টানাপোড়েন
টানাপোড়েন
নিখিল দও ও বীনা দও এর দুই ছেলে। ছোট ছেলে তমাল আর বড়ো ছেলে তুহিন। কোচবিহারের ব্যবসায়ী পরিবার। তুহিন এবার উচ্চমাধ্যমিক দিলো।
বীনার বোন বনানী কোলকাতায় থাকে । তাঁর স্বামী গত কয়েক বছর হলো মারা যান। ছেলে মেয়ে কেউ নেই। একা একা থাকেন।
বীনা নিখিল কে বলে তারা যদি তুহিন কে বনানীর কাছে পাঠিয়ে দেয় তাহলে তুহিনও পড়াশোনাটা কোলকাতা র কলেজে করতে পারবে আর বনানীর ও ভালো লাগবে। "বেচারি কোলকাতায় একা একা দিন কাটাচ্ছে।"
নিখিল এব্যপারে মত দিলো। আর তুহিন কে কোলকাতা পাঠানোর ব্যবস্থা শুরু করলো।
বনানী যখন জানতে পারলো তার দিদি তুহিন কে পাঠাচ্ছে, ভীষণ খুশি হলো। এতদিন একা খুব খারাপ লাগতো , তুহিন আসছে শুনে সব কিছু গোছানো শুরু করলো।
তুহিন এর জন্য ঘর বিছানা, টেবিল সব গুছিয়ে রাখলো।
বনানীর পাড়ায় থাকে সৃজা। সৃজাদের অবস্থা তেমন ভালো নয়। সৃজার বাবা-মা কোনোরকমে মেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে । সৃজা এবার মাধ্যমিক দিয়েছে। তবে বনানী সৃজাকে সাহায্য করে সমস্ত ব্যপারে ,যাতে সে পড়াশোনা টা এগোতে পারে। একেবারে নিজের মেয়ের মতো দেখে। আর সৃজাও বনানীর বাড়ি খুব আসে। বনানী র দরকারে সৃজা সবসময় এগিয়ে।
বনানীর সঙ্গে সৃজাদের পরিবার জড়িয়ে আছে অনেক দিন থেকেই।
সেদিন সৃজা এসে বনানী কে বললো, "কাকিমা কি হলো এত গোছাচ্ছো কেন?"
বনানী বললো, "আমার বনপো আসছে কোচবিহার থেকে এখানেই থাকবে , কলেজে পড়বে তাইতো গুছিয়ে নিচ্ছি সব।"
সৃজা -- "ও ..তোমার সেই দিদি, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। তা কেনাকাটা করতে যাবে বললে কবে যাবে কাকিমা?"
বনানী-- "সামনে সপ্তাহের দিকে যাবো , তুইও যাবি কি রে..?
সৃজা-- "আচ্ছা যাবো। "
দেখতে দেখতে মাধ্যমিক এর রেজাল্ট বের হলো সৃজার। খুব ভালো রেজাল্ট করলো সৃজা।
সৃজার মা বনানীর বাড়ি এসে-- "বানানী দি সৃজা ভালো ভাবে পাশ করলো, তুমি না থাকলে মেয়ের পড়াশোনা করাতেই পারতাম না। তাই সৃজার বাবা বলছিল একদিন আমাদের বাড়িতে এসো।
বনানী-- "ওর নিজের ও খুব ইচ্ছে ছিলো বলেইনা ভালো ফল করেছে। আচ্ছা যাবো, দাদাকে বলো।
তা সৃজা কোথায়? ওকে তো আমায় কিছু দিতে হবে। সকাল থেকে তো একবার ও আসেনি। ওকে নিয়ে কেনাকাটা করতে যাব ভাবছিলাম। আমার বনপো আসছে আবার কোচবিহার থেকে।
সৃজার মা -- "সৃজার কাছে শুনেছি তোমার দিদির ছেলে আসছে এখানেই থাকবে নাকি !।
বনানী--" হ্যাঁ , তুহিন এর উচ্চমাধ্যমিক এর রেজাল্ট ও তো বেরিয়েছে। এই বার ও চলে আসবে।
সৃজার মা-- " আচ্ছা। তোমার বাড়িটা এবার গমগম করবে দেখো বনানী দি।"
বনানী-- "সে তো সৃজাই এসে ভরিয়ে রাখে। "
সৃজার মা হাসলো আর বললো, " ওই করছে সারাদিন কথার কোনো বিরাম নেই।"
বনানী, -- "বাচ্চা মেয়ে যা মন চায় করুক।"
কয়েকটা দিন পরে..
সৃজা বনানী র বাড়িতে এসে-- " কাকিমা কেনাকাটা করতে যাবে বললে কবে যাবে গো?
বনানী-- "এই যে সৃজা কি রে তুই! রেজাল্ট এর পর কাকিমা কে এতদিনে মনে পড়লো?"
সৃজা --" না গো কাকিমা একাদশ এ ভর্তি হবো না তাইতো এতদিন আসতে পারেনি। তা ...
পাশের ঘর থেকে তুহিন বেরোলো সৃজার আওয়াজ শুনে।
বনানী পরিচয় করালো। সৃজার সঙ্গে তুহিন এর।
সৃজা বলে উঠলো, "ও.. এসে গেছে."
বনানী বললো, "নে আজ লুচি আলুর দম করেছিলাম দুজনে বসে টেবিলে খেয়ে নে।"
তুহিন সৃজার সঙ্গে খেতে বসলো। সৃজা দুনিয়ার গল্প শুরু করলো। পাড়ার কোথায় কে আছে। পাড়ায় কে ভালো কে খারাপ ।
সৃজা কোলকাতার সব চেনে আর তুহিন চাইলেই ওকে ঘুরিয়ে দেখাবে। সৃজার বকবক তুহিন হা.. করে কেবল শুনেই গেলো। তুহিন এর কিছু বলার কোনো সুযোগ ছিলো না।
কথা বলতে বলতে সৃজা বিসোম খেলো হঠাৎ করে ।
বনানী --- "সৃজা আস্তে আস্তে খা.."
তুহিন এই বার বলে উঠলো, -- "বাবারে বাবা! এত কথা বললে তো এমন হবেই। কি বকবক টাইনা করতে পারো তুমি। মনে হচ্ছিল ট্রেনে করে আমি দুনিয়া ঘুরে নিলাম।
বনানী র দিকে তাকিয়ে মাসিমনি বলতেই ..
