গানের স্মৃতি আছে?
গানের স্মৃতি আছে?
কৌতূহলী প্রশ্নকর্তা বললেন, “আপনাকে একটি প্রশ্ন করি : আচ্ছা, সকাল সকাল আপনার কি কোনো গানের স্মৃতি মনে পড়ছে?”
উত্তরখানা এবার দিই :—
আজকে প্রশ্নের উত্তরটা তৈরি করতে গিয়ে আমার খানিকটা কেঁচো খোঁড়ার মতো অবস্থা হয়েছে। না হলে যে কেউটে সহজে বের হতে চাচ্ছিলো না। স্মৃতি খোঁড়াখুঁড়ি করতে যাওয়া মানে দুই আর দুই যোগ করা অথবা দুই আর দুই গুণ করার মতো অতটা সহজ নয়। এইখানে যোগ আর গুণের বেলায় একই উত্তর নিয়ে দুই জায়গায় চালানো যায়। দুটি ক্ষেত্রেই উত্তর হয় ৪; হিসেবে গণ্ডগোল হওয়ার জো নেই। কিন্তু স্মৃতি খোঁড়াখুঁড়ি করা অতটা আসান নয়।
আজ সকাল বেলা গানের স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে দেখলাম গানের বদলে অন্যসব স্মৃতিগুলো লাইন দিয়ে আসছে আর সেগুলো একে অপরকে ঠেলাঠেলি শুরু করেছে। তার থেকে আলাদা করে গানকে ধরে বের করে আনতে বেশ বেগ পেতে হলো। আমার নিজের যখন এই অবস্থা, ভাবছি যাদের কোনো গানের স্মৃতি নেই বা যারা এটা রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি তাদের অবস্থা কীরকম হবে...! কোনো উপায় নেই রিজার্ভ বেঞ্চে বসে বসে তাদের খেলা দেখতে হবে। প্রশ্নটা একবার পড়ার পর কেউ হয়তো রিস্ক না নিয়ে নিজে থেকেই রিজার্ভ বেঞ্চে বসে পড়ে কমফোর্ট ফিল করবেন, মাঠে নামার ঝুঁকি নেবেন না। তারা সুবিধা মতো বসে বসে অন্য কারো খেলা দেখতে পছন্দ করবেন।
এছাড়া অনেকে তো ‘দূর—ছাই!’ বলে গজগজ করতে করতে মাঠ ছেড়ে চলে যাবেন। পিছন ফিরে তাকাবেন না। দারুণ গোঁসা হতে পারে।
এবার আজকের প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু কথা বলি। এই বিষয়ে লেখার থেকে বরং এক কলি গান গেয়ে শোনানো আমার জন্য সহজ হতো। কে আর জানতো, প্রতিলিপি আজ আমার এই দশা করে ছাড়বে! কোথাকার কোন্ গানের স্মৃতি শুনতে চাইবে! বলতে কি, গানের গলাটা তত খারাপ নয় আমার, তবে তাতে সুর তেমন একটা ওঠে না। অনেক চেষ্টা করেছি, হয়নি। স্বপ্ন দেখেছিলুম বড় গায়ক হবো। মাইকেল জ্যাকসনের ভেঙে ভেঙে যাওয়া ঘাড়, হাত আর গোড়ালির কাজ দেখে অভিভূত হয়েছিলুম। গায়ক হওয়ার ভূত কখন যে ঘাড়ে চেপেছিলো টের পাই নি। একদিন নিজ পরিবারে কড়া ওঝার পাল্লায় পড়ে গানের সেই ভূত ঘাড় থেকে নেমে দে দৌড়। আর এমুখো হয়নি। আমিও আর ও পথ মাড়াইনি।
বাংলা গানের ভালো স্মৃতি তাদের থাকার কথা, যারা গানের চর্চা করেছেন। আমার কথা তো আগে বললাম, অঙ্কুরেই চারা বিনষ্ট হয়ে গেছে। তথাপি পুরনো একটি ঘটনা বলে নিজেকে কিছু হালকা করি। গল্পটা আপনার কাছে কতখানি ভালো লাগবে জানিনা, কিন্তু আমার কাছে ওটা মজার স্মৃতি হয়ে থেকে গেছে, উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ায় সেটা ভুস করে আবার ভেসে উঠলো।
বলাবাহুল্য, সেটা সেই ঊষাকালের ঘটনা। গনগনে মধ্যাহ্নে সেসব নিয়ে নাড়াচাড়া করার বড় প্রয়োজন ছিলো না। মানুষ তার জীবনের অপরাহ্নে বা সায়াহ্নে এগুলো নিয়ে উতলা হয়, নিজের কথা শোনানোর লোক খুঁজে বেড়ায়। প্রতিলিপিতে সে বালাই নেই। যখন তখন অন্যের খিড়কি দিয়ে উঁকি ঝুঁকি করা প্রতিলিপিতে একটা রেওয়াজ হয়েছে বলা যায়। উঁকি ঝুঁকির একটা ইতিবাচক দিক অবশ্য আছে, আলোচনার পরিবেশ অনেক লঘু থাকে। গুরুগম্ভীর পরিবেশ থেকে খানিক মুক্তি পাওয়া যায়।
তাহলে চলুন, আমার এই জীবনের সেই ঊষাকালে ক্ষণিক উঁকি মেরে আসি। বাল্যকালের বেশিরভাগ স্মৃতিই টাটকা থেকে যায়। বলা চলে, আমরা টাটকা রাখতে পছন্দও করি।
তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র আমি। অনেক দুষ্টু ছিলাম। অনেক সময় ইচ্ছে করে গোল বাঁধাতাম। কেন ওগুলো করতাম তার সদুত্তর এখন আর খুঁজে পাই না।
বিদ্যালয়ে ক্লাসগুলো ছিলো প্লাইবোর্ডের আধা পার্টিশন দেওয়া।
প্রেয়ার হতো লম্বা বারান্দায়। কিন্তু কখনো সখনো সেই প্রেয়ার যে যার ক্লাসের মধ্যে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে করতে হয়েছে। এখন বলবো তেমনই একদিনের ঘটনা। তখন সেই প্রেয়ারগুলোর একটি ছিলো জাতীয় সংগীত। এছাড়া অন্য কবিদের দু’একটি গানও ছিলো। বেশিরভাগ সময় জাতীয় সংগীত গাওয়া হতো।
সমবেত গাওয়া সেই সুর গমগম করে প্রতিধ্বনিত হয়ে বিদ্যালয় থেকে বিদ্যালয়ের বাইরে ছড়িয়ে পড়তো। গাওয়া শেষ হলে কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতা। তারপর লাইন ভাঙতে শুরু করলে কোলাহলে পূর্ণ হয়ে যেতো স্কুল চত্বর যতক্ষণ না শ্রেণীর পঠন পাঠন আরম্ভ হতো।
একদিন যে যার শ্রেণীতে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়া হচ্ছে। আমাদের শ্রেণীতে আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমাদের ইংরেজির শিক্ষিকা। গাইতে গাইতে মাঝপথে আমি লাইনের খেই হারিয়ে ফেললাম। আগে কখনো এটা হয়নি। সেদিন হলো। অন্যেরা গাইছে তাদের মতো— আর আমি গাইছি আমার মতো। আমি এক লাইন পিছিয়ে পড়েছি।
তারা যখন গাইছে, ‘গাহে তব জয় গাথা’, আমি তখন গাইছি, ‘তব শুভ আশিষ মাগে’..... এভাবে তারা একসাথে তাদের সংগীত শেষ করলো। আমার উচিত ছিলো ওদের সাথে সাথে থেমে পড়া। হতে পারে সেই আক্কেল আমার তখন হয়নি। কিন্তু নিজের গাওয়া জাতীয় সংগীত আমি পূর্ণ করলাম। যখন অন্যেরা সবাই চুপচাপ করে আছে, আমি একা তখন গাইছি, ‘জয় হে জয় হে, জয় জয় জয় হে—’। সবাই তখন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হি হি করে হেসে উঠেছে।
ইংরেজির দিদি অন্যদেরকে জোরে ধমক দিয়ে বললেন, ‘এ্যাই, সব চুপ কর।’ সবাই চুপ করে গেলো।
দিদি এরপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘তোর কি হলো, সবাই যখন ট্রেনে করে এলো তুই কিসে করে এলি!’
একটি ফাজিল ছোকরা ফোড়ন কাটলো, ‘ও গরুর গাড়িতে এসেছে।’
দিদি তাকে আবার ধমক দিলেন, ‘চুপ করে বস। তোকে কিছু বলতে বলেছি!’
সেদিন আমি মুখ তুলে দিদির দিকে ঠিকমতো তাকাতে পারছিলুম না। আমাকে এ অবস্থায় একা না রেখে তিনি আমাকে বসতে বললেন।
আরও একটি বাংলা গান আছে যার সাথে আমার কোনো স্মৃতি নেই। কিন্তু ভেবে পাইনা ঘটনা কী!
সেটা হলো জনপ্রিয় প্রয়াত গায়ক মান্না দে’র গাওয়া— ‘আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না.....’
আমার মনের ফাঁকে আটকে থাকা প্রশ্নের কোনো উত্তর পাই না, খোঁজার চেষ্টাও করিনি।
১. এই জনৈক ‘ভজহরি মান্না’ কে?
২. সবশেষে গায়ক ‘ভজহরি মান্না’ কীভাবে হলেন?
৩. এই ‘ভজহরি মান্না' মানুষটি কেমন ছিলেন, খুব আমুদে নাকি খুব দুখী?