিন্দ বলল, "আচ্ছা তরী.. এতে রাগ করার কি আছে? আমার তো মনে পড়ছে না যে আজ কোনো বিশেষ দিন।। তাই এত গোলাপ ...."
তরী তার ফোনে গুগল সার্চ দিয়ে, অলিন্দ এর সামনে ধরলো আর বললো, " নিজেই দেখো.., "
অলিন্দ দেখলো , তারপর বুঝতে পারলো এখন ভ্যালেন্টাইন উইক চলছে, আজ Rose ডে ।।
অলিন্দ বললো, "আচ্ছা গোলাপ টা তো যেকোনো দিন দেয়া যেত তাই না ..!!"
তরী বলল, "তাতে কি হয়েছে আজ কের দিনে এই যে দিলাম , প্রতি বছর যখন Rose ডে আসবে, তোমার মনে পড়বে ।।
অলিন্দ বললো, " সে তো তুমি পরের বছর ও দেবে, এই নিয়ে দুবছর তো চলছে।।
কই গোলাপ গুলো দাও, নাকি খালি রাগই দেখাবে।।"
তরী বাঁকা হেসে বললো, "এই নাও তবে আমার শর্ত টা মনে আছে ??"
অলিন্দ বললো, "হ্যাঁ আমি কি ভুলতে পারি ?..।।"
তরী প্রথম বছর ই শর্ত দিয়েছিল গোলাপ গুলো অলিন্দ কে রেখে দিতে হবে।।
অলিন্দ শর্ত মেনে সব গোলাপ গুলো একটা কাঠের বাক্স তে ঢুকিয়ে রেখে দেয় এই নিয়ে তিনবছরের গোলাপ।।
পরের দিন অলিন্দ আবার অপেক্ষা করছে , আর তরী এসে হাত ধরে বললো, " আজ জানো নিশ্চয়ই কি দিন?"
অলিন্দ বললো, " হ্যাঁ propose ডে, আর আমি তো এসবে ছিলাম না কোনো দিনই।।"
তরী --" ভীষন আনরোমান্টিক তুমি, তাও যে কেন সেদিন তোমাকে হ্যাঁ বলেছিলাম জানি না !!"
অলিন্দ বললো, " বেশ আমি না হয় আনরোমান্টিক তুমি তাহলে আজ প্রোপোজ করো আবার , দেখি কি আলাদা রোম্যান্স হয়। "
তরী -- "আমার একটা প্রোপোজাল আছে আমার হাত ধরে হাটতে হবে তোমাকে এখন , আর আমি যা শব্দ বা কোনো কথা বলবো ...
তার একটা উওর দিতে হবে, একটু রোমান্টিক হতে হবে উওর গুলো, মিথ্যে বলা চলবে না।।"
তরী র কথা শুনে অলিন্দ রাজি হলো ।।
হাঁটতে শুরু করলো আর সঙ্গে তরীর খেলা টাও শুরু..
তরী বলে উঠলো -- " মেঘের দেশে"
অলিন্দ একটু ভেবে নিয়ে--"বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর..."
তরী হেসে বলল-- "চাঁদের বাড়ি.."
অলিন্দ -- "তোমায় দেবো কিনে.."
তরী- বাঁকা হেসে বলল-- " রঙিন ছাতা. .
অলিন্দ -- "আর এই পথ হাঁটা.."
তরী অলিন্দ এর দিকে তাকিয়ে বলল-- "একটা চিঠি."
অলিন্দ -- "হাজার কথায় মোড়া ।"
তরী-- "ফাগুন বেলা.."
অলিন্দ হেসে -- "শিমুল পলাশ রঙের খেলা।"
তরী-- "চোখের নেশা.."
অলিন্দ -- "হেই সামালো.."
তরী মৃদু হেসে এবার বললো--" ভরা ঢেউ.."
অলিন্দ তরীকে কাছে টেনে বললো, " ভয় নেই আমার সঙ্গে আছে তরী... ।।"
তরী গম্ভীর চোখে ---" ভালোবাসো আমায়.."
অলিন্দ মৃদু ভেসে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে-- "একটু ও না ..."
