হঠাৎ
হঠাৎ


ইনস্যুলিনের ইঞ্জেকশানটা নেওয়া হয়নি আজ। শরীর ভীষণ অসুস্থ লাগছিলো পার্থবাবুর। পার্থ মুখার্জী। কলকাতার একটি প্রখ্যাত কলেজের ইকোনমিকসের প্রফেসর। বয়স চুয়ান্নর কাছাকাছি। ব্লাড সুগার ৪৫০ মতন। নিয়মিত ইনস্যুলিন নিতে হয়, দিনে তিনবার। এর সাথে আছে হাই ব্লাড সুগার। একটা অ্যাটাক হয়ে গেছে। খুব সাবধানে চলতে হয়। ইনস্যুলিনের ইঞ্জেকশনটা আজ বাড়িতেই ফেলে এসেছেন। শরীর এতটা খারাপ হয়ে যাবে বুঝতে পারেননি। নাহলে অন্য ব্যবস্থা করা যেত। এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কপালে আজ দুর্ভোগ লেখাই ছিলো বোধহয়।
নিজেই গাড়ি চালান পার্থবাবু। লোকে বলে তিনি নাকি একটু পয়সার পিশাচ। কলেজ থেকে যা মাইনে পান, তার দশগুন আসে কোচিং থেকে। এরপর ভর্তির সময় ঘুষঘাস যা পাওয়া যায়, তারও একটা বখরা পার্থবাবুর পকেটে যায় - এমন নিন্দুকেরা বলে। তবু কিপটেমি যায় না। বাজে খরচ একদম করেন না। ড্রাইভার রাখতে চান না।
কলকাতার রাস্তায় গাড়ি যে স্পীডে চলে, তাতে আর যাই হোক, বিপদ ঘটা খুব কঠিন। কিন্তু আজ ঘটলো। আর ঘটলোও বাইকটার জন্য। বাইকেরই দোষ।
সিগন্যাল তখনো সবুজ ছিলো। গাড়ি নিয়ে ক্রসিংটা পার হতে যাবেন, হঠাৎ পার্থবাবুর এস.ইউ.ভির সামনে সাইড থেকে চলে এলো একটা বাইক। বাইকে বছর কুড়ির এক যুবক। সোজা ধাক্কা লাগলো সামনে। রাস্তার সাথে ঘষটে উল্টে পড়লো বাইকটা, আর চোখের পলকে ছ'সাত হাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়লো ছেলেটার ছিপছিপে শরীরটা। পার্থবাবু শেষ মুহূর্তে খুব জোরে ব্রেক কষেও আটকাতে পারলেন না কিছুই।
**************************************************
রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা। ছেলেটা প্রায় অচেতন। হৈ হৈ করে লোকজন ছুটে এসেছে চারদিক থেকে। মোড়ের মাথায় গাড়িটা দাঁড় করিয়ে ভিতরে বসে অসহায়ভাবে দেখছেন পার্থবাবু। দরদর করে ঘামছিলেন তিনি। যেকোনোরকম উত্তেজনা তার পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর। কিন্তু এরকম অবস্থায় কীবা করবেন তিনি! মরে গেলো নাকি ছেলেটা ? ঠাহর করার চেষ্টা করলেন তিনি। হেলমেট পরা ছিলো, কিন্তু নিশ্চয়ই আলগা ছিলো, সেটাও মাথা থেকে খুলে পাশে ছিটকে পড়েছে। কি বিপত্তি। ইনস্যুলিনের ইঞ্জেকশনটা তার এক্ষুনি চাই। দেরী হলে খুব বিপদ। তিনি কি গাড়ি ঘুরিয়ে বেরিয়ে যাবেন ?
খুব বেশিক্ষন ভাবতে হলো না। 'বেরো শালা শুয়োরের বাচ্চা-'... উন্মত্ত জনতার কেউ একজন প্রথম লাথিটা মারলো ডানদিকের দরজায়। একটা ইঁট এসে পড়লো উইন্ডস্ক্রিনে। ঝর ঝর করে ভেঙে পড়লো সেটা। আরেকটু হলে তার গায়েই লাগতো। মাথায় রক্ত উঠে গেলো পার্থবাবুর। কলেজের ইলেকশনের সময় অনেক হাঙ্গামা দেখেছেন তিনি, করিয়েওছেন। ভয় পান না। দুটো কাঁচা খিস্তি দিয়ে দরজা খুলে তিনি নেমে এলেন।
মারমুখী জনতা টেনে হিঁচড়ে তাকে নিয়ে গিয়ে ফেললো ছেলেটার পাশে। মাথায় লেগেছে ছেলেটার। সে তখন কোনোক্রমে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করছে। কয়েকজন এম্বুল্যান্স ডাকাডাকি করছে। কিছুজন নাটক দেখছে। ভীড় হয়ে গেছে পুরো জায়গাটা।
**************************************************
"টাকা দিয়ে দেবো", উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বললেন পার্থবাবু। "ছাড় আমাকে, ছাড়। যা টাকা লাগবে দেবো বলছি তো।"
প্রস্তাবটা তার অসৎ ছিলো না। কিন্তু এতে আগুনে ঘৃতাহুতি হলো যেন। জীবনের সব জায়গায় টাকার জোরের কাছে হেরে যেতে থাকা মানুষ পার্থবাবুর এই কথায় আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো।
'টাকা আছে, গাড়ি আছে বলে মানুষ খুন করবি ?' 'মার শালাকে, মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দে। তবে এরা বুঝবে।' সত্যি সত্যিই একটা চড় এসে পড়লো এবার পার্থবাবুর গালে। তিনি হাত তুলে চেঁচিয়ে বলার চেষ্টা করলেন যে দোষ তার নয়, বাইকের। কিন্তু উপস্থিত জনতা তাকে কোনো যুক্তিতর্কের সুযোগ দিলো না। গাড়ি এসে বাইকে ধাক্কা মারায় বাইক আরোহী মৃতপ্রায়। অতএব দোষ গাড়ির। সহজ হিসাব।
এই মোড়ে কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই। কাছাকাছি থেকে পুলিশ এসে পৌছালো দশ মিনিটের মধ্যে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। এই শরীরে এতো ধকল আর নিতে পারেনি তার দেহ। ইন্টারন্যাল হ্যামারেজের সাথে সাথেই বুকে দ্বিতীয় একটা অ্যাটাক এলো। উপস্থিত জনতা যতক্ষণে বুঝতে পেরেছে, তখন আর কিছু করার ছিলো না। বরং ভয়ে তারা যে-যেদিকে পারে সরে দাঁড়িয়েছে। আর মনে মনে ভেবেছে, খুব ভুল হলো।
**************************************************
দুটো গাড়ি এলো। একটা পার্থবাবুর মরদেহ তুলে নিয়ে গেলো। আরেকটা এম্বুল্যান্স আহত ছেলেটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য এলো। স্ট্রেচারে করে যখন তাকে তুলে নেওয়া হচ্ছে, ছেলেটার মুখে এক চিলতে হাসি খেলে গেলো।
কলেজে ভর্তি করে দেবার জন্য পঁচিশ হাজার টাকা "চায়ে পানি" চেয়েছিলেন পার্থবাবু। গরীব ঘরের ছেলে সে। কোনোরকমে ধারদেনা করে হাজার সতেরো জোগাড় করেছিলো তারা। কিন্তু তাতে রাজী হননি পার্থবাবু। তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাদের।
তারপর দু'বছর ধরে অনেক খোঁজ খবর নিয়েছে ছেলেটা। পার্থবাবুর রোজনামা, কীভাবে আসা-যাওয়া করেন, কী কী ওষুধ নেন, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনেছে। আর তক্কে তক্কে থেকেছে।
পুলিশ নিশ্চয়ই ডায়েরিতে মামুলি দুর্ঘটনা বলে লিখবে। চলন্ত এম্বুল্যান্সে শুয়ে চোখ বুজলো ছেলেটা। পুরো প্ল্যান সফল তার। কেউ জানবে না এটা আদতে তার বদলা ছিলো।