বনানী হেসে উঠলো ..।
কয়েকটা দিন এর মধ্যে তুহিন কলেজে ভর্তি হলো। কলেজ শুরু হলো।
ওদিকে সৃজার ও স্কুল চলছে ।
একদিন হঠাৎ সৃজার পড়াশোনা দেখিয়ে দেওয়ার ভার বনানী তুহিনকে দিলো আর বললো, "দ্যাখ মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো টিউশনির খরচ চালাতে পারবেনা ওরা। তুই ওকে দেখিয়ে দে, তাহলে ওর সুবিধা হয় ।" তুহিন রাজি হলো আর সৃজা পড়া বুঝতে আসতে শুরু করলো তুহিন এর কাছে ।
একদিন সন্ধ্যায় সৃজা -- "আচ্ছা তুহিন দা তুমি না কোনো প্রশ্নের উত্তর একটু ও ছোট করে দিতে পারো না। এতো বড়ো মনে রাখা যায় বলতো?"
তুহিন-- "জানি তো ও মাসিমনি যতই বলুক তুই ভালো স্টুডেন্ট আসলে আমি বেশ বুঝতে পারছি তুই পড়াশোনা য় কাঁচা হয়ে গেছিস। ছোট করেই দেওয়া এগুলো, এর থেকে বেশী ছোট করলে না নম্বরটাও ছোট হয়ে যাবে।
সৃজা হেসে উঠলো।
সৃজা এবার বলতে শুরু করলো -- "এই শোনো তুহিন দা বলেই শুরু করলো নানান রকমের কথা।
কিছু ক্ষন পরে..
তুহিন বলে উঠলো, -- " কথার জাহাজ আজ আর থামবে না। এত কথা তুই পাস কোথা থেকে উহঃ বাবরে বাবা! পড়ার বেলা যত ফাঁকিবাজি, আর এখন ...
সৃজা আর তুহিন এর পড়তে পড়তে রোজই এমন কথার ঢেউ চলতেই থাকে।
দেখতে দেখতে আকাশে বাতাসে পুজোর সুবাস চলে এলো। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে ক্লাব থেকে সরোজ বাবু বনানীর বাড়িতে চাঁদা চাইতে এলো।
তুহিন কে বললো, "শোনো তুমিতো পাড়াতে নতুন এবারে কিন্তু ক্লাবে আসতে হবে। আমাদের পুজো খুব জমজমাট হয়। তোমার মেসোমশাই যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন এই পুজোর দায়িত্বে ছিলেন। তুমি ও আসবে। "
তুহিন একদিন
এর মধ্যে ক্লাবে গিয়ে সবার সাথে আলাপ করে এলো।
ক্লাবের ছেলে পল্টু প্যান্ডেলের কাজ সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো।
ক্লাবের ছেলে সুজিত বললো, "তুহিন দা একদান ক্যারাম চলবে।"
তুহিন বললো, "আমি তেমন জানি না। সবাই মিলে তুহিন কে ক্যারাম খেলা শেখালো।
হৈহৈ করে দিনটা কাটলো।
সন্ধ্যা বেলা সৃজা এসে প্রশ্নের উত্তর লিখতে লিখতে বকবক শুরু করতেই কড়া ভাবে তুহিন তাকে শাসন করতে শুরু করলো ।
সৃজা বলে উঠলো, "উহঃ তুমি জানো না তুহিন দা পুজো এসে গেছে, এখন কি আর পড়তে ভালো লাগে , তোমার খালি বই আর বই। নিজেতো ক্যারাম খেলা প্র্যাকটিস করছো আর আমার বেলাই যত শাসন।
তুহিন হেসে উঠলো তারপর বললো, আচ্ছা এই খবরটাও তুই পেয়ে গেছিস ।
সৃজা আবার হেসে উঠলো।
তুহিন বললো, "ঠিক আছে
এবার পুজোয় তোর সাথে ঠাকুর দেখতে বেরোবো।"
সৃজা কথা শুনেই উচ্ছ্বসিত হয়ে তুহিন হাতটা ধরে ....সত্যি বলছো?"
তুহিন সৃজার উচ্ছ্বাস টা দেখে আনন্দ পেলো।
এই কয়দিনে এর মধ্যে সৃজার প্রতি একটা অদ্ভুত অনুভুতি তুহিনের কাজ করছে। যদিও সৃজা এখনোও কিছু ই সেভাবে বোঝেনি আর সৃজার এই সরলতাই তুহিনের ভালোলেগেছে।
দেখতে দেখতে পুজো চলে এলো।
মন্ডপে ঢাকের বাদ্যি শোনা যাচ্ছে।
শরৎ এর মেঘ সারা আকাশ জুড়ে।
তখন অষ্টমীর সকাল..
সৃজার মা বললো," তুই তাহলে বনানী দি কে ডেকে আন। আমি মন্ডপে যাচ্ছি, আর তাড়াতাড়ি আসিস, অঞ্জলী শুরু হয়ে যাবে আবার
সৃজা বললো--"ঠিক আছে, তুমি যাও।"
সৃজা একটা জাম রঙা শাড়ি পরেছে। সঙ্গে সাদা রঙের কারুকাজ।
বনানী র বাড়ি গিয়েই বললো, " কাকিমা চলো, মা চলে গেছে , অঞ্জলী শুরু হয়ে যাবে, তুহিন দা যাবে না? কোথায় গো?"
বনানী বললো, " আরে দ্যাখ না কখন বলেছি তৈরি হতে। তো ঘুমিয়ে আছে তো আছে, ওঠে আর না।"
সৃজা গেলো তুহিন কে ডাকতে ।
তুহিন ঘুমন্ত গলায় , "আজ সারাদিন ধরে অঞ্জলী হবে একটু পরে গেলে কি হবে?"
সৃজা বোতল থেকে জল নিয়ে জলের ছিটে দিতেই ধড়পড় করে উঠে মাসিমনি মাসিমনি..
সৃজা--" মাসিমনি নয় আমি সৃজা , তাড়াতাড়ি যাও তৈরি হও। "
তুহিন সৃজাকে অবাক হয়ে দেখছে, দেখিয়ে যাচ্ছে। তার পর বিছানা ছেড়ে উঠে নিজেকে তৈরি করলো।
কিছু ক্ষন পরে
মন্ডপে ওরা পৌঁছে গেলো , অঞ্জলী দিতে দিতে তুহিন সৃজাকে বললো, "তোকে না আজ দারুন দেখতে লাগছে। এই রঙটা বেশ ।"
সৃজা মুখ নীচু করে হাসলো।
সন্ধ্যেবেলায় সৃজার সাথে তুহিন ঠাকুর দেখতে বেরোলো। অনেক টা সময় দুজনের ঘোরাঘুরি চললো
কিছু সময় পরে
তুহিন বলে উঠলো,
, "আমার দ্বারা সম্ভব নয় , বাড়ি চল এবার। পা পুরো ধরে গেছে।
সৃজা--- "তুহিন দা .. আরো কটা ঠাকুর দেখলে
হতো না বলো ?"
তুহিন--
" আমি আর পারবো না। পুরো হাঁপিয়ে গেছি।
সৃজা ছুটে গিয়ে আইসক্রিম নিয়ে আসলো।
তুহিন আনন্দিত হয়ে বলে উঠলো, "এটাই আমি খুঁজছিলাম। তুই কি করে বুঝলি?"