ব্যস... তরী ওমনি রাগ দেখালো, আর অলিন্দ খুনসুটি শুরু করলো।।
এভাবে দিনটা শেষ হয়ে গেল।।
পরের দিন অলিন্দ আবার দাঁড়িয়ে আছে তরীর অপেক্ষা য়।।
তরী এসে বললো, " চোখ বন্ধ আর হাত বার করো,
তারপর একটা বড় চকলেট এর প্যাকেট অলিন্দ এর হাতে দিল।।
অলিন্দ বললো, " এই দিন টা সত্যি ভীষন পছন্দের আমার কাছে বেশ একটা চকলেট পাওয়া যায় , ।।"
এর পরের দিন তরী একটা ছোট্ট টেডি অলিন্দ এর হাতে দিয়ে বললো, " আমি যখন থাকবো না , তোমার কথা বলতে ইচ্ছে হলে তখন তুমি ওর সঙ্গে কথা বলো।।"
অলিন্দ -- "ফোন করলেই কিম্বা হোটাসআ্যাপ করলেই কথা বলতে পারবো।। যত দিন যাচ্ছে তুমি ততই বাচ্চা হয়ে যাচ্ছো, এই নিয়ে তিনটে টেডি আমার কাছে ।।"
তরী আবার রাগ দেখালো-
আর অলিন্দ রাগ ভাঙাতে শুরু করলো আর এই ভাবে দিনটাও শেষ হলো।।
এরপর পরের দিন তরী জানালো বিকেলে অলিন্দ যেন নদীর পাড়ে আসে ।।
অলিন্দ তাই করলো।।
তরী এসে অলিন্দ এর হাত হাত দিয়ে, বললো এই জল ওই আকাশটাকে আর ডুবতে থাকা সূর্য কে সাক্ষী রেখে কথা দিলাম আমি কখনো তোমায় ছেড়ে যাবো না।। প্রমিস....।।
অলিন্দ হেসে উঠলো বললো, " আগের বার দেশলাই কাঠি জ্বেলে আগুন কে সাক্ষী রেখে বলেছিলে আর এই বার জল সূর্য।। কিন্তু
তাতে কি !!!আমি তো কোনো প্রমিস করলাম না।।
দুজনে মিলে না করলে কিসের প্রমিস....।।"
তরী আবার রাগ করে নদীর পাড়ে বসে পড়লো আর অলিন্দ রাগ ভাঙাতে শুরু করলো।।
এরপরের দিন অবাক কান্ড,
অলিন্দ দেখলো তরী তার আগেই চলে এসে দাড়িয়ে আছে পার্কে গাছের তলায়।।
অলিন্দ যেই তরী র কাঁধে হাত দিল ওমনি তরী উচ্ছল প্রাণবন্ত ঝরনার মতো আছড়ে পড়ল অলিন্দ এর বুকে।।
অলিন্দ হেসে বলল, " এটা ই তাহলে তোমার hugs ডে স্পেশাল।।
তরী -- "তুমি তো hug করলে না কিন্তু আমি করলাম, এটা মনে রাখবে চিরকাল, প্রতিবার এই দিন আমি তোমাকে hug করছি।।
অলিন্দ অহংকার করে বলে উঠলো--" আমি না এলে কাকে তুমি hug করতে...
তরী গাছটা দেখিয়ে বললো, ওকে...
অলিন্দ হেসে উঠলো...
দিন টা পেরিয়ে গেল।।
পরের দিন অলিন্দ তরী রেস্টুরেন্ট এ অনেকটাই সময় ভীষন ভালো কাটিয়ে ফেরার পথে নিয়ন আলোয় অলিন্দ তরী কাছাকাছি শেষ মুহূর্তে তরী অলিন্দ এর ঠোঁট এ আঙ্গুল দিয়ে , আমার কোনো তাড়া নেই।।
অলিন্দ --" সব দিন গুলো পালনের ঘটা দেখে আমি তো ভাবলাম... তবে প্রতি বছর ই ফাঁকি থাকে এবছর আমি আশাবাদী ছিলাম।।
তরী-- " ইশ্ তোমার কি উচ্চ আশা..
তারপর হেসে উঠলো তরী....।।
তরী আবদার করলো, পরের দিন একটা নীল রঙের পোশাক পরতে হবে অলিন্দ কে।।
কিন্তু অলিন্দ এর কাছে কোন ও নীল রঙের সার্ট বা পাঞ্জাবি ছিল না।। তাই তরী নিজে একটা নীল রঙের সার্ট কিনে দিল অলিন্দ কে..
অলিন্দ বললো -- "আগের বছর তো হলুদ ছিল তার আগের বার ধূসর, এখন নীল..., এরপরের বার কি বলবে?
তরী--" তার জন্য তোমায় পরের বছর অবধি অপেক্ষা করতে হবে।।
দেখতে দেখতে পাঁচ বছর পর ........
হঠাৎ সম্বি্ৎ ফিরে পেলো অলিন্দ চোখ খুললো।। সেদিন থেকে আজ....।। নদীর পাড়ে সূর্য ডুবছে।
হাতে কাঠের বাক্স তাতে ভরা শুকনো গোলাপ , পাশে ছোট্ট টেডি আর অলিন্দ পরে আছে নীল রঙের সার্ট টা।।
তারপর থেকে আর জানা হয়নি তরী তাকে কি রং পরতে বলবে।।
সেবার ফেব্রুয়ারি ১৪ পেরানোর পর পরই তরী র বাড়িতে তার বাবা মা বিয়ে আয়োজন করা শুরু করে।। তরীর বাবার বন্ধুর ছেলে, বিদেশে চাকরি করে , তরী তার পছন্দ অলিন্দ এর কথা জানালে ওরা তরীর কথাকে পাত্তা দেয় না।
তখন তরী ভাবে অলিন্দ কে সব কিছু জানালে নিশ্চয়ই একটা উপায় বেরোবে দরকার হলে তরী তার বাবা মায়ের অমতে অলিন্দ কে বিয়ে করবে।।
তরী যখন ফোন করে তখন অলিন্দ শহর ছেড়ে তার মায়ের কাছে গেছে গ্রামের বাড়িতে।।
অলিন্দ এর মায়ের অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে
অলিন্দ ব্যস্ত ছিলো।।
অলিন্দ তরীর সব কথা না শুনেই জানায় সে এখন ভীষন সমস্যায় আছে সে পরে কথা বলবে, তরী যেন চিন্তা না করে সে ফিরবে খুব তাড়াতাড়ি।। আর ফোন কেটে দেয়।।
কিন্তু তরী তার বাবা মা কে বোঝাতে পারলো না , তরী বার বার বললো অলিন্দ ভালো ছেলে চাকরি করে, ফিরবে খুব তাড়াতাড়ি, কিন্তু কোন লাভ হলো না।। তরী র বাবা মা শুনতে রাজি নয়।।
শেষে বিয়েটা হয়ে গেলো।।
তরীর বিয়ের দিন অলিন্দ এর ফোন এল ততখনে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেছে।।
তরী ওপার থেকে জানায় আমি এখন কথা বলতে পারবো না,বলে ফোন টা কেটে দেয়।।
অলিন্দ ভাবে তরী হয়তো রাগ করে এরকম কথা বলছে।।
তরীর সমস্ত খোঁজ নিতে তার বান্ধবী দিপীকা কে যখন
জিগ্গেস করে তখন সমস্ত কিছু জানতে পারে।।
অলিন্দ তার মায়ের অসুস্থতার কথা জানায় দিপীকা কে, এই কয়েকটাদিনে এত কিছু হবে তা কল্পনা করতে পারেনি অলিন্দ।।
দিপীকা বলে এখন আর কোন কিছু উপায় নেই।। তরীর আর কিছু দিন বাদেই তার বরের তাকে বিদেশে নিয়ে যাবে।। তোমার সাথে আর হয়তো তরী র দেখা হবে না।। তরী তোমায় ভীষন ভালোবাসত কিন্তু তরী র বাবা মা কোনো কথাই শোনেনি তারা যা ভেবেছে সেটাই করেছে।।
অলিন্দ কে দিপীকা বলে , "অলিন্দ তুমি সেই দিন কেন সব কথা না বলে তরী র ফোনটা কেটে দিয়েছিলে।। তরী র বাবা মা তাই ভাবলো তুমি হয়তো ভালো ছেলে নয় আর তরীর কোনো কথাই শোনে নি ওকে জোর করে একরকম বিয়ে দিল।।
দীপিকা জানালো সে শুধু তরীর কাছে অলিন্দ এর খবর টুকু পৌঁছে দিতে পারে।।
এর পর তরী সব কিছু দিপীকা র কাছ থেকে জানতে পারে তখন অলিন্দ এর জন্য তরী একটা চিঠি পাঠায় ,
দিপীকা সেই চিঠি অলিন্দ এর কাছে পৌঁছে দেয়।।
আজ সেই পাঁচ বছর পরে আবার একটা ১৪ইফেব্রুয়ারী ভ্যালেন্টাইস ডে।। তরীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর
অলিন্দ এইভাবে প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি টা কাটায়
নদীর পাড়ে বসে,
অলিন্দ এখন অনুভব করে, মানুষ তার প্রিয়জনকে প্রতিদিন ভালো বাসতে পারে তবুও এইসব বিশেষ দিন প্রয়োজন , এই বিশেষ দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো সারা জীবন স্মৃতির অ্যালবামে রয়ে যাবে।। ঠিক যেমন তরীর দেওয়া গোলাপ গুলো, টেডি গুলো।। তরীর সঙ্গে কাটানো সেই দিন গুলো র স্মৃতি।।
তরীর লেখা সেই চিঠিটা অলিন্দ খুললো , যাতে লেখা ছিল,
অলিন্দ,
তোমায় চিঠি লিখছি প্রথম বার।। কোনো দিন প্রয়োজন হয়নি।।
দীপিকার কাছে সব শুনলাম।। সেদিন তুমি যদি আমাকে একবার শুনতে।। যাইহোক,
তোমার আমার গল্প টা এই অবধি ছিল।। এখন থেকে তোমার আমার সব কিছু আলাদা।। ইচ্ছে ছিলো জীবনের সব ভ্যালেন্টাইনস ডে গুলো তোমার সঙ্গে কাটানোর কিন্তু......
নতুন করে তুমি ভেবো , আমি তোমার জীবনে এখন একটা স্মৃতির অ্যালবাম মাত্র।। তোমায় আর আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না দীর্ঘ সময়।।
হয়তো আবার একদিন দেখা হয়ে যাবে তোমার সঙ্গে কখনো....
অলিন্দ টেডি হাতে নিয়ে মনে মনে, তোমার দেওয়া অসংখ্য জিনিস আমায় মনে করায় তোমার কথা, তরী... তোমার কি মনে পড়ে... বলেছিলে দেখা হয়ে যাবে কখনো...
অপেক্ষা র পর আগে তোমার সাথে দেখা হয়ে যেত কিন্তু এখন শুধু ই অপেক্ষা..