গুলাল আবু বকর ‹›

Classics comedy

4.2  

গুলাল আবু বকর ‹›

Classics comedy

ওয়ার্ক ফ্রম হোম

ওয়ার্ক ফ্রম হোম

5 mins
518


এক অফিস কর্মীর জবানবন্দী (ওয়ার্ক ফ্রম হোম) :


আমি কলকাতা ভিত্তিক এক বহুজাতিক কোম্পানির আই টি কর্মী। আমি খুবই মর্মাহত যে আমার ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ এর সেই দুঃসহ স্মৃতি এখন আমাকে বর্ণনা করতে হচ্ছে যা আমার কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করে বেড়ায়।

বর্তমানে এই পরিস্থিতি অবশ্য কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে কিন্তু কতদিন এই হাল বজায় থাকবে হলফ করে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। 

আশা করি, এপথে আমি একা নই আমার সহকর্মীদেরও অনুরূপ পরিস্থিতি কমবেশি সামলাতে হয়েছে ও হচ্ছে। তবে ব্যাপারটা কে কিভাবে দেখছেন সেটা তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা।

আমার অভিজ্ঞতার একটা ঝলক এখানে উপহার দিই।

সুখের সেদিন যেদিন থেকে অন্তর্হিত হলো, তখন থেকে আমি বাড়িতে বসে কাজ করছিলুম। নিত্যদিনের অফিস যাত্রার অভ্যাস ত্যাগ করে আমি ঘরবন্দী হয়ে পড়লুম। কি যন্ত্রণা! আমি আমার ঘর থেকে কাজ শুরু করলুম, বলা চলে আমার শোবার ঘরের বিছানার ওপর থেকে শুরু হলো। বিছানা ভরে গেলো কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, ফাইলপত্র, কিছু বই, নোট খাতা, কাপপ্লেট, প্লেট রাখার ম্যাট, বিস্কুটের ডিবে, জলের বোতল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সামগ্রীতে। যেখানে চলতে লাগলো কাজ আর খাওয়া। শোওয়া ও ঘুমের জন্য আমি একটা সোফা ব্যবহার করতে শুরু করলুম। দিনের পর দিন বিছানার ওপরের চাদর পাল্টানো হয় না, তেল চিটচিটে হয়ে গেলো। সোফায় পড়ে পড়ে ঘুমানোর জন্য বেশি ব্যবহারে সেটি আর আমার ভার সহ্য করতে পারলো না, একটি পায়া ভেঙে গেলো। নতুন করে একটা মজবুত সোফার আমি অর্ডার দিলুম স্থানীয় দোকানে। ঠিক সময়ে তাদের তৈরি করা সোফাটা এনে তারা হাজির করলো কিন্তু কিছুতেই আমার দরজা দিয়ে সেটা ভেতরে গলানো গেলো না। প্রথমে তারা দুজন এসেছিলো, যখন দেখলো তাদের দ্বারা হচ্ছে না তখন দোকান থেকে আরও দুজন কর্মীকে ডেকে পাঠালো। এরপর অনেক টানাহেঁচড়া করে কোনোরকমে জিনিসটা ঢুকিয়ে দিলো। এই সোফার গদি এতো নরম ছিলো যে শুয়ে পড়ার পর আমি সোফায় তলিয়ে যেতে লাগলুম। দুদিন ভালো করে ঘুম হলো না। আমার ঘুম বলতে সারা রাত ধরে কাজ করে কাটানো আর ভোর বেলায় ঘুমোতে যাওয়া। সকালের সূর্য আর প্রভাতের শিরশির বাতাস কী, তা শীঘ্রই ভুলে গেলুম। আগে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস ছিলো কিন্তু ওয়ার্ক ফ্রম হোম সেই অভ্যাস একেবারে বদলে দিয়েছে। সাথে যুক্ত হয়েছে ভয়ংকর সব দুঃস্বপ্ন দেখা। একবার দেখলাম, আমার কম্পিউটার একটা কুমীরের মুখের আকৃতি ধারণ করেছে আর মুখের ভিতরে রয়েছে বড় বড় ধারালো দাঁত। সেবার এটা দেখে ভয়ে সোফা থেকে পড়ে গোঙাতে লাগলুম যতক্ষণ না বাড়ির লোক এসে উদ্ধার করলো। এটা ঘটলো একেবারে দুপুরবেলা।

বাড়িতে বসে কাজ করার শারীরিক ধকল ও মানসিক চাপ কমানোর জন্য আমি দিনের কিছু সময় ব্যয় করে কার্টুন আঁকা শুরু করলাম। আমাকে আগামী কতদিন ধরে এইরূপ কার্টুন এঁকে যেতে হবে শুরুতে আমার কোনো ধারণা ছিলো না। বাড়ির লোক এবার ভাবতে শুরু করলো আমার এই অস্বাভাবিক কাজের ধরণের জন্য আমি হয়তো পাগল হতে শুরু করেছি। আমার যে কিছু হয়নি, এটা আমি তাদের বুঝিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও তারা বুঝলো কিনা জানিনা, উপরন্তু আমার দিকে কেমন সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো। এসবই ওয়ার্ক ফ্রম হোম এর ফলাফল কিনা কে জানে!

কম্পিউটারে একটানা কাজ করতে গিয়ে নিজেকে মনে হলো, একটি নির্জন দ্বীপে আমি একাকী রয়েছি। এঘর ওঘরের মধ্যে পার্থক্যকে মনে হচ্ছে সমুদ্রের এপার আর ওপার। কাজের মধ্যে যখন গভীরভাবে প্রবেশ করি তখন এটাও মনে হলো চোখের দুটো বল চোখের কোটর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে অবস্থান করছে। চোখে হাত দিয়ে বুঝতে পারি, না না, সেগুলো যথাস্থানে রয়েছে।

বাইরে কাজ করার যে ক্লান্তি সেটা এখন মনে হয় কিছুই নয় যখন দেখি বাড়িতে কাজ করে আমি ক্রমশঃ আরও বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ছি।

বাড়িতে থেকে কাজের যে চাপ তা অফিসের থেকে অনেক বেশি। অফিসে যখন থাকতুম সময় নানাভাবে কেটে যেতো, রাস্তায় গাড়ির জন্য অপেক্ষা করা, লাঞ্চে টিফিন খাওয়া, কলিগদের সাথে এটাসেটা নিয়ে খুনসুটি করা, ওয়াশরুমে যাওয়া.... এসবের মধ্যেই হতো অফিসের কাজ।

বাড়িতে বসে কাজ করে আমি মানুষজনকে খুব মিস করি। মানুষের সাথে কাজ করার একটা আলাদা চার্ম আছে। জুম কলের সাহায্যে সতীর্থদের সাথে মিটিং করে সেই অভাব মেটানো যায় না। জুম কলে নিজেকে এতো ছোট একটি চৌকোর মধ্যে দেখে বেশ অদ্ভুত মনে হয়। অন্যদেরও কেমন যেন ক্লান্ত ক্লান্ত দেখি।

আমি বুঝতে পারিনা, বাড়িতে থেকে কাজ করে মানুষ কীভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ে! ..... এইরকম ক্লান্ত মানুষগুলোকে একজায়গায় দেখে আমার হতাশার থার্মোমিটারের পারদ আরও চড়ে যায়।

এক একদিন কতগুলো যে মিটিং সারতে হয়, তার হিসেব রাখা মুশকিল! মিটিং করার জন্য ই-মেল করা, মিটিংয়ের প্রস্তুতি নেওয়া, বসের কাছ থেকে কাজ নেওয়া, মিটিং শেষের পর কাজের ফিরিস্তি নোট করা, পরবর্তী মিটিংয়ের বিষয় ঠিক করা প্রভৃতি করতে গিয়ে সেদিন কাজের সময় সামান্যই বেঁচে থাকে।

মিটিংয়ে যারা হাজির থাকি তাদের মধ্যকার গুমরে থাকা অবসাদ, পরিমাপ করলে দেখা যেতো সেটা পা থেকে কন্ঠনালী পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তার উপরের মুখমণ্ডলে যা আছে তা হলো একটা মেকি হাসি মাত্র।

মিটিংয়ে সময়ও কাটে অদ্ভুতভাবে। কেউ একেবারেই চুপচাপ স্থবির হয়ে বসে থাকে। কেউ নিজেদের মধ্যে চ্যাটিং চালাচালি করে। কেউ চলে যায় সোস্যাল মিডিয়ায়।

অফিস করার সময় সপ্তাহান্ত বলে একটা অবকাশ আমরা সবাই পেতাম, কিন্তু ওয়ার্ক ফ্রম হোম হয়ে সেই অবকাশ আর দরকার পড়ে না। পড়বেই বা কিভাবে, তাহলে সেই অবকাশ কাটানোর জায়গা পাবো কোথায়!

যেখানে সপ্তাহান্তের খোঁজখবর নেই, সেখানে ক্লান্তি বের হয়ে যাবারও খবরাখবর নেই।

রাতের বেলা কাজের মধ্যে বসে ভাবি, ‘আহা, সেদিন কোথায় গেলো যেদিন রাতে শোবার জন্য যেতে পারতাম!’ অপরদিকে দিনের বেলা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি, কম্পিউটার আমাকে দেখতে পেলেই যেন তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

যেদিন মিটিং থাকে, চুল আঁচড়ে কাপড় পরে ফিটফাট হয়ে বসে থাকি আর যেদিন থাকে না, দেখলে মনে হবে আমাকে কেউ আছড়ে দিয়েছে, তাই চেহারার এই করুণ অবস্থা!

বাড়িতে বসে আমাদের কোম্পানিকে যে আউটপুট দিই তা অনেক ফোলাফাঁপা, বেশি—কিন্তু যখন অফিস যেতাম তখন এর সিকিভাগ হয়তো দিতে পারতাম।

এখন বাড়িতে আমি যে পরিমাণ চুপচাপ থাকি তাতে ভবিষ্যতে কোনোদিন অফিসে গেলে, কথা বলতে হয়তো ভুলে যাবো। ভুলে যাবো অফিসের সেই নির্ধারিত ড্রেসটা পরতে। কেউ হয়তো যাবো হাফপ্যান্ট আর টিশার্ট পরে আবার কেউ বা যাবো খালি গায়ে।

এইভাবে চলতে থাকলে আগামীদিনের মায়েরা যখন তার শিশুকে হাত ধরে মিউজিয়ামে বেড়াতে নিয়ে যাবেন, তারা সেখানে একটি ছবির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে বলবেন,

“ঐ দ্যাখো ঐটা হলো একটা অফিসের ছবি—”

...... যেখানে আছে কিছু আলোকিত কক্ষ, কিছু মানুষ কয়েকটি কম্পিউটারের সামনে বসে একাগ্রচিত্তে কি যেন দেখছে।

              (আপাতত এলাম)



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics