সাহিত্য ও মনোরঞ্জনকারী
সাহিত্য ও মনোরঞ্জনকারী
নিঃসন্দেহে এই বিষয়টি নিয়ে দরকারি আলোচনা করা যায়। কিন্তু এই আলোচনার ফলশ্রুতিতে আমাদের কতটা শুদ্ধিকরণ হবে, পূর্ব আন্দাজ করা শক্ত।
সরাসরি সত্য প্রকাশ করলে অনেকেই আমার প্রতি বিরাগভাজন হবেন। তবুও তা প্রকাশ না করলে অন্যদিকে সত্যের অপলাপ হবে। আমাদের অনেকেই পর্ণ-সাহিত্যের সমালোচনা করে থাকি। কারো কারো এই সমালোচনা পছন্দ নয়। অনেকে আছেন পছন্দ অপছন্দের দুটো ধারাকেই ব্যালেন্স করে চলেন। বিপজ্জনক ধারা বলে মনে হয়। যারা বোঝেন না, সু্যোগ থাকে তাদেরকে বোঝানোর। যারা বোঝার ভান করেন..... খুব মুশকিল!
মনোরঞ্জনকারী লেখার দুটো স্পষ্ট ও পৃথক রূপ আছে। প্রথম রূপটি হলো, কোনো লেখার ভিতর মজাদার কিংবা আনন্দপূর্ণ উপাদান সংযোজন করে উপস্থাপন করা। এটা সাহিত্যের অন্যতম আকর্ষণ বলা যায়। এ লেখার কারিগর হিসেবে আছেন বহু বড়ো বড়ো সাহিত্যিক। অপরপক্ষে মনোরঞ্জনের দ্বিতীয় ধরণটি হলো, অশ্লীল শব্দ সহযোগে কিংবা যৌনতার দিকে ঈঙ্গিত করে বা সরাসরি রগরগে বর্ণনা দিয়ে বিকৃত মনোরঞ্জন করা ‘খাদ্য’ নিয়ে খাদকের মুখের কাছে তুলে ধরা। পাতে পড়ার আগেই গোগ্রাসে গিলে নেওয়ার মতো উৎসুক জনতার হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। এইপ্রকার যৌন বর্ণনা যারা নিয়মিত পড়েন তাদের কাছে এ সাহিত্য রসনা প্রশমকারী, মনোবেদনা উপশমকারী। মনোবিকার ও চিত্ত বিক্ষেপ শুরুই হয় এখান থেকে।
ওরা বলে, পতিতালয়ের যেমন “সামাজিক উপযোগিতা” আছে, এটারও আছে একই ভূমিকা। এভাবে এরা সমাজে ভ্রাম্যমান অর্ধনগ্ন নারীর মধ্যে ‘বিপ্লবী’ আধুনিকতা খুঁজে পায়, কোনও একদিন চলমান পূর্ণনগ্ন নারী বা পুরুষের মধ্যে যুগান্তকারী কোনো শিল্পের সন্ধান ঠিকই খুঁজে পাবে।
এই বিপ্লবে লাভ কার, ক্ষতিই বা কার? ভাবার মতো ধৈর্য্য নেই পতনোন্মুখ সমাজের।
নতুন ও উদ্ভাবনী গল্পগুলো লেখার মতো মেধার সংকট তৈরি হলে উক্ত লেখাগুলোর প্রস্তুতকারীর সংখ্যা ও গুণগ্রাহী বৃদ্ধি পায় বলাবাহুল্য। মূল্যবোধ বর্জিত লেখক লেখিকা যৌনতাকে ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার বলে মনে করেন। তারা খোঁড়া যুক্তি দেন এই বলে যে, ‘গল্পের প্রয়োজনে লীলাকর্মগুলো আনা অনিবার্য হয়ে উঠেছে’। আমার কথা হলো ঐরূপ গল্প লেখার দরকার কি, যেখানে গল্প পিচ্ছিল হয়ে যায় এবং পাঠক পাঠিকা ‘পা হড়কে’ মনোবিকারে আকৃষ্ট হন! খোলা জায়গায় আপনি উত্তপ্ত বস্তু ফেলে রাখতে পারেন না। বোঝা যাচ্ছে, লেখক লেখিকার ভিন্ন ধরণের গল্প লেখার কল্পনায় অভাব আছে, তাই না? ....
প্রথম ক্ষেত্রে উল্লিখিত মনোরঞ্জনের ধরণখানা সকল সাহিত্যের, সকল যুগের, বিশ্বের যে কোনো ভালো সাহিত্যিকের একটি অতিরিক্ত দক্ষতা হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। তার ঐ লেখার মধ্যে এমন কিছু উপাদান লেখক লেখিকা সন্নিবেশিত করে থাকেন যার দ্বারা একাধারে বিষয়বস্তু হাস্যরসাত্মক হয় অপরদিকে পড়ার সময় পাঠক পাঠিকা পর্যাপ্ত আনন্দ সহকারে সাহিত্যের রস আস্বাদন করে থাকেন। এটাও মনোরঞ্জনকারী লেখা অবশ্যই। তবে "চটুল মনোরঞ্জনকারী" কিন্তু নয়। 'চটুল' শব্দের অর্থ এখানে লঘু ও আদিম বোঝাবে।
নির্মল মনোরঞ্জনকারী লেখা বহুপ্রকার বিষয়ের উপর হতে পারে। যা শুধুমাত্র পরিচ্ছন্ন বিনোদন দেয়। যেমন, খেলাধুলা, চলচ্চিত্র, আবিষ্কার, রোজনামচা, নিত্য ঘটনা, অভিজ্ঞতাসহ বিভিন্ন বিষয় হতে পারে। এর কোনো সীমা পরিসীমা নেই।
যে কোনো লেখাই হোক, ততক্ষণ সংস্কৃতিমনস্ক থাকে যতক্ষণ তা যৌনতাবর্জিত ও অশ্লীল শব্দ থেকে দূরে থাকে। অশ্লীল কী, তা আমি জানি, যদি না ভণ্ডামির কোনোরূপ মুখোশ পরার চেষ্টা করি। উত্তেজক কথাই অশ্লীল। যখনই কোনো লেখায় এগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটে তখন তা মনোরঞ্জনকারী লেখা থাকে না, তা হয়ে যায় নিম্নমেধার লেখা। এটা মোটেও সুপাঠ্য সাহিত্য নয়। চটুল সাহিত্য বললে হয়তো বলা যায়, এটা রগরগে কাহিনী। যা পাঠক পাঠিকাকে চেতনে অবচেতনে সুড়সুড়ি দেয়। চিন্তাকে নিম্নগামী করে।
বর্তমান সাহিত্য মঞ্চগুলো সাজানো হচ্ছে এমন সব চটুল লেখার মালা সাজিয়ে। অসুস্থ ও আপত্তিকর প্রচ্ছদের হিড়িক এসে গেছে। অনুভূতিপ্রবণ মন এবং চোখ দুটোকেই কষ্ট দেয়। মেধাবী সাহিত্যিকের পাঠক অন্যদিকে কমছে। আগের যুগে এরকম ছিলো, এ যুগেও আছে, ভবিষ্যতে এই চিত্রের বদল হবে না।
আমার এই লেখার মধ্যে স্পষ্টিকরণ হয়ে গেছে যে আমি সাহিত্যকে কীভাবে দেখতে চাই। আমি জানি, প্রকাশকের ভূমিকা ঠুঁটো জগন্নাথের মতোই। তারা স্বেচ্ছায় এদেরকে চটাতে চান না। আমারও আগ্রহ নেই ওই প্রকাশককে ‘খোঁচা’ দেওয়ার। আমার এই লেখা যদি কোনোরূপ সচেতনতা বৃদ্ধি ও শুদ্ধিকরণে সহায়তা করে তাই এই চেষ্টা এবং কোনো কাজে লাগলে আমি যারপরনাই আনন্দিত হবো।
[নিঃসঙ্কোচে মতামত জানাতে পারেন। ফটোহীন বেনামে নয়।]