সৃজা তাকলো তুহিন এর দিকে। দুজনের মধ্যে গড়ে উঠা অদৃশ্য ভালোবাসা সেদিন ঢাকের আওয়াজ এ মুখোরিত হয়ে উঠলো।
পুজো পেরিয়ে গেলো, পাড়ার বিসর্জন, হৈহৈ করে সব শেষ ।
বিজয়া করতে বনানী এলো সৃজার বাড়ি, বনানী মিষ্টি হাতে দিলো সৃজার মায়ের।
বনানী সেদিন কথায় কথায় সৃজার মাকে বলেই রাখলো আগামী দিনে তুহিনের সাথে সৃজার সমন্ধের কথা।
সৃজার মা খুশি হয়ে, "আমি তো ভাবতেই পারি না। কিন্তু তোমার দিদি রা কি এটা মেনে নেবেন।
তাছাড়া তুহিন কি ভাবছে।"
বনানী-- " আমার দিদি জামাইবাবু ভীষণ ভালো , সৃজাকে তাদের খুব পছন্দ হবে আর এখন তো ওরা পড়াশোনা করছে। ওরা বড় হোক তবেই আলোচনা এগোবো। আমি ওদের মধ্যে এই অল্প দিনে যা লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ওরা সুখী হবে। "
সৃজার মা--" বেশ তো বনানী দি তাহলে তাই।"
বনানী আর সৃজার মায়ের মধ্যেকার এই কথা তাদের মধ্যে ই থেকে গেলো। নিখিল বীনা এসব কথা তখনোও জানতেন না।
আরো কয়েকটা দিন পরে,
সেদিন হেমন্ত এর ঝিমানো একটা বিকেল সূর্যের আলো ফুরিয়ে আসছে তখন।
তুহিন কে নিয়ে সৃজা , কাছেই একটা ঝিলের ধারে নিয়ে এলো আর বললো," এই জায়গাটায় অনেক পাখি আসে জানো। "
তুহিন বলে উঠলো, - "তাই ..! আমার না পাখি দেখতে খুব ভালো লাগে।
জায়গাটা দারুন, সূর্য অস্ত এখানে ঝিলের ধারে খুব সুন্দর। এই জায়গাটার কথা আগে বলিসনি কেন?"
সৃজা বললো, -- "জানো তুহিন দা আমার না ঘুরতে যেতে দারুন লাগে , কিন্তু আমাদের অবস্থা তো জানো ? ছেলেবেলায় বাবার সাথে একবার গেছিলাম , সে অনেক দিন হতে চলল। তারপর সৃজা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
তুহিন বলে উঠলো-- "বেশতো শোন !আমি যখন চাকরি করবো , তুই যেখানে যেতে চাইবি সেখানেই নিয়ে যাবো, দেশ ,বিদেশ।
সৃজা উচ্ছ্বসিত হয়ে সত্যি বলছো? তারপর আবার গম্ভীর হয়ে ধুর.. ছাই.. তখন তোমার আমার কথা মনেই থাকবেনা।"
তুহিন রাগ দেখিয়ে --" তারমানে তুই আমায় বিশ্বাস করছিস না? ঠিক আছে।"
সৃজা -- "ওহ্ আচ্ছা রাগ করবার কি আছে! আমি তোমাকে বিশ্বাস করি । চলো বাড়ি চলো হিম পড়ছে !"
তুহিন-- "পড়ুক ..!"
সৃজা --" হিম গায়ে লাগলে শরীর খারাপ হবে।"
তুহিন-- "আমার হবে তোর কি?"
সৃজা -- "তোমার কিছু হলে আমার বাজে লাগবে। "
তুহিন--" কেন বাজে লাগবে ?"
সৃজা,-- "উহঃ কত বাজে কথা তুমি বলতে পারো বলেই তুহিন এর হাত ধরে চলো এখনি, খালি রাগ।বলছি তো তোমায় সরি সরি ... সরি! আর বলবো না। এবার চলো..."
তুহিন সৃজার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
দেখতে দেখতে কেটে গেলো কয়েকটা বছর ...
তুহিন এম এ পড়ছে । আর সৃজা কলেজে ভর্তি হলো।
হঠাৎ একদিন নিখিল কোচবিহার থেকে বনানী কে ফোনে বললো, ভীষণ জরুরী একটা দরকার তাই এখনি যেনো তুহিন চলে আসে কোচবিহার।
বনানী ও তুহিন কে কোচবিহার যেতে বললো,
তুহিন চলে যাচ্ছে শুনে সৃজার মনখারাপ হয়ে গেল।
তুহিন সৃজাকে বললো, -- "আরে আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরবো। আর ফিরেই তোকে নিয়ে বেড়াতে যাব এই প্রমিস!" ! সৃজার হাত ধরে কথাটা বলতেই সৃজা হাসলো।
তুহিন চলে গেলো।
তুহিন আর সৃজার সম্পর্কটা বেশ গভীরতা পেয়েছে। একে অপরকে ছাড়া এখন ওদের চলতোই না। দুজনের বকবক লেগেই থাকতো।
তুহিন কোচবিহার পৌঁছে গেলো।
নিখিল বললো, "এভাবে তোমায় আমি ডাকতাম না তুমি এম এ পড়ছিলে কিন্তু একটা ভারী বিপদ হয়েছে।"
বীনা--" হ্যঁরে বাবা, তোর বাবার বন্ধু ধীরেন বাবু খুব অসুস্থ।
নিখিল আবার বললো, -- "আমাদের দার্জিলিং এ একটা ব্যবসা আছে যেটাতে ধীরেন এর ও সমান ভাগ। একসঙ্গে শুরু করেছিলাম।
ধীরেন ছিলো বলে আমায় ওটা নিয়ে মাথাঘামাতে হয়নি কোনদিন। কিন্তু আজ সে অসুস্থ, ব্যবসাটা ভেঙে পড়ছে তাই সেখানে তোমায় যেতে হবে। সবটা সামলাতে হবে। তমাল তো ছোট তাই ওকে দায়িত্ব দিতে চাই না। তুমি যাও সেখানে।"
তুহিন তার বাবার কথা মতো চলে গেলো দার্জিলিঙে ব্যবসার হাল ধরলো।
এদিকে ধীরেন এর শরীর খারাপের দিকে । উন্নতির কোনো আশা নেই।
ধীরেন এর মেয়ে অপরূপা র সাথে তুহিন আলাপ হলো দার্জিলিঙে।
কয়েকটা দিনের মধ্যেই অপরুপার সাথে তুহিনের বেশ ভালোই আলাপ হয়ে গেলো।
তুহিন অপরূপার প্রতি ধীরে ধীরে মুগ্ধ হয়ে পড়লো।
ধীরেন তুহিন ডেকে বললো, তার মেয়ে অপরূপা কে বিয়ে করতে।
ধীরেন আরো বললো, "দ্যাখো তুহিন তুমি আমার বন্ধু র ছেলে তাই
তুমি যদি অপরূপাকে বিয়ে করো আমি নিশ্চিন্ত এ মরতে পারবো। "
তুহিন অপরূপার সাথে এতদিন এখানে দার্জিলিঙে ঘোরাঘুরি করেছে । অপরূপা র সাথে বেশ কিছু সময় কাটিয়েওছে। কিন্তু তবুও তুহিন এর মনে একটা টানাপোড়েন কাজ করলো।
তুহিন কোন সিদ্ধান্ত জানাচ্ছে না দেখে
ধীরেন টেলিফোন করে
নিখিলকে জানালো , বিয়ে দিতে চায় নিজের মেয়ের সাথে ।
নিখিল ভাবলো অপরূপা তার বন্ধুর মেয়ে , অসুবিধা কিছুই নেই। তাই আপত্তি জানালো না।
এদিকে অসুস্থ ধীরেনের কথা রাখতে নিখিলের নির্দেশ মেনে তুহিন অপরূপাকে বিয়ে করছে সেটাই স্থির হলো।
দার্জিলিঙে র কম্পানি র ম্যানেজার সন্তু একদিন তুহিন কে বললো, স্যার একটা কথা বলছি কিছু মনে করবেন না তো ?
তুহিন বললো, " বলুন না কি হয়েছে।"
সন্তু বললো, " আপনি অপরূপা ম্যাডামকে বিয়েতে মত না দিলেই পারতেন, এত অল্প দিন আপনি এখানে এসেছেন, অপরূপা ম্যাডাম তেমন সুবিধের মানুষ নন।"
তুহিন বললো , " কি বলছেন এসব ধীরেন কাকু আমার বাবার বন্ধু আর তার মেয়ে সম্পর্কে আপনি.. অপরূপা কে বেশ ভালোই মনে হয়েছে তাহলে।"
সন্তু বললো, " আমার যা মনে হলো তাই বললাম।"
কথাটা বলে উনি চলে গেলেন।
বিয়েটা তুহিন বাধা দিতে চাইলে পারতো কিন্তু কেন যে পারলো না তুহিন নিজেও বুঝতে পারলো না। কিছু ক্ষনের জন্য তুহিন অপরূপার প্রতি মুগ্ধ ছিলো। আর তাই তুহিন এর মনে যত টানাপোড়েন থাকুক না কেন সে বিয়েটা করেই ফেললো।
তাড়াতাড়ি তুহিন অপরূপার বিয়ে হলো জাঁকজমক ছাড়াই।
কিছু দিন পরেই ধীরেন বাবু মারা গেলো।
তারপর অল্প দিনের মধ্যেই অপরূপার সাথে সংসার করতে গিয়ে প্রতিমুহূর্তে সৃজার কথা তুহিনের মনে পড়তে লাগলো।
আর অপরূপার জীবনযাত্রার সঙ্গে তুহিন নিজেকে মানিয়ে নিতে ও পারলো না।
তুহিন সাদামাটা জীবন এ অভ্যস্ত। অপরূপা হৈচৈ , বন্ধুদের সাথে পার্টি, দামী জিনিসপত্র নিয়ে বেশি চিন্তা করে। তুহিন এর সাথে অপরূপার সম্পর্ক টা খুব একটা ভালো তৈরি হলো না।
কিছু দিনের মধ্যেই
টেলিফোনে বনানী সমস্ত খবর জানতে পারলো।
বনানী এই বিয়ে র খবর শুনে বীনা এবং নিখিলের কাছে বিরক্তি প্রকাশ করলো।
বীনা বললো, "দ্যাখ বনানী জানি তুহিনের এভাবে বিয়ে হোক তা আমরোও চাইনি কিন্তু ধীরেন বাবুর কথা ভেবেই তোর জামাই বাবু এই বিয়েতে মত দিয়েছিলো।"
বনানী বলে উঠলো, তোমরা তুহিনের এই বিয়েটা দিয়ে দিলে। এই বিয়েটা না দিলেই পারতে এত তাড়াতাড়ি না বুঝে।
নিখিল ফোনে বনানীকে বোঝানোর চেষ্টা করলো বললো, ধীরেন এর মেয়ে অপরূপা তুহিনের জন্য খারাপ হবে না।
বনানী বললো," এখানে খারাপ ভালো বিষয়টা নয় , আমি যতটুকু তুহিন কে জানি সে এই বিয়েতে ভালো থাকতে পারে না।
বনানী টেলিফোন রাগ করে রেখে দিলো।
নিখিল বীনা কে বললো," বনানী এত কেন রাগ করছে কিছুই বুঝতে পারছি না।"
বীনা বললো, "আসলে তুহিন কে তো নিজের ছেলেই ভাবে , তাই ওর একটা অধিকার ছিলো। ওকে হয়তো বিয়ের আগে আমাদের জানানো উচিত ছিলো। তাছাড়া তুহিন এরোও এ বিয়েতে তেমন মত ছিলো না।"
সমস্ত আলোচনা শুনে তমাল বললো, " দাদা তো শেষপর্যন্ত রাজি হয়েই বিয়েটা করলো, এখন আর ভেবে কি হবে।
নিখিল বললো, "কিন্তু ধীরেন যে আমাকে বললো ওরা ভালোই দার্জিলিং এ একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা করেছে, ওদের ভালো সম্পর্ক ও স্থাপন হয়েছিলো নাকি।। এখন ওরা যদি সুখী না হয় তবে নিজেকে অপরাধী মনে হবে।"
বীনা-- "কি জানি অপরুপা কে তো ভালো মেয়ে বলেই জানি। এখন আর এত ভেবে কোনো লাভ নেই। তারচেয়ে বরং একবার ওদের ওখানে গিয়ে চলো দেখে আসি ওরা কেমন আছে।
তমাল ---" মাসিমনি আমাদের ওপর রাগ করলো, আর যোগাযোগ ই করবে না হয়তো।"
নিখিল -- "হ্যাঁ বনানী কে বোঝাতে পারলাম না।"
এদিকে
সৃজা ও জানতে পারলো বনানীর কাছ থেকে তুহিনের বিয়ের ব্যপারটা।
সৃজা বাড়ি ফিরে একলা কেঁদে ফেললো।
সৃজার মা পরে বনানীর কাছে গিয়ে সবটা জানলো
সৃজার মায়ের সঙ্গে বনানী কথা বললো ।সমস্ত ঘটনা জানালো আর বললো, "আমি যা ভেবেছিলাম তা তো হবার নয় জানি না আগামী দিনে কি আছে। দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না।"
সৃজার মা-- " তুমি আর কি করবে বনানী দি সবই ভাগ্য।"
কেটে গেলো অনেকগুলো বছর...
এদিকে তুহিন অপরূপা মধ্যে অশান্তি লেগেই আছে। অপরূপা তুহিন কে ঠিক ভাবে বোঝার চেষ্টাই করতো না ।
কেবল তার কাছে টাকা, আর লোকদেখানো বাহুল্য ছিল বেশি প্রয়োজনীয়।
তুহিন ধীরে ধীরে ব্যবসায় ব্যস্ত থাকতে শুরু করলো। আর অপরূপা তার বন্ধু, ক্লাব এসব নিয়ে মেতে উঠলো।
তুহিন যে ভালো নেই তা সে কোনো ভাবেই প্রকাশ করলো না।
নিখিল , বীনার কথা ভেবে তুহিন চুপচাপ সবটা মেনে নিয়েছে। নিখিল বীনার বয়স বেড়েছে তাদের মনে যাতে কোনো চাপ না পড়ে তাই তুহিন কখনো নিজের খারাপ লাগার কথা কাউকে অভিযোগ করতো না।তমাল এর ও বিয়ে হয়েছে । কোচবিহারের সব কিছু এখন সে সামলায়। নিখিল আর তেমন ব্যবসায় মাথা ঘামায় না, শরীর ইদানিং ভালো যাচ্ছে না বলে।
এদিকে বনানীরও বয়স হয়েছে। একা একা আর সবটা পারে না।বহুদিন বনানীর সাথে তুহিন এর কোনো যোগাযোগ নেই। তমালের বিয়েতেও বনানী আসেনি তার দিদি জামাইবাবু উপর রাগ করে।
বনানী তুহিন কে একদিন হঠাৎ টেলিফোনে বললো, "আমায় নিয়ে যাবি বাবা , আমার বয়স হয়েছে, কখন কি হয় , তোকে ছাড়া আর কাকেই বা বললবো। "
তুহিন সব কিছু শুনে ঠিক করলো, বনানী কে সে দার্জিলিং এ এনে রাখবে।
এদিকে সৃজার বাবা মারা গেছে, মা অসুস্থ, সেলাইএর কাজ করে সৃজা সংসার চালায়।
সৃজা আর বিয়ে করেনি।
বনানী কে নিতে কোলকাতায় এলো তুহিন।
পুরোনো একঝাঁক স্মৃতি। বনানী এতদিন বাদে তুহিন কে দেখে কেঁদে ফেললো।
বনানী-- "তুইযে সেই গেলি তারপর এতগুলো বছর এ কি মাসিমনিকে একবার ও মনে পড়লো না। এমন কেন করলি রে?"
তুহিন-- "মাসিমনি তুমি তো সবই জানো আমার জীবন টাইতো বদলে গেলো। "
বনানী-- "আর কি বলবো সবই ভাগ্য ।"
বিকেল বেলা তুহিন সৃজার বাড়ি যাবে বলে বেরলো। রাস্তায় পাড়ার ক্লাবটা দেখে পুরোনো দিন গুলো মনে পড়ে গেলো।
সৃজার বাড়ির বেল বাজাতেই সৃজার মা দরজা খুললো, তুহিন কে দেখে আপ্লুত হয়ে আয় ভেতরে আয়। শুনেছিলাম বনানী দি বলেছিল তুই নাকি আসবি ,
তুহিন--" আপনারা ভালো আছেন মাসিমা?
সৃজার মা-- "আর ভালো থাকা উনি তো মারা গেলেন কয়েক বছর হলো আর আমার তো শরীর খারাপ লেগেই আছে। সৃজা দিনরাত সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালায়। আমি চলে গেলে ওর যে কি হবে জানি না, সৃজা তো বিয়েটাও করলো না। "
তুহিন এর মনখারাপ হলো সব শুনে ।
কিছু ক্ষন পর সৃজা এলো।
সৃজা কে দেখে তুহিন অবাক হয়ে তাকলো অনেক ক্ষন।
তারপর বলে উঠলো-- সৃজা... কেমন আছিস?"
সৃজা-- মুখ নীচু করে , "ঠিক আছি।"
তুহিন-- "মাসিমা বলছিলেন তোর নাকি সেলাইকরে খুব ধখল যাচ্ছে।"
সৃজা-- "উহঃ মা র কথা ছাড়তো, বসো চা করি।"
তুহিন-- "না থাক , কাল একবার বিকেলে সেই ঝিলের ধারে আসিস।"
সৃজা-- "আচ্ছা .."
পরেরদিন ঝিলের ধারে,
সৃজা-- "জানো তুহিন দা সে বার কি সুন্দর একটা পাখি এসেছিল , তোমার কথাই মনে পড়ছিলো। কত কথাই বলা হলো না তোমায় ,
তুমি তো আর এলেই না।
কাকিমা বলেছিলো তোমার বিয়ের কথাটা।
তুহিন-- "আচ্ছা যদি আমি আর ফিরে না যাই তবে তোর ভালোলাগবে। "
সৃজা-- "কি বাজে কথাই না তুমি বলো। মনে আছে সে বার বলেছিলে চাকরি পেলে আমায় নাকি দেশ বিদেশ নিয়ে যাবে। তারপর ট্রেনে ওঠার আগে সেই দিন বলেছিলে খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে.. কিন্তু কি হলো!"
তুহিন সৃজার হাত ধরে নিজের কাজে টেনে" দ্যাখ সৃজা আমি জানি কথা গুলো রাখতে পারিনি, কিন্তু বিশ্বাস কর , কথা গুলো কিন্তু মন থেকে বলেছিলাম আমি তো সত্যি ই চেয়েছিলাম বাকি পথ টা তোর সাথে চলতে কিন্তু কোথায় কি হয়ে গেলো আমায় তুই ক্ষমা করিস।"
সৃজা-- "আরে তুমি না কি যে করো না , আচ্ছা জীবনের কথা কে বলতে পারে বলো। কখন কি ঘটে।
তুহিন-- "তোর আমার কত বার মনে পড়েছে এই ক বছরে ?, তোর খারাপ লাগেনি আমি আসলাম না বলে?"
সৃজা--" কি করবে তুমি জেনে?"
তুহিন-- "তুই বিয়ে করলি না কেন? মাসিমা বলছিলো
সৃজা-- "আমি বিয়ে করলে তোমার ভালো লাগতো?"
তুহিন-- "তুই সুখে আছিস জানলে নিশ্চয়ই ভালো লাগতো।"
সৃজা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, -- "কেন ডাকলে এখানে ? এত বছর বাদে আমার সাথে দেখা করার তো তোমার কোনো দরকার ছিলো না। তুমি কাকিমা কে নিতে এসছিলে। নিয়ে চলে যেতে , আমার কথা তো ভাবার দরকার নেই। আর তুমি তো কখনো ভাবোও নি আমি জানি সেটা।"
তুহিন-- "সৃজা .. আমি জানি তুই ভাবছিস আমি কেন তোর কাছে আগে আসিনি , আসলে এমন একটা পরিস্থিতি হলো আমার গোটা জীবনটাই অন্যরকম হয়ে গেলো। কিন্তু তোর কথা ভাবিনি, মনে পড়েনি তা কিন্তু নয়, শোন ! আমার ফোন নাম্বার টা রাখ তোর কাছে।"
সৃজা-- "কি হবে ?"
তুহিন--" তোর যখন যখন দরকার হবে , ইচ্ছে করবে আমায় ফোন করিস। "
সৃজা র চোখ ছলছল করে উঠলো, বললো" কেন তুহিন দা.. এভাবে পিছুটান রাখছো। এই টানাপোড়েন এর কি প্রয়োজন।"।"
সৃজার চোখে র জল তুহিন মুছে দিয়ে বললো, "দ্যাখ আমি তোর পাশে হয়তো থাকছি না কিন্তু আমার ভালোবাসা সেটা থাকছে।"
সৃজা তাকিয়ে রইলো তুহিনের দিকে বহুক্ষন কথা হারিয়ে ফেলেছে সৃজা কি বলবে কিছুই জানে না ভিতরের খুশিটা ও প্রকাশ করতে পারলো না।
সৃজা-- "কাকিমা কে তো নিয়ে যাবে। বাড়িটা পড়েই রইলো। আর কখনও আসবে না তুহিন দা?"
তুহিন--" জানি না মাসিমনি বাড়িটার ব্যপারে কিছু বলে নি। "
সৃজা-- "ছোট্ট থেকে ওই বাড়িতে আসছি তারপর তুমি এলে , কত কথা হলো আর হয়তো আসবে না কোনোদিন এখানে আর কেনইবা আসবে।"
তুহিন-- " অসহায় ভাবে উওর দিলো আমার কিছু করার নেই। অদ্ভুত একটা টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে জীবন টাকে বয়ে বেড়াচ্ছি। ভালো মন্দ সবই এখন একি লাগে।"
সৃজা তুহিনের হাতে হাত রেখে বললো, আমি তোমায় ফোন করবো। তুমি যেখানেই থাকো না কেন, জানবে কেউ একজন তোমার কথা সবসময় মনে করছে তোমায় নিয়ে ভাবছে।
তুহিন উচ্ছ্বসিত হয়ে, " সৃজা.. বলে তাকলো...."
পরেরদিন ট্যাক্সিতে বনানী তুহিন উঠবে তার আগে বনানী সৃজা কে বললো, "সাবধানে থাকিস, নিজের খেয়াল রাখিস, বনানী সৃজাকে ধরে কাঁদল
সৃজা-- "কাকিমা কাঁদছো কেন ? আমি তোমার খোঁজ নেবো ফোনে।"
তারপর ওদের ট্যাক্সিটা চলে গেলো।
সৃজা একা ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে রইল।
দু বছর পরে....
দার্জিলিঙে বনানী আরামেই আছে। কিন্তু মানসিক ভাবে ভালো নেই। অপরূপার উ ৎশৃঙ্খল আচরন বনানী কে কষ্ট দেয় । তুহিন চেষ্টা করে সবটা সামলাতে । অপরূপা এমন আচরণে র কথা বনানী তার দিদি জামাইবাবু কেও কখনো বলেনি। তাদের মনে আঘাত লাগবে এটা ভেবে।
ওদিকে সৃজার অবস্থার উন্নতি নেই। রোজকার সেই একি রুটিন। সকাল থেকে উঠে ঘরের কাজ , রান্না তারপর সেলাইয়ের কাজ করা। সৃজার মায়ের দুশ্চিন্তা রোজ বাড়ছে, কেমন করে সৃজা বাকি জীবন টা কাটাবে।
একদিন সন্ধ্যায় সৃজার মা , "আগে তাও বনানী দি ছিলো সময়ে অসময়ে আমাদের পাশে থাকতো এখন তো আর কেউ নেই। "
সৃজা--" উহঃ মা ফের শুরু করলে, তুমি যাওতো পাশের ঘর এ বসে একটু টিভি দ্যাখো আমি হাতের কাজ গুলো এগিয়ে নি।"
সৃজার হঠাৎ মনে হলো অনেক দিন বনানী কে সে ফোন করেনি।
তুহিনের নম্বরটাও ছিল সেটাও সে করেনি।
তুহিন বরং কয়েক বার ফোন করেছে কিন্তু সৃজার মার সাথে কথা হয়ছে ।
সৃজা ভাবলো আজ একবার সে বনানী কে ফোন করবে।
ফোনটা হাতে নিয়ে নম্বরটা টিপলো, ওদিকে রিং বেজে বেজে কেটে গেলো, আবার করলো একি রকম হলো। তারপর বেশ কয়েক বার , কিন্তু বেজে কেটে গেলো।
সৃজার এবার অদ্ভুত লাগলো। সৃজা এবার তুহিন কে ফোন করলো। তুহিন ফোন ধরলো-- " এত দিনে মনে পড়লো ।তোকে যতবারই ফোন করি মাসিমা ধরে বলেছে তুই বাড়ি নেই। "
সৃজা-- "তোমরা কেমন আছো ? কাকিমা কেমন আছে? আচ্ছা কাকিমা..
তুহিন-- " কি হয়েছে বলতো তোর গলা এত চিন্তিত লাগছে?"
সৃজা-- " না আসলে কাকিমা কে কতবার ফোন করলাম কিন্তু ধরলো না তো তাই মনে হলো।
তুহিন-- " ও তাহলে মাসিমনি হয়তো কোনো কাজে আছে। তাছাড়া বাড়িতে তো অপরূপা ও আছে , আচ্ছা আমি তো এখন কম্পানি তে, বাড়ি ফিরে মাসিমনিকে বলবো তোকে যেনো ফোন করে। তারপর বল তোর সব কিছু..
সৃজা--" ঠিক আছে
বলেই দুম করে ফোন ছেড়ে দিলো।
তুহিন ভাবলো সৃজা অতিরিক্ত চিন্তা করছে।
কিন্তু সৃজার মনটা কেমন খচখচ করেই চললো।
ওদিকে তুহিন কাজ শেষ করে সন্ধ্যে বেলা যখন ঘরে এলো দেখলো বাড়ি ফাঁকা । অপরূপা নেই। বনানী বিছানায় ছটফট করছে।
তুহিন বনানী কে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করলো। বনানী কে হাসপাতালে রেখে তুহিন বাড়ি ফিরলো আর অপরূপা র কাছে কৈফিয়ত চাইলো
তুহিন বললো, " তুমি অসুস্থ মাসিমনিকে এভাবে ফেলে বাড়ি থেকে চলে গেলে এতটা দায়িত্বহীন তুমি। তোমার বাইরের জগৎ টা এতটা বড় যে বাড়ির কারোর জন্য তোমার সময় নেই।"
অপরূপা বলে উঠলো, "তোমার মাসিমনির বয়স হয়েছে , আজ এটা তো কাল সেটা লেগেই আছে, থাকবেও ।তার জন্য আমি আমার কাজ গুলো বন্ধ করে বসে থাকতে পারি না। উনি বলে ছিলেন ওরার একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তা ওনার প্রায়ই হয়, যাইহোক এখন তো হাসপাতালে আছে।"
তুহিন ভীষণ বিরক্ত হলো অপরূপা র কথায়।
কিছু দিন পরে...
বনানী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলো।
সৃজা র কথা তুহিনের কাছে জেনে খুশি হলো।
বনানী বললো, " এতদিনে র টান তাই হয়তো ওইদিনই সৃজা আমায় ফোন করেছিলো।"
দেখতে দেখতে আরো কয়েকটা দিন কাটলো।
অপরূপার কলেজের বন্ধু প্রদীপ যার সঙ্গে অপরূপা কে প্রায়ই ইদানিং দেখা যায়।
কম্পানির অনেক লোক কথ টা নিয়ে বলাবলি শুরু করলো।
তুহিন অপরূপা কে বললো," তুমি কি চাও? অনেক লোকই তোমায় প্রায়ই একটি ছেলের সঙ্গে দেখেছে। আমি জানতে চাই সে কে? আর কেনই বা তুমি।"
অপরূপা বললো, হ্যাঁ আমি বলতাম , তুমি জিগ্যেস করলে যখন আজই বলতে চাই। প্রদীপ আমার পুরোনো বন্ধু। আমরা কলেজে একসাথে পড়তাম তারপর ও বিদেশে ছিলো এখন ফিরে এসছে।
তুহিন বললো, "তাহলে আমার সঙ্গে সেদিন ভালোবাসার অভিনয় করেছিলে কেন?।"
অপরূপা বললো," দ্যাখো তোমার সাথে আমার সম্পর্ক টা ঠিক হলোই না যখন তুমি আমার বাবার কম্পানিটা ছেড়ে চলে যাও । আমি প্রদীপকে বিয়ে করতে চাই। তাতে তুমি ও ভালো থাকবে আর আমিও।"
তুহিন বললো, "কি আবোল তাবোল বলছো ?পুরো কম্পানিটা তোমার বাবার.. একথার মানে কি? এই কম্পানির পঞ্চাশ শতাংশ আমার বাবার আর তোমার বাবার মৃত্যুর সময় আমাকে বাকি অংশ টা দিয়ে যান । পরে একটা দানপত্র হয় যেটা আমার বাবা আমার নামে অংশ টা দেন এবং আমার অবর্তমানে আমার স্ত্রী এবং সন্তান দের অথবা আমার পরিবারের সদস্যরা এই কম্পানি পাওয়ার কথা ।
তুমি ভুল করছো।
অপরূপা একটা দলিল নিয়ে এসে দেখায় যেটাতে তুহিনের সই। অপরূপা তার নিজের নামে সমস্ত কম্পানি করে রেখেছে। কাগজে তাই লেখা ছিলো।
এসব দেখে তুহিন অবাক হয়ে যায়।
তুহিন বলে, " তুমি আমার সই জাল করেছো? ছিঃ ছিঃ এসব তুমি কেন করলে কি জন্য করলে?
অপরূপা-- "বাবা আমাকে সম্পত্তি না দিয়ে তোমায় দিয়ে গেছিলো। সেটা আমার পছন্দ ছিলো না তাছাড়া প্রদীপ বিদেশ ছিলো আর জানতাম বাবা প্রদীপকে হয়তো মেনে নিতো না। তাই ছলনা করতে হয়েছিল এখন আমি ডিভোর্স চাই। আর কম্পানি টাও।
তুহিন বলে উঠলো, -- আমি আমার পরিশ্রম দিয়ে এই কম্পানি টা দাঁড় করিয়েছি। তুমি এত ছোট মনের আমি ভাবতেও পারি না।
বনানী সমস্ত কথা টেলিফোন এ নিখিল কে বলে। নিখিল এসব শুনে উত্তেজিত হয়ে আরোও অসুস্থ হয়ে পড়লো।
বীনা জানায় সব কিছু ছেড়ে দিতে। তুহিন যেনো কোনো ঝামেলায় না জড়ায়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে তমাল দার্জিলিং এ যায়।
কোর্টে মামলা শুরু হয়। বিষয়টা জটিল হয়ে ওঠে।
দেড় বছর পরে..
মামলাটায় ও তুহিনরা জেতে , তুহিন তার বাবার অংশটুকু নিয়ে বাকিটা অপরূপাকে পরে দিয়ে দেয়। এবং অপরূপার সাথে ডিভোর্স টাও হয়ে যায়।
এতদিন ধরে যুদ্ধ করে করে তুহিন অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
দার্জিলিং এর কম্পানি র কাজ গুলো ম্যানেজার সন্তুকে দায়িত্ব দিয়ে তুহিন আর বনানী কোলকাতায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয়।
ম্যানেজার সন্তু বলে, "চিন্তা করবেন না আমি সবটা সামলে নেবো। আপনি আগে সুস্থ হয়ে উঠুন স্যার ।
তুহিন বললো, "সেদিন আপনি আমায় বলেছিলেন আমি বিশ্বাস করিনি , আজ তার ফল পেলাম।
আমি তাহলে কোলকাতায় ফিরছি আপনি যখন যা প্রয়োজন হবে ফোনে জানাবেন।
সন্তু-- " ওসব পুরোনো কথা ভুলে যান স্যার নতুন করে বাঁচুন।"
তুহিন এবং বনানী ফিরে আসে কোলকাতায়। বনানী সৃজাকে জানায় তুহিন ভীষণ অসুস্থ তার যত্নের প্রয়োজন।
বনানী সৃজার ওপর সব দায়িত্ব দেয় । তুহিন কে সৃজা সুস্থ করে তোলে।
বনানী কোচবিহারে ফোন করে নিখিল বীনাকে নিয়ে তমালকে আসতে বলে কোলকাতায়।
ওরা সবাই কোলকাতায় পৌঁছে গেলে। সৃজার কথা ওদের জানায়।
আর সৃজার সাথে বিয়ের বন্দোবস্ত করে।
দেখতে দেখতে তুহিনের সাথে সৃজা বিয়ে হয়ে যায়।
সৃজার মা আজ খুশি, বনানীরোও মনের আশা পূরণ হয়েছে। তুহিন এরও মানসিক টানাপোড়েন আজ মিটেছে।
ফুলশয্যার রাতে
তুহিন বললো, "আমি এলাম তোর কাছে।"
তারপর সৃজা তুহিনের বুকে মাথা দিয়ে বললো, " আমি অপেক্ষা করছিলাম।"
তুহিন বললো," কতদিন অপেক্ষা করতে..."
সৃজা বলে উঠলো, "অনন্তকাল..."
তারপর গোটা রাত রজনীগন্ধা র গন্ধ মেখে ওদের দুজনের ভালোবাসা জেগে উঠলো নতুন সুখের উল্লাসে।
বিয়ের অনুষ্ঠান সব মিটে গেলো।
সকাল বেলা ...
বনানীর বাড়ির খাবার টেবিলে সবাই বসে দারুন গল্প চলছে।
নিখিল বললো, "তাহলে বনানী আমি , তোমার দিদি আর তমালদের নিয়ে এবার কোচবিহার ফিরবো। "
বীনা বললো, "তুই তাহলে তুহিন আর সৃজাকে নিয়ে একবার কোচবিহার ঘুরে যাস বনানী। সেই রাগে আর তো তুই কোচবিহার যাস না , কিন্তু নতুন বউমাকে নিয়ে যাস।।
তমাল-- "হ্যাঁ মাসিমনি তুমি আমার বিয়েতে অবধি আসোনি।"
বনানী-- "আচ্ছা তমালের খুব রাগ হয়েছে দেখছি।
ব্যাসতো তাছাড়া সৃজাকে তো নিয়ে যেতেই হবে !ওর আসল শ্বশুরবাড়ি তো কোচবিহার এ সেটা দেখাতে হবে না।"
নিখিল বললো , "তুহিন তাহলে কোলকাতায় একটা কিছু নতুন বিজনেস শুরু করুক, ওকে আর আমি দার্জিলিং এ যেতে দেবো না।"
বীনা-- "না না ছেলেকে আর আমি ওখানে পাঠাতে চাই না। "
এসব কথা আলোচনা হতে হতে সৃজা আর তমালের স্ত্রী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো সমস্ত ব্রেকফাস্ট প্লেটে সাজিয়ে লুচি আর আলুর দম।
সৃজা বনানী কে অভ্যাস মতো কাকিমা বলে ডাকতেই
বীনা বলে উঠলো, "বউমা এবার থেকে ওকে মাসি মনি বলেই ডেকো।"
সৃজা মাথা নাড়লো।
নিখিল বললো, "আমরা কিন্তু এবার কোচবিহার ফিরবো বউমা , তুমি কিন্তু তোমার এই মাসিমনিকে নিয়ে খুব শিগগিরই একবার যাবে আমার ওখানে। বয়স তো বাড়ছে কখন কি হয়।"
বনানী বললো," আহ্ জামাইবাবু কেন এই শুভ সময় এসব কথা বলছেন।"
তমাল সৃজার দিকে তাকিয়ে বললো," উহঃ দারুন খিদে পেয়েছে, আমাকে আরো বেশি করে দাও বউদি?
বনানী বলে উঠলো, "সৃজা ওকে বেশি করে দে...
সৃজা তমালকে দিতে যাবে বেশি করে কয়েক টা লুচি ওমনি তমালের স্ত্রী বলে উঠলো, "না না একদম না বেশি খেয়ে চেহারা র কি অবস্থা করেছে, সৃজাদি ওকে একদমই দেবে না।"
বাকিরা সবাই হেসে উঠলো।
এবার তুহিন এলো। এসেই বললো, "কি হচ্ছে এখানে এত হাসি ।"
বীনা বললো," আয় বস এত দেরি করলি কেন?"
তুহিন বসলো।
নিখিল বললো তুহিন কে বলে উঠলো, " তুমি কোলকাতাতে নতুন কোনো বিজনেস শুরু করো , তোমার মাসিমনি আছে। তাছাড়া যখন যা প্রয়োজন কোচবিহারে আমাদের টেলিফোনে জানিয়ো।"
তুহিন বললো, "হ্যাঁ আমি ভেবেছি , খুব তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নেবো।"
বনানী বললো, " তুমি কোনো চিন্তা করো না জামাইবাবু, তুহিন নতুন করে আবার সবটা ঠিক শুরু করতে পারবে।"
টেবিলের উপর থেকে প্লেট নিয়ে সৃজা তুহিন এর সামনে রাখলো আর
সৃজা তুহিন কে জিজ্ঞেস করলো "তুহিনদা কটা লুচি দেবো তোমাকে?"
তুহিন ও বলে উঠলো, "বেশি দিস না,এ.. ঠিক আছে যা দিয়েছিস আর শোন না তুই ঘর থেকে আমার মোবাইল এনে দে তো।"
সৃজা বললো, "আচ্ছা তুহিন দা.."
এই কথোপকথন শুনে তমাল আর তমালের স্ত্রী প্রায় হেসেই ফেললো একে অপরের দিকে তাকিয়ে।
তমালদের এরকম হাসি দেখে তুহিন বলে উঠলো, "কি হলো তমাল তুই হাসছিস কেন?"
বনানী বললো, " হাসবে না তো কি ! বর বউকে তুই করছে ! বউ আবার বরকে দাদা বলে ডাকছে! উহঃ... তোরা কি সেই ছোট্ হয়েই থেকে যাবি।
বাকিরা এবার সবাই একসাথে হেসে উঠলো।
তমাল বললো, "বউদি এবার তুমি দাদা বলাটা ছাড়ো।"
সৃজা মুখ নীচু করে হাসলো। তুহিন ও হাসলো
দুদিন পর...
নিখিল, বীনা তমালরা সবাই চলে গেছে।
সেদিন সকাল .....
বিছানায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে তুহিন।
চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে সৃজা জানলা টা খুলতেই তুহিন এর ঘুম একটু ভেঙে গেলো। আলো এসে তুহিনের মুখে পড়লো।
সৃজা তুহিন কে অনেক বার ডাকলো কিন্তু তুহিন উঠলো না কিছুতেই।
সৃজা গরম চায়ের কাপে তুহিনের আঙুল টা ঢুকিয়ে দিতেই তাড়াতাড়ি উঠলো তুহিন।
তারপর সৃজার দিকে তাকিয়ে , "এটা কি হলো?"
তুহিন রাগ দেখিয়ে বসলো।
সৃজা বললো, আবার রাগ , সরি .. চা টা ধরো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো তাই তো এরকম করলাম ..
তুহিন নিজের দিকে সৃজাকে টানলো সৃজার হাতে প্লেট সমেত কাপ কেঁপে উঠল আর চলকে পড়লো চা, সৃজা চমকে গেলো আর বললো, এ বাবা .. বেড কভার এ চা পড়লো তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না।"
তুহিন হেসে উঠলো।
এবার সৃজার রাগ করা মুখ দেখে
তুহিন বললো, " সরি ... আমি এখুনি বেড কভার পাল্টে দিচ্ছি।
সৃজা আবার তাকলো তুহিন এর দিকে আর দুজনে একসাথে হেসে উঠলো।
এভাবেই ধীরে ধীরে চলতে থাকলো ওদের নতুন পথ চলা।