গুলাল আবু বকর ‹›

Fantasy

4.3  

গুলাল আবু বকর ‹›

Fantasy

ইন্টারনেট নেই

ইন্টারনেট নেই

5 mins
645


একটি কল্পকাহিনী :—

‘কল্পনা’ হলো আমার সবচেয়ে ভালো বান্ধবী। সারাদিনে আমি কিছু না কিছু সময় এর সাথে কাটাই। কথা বলি, নিঃশব্দে।....

খানিকটা অবাক করে দিলাম বোধহয়। ঐ যে বান্ধবীর নাম বলে ফেললাম, ‘কল্পনা’!

হ্যাঁ, বান্ধবীই বটে। সবাইকে হয়তো ছেড়ে থাকা যায়, কিন্তু ‘কল্পনা’ আর ‘ভাবনা’কে ছেড়ে থাকা যায় কিনা, জানা নেই।

এখন সেই কল্পনাকে নিয়েই কিছুটা সময় কাটাতে চাই। এ কল্পনা আমারই মস্তিষ্কপ্রসূত।


ইন্টারনেট চলে ৯৯% কেবল (cable) আর ১% স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। আমি কেবল কাটার উপযুক্ত একখানা কাতুরি নিয়ে সমুদ্রে বিছিয়ে রাখা কেবল সংযোগগুলো কেটে দিলাম আর ক্ষেপনাস্ত্র ছুড়ে ব্রডব্যাণ্ড সাপ্লায়ার স্যাটেলাইটগুলো নষ্ট করে দিলাম। ব্যাস্ কেল্লা ফতে। ইন্টারনেট ছাড়া জীবন শুরু। এভাবে একসপ্তাহ... তারপর একমাস... তারপর একবছর রাখবো। দেখি কী হয়।

প্রথম দিকটা বিপর্যয় হবে। সাংঘাতিক বিপর্যয়। বলা যায় জীবনের গতি অনেকটা ধাক্কা খাবে। ব্যক্তিগত ধাক্কা তো আছেই। সে বিষয়ে পরে আসছি।


বিশ্বের অগণিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংবাদ সংস্থা, গবেষণাগার, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক, বিভিন্ন বড় মাঝারি ও ছোট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসহ কোটি কোটি মানুষ কম্পিউটার ও মোবাইলের সাথে ইন্টারনেটে যুক্ত রয়েছে । ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি যেকোনো স্থান থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে।

লেখাপড়া, গবেষণা, সাহিত্য চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও বই এখানে পাওয়া যায়। তাই লাইব্রেরি ঘরের মধ্যে। পর্যটকদের প্রয়োজনীয় তথ্য, হোটেল রিজার্ভেশন, টিকেট কাটার জন্য চাই ইন্টারনেট। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শের জন্য লাগে ইন্টারনেট। সিনেমা-নাটক দেখা, খেলা দেখা প্রভৃতি বিনোদন ঘরের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলি যেমন ফেসবুক, টুইটার, প্রতিলিপি ইত্যাদির মাধ্যমে রোজ বন্ধুত্ব স্থাপন এবং যোগাযোগ। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের জন্য ইন্টারনেট খুলে দিয়েছে নতুন দিগন্ত। অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং। সংবাদপত্র এবং খেলাধুলার ক্ষেত্রকেও ইন্টারনেট অনেক সহজ করে দিয়েছে।


গুরুত্ব সহজ করার জন্য উপরে কিছু বাড়তি উদাহরণ টানতে হলো। এটা বোঝাতে যে, ইন্টারনেট cable আমাদের কীভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে।

এবার ঢুকে পড়ি কল্পনায়। এ আরেক সায়েন্স ফিকশন। ইদানিং আলোচনায় কিছু লেখা মানে, হয় ‘আপনার পছন্দ’ নয়তো ‘সায়েন্স ফিকশন’।

প্রথম সপ্তাহ কেমন কাটতে পারে দেখি গিয়ে।

দেখা দিয়েছে ঘরে ঘরে মাথাব্যথা আর বমি। ঘটনার এফেক্ট শুরু ভোর থেকে । 

“বলি, ব্যাপার কি মশাই?”

.....“আর বলেন কেন, কাল থেকে ছেলেটার প্রচণ্ড জ্বর, মেয়েটা সারাদিন খায়নি, আমার অল্প শ্বাসকষ্ট, চিন্তায়—পকেট এক্কেরে ফাঁকা, ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা তুলতে পারবো কিনা বুঝতে পারছি না.... এই হাল দেখে গিন্নি বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে। ওর মাথায় বালতি বালতি জল ঢালতে গিয়ে আমি নাজেহাল হচ্ছি।”

“শুনেছি আবু বকর বলে কেউ একজন ইন্টারনেটের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে, তা সে হচ্ছে সবে ২৪ ঘন্টা হলো। তাতে সংসারের এই করুণ অবস্থা?”

“২৪ ঘন্টা হোক আর ২৪ মাস, ঐ একই হলো। এখন খাবো কি? টাকা তো তুলতে পারছি না। সব নাকি ক্যাশলেস! ওদিকে ছেলে মেয়ে বলে দিয়েছে তারা অনশন ধর্মঘটের ডাক দেবে। গিন্নির কথা আর বলবেন না, ওদের তালে তাল দেয়। যত জ্বালা আমার। ঐ হতচ্ছাড়া ইন্টারনেট হলো যত নাটের গুরু। উজবুকটাকে হাতের নাগালে পেলে ওর cable ছাড়িয়ে দেখতুম ভেতরে কী আছে!”

“ভেতরে সোনাদানা পাবেন নাকি, চুলের মতো সরু সরু তার ছাড়া কিচ্ছুটি নেই!”

(***ক্রমশঃ)


“অ্যাঁ, সরু সরু চুল! —না কি বললেন যেন, সরু সরু তার? আর তাতেই আমার সংসারের এই নাভিশ্বাস উঠলো! হা ঈশ্বর, তুমি ওদের ক্ষমা করো!”

“শুধু কি আপনার একার হাল হকিকত, দেখেন গিয়ে পাশের বাড়িতে ঐ একই অবস্থা; বরঞ্চ আরও শোচনীয়। খবর পেলুম এই পাশের বাড়ির দুই ছেলে সকাল থেকে গায়েব। লা-পাত্তা। একজনকে অনেক খোঁজাখুঁজি করে পাওয়া গেছে পাড়ার ওদিকটায় যেখানে উঁচু টাওয়ারটা বসানো আছে তার মাথায়। সেখান থেকে তাকে কিছুতেই নামানো যাচ্ছে না। সে শুধু মাথা নাড়ছে আর বিড়বিড় করে বলছে, ‘এখানেই তো ছিলো, গেলো কোথায়?'—বুঝুন ঠেলা, ঐ ছেলেকে কি আর ফেরৎ পাওয়া যাবে?”

“এ তো সাংঘাতিক কাণ্ড! সারা পাড়াটা এইরকম সব অসুখে ভুগছে নাকি।‌”

“তাহলে আর বলছি কী। আর ছোট ছেলেটার তো খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না, নিরুদ্দেশ। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে, থানায় বসে পুলিশের সব বাবুরা মাথায় হাত ঠেকিয়ে বসে রয়েছেন। কি হয় কি হয় দুরুদুরু অবস্থা। খুব বয়স্ক মানুষরাই যা বাড়িতে আছেন। বাকিরা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে কে যে কোথায়, কার খবর কে নেবে?”


দৃশ্য দুই :

বয়স্ক মানুষগুলো বেজায় খুশি। খুশির কারণ ছেলেপুলেগুলো তাদের প্রতি যে অবহেলা এতদিন ধরে দিয়ে এসেছে এবার বোধহয় তার একটা সুরাহা হলো। মোবাইল, কম্পিউটারের মতো ওই অস্বাস্থ্যকর বস্তুটি নিয়ে সকাল সন্ধ্যে শুধু খুটুর খুটুর। সময় মতো নাওয়া নেই খাওয়া নেই। জিনিষটার ওপর খালি লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে। যেখানেই তারা থাকুক, লুকোচুরি খেলার মতো বার করে দেখছে আর লুকোচ্ছে। এই বিপর্যয়ের দিনে বয়স্কদের বেজায় আনন্দ। তাদের কথা হলো, ‘যখন ইন্টারনেট ছিলো না, তখন আমরা কি বেঁচে ছিলাম না!’ —তাদের সামনে একথার বিরুদ্ধে কিছু বলা যাচ্ছে না। ইন্টারনেটের সপক্ষে কিছু বললেই, পড়ে যাওয়া দাঁতের মধ্য দিয়ে ফোকলা গাল দেখিয়ে অট্টহাসি দেবেন নয়তো খিঁচুনি দেবেন।


দৃশ্য তিন :—

চাকুরীজীবিদের অবস্থা সবচেয়ে নড়বড়ে। মেশিনে কাজ করে করে ওনাদের হাতির মতো অবস্থা। সব কম্পিউটার বন্ধ। তাই নড়াচড়া শামুকের মতো হয়ে গেছে। তার ওপর বিদ্যুতের পাওয়ার গ্রিড ফেল। জেনারেটর চালিয়ে হাওয়ায় বসে থাকছেন। অনেকেই অফিস ঢোকার আগে হয় চিনেবাদাম নয়তো মটরভাজা কিনে আনছেন। কাজ নেই। চুপচাপ বসে থেকে ঢুলুনি এসে যায়, যদি চোয়াল দুটো জাবর কাটার মতো ক্ষেপে ক্ষেপে নাড়ানো যায়, ব্রেন সক্রিয় থাকে, সেক্ষেত্রে ঘুম ঘোরে চেয়ার থেকে পড়ে যাবার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। কেউ আবার লুডো সঙ্গে করে আনছেন। কয়েক দান খেলার পর নিজেরাই বিরক্ত হয়ে পড়ছেন। তাস পেটা মোটেও অ্যালাউ নেই। ইন্টারনেট নেই বলে অফিসকে আড্ডাখানা বানানো যায় না। শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে হবে।

ওদিকে IT সেক্টরের অবস্থা একেবারেই সঙ্গীন। অফিসে ঢুকলে মনে হয় কম্পিউটারগুলোকে ভূতে ধরেছে। অবস্থার গুরুত্ব বুঝে মাননীয় রাষ্ট্রপতি অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি ঘোষণা করেছেন। কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন বাড়িতে অবস্থান করে। সমুদ্রের ধারে যাওয়া বা পাহাড়ে ওঠা এখন যাবে না। ইন্টারনেট আসামাত্রই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে দৌড়ে কাজে যোগ দিতে হবে। 

পৃথিবীর সবচেয়ে অলস প্রাণীটির নাম শ্লথ। দেখা যাবে মানুষ হয়তো শ্লথকে হারিয়ে প্রথম পজিশন নেবে। ইন্টারনেট ব্যবহার করে মানুষ ক্রমশঃ সেদিকে এগোচ্ছিলো, এবার ইন্টারনেটের অবর্তমানে হয়তো ঐ উপাধি আরও দ্রুত পাওয়া যাবে। এমনই আশঙ্কা। 

আমরা কবে যে খোঁড়া হয়ে লেংচে লেংচে হাঁটতে শুরু করেছিলাম তা ইন্টারনেট গুবলেট হওয়ার আগ পর্যন্ত ঘুনাক্ষরে বুঝতে পারিনি। ঠিক অনেকটা শরীরে ডায়াবিটিস বাসা বাঁধার মতো করে।

মাত্র একসপ্তাহ ইন্টারনেট বন্ধ করে যদি এই অবস্থায় নিয়ে আসতে পারি তবে একমাস কিংবা একবছর ইন্টারনেটকে টাইট দিয়ে কোথায় পাঠাতে পারি, সে ধারণা আছে কি?